নিউইয়র্ক ০৮:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

রাষ্ট্র উল্টো ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৪৪:০৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩
  • / ৩ বার পঠিত

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

হককথা ডেস্ক : স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলো। স্বাধীনতার যেসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল, তা কতটা অর্জিত হয়েছে ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দ্রুত এবং পুরোপুরি অর্জিত হবে, এটা আমরা আশা করিনি; কিন্তু যা ঘটেছে, তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটি বড় রাষ্ট্রকে ভেঙে ছোট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ছিল না, ছিল মুক্তির; অর্থাৎ এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার, যেটি হবে সমাজতান্ত্রিক। সেদিকে আমরা এগোতে পারিনি। উন্নয়ন যা ঘটেছে, তা পুঁজিবাদী ধরনের। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাই বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে শোষণ। সম্পদ সৃষ্টি হয় মেহনতি মানুষের শ্রমে। এবং সেই সম্পদের একাংশ পাচার হয়ে গেছে বিদেশে, অন্য একটা অংশ খরচ হয়েছে ধনিক শ্রেণির ভোগবিলাসে। ব্রিটিশ শাসন ছিল ঔপনিবেশিক; পাকিস্তানি শাসকেরাও বাংলাদেশকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও কিন্তু একধরনের ঔপনিবেশিকতাই দেখা যাচ্ছে। সেটা দেশীয় বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিকতা। শোষণ ও সম্পদ পাচার—দুটিই পুরোমাত্রায় চলছে।

দেখা যাচ্ছে যে মেয়েরা ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে গেছে ; কিন্তু পুঁজিবাদের পিতৃতান্ত্রিকতার অধীনে তাদের নিরাপত্তা বাড়েনি, বরং কমেছে। ধর্ষণ আগেও ছিল, কিন্তু দলবদ্ধ ধর্ষণের কথা শোনা যেত না, এখন সেটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ব্যর্থতাটা মূলত সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক শক্তির। তারা তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণিকে ব্যর্থ বলা যাবে না। তাদের পক্ষে তরুণদের বিপথগামী ও রাজনীতিবিরোধী করে তোলাটাই স্বাভাবিক। তারা চায় না যে তরুণেরা বিদ্রোহ করুক। তরুণের সাহসকে তারা ভয় পায়

কেন অর্জিত হলো না? এ জন্য কি কেবল রাজনীতিকে দায়ী করবেন, না দেশের অগ্রণী নাগরিক হিসেবে লেখক-বুদ্ধিজীবীদেরও দায় ছিল ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দায় আছে উভয় অংশেরই। মূল দায়িত্ব রাজনীতিকদের; কিন্তু বুদ্ধিজীবীদেরও দায়িত্ব ছিল। তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। প্রথম সত্য হলো এই যে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কোন ধরনের সমাজ চাই, সেটা তাঁরা মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। অনেকেই শুধু স্বাধীনতার কথাই ভেবেছেন, মুক্তির স্বপ্নকে বাদ দিয়ে। সম্পদের সামাজিক মালিকানার বিষয়টি তাঁদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। কারও কারও কাছে গ্রহণযোগ্যও মনে হয়নি। অগ্রসর চিন্তার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ শহীদ হয়েছেন যুদ্ধে। ওদিকে রাষ্ট্রে এমনকি বুর্জোয়া ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা পায়নি। স্বাধীনতা বুদ্ধিজীবীদের কারও কারও জন্য অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনেছে, যা তাঁরা গ্রহণ করে লোভী ও সুবিধাবাদী হয়ে পড়েছেন। রাষ্ট্র মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত তো করেইনি, উল্টো ক্রমেই ভীতির একটি সংস্কৃতিই গড়ে তুলেছে।

স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও গণতন্ত্রের ও সংস্কৃতির উন্নতি হলো না কেন? চিন্তাভাবনায় আমরা সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছি কেন ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: রাষ্ট্রের যাঁরা শাসক হয়েছেন, তাঁরা পরমতসহিষ্ণুতা দেখাননি। চিন্তার স্বাধীনতা দিতে চাননি। আনুগত্য দাবি করেছেন। সৃষ্টিশীলতা পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। মুনাফালিপ্সা ও ভোগের স্পৃহা সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলতে চেয়েছে। টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সংস্কৃতির চর্চায় সামাজিকতার জায়গায় ব্যক্তিগত উপভোগকে প্রধান করে তুলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তিন ধারার বিস্তারও সমাজ ও সংস্কৃতি উভয়কেই অত্যন্ত ক্ষতিকর রূপে বিভক্ত করে চলেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।

অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেবল টাকাই আসেনি, মৌলবাদের চর্চায় উৎসাহও এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি; তার বিপরীতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় কওমি মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য ঘটেছে। গণতান্ত্রিক ও সামাজিক সংস্কৃতির চর্চা যাঁদের করার কথা, তাঁরা অনেকেই ঝুঁকে পড়েছেন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের দিকে। কেউ কেউ আবার সেবকে পরিণত হয়েছেন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের। পাড়ায়-মহল্লায় সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। এমনকি খেলাধুলার জায়গাও কমে গেছে। অপর দিকে ওয়াজের নামে ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার প্রচারকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাস্যকৌতুক বেশ দুর্লভ হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার প্রধান অর্জন এবং গত ৫২ বছরে আমাদের বিসর্জন বা ব্যর্থতা চিহ্নিত করতে বললে কী বলবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অর্জন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা; বিশ্বপরিসরে আত্মপরিচয়ে প্রতিষ্ঠার সুযোগ; এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষয়িক উন্নতি। ব্যর্থতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়া। আমরা আগে ভাবতাম যে আদি সংবিধানে যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উল্লেখ ছিল, তাদের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞাটি রয়েছে; পরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে দিয়েছে যে সেখানেও অস্পষ্টতা ছিল এবং স্পষ্ট করে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে একটি সামাজিক বিপ্লবের চেতনা, যে বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা। ওই চেতনা থেকে তো আমরা অবশ্যই সরে গেছি। এমনকি আদি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোও এখন আর কার্যকর নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে মানবিক করে তোলার জন্য তাই সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজা–প্রজার পুরোনো সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে প্রত্যেকের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগের ব্যবস্থা করার স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের চালিকা শক্তি। সামাজিক বিপ্লবের ওই লক্ষ্য থেকে আমরা সরে এসেছি।

বাংলাদেশে যাঁরা কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য রাজনীতি করেছেন এবং এখনো করছেন, অর্থাৎ বামপন্থীরা কেন বৃহত্তর জনগণের সমর্থন পেলেন না? জাতীয় রাজনীতিতে তাঁরা কেন ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় আছেন? বিকল্প ধারা তৈরি না করে অনেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে লীন হয়ে গেলেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বামপন্থীদের প্রধান দুর্বলতা সৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চার অভাব। কেবল যে তত্ত্বগত জ্ঞানের অভাব ঘটেছে তা নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে জ্ঞান আসে, অভাব ঘটেছে সেটিরও। পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানি শাসকদের উপনিবেশে পরিণত হচ্ছিল এবং সে জন্য যে রাষ্ট্রশক্তি দখল করে রাষ্ট্রকে ভেঙে সেখানে একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক, এই জ্ঞান লাভে তাঁদের বিলম্ব ঘটেছে। জাতি সমস্যারও সঠিকভাবে মোকাবিলা তাঁরা করতে পারেননি। উপমহাদেশ ছিল বহুজাতির একটি দেশ, শাসকেরা ভারতবর্ষকে দুই জাতির দেশ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। পাকিস্তানও ছিল একটি নয়, পাঁচটি জাতির একটি অবাস্তব, আমলা শাসিত রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের শাসন থেকে মানুষকে মুক্ত করার দায়িত্ব ছিল বামপন্থীদের। তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে তাঁরা অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের হাতে। এবং ওই জাতীয়তাবাদীদের জন্য প্রধান শত্রু ছিল বামপন্থীরাই ব্রিটিশ আমলে যেমন, পাকিস্তান আমলেও তেমনি। কারণ, বামপন্থীরা সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে চায়, আর বুর্জোয়ারা চায় সমাজকাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে নিতে। বামপন্থীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কোনো সীমা মানা হয়নি। বাংলাদেশ আমলেও বুর্জোয়াদের শাসনের অবসান ঘটেনি। বুর্জোয়াদের শাসন বামপন্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। একালে প্রচারমাধ্যমের ক্ষমতা অপরিসীম; শাসকশ্রেণি প্রচারমাধ্যমকে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে বামপন্থীদের দেশদ্রোহী ও নাস্তিক বলে প্রচার করতে।

বামপন্থীদের রাজনীতি বুর্জোয়াদের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের হওয়া দরকার ছিল, সেটা হয়নি। বিশেষ রকমের বিচ্যুতি ঘটেছে নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহের কারণে। ব্রিটিশ শাসকেরা জাতীয়তাবাদীদের জন্য নির্বাচনের ছাড় দিয়ে ফাঁদ পেতেছিল। ওই ফাঁদে পড়ে জাতীয়তাবাদীরা একদিকে আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নির্বাচনে উৎসাহী হয়েছে, অপরদিকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে; যে বিভাজনের পরিণতিটা দাঁড়িয়েছে দেশভাগ। দেশভাগের ফলে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বামপন্থীরা। তাঁরা আবার নির্বাচনমনস্কও হয়ে পড়েছেন। এই নির্বাচনমনস্কতা পাকিস্তান আমলেও তাঁদের মধ্যে ছিল। দেশি-বিদেশি শাসক ও তাঁদের সমর্থকেরা সংস্কৃতিতে ভাববাদিতার যে পরিমণ্ডল তৈরি করে রেখেছিল, বস্তুবাদী বামপন্থীদের পক্ষে সেটা ছিন্ন করা ছিল কষ্টসাধ্য।

সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামপন্থী মহলে যে সংশোধনবাদী প্রবণতা দেখা দেয় এবং পরবর্তী চীন -রাশিয়া বিরোধ যে বিভাজনের সৃষ্টি করে, সে দুটি ঘটনা ছিল অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটাও সত্য যে বুর্জোয়াদের পক্ষে ‘জাতীয়’ শত্রুকে চিহ্নিত করাটা ছিল সহজ, কারণ তারা বিদেশি; কিন্তু বামপন্থীদের পক্ষে শ্রেণিশত্রুকে চিহ্নিত করাটা ছিল কষ্টসাধ্য। কারণ, ওই শত্রুরা স্বদেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে ‘আপনজন’। পাকিস্তান আমলে এমনকি সামরিক সরকারের আমলেও বুদ্ধিজীবীরা যে সাহসী ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, গণতান্ত্রিক আমলে তা পারছেন না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : গণতান্ত্রিক আমল বলতে যা বোঝায়, সত্যিকার অর্থে তো সেটা পাওয়াই যায়নি। বাংলাদেশের শাসকেরা অত্যন্ত অসহিষ্ণু। তাঁরা লোভ দেখান এবং ভয় দেখান। বুদ্ধিজীবীরা কেউ পড়েন লোভে, অনেকেই থাকেন ভয়ে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ভয়ের একটি সংস্কৃতিই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। আরেকটি বাস্তবতা হলো এই যে বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত নন। তার ওপর তাঁরা আবার দলীয়ভাবে বিভক্ত। স্বাভাবিকভাবেই সরকারপন্থী হওয়ার দিকেই ঝোঁকটা থাকে অধিক। দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন দুর্বল; সে কারণেও সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানটা সবল হয় না। তার ওপর মিডিয়া বিরোধীপক্ষের সংবাদ প্রকাশে উৎসাহ প্রকাশ করে না। ফলে সরকারবিরোধী অবস্থান নিলেও সেটা তেমন প্রচার পায় না। বিভিন্ন ঘটনায় বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন। মাঠে নামছেন না। এর পেছনে সুবিধাবাদ না পলায়নপরতা কাজ করছে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : সুবিধাবাদ আছে এবং ভয়ও কাজ করছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি আরেকটি সংঘাত অনিবার্য?সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : সংঘর্ষ না ঘটলেও অরাজকতা তৈরি হতে পারে। অরাজকতাটা কেমন দাঁড়াবে এবং তার পরিণতি কী হবে, সেটা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো কে কী রকম আচরণ করে, তার ওপর।

আওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলছে। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো মৌলিক ফারাক আছে ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ফারাক অবশ্যই আছে; কিন্তু সেটা মৌলিক নয়। তার কারণ, যে প্রতিশ্রুতিই তাঁরা দিন না কেন, ক্ষমতায় গেলে যে তার বাস্তবায়ন ঘটাবেন, এটা আশা করা যায় না। প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়াটাই তাঁদের স্বভাব। আর এটাও তো সত্য যে বুর্জোয়ারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবেন; এবং তাঁদের স্বভাব ও অভ্যাসে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাঁরা গণতন্ত্রমনস্ক নন এবং তাঁদের দেশপ্রেমে বিস্তর ঘাটতি রয়েছে। আর এটা তো দৃশ্যমানই যে তাঁদের দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। নির্বাচন এলেই বিদেশিদের কাছে রাজনীতিকদের ধরনার মাত্রা বেড়ে যায় এবং এক দল অপর দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। বিদেশিদের কাছে এ ধরনার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ঘটনাটা লজ্জাকর বটে। অনেক কষ্টে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি; রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেটা ঘটছে না। কারণ, রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি দেশের মানুষের সমর্থনের ওপর ভরসা করে না, তারা বিদেশিদের সমর্থন চায়। শাসকেরা পরস্পরের মিত্র নন, কিন্তু আদর্শগতভাবে তাঁদের মধ্যে আত্মীয়তা রয়েছে। তাঁরা সবাই পুঁজিবাদী এবং আমাদের দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা বিশ্ব পুঁজিবাদী বন্দোবস্তেরই অংশ। অন্যদিকে পুঁজিবাদীরা সাম্রাজ্যবাদীও, তারা চায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে। নির্বাচন এলে সরকার পরিবর্তনের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা চায় তাদের পছন্দের অংশ ক্ষমতায় আসুক; তারা তাই তৎপর হয়। ঘটনাটা দ্বিপক্ষীয়, দেশীয়রা সাহায্য চায়, বিদেশিরাও প্রস্তুত থাকে সাহায্য দিতে।

পুঁজিবাদের বিপরীতে আপনারা সামাজিক মালিকানার কথা বলছেন। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সেই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারল না কেন? সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক আগেই ভেঙে গেছে, চীন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেখানেও ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : সামাজিক মালিকানার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে, কিছুটা সফলতাও এসেছিল; কিন্তু ব্যবস্থাটা টেকেনি। প্রধান কারণ পুঁজিবাদের চাতুর্য, প্রচারদক্ষতা ও ক্ষমতা। মানুষ কিন্তু সমাজতন্ত্রী হয়ে জন্মায় না; জন্মায় সে পুঁজিবাদী প্রবণতা নিয়েই; সমাজতন্ত্রী হতে হলে তাকে কষ্ট করতে হয়। সে কারণে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই যে পুঁজিবাদী প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তা নয়। সেটা ছিল। এবং ওই ছিদ্রপথেই প্রবেশ করেছে পার্টির আমলাতন্ত্র। পার্টির আমলাতন্ত্র সাধারণ আমলাতন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। এই আমলাতন্ত্র সমষ্টি চেতনাকে লালন করেনি; উল্টো দমন করেছে। ওদিকে পুঁজিবাদ তার চাতুর্য ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছে। মেহনতিদের ছাড় দিয়েছে, বামপন্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে এবং ভোগবাদিতা প্রচার করেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন এটাও প্রমাণ করল যে পুঁজিবাদের মতোই, সমাজতন্ত্রকেও বিশ্বজনীন করা চাই।

মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের কিন্তু ব্যক্তিমালিকানার অগ্রগামিতারও ইতিহাস। পুঁজিবাদ হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাবাদী ওই সভ্যতার উন্নতির শেষ প্রান্ত। পুঁজিবাদ যা দেওয়ার তা ইতিমধ্যেই দিয়ে ফেলেছে। এখন সে যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তার দানে ও শোষণে পৃথিবী এখন মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। সভ্যতা এখন হয় ব্যক্তিমালিকানার পথ ধরেই এগোবে এবং খাদে গড়িয়ে পড়বে; নয়তো সামাজিক মালিকানার দিকে ঘুরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের উন্নতির নতুন এক সভ্যতার সূচনা ঘটাবে। কোনটি ঘটতে যাচ্ছে, এই প্রশ্নটা আজ সারা বিশ্বের।

এক বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। সারা বিশ্বের মানুষই এ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইরাক যুদ্ধের সময় দেশে দেশে বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, এবার তা দেখা যাচ্ছে না কেন? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত নন। তাঁরা ভয় ও লোভের দ্বারা আক্রান্ত। তার ওপর সর্বশক্তিমান প্রচারমাধ্যম যুদ্ধবাজ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃত্বাধীন। এগুলোই হচ্ছে কারণ।মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র বা বৈষম্যহীনতার চেতনা কেন তরুণদের মধ্যে প্রবাহিত করা যায়নি? তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিও অনাগ্রহী। এ ব্যর্থতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : তরুণেরা দুঃসাহসী। সাহস হারালে তাদের সঞ্চয় বলে আর কিছু থাকে না। হতাশা দেখা দেয়। বাংলাদেশে তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। একদা যে তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, আজ তাঁরা অনেকেই হতাশাগ্রস্ত। অপরাধীদের কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। ব্যর্থতাটা মূলত সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক শক্তির। তারা তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণিকে ব্যর্থ বলা যাবে না। তাদের পক্ষে তরুণদের বিপথগামী ও রাজনীতিবিরোধী করে তোলাটাই স্বাভাবিক। তারা চায় না যে তরুণেরা বিদ্রোহ করুক। তরুণের সাহসকে তারা ভয় পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয় না, সেটা একটা প্রমাণ তারুণ্যের প্রতি শাসকশ্রেণির অবিশ্বাসের।

এত আশাহীনতার মধ্যে স্বদেশ, সমাজ নিয়ে কোনো আশাবাদ দেখতে পান কি ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই দেখতে পাই। কারণ, সাধারণ মানুষ আছেন, বিবেকবান মানুষেরও অভাব নেই, তরুণেরাও রয়েছেন। তাঁরা রাজনীতিকদের ওপর আস্থা হারিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু নিজেদের ওপর আস্থা হারাননি। তাঁরা শ্রম করেন এবং স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের শ্রম ও স্বপ্নই পরিবর্তনের কারণ হয়ে থাকে। ভরসা করি, তাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। কেবল আমাদের দেশে নয়, সব দেশে; এবং সভ্যতাকে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবেন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে না এবং বাঁচার জন্যই নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্নটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

সুমি/হককথা

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

রাষ্ট্র উল্টো ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে

প্রকাশের সময় : ০১:৪৪:০৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩

হককথা ডেস্ক : স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলো। স্বাধীনতার যেসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল, তা কতটা অর্জিত হয়েছে ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দ্রুত এবং পুরোপুরি অর্জিত হবে, এটা আমরা আশা করিনি; কিন্তু যা ঘটেছে, তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটি বড় রাষ্ট্রকে ভেঙে ছোট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ছিল না, ছিল মুক্তির; অর্থাৎ এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার, যেটি হবে সমাজতান্ত্রিক। সেদিকে আমরা এগোতে পারিনি। উন্নয়ন যা ঘটেছে, তা পুঁজিবাদী ধরনের। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাই বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে শোষণ। সম্পদ সৃষ্টি হয় মেহনতি মানুষের শ্রমে। এবং সেই সম্পদের একাংশ পাচার হয়ে গেছে বিদেশে, অন্য একটা অংশ খরচ হয়েছে ধনিক শ্রেণির ভোগবিলাসে। ব্রিটিশ শাসন ছিল ঔপনিবেশিক; পাকিস্তানি শাসকেরাও বাংলাদেশকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও কিন্তু একধরনের ঔপনিবেশিকতাই দেখা যাচ্ছে। সেটা দেশীয় বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিকতা। শোষণ ও সম্পদ পাচার—দুটিই পুরোমাত্রায় চলছে।

দেখা যাচ্ছে যে মেয়েরা ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে গেছে ; কিন্তু পুঁজিবাদের পিতৃতান্ত্রিকতার অধীনে তাদের নিরাপত্তা বাড়েনি, বরং কমেছে। ধর্ষণ আগেও ছিল, কিন্তু দলবদ্ধ ধর্ষণের কথা শোনা যেত না, এখন সেটা ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ব্যর্থতাটা মূলত সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক শক্তির। তারা তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণিকে ব্যর্থ বলা যাবে না। তাদের পক্ষে তরুণদের বিপথগামী ও রাজনীতিবিরোধী করে তোলাটাই স্বাভাবিক। তারা চায় না যে তরুণেরা বিদ্রোহ করুক। তরুণের সাহসকে তারা ভয় পায়

কেন অর্জিত হলো না? এ জন্য কি কেবল রাজনীতিকে দায়ী করবেন, না দেশের অগ্রণী নাগরিক হিসেবে লেখক-বুদ্ধিজীবীদেরও দায় ছিল ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দায় আছে উভয় অংশেরই। মূল দায়িত্ব রাজনীতিকদের; কিন্তু বুদ্ধিজীবীদেরও দায়িত্ব ছিল। তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। প্রথম সত্য হলো এই যে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কোন ধরনের সমাজ চাই, সেটা তাঁরা মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেননি। অনেকেই শুধু স্বাধীনতার কথাই ভেবেছেন, মুক্তির স্বপ্নকে বাদ দিয়ে। সম্পদের সামাজিক মালিকানার বিষয়টি তাঁদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। কারও কারও কাছে গ্রহণযোগ্যও মনে হয়নি। অগ্রসর চিন্তার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ শহীদ হয়েছেন যুদ্ধে। ওদিকে রাষ্ট্রে এমনকি বুর্জোয়া ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা পায়নি। স্বাধীনতা বুদ্ধিজীবীদের কারও কারও জন্য অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনেছে, যা তাঁরা গ্রহণ করে লোভী ও সুবিধাবাদী হয়ে পড়েছেন। রাষ্ট্র মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত তো করেইনি, উল্টো ক্রমেই ভীতির একটি সংস্কৃতিই গড়ে তুলেছে।

স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও গণতন্ত্রের ও সংস্কৃতির উন্নতি হলো না কেন? চিন্তাভাবনায় আমরা সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছি কেন ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: রাষ্ট্রের যাঁরা শাসক হয়েছেন, তাঁরা পরমতসহিষ্ণুতা দেখাননি। চিন্তার স্বাধীনতা দিতে চাননি। আনুগত্য দাবি করেছেন। সৃষ্টিশীলতা পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। মুনাফালিপ্সা ও ভোগের স্পৃহা সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলতে চেয়েছে। টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সংস্কৃতির চর্চায় সামাজিকতার জায়গায় ব্যক্তিগত উপভোগকে প্রধান করে তুলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তিন ধারার বিস্তারও সমাজ ও সংস্কৃতি উভয়কেই অত্যন্ত ক্ষতিকর রূপে বিভক্ত করে চলেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়।

অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেবল টাকাই আসেনি, মৌলবাদের চর্চায় উৎসাহও এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়নি; তার বিপরীতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় কওমি মাদ্রাসার সংখ্যাধিক্য ঘটেছে। গণতান্ত্রিক ও সামাজিক সংস্কৃতির চর্চা যাঁদের করার কথা, তাঁরা অনেকেই ঝুঁকে পড়েছেন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের দিকে। কেউ কেউ আবার সেবকে পরিণত হয়েছেন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের। পাড়ায়-মহল্লায় সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সংকুচিত হয়ে এসেছে। এমনকি খেলাধুলার জায়গাও কমে গেছে। অপর দিকে ওয়াজের নামে ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার প্রচারকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। হাস্যকৌতুক বেশ দুর্লভ হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার প্রধান অর্জন এবং গত ৫২ বছরে আমাদের বিসর্জন বা ব্যর্থতা চিহ্নিত করতে বললে কী বলবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অর্জন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা; বিশ্বপরিসরে আত্মপরিচয়ে প্রতিষ্ঠার সুযোগ; এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষয়িক উন্নতি। ব্যর্থতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়া। আমরা আগে ভাবতাম যে আদি সংবিধানে যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উল্লেখ ছিল, তাদের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংজ্ঞাটি রয়েছে; পরের অভিজ্ঞতা জানিয়ে দিয়েছে যে সেখানেও অস্পষ্টতা ছিল এবং স্পষ্ট করে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে একটি সামাজিক বিপ্লবের চেতনা, যে বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা। ওই চেতনা থেকে তো আমরা অবশ্যই সরে গেছি। এমনকি আদি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোও এখন আর কার্যকর নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে মানবিক করে তোলার জন্য তাই সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজা–প্রজার পুরোনো সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে প্রত্যেকের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগের ব্যবস্থা করার স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের চালিকা শক্তি। সামাজিক বিপ্লবের ওই লক্ষ্য থেকে আমরা সরে এসেছি।

বাংলাদেশে যাঁরা কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য রাজনীতি করেছেন এবং এখনো করছেন, অর্থাৎ বামপন্থীরা কেন বৃহত্তর জনগণের সমর্থন পেলেন না? জাতীয় রাজনীতিতে তাঁরা কেন ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় আছেন? বিকল্প ধারা তৈরি না করে অনেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে লীন হয়ে গেলেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বামপন্থীদের প্রধান দুর্বলতা সৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চার অভাব। কেবল যে তত্ত্বগত জ্ঞানের অভাব ঘটেছে তা নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে জ্ঞান আসে, অভাব ঘটেছে সেটিরও। পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানি শাসকদের উপনিবেশে পরিণত হচ্ছিল এবং সে জন্য যে রাষ্ট্রশক্তি দখল করে রাষ্ট্রকে ভেঙে সেখানে একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক, এই জ্ঞান লাভে তাঁদের বিলম্ব ঘটেছে। জাতি সমস্যারও সঠিকভাবে মোকাবিলা তাঁরা করতে পারেননি। উপমহাদেশ ছিল বহুজাতির একটি দেশ, শাসকেরা ভারতবর্ষকে দুই জাতির দেশ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। পাকিস্তানও ছিল একটি নয়, পাঁচটি জাতির একটি অবাস্তব, আমলা শাসিত রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের শাসন থেকে মানুষকে মুক্ত করার দায়িত্ব ছিল বামপন্থীদের। তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে তাঁরা অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের হাতে। এবং ওই জাতীয়তাবাদীদের জন্য প্রধান শত্রু ছিল বামপন্থীরাই ব্রিটিশ আমলে যেমন, পাকিস্তান আমলেও তেমনি। কারণ, বামপন্থীরা সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে চায়, আর বুর্জোয়ারা চায় সমাজকাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের দখলে নিয়ে নিতে। বামপন্থীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কোনো সীমা মানা হয়নি। বাংলাদেশ আমলেও বুর্জোয়াদের শাসনের অবসান ঘটেনি। বুর্জোয়াদের শাসন বামপন্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। একালে প্রচারমাধ্যমের ক্ষমতা অপরিসীম; শাসকশ্রেণি প্রচারমাধ্যমকে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে বামপন্থীদের দেশদ্রোহী ও নাস্তিক বলে প্রচার করতে।

বামপন্থীদের রাজনীতি বুর্জোয়াদের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের হওয়া দরকার ছিল, সেটা হয়নি। বিশেষ রকমের বিচ্যুতি ঘটেছে নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহের কারণে। ব্রিটিশ শাসকেরা জাতীয়তাবাদীদের জন্য নির্বাচনের ছাড় দিয়ে ফাঁদ পেতেছিল। ওই ফাঁদে পড়ে জাতীয়তাবাদীরা একদিকে আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নির্বাচনে উৎসাহী হয়েছে, অপরদিকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে; যে বিভাজনের পরিণতিটা দাঁড়িয়েছে দেশভাগ। দেশভাগের ফলে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বামপন্থীরা। তাঁরা আবার নির্বাচনমনস্কও হয়ে পড়েছেন। এই নির্বাচনমনস্কতা পাকিস্তান আমলেও তাঁদের মধ্যে ছিল। দেশি-বিদেশি শাসক ও তাঁদের সমর্থকেরা সংস্কৃতিতে ভাববাদিতার যে পরিমণ্ডল তৈরি করে রেখেছিল, বস্তুবাদী বামপন্থীদের পক্ষে সেটা ছিন্ন করা ছিল কষ্টসাধ্য।

সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামপন্থী মহলে যে সংশোধনবাদী প্রবণতা দেখা দেয় এবং পরবর্তী চীন -রাশিয়া বিরোধ যে বিভাজনের সৃষ্টি করে, সে দুটি ঘটনা ছিল অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটাও সত্য যে বুর্জোয়াদের পক্ষে ‘জাতীয়’ শত্রুকে চিহ্নিত করাটা ছিল সহজ, কারণ তারা বিদেশি; কিন্তু বামপন্থীদের পক্ষে শ্রেণিশত্রুকে চিহ্নিত করাটা ছিল কষ্টসাধ্য। কারণ, ওই শত্রুরা স্বদেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে ‘আপনজন’। পাকিস্তান আমলে এমনকি সামরিক সরকারের আমলেও বুদ্ধিজীবীরা যে সাহসী ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, গণতান্ত্রিক আমলে তা পারছেন না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : গণতান্ত্রিক আমল বলতে যা বোঝায়, সত্যিকার অর্থে তো সেটা পাওয়াই যায়নি। বাংলাদেশের শাসকেরা অত্যন্ত অসহিষ্ণু। তাঁরা লোভ দেখান এবং ভয় দেখান। বুদ্ধিজীবীরা কেউ পড়েন লোভে, অনেকেই থাকেন ভয়ে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে ভয়ের একটি সংস্কৃতিই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। আরেকটি বাস্তবতা হলো এই যে বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত নন। তার ওপর তাঁরা আবার দলীয়ভাবে বিভক্ত। স্বাভাবিকভাবেই সরকারপন্থী হওয়ার দিকেই ঝোঁকটা থাকে অধিক। দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন দুর্বল; সে কারণেও সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানটা সবল হয় না। তার ওপর মিডিয়া বিরোধীপক্ষের সংবাদ প্রকাশে উৎসাহ প্রকাশ করে না। ফলে সরকারবিরোধী অবস্থান নিলেও সেটা তেমন প্রচার পায় না। বিভিন্ন ঘটনায় বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন। মাঠে নামছেন না। এর পেছনে সুবিধাবাদ না পলায়নপরতা কাজ করছে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : সুবিধাবাদ আছে এবং ভয়ও কাজ করছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি আরেকটি সংঘাত অনিবার্য?সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : সংঘর্ষ না ঘটলেও অরাজকতা তৈরি হতে পারে। অরাজকতাটা কেমন দাঁড়াবে এবং তার পরিণতি কী হবে, সেটা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো কে কী রকম আচরণ করে, তার ওপর।

আওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলছে। এই দুইয়ের মধ্যে কোনো মৌলিক ফারাক আছে ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ফারাক অবশ্যই আছে; কিন্তু সেটা মৌলিক নয়। তার কারণ, যে প্রতিশ্রুতিই তাঁরা দিন না কেন, ক্ষমতায় গেলে যে তার বাস্তবায়ন ঘটাবেন, এটা আশা করা যায় না। প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়াটাই তাঁদের স্বভাব। আর এটাও তো সত্য যে বুর্জোয়ারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবেন; এবং তাঁদের স্বভাব ও অভ্যাসে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাঁরা গণতন্ত্রমনস্ক নন এবং তাঁদের দেশপ্রেমে বিস্তর ঘাটতি রয়েছে। আর এটা তো দৃশ্যমানই যে তাঁদের দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। নির্বাচন এলেই বিদেশিদের কাছে রাজনীতিকদের ধরনার মাত্রা বেড়ে যায় এবং এক দল অপর দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। বিদেশিদের কাছে এ ধরনার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ঘটনাটা লজ্জাকর বটে। অনেক কষ্টে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি; রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেটা ঘটছে না। কারণ, রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি দেশের মানুষের সমর্থনের ওপর ভরসা করে না, তারা বিদেশিদের সমর্থন চায়। শাসকেরা পরস্পরের মিত্র নন, কিন্তু আদর্শগতভাবে তাঁদের মধ্যে আত্মীয়তা রয়েছে। তাঁরা সবাই পুঁজিবাদী এবং আমাদের দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা বিশ্ব পুঁজিবাদী বন্দোবস্তেরই অংশ। অন্যদিকে পুঁজিবাদীরা সাম্রাজ্যবাদীও, তারা চায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে। নির্বাচন এলে সরকার পরিবর্তনের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা চায় তাদের পছন্দের অংশ ক্ষমতায় আসুক; তারা তাই তৎপর হয়। ঘটনাটা দ্বিপক্ষীয়, দেশীয়রা সাহায্য চায়, বিদেশিরাও প্রস্তুত থাকে সাহায্য দিতে।

পুঁজিবাদের বিপরীতে আপনারা সামাজিক মালিকানার কথা বলছেন। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সেই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারল না কেন? সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক আগেই ভেঙে গেছে, চীন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেখানেও ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রকট।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : সামাজিক মালিকানার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে, কিছুটা সফলতাও এসেছিল; কিন্তু ব্যবস্থাটা টেকেনি। প্রধান কারণ পুঁজিবাদের চাতুর্য, প্রচারদক্ষতা ও ক্ষমতা। মানুষ কিন্তু সমাজতন্ত্রী হয়ে জন্মায় না; জন্মায় সে পুঁজিবাদী প্রবণতা নিয়েই; সমাজতন্ত্রী হতে হলে তাকে কষ্ট করতে হয়। সে কারণে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই যে পুঁজিবাদী প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, তা নয়। সেটা ছিল। এবং ওই ছিদ্রপথেই প্রবেশ করেছে পার্টির আমলাতন্ত্র। পার্টির আমলাতন্ত্র সাধারণ আমলাতন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। এই আমলাতন্ত্র সমষ্টি চেতনাকে লালন করেনি; উল্টো দমন করেছে। ওদিকে পুঁজিবাদ তার চাতুর্য ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছে। মেহনতিদের ছাড় দিয়েছে, বামপন্থীদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে এবং ভোগবাদিতা প্রচার করেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন এটাও প্রমাণ করল যে পুঁজিবাদের মতোই, সমাজতন্ত্রকেও বিশ্বজনীন করা চাই।

মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের কিন্তু ব্যক্তিমালিকানার অগ্রগামিতারও ইতিহাস। পুঁজিবাদ হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাবাদী ওই সভ্যতার উন্নতির শেষ প্রান্ত। পুঁজিবাদ যা দেওয়ার তা ইতিমধ্যেই দিয়ে ফেলেছে। এখন সে যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তার দানে ও শোষণে পৃথিবী এখন মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রায় অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। সভ্যতা এখন হয় ব্যক্তিমালিকানার পথ ধরেই এগোবে এবং খাদে গড়িয়ে পড়বে; নয়তো সামাজিক মালিকানার দিকে ঘুরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের উন্নতির নতুন এক সভ্যতার সূচনা ঘটাবে। কোনটি ঘটতে যাচ্ছে, এই প্রশ্নটা আজ সারা বিশ্বের।

এক বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। সারা বিশ্বের মানুষই এ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইরাক যুদ্ধের সময় দেশে দেশে বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, এবার তা দেখা যাচ্ছে না কেন? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বুদ্ধিজীবীরা সংগঠিত নন। তাঁরা ভয় ও লোভের দ্বারা আক্রান্ত। তার ওপর সর্বশক্তিমান প্রচারমাধ্যম যুদ্ধবাজ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃত্বাধীন। এগুলোই হচ্ছে কারণ।মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র বা বৈষম্যহীনতার চেতনা কেন তরুণদের মধ্যে প্রবাহিত করা যায়নি? তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিও অনাগ্রহী। এ ব্যর্থতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : তরুণেরা দুঃসাহসী। সাহস হারালে তাদের সঞ্চয় বলে আর কিছু থাকে না। হতাশা দেখা দেয়। বাংলাদেশে তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। একদা যে তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, আজ তাঁরা অনেকেই হতাশাগ্রস্ত। অপরাধীদের কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। ব্যর্থতাটা মূলত সমাজ পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক শক্তির। তারা তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণিকে ব্যর্থ বলা যাবে না। তাদের পক্ষে তরুণদের বিপথগামী ও রাজনীতিবিরোধী করে তোলাটাই স্বাভাবিক। তারা চায় না যে তরুণেরা বিদ্রোহ করুক। তরুণের সাহসকে তারা ভয় পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয় না, সেটা একটা প্রমাণ তারুণ্যের প্রতি শাসকশ্রেণির অবিশ্বাসের।

এত আশাহীনতার মধ্যে স্বদেশ, সমাজ নিয়ে কোনো আশাবাদ দেখতে পান কি ? সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই দেখতে পাই। কারণ, সাধারণ মানুষ আছেন, বিবেকবান মানুষেরও অভাব নেই, তরুণেরাও রয়েছেন। তাঁরা রাজনীতিকদের ওপর আস্থা হারিয়েছেন ঠিকই; কিন্তু নিজেদের ওপর আস্থা হারাননি। তাঁরা শ্রম করেন এবং স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের শ্রম ও স্বপ্নই পরিবর্তনের কারণ হয়ে থাকে। ভরসা করি, তাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। কেবল আমাদের দেশে নয়, সব দেশে; এবং সভ্যতাকে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করবেন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে না এবং বাঁচার জন্যই নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্নটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।

সুমি/হককথা