নিউইয়র্ক ০৯:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

প্রবাসে বাংলাদেশী সংগঠনের চালচিত্র : মতের অমিল, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর আঞ্চলিকতাই প্রধান কারণ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:১৬:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪
  • / ১০৬৬ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: বলা যায় যুক্তরাষ্ট্র তথা উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ প্রবাসী বাংলাদেশীর আয়ের প্রধান উৎস ট্যাক্সি ক্যাব। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই পেশার সংখ্যাও। পাশাপাশি বিস্তার লাভ করেছে দেশি পণ্যের নানা ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সব কিছুর মাঝেই চলছে সভা-সমিতি। চোখ মেলে ধরলে দেখা মেলে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার আবর্তে প্রায় সব ক’টি বিভাগীয় শহর-উপশহর, জেলা-উপজেলা, থানা এবং গ্রাম নামের আবর্তে একের অধিক সমিতির অবস্থান। আমেরিকায় বসবাসকারী অন্যান্য দেশ ও জাতির অবস্থান আরো বেশী থাকলেও সভা-সমিতি ও সংগঠনের দৌরাতেœ বাংলাদেশ রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যার প্রভাব এখানে বসবাসকারী অন্যান্য দেশ ও জাতির অভিবাসীদের মধ্যে নেই বললেও চলে। পাশের দেশ ইন্ডিয়া-পাকিস্তান কিংবা নেপাল-ভুটানের প্রবাসীদের কোন সংগঠনের আধিক্য এখানে দেখা যায় না; যতটা না বাংলাদেশীদের মাঝে বিদ্যমান।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রবাসিদের কাছে পারিবারিক তথা সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব যতটা না বেশি তার চেয়ে বেশি হচ্ছে কমিউনিটির নামে বিভিন্ন সংগঠনের আধিপত্য নিয়ে। দেশের প্রায় সবক’টি জেলা-উপজেলার সংগঠনের কার্যক্রম চলছে এলাকা ভিত্তিক কয়েকজন প্রবাসী অভিবাসীদের নিয়ে। মতের অমিল হলে মাত্র কয়েকদিনের মাথায় সেটা ভেঙ্গে গড়ে উঠে নতুন আরেকটি সংগঠন। বিভিন্ন নামে শুরু হওয়ায় এসব সংগঠন আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও অহমিকার দম্ভে ভেঙ্গে এক সংগঠন বেড়ে হচ্ছে কয়েকটি। বাংলা পত্রিকার ধারাবাহিক প্রতিবেদনে পাঠকদের জন্য এবার তুলে ধরা হলো প্রবাসী ট্যাক্সি চালকদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন ক্যাবি সংগঠনের ইতিহাস।
প্রবাসী বাংলাদেশী কয়েকজন ক্যাব চালকদের নিয়ে ১৯৯৪ সালে প্রথম গঠন হয় ‘ইয়োলো সোসাইটি নিউইয়র্ক ইনক’.। মাত্র ৪৭জন ক্যাবীদের নিয়ে গঠিত এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ শাহ আলম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কামাল ইউ. আহমেদ। একবছরের মাথায় মতের অমিল এবং আঞ্চলিকতার প্রভাবে ইয়োলো সোসাইটি ভেঙ্গে গঠন হয় ‘বেঙ্গল ক্যাবি সোসাইটি অব নিউইয়র্ক’। ১৯৯৫ সালে গঠিত ক্যাবীদের দ্বিতীয় সংগঠন ‘বেঙ্গলে’র আহ্বায়ক ছিলেন লুৎফর রহমান। কিছু দিন না যেতেই তা আবার ভেঙ্গে গঠিত মদিনা সোসাইটি, বিজয় বন্ধু’সহ নাম না জানা আরো বেশ কয়েকটি ক্যাবী সংগঠন। এছাড়াও ইয়োলো থেকে বেঙ্গলের পর কাউয়া সোসাইটি নামের আরেকটি সংগঠন গঠন হয়। আঞ্চলিকতার প্রভাবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে ক্যাবীদের সংগঠন।
এছাড়াও একে একে গঠন হয় শাপলা ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন যা আবার ভেঙ্গে বলাকা ওয়েল ফেয়ার; সেখান থেকে পদ্মা ইয়োলো সোসাইটি। এভাবেই ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় ক্যাবীদের নিয়ে গড়া সংগঠনের নেতাদের কেউ বছরে একবার হলেও সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। অন্যদিকে, সংগঠনের নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছেন অনেকেই।  যার মধ্যে দু’চারটি ছাড়া বাকী গুলোর সাংগঠনিক অবস্থান নেই বললেই চলে। আর যে গুলো রয়েছে এখনো তারা বছরে অন্তত একটি বনভোজন, বার্ষিক পুনর্মিলনী-পুরস্কার বিতরণ তথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নতুন নামে অ্যাসোয়িশেন কিংবা সমিতির দৌরাত্ম এখানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। কে কাকে ঘায়েল করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করবে। বছরে একবার মঞ্চের প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে কথা বলবে। পত্রিকা বিজ্ঞাপন দিয়ে পরবর্তিতে সংবাদের শিরোনামেই সীমাবদ্ধ এসব সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামো। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবতো রয়েছেই। পুরো দেশের ট্যাক্সি ক্যাবীদের প্রতিনিধিত্ব করবে এমন সংগঠন নেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে কথা বলেন, বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ সাখাওয়াত বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আমি এখন রাজনীতি ও আঞ্চলিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। ক্যাবীদের সংগঠনের সময় দেয়া হয়না আগের মত। স্বোচ্ছাসেবক লীগ যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছি। একসময়ে পদ্মা ইয়োলো সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম’।
তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের ক্যাবীদের সংগঠন অনেকগুলো হয়ে গেছে যা কাম্য নয়। নিউইয়র্কের সবচে বড় এবং প্রথম সংগঠন হচ্ছে ইয়োলো সোসাইটি নিউইয়র্ক ইন্ক। আগামীতে ওটার সাথে কাজ করেই বাংলাদেশী ক্যাবীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাবো। কারণ মতের অমিলে একটা ভেঙ্গে আরেকটা গড়ে ঠিকই। মূলত এগুলো আমাদের বৃহত্তর স্বার্থে কাজে আসেনা। ধরুন নিউইয়র্কে আমাদের সকল ক্যাবীদের যদি একটি সংগঠন থাকে, তাহলে যে কোন সামাজিক কাজে সবার সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ অনেক বড় ভুমিকা রাখতে পারে। বাস্তব হলেও সত্যি। আমরা তা প্রতিষ্ঠায় এখনো উদাসীন। ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আশা করছি সময়ের সাথে মানুষের পরিবর্তনও ঘটবে।
ইয়োলো সোসাইটি থেকে বেরিয়ে গঠিত ‘বেঙ্গল ক্যাবী সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডেন্ট আবু তালেব চৌধুরী চান্দুর সাথে কথা হয়। এতে অধিক ক্যাবি সংগঠন প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা তুলে ধরেন তিনি। জানান, ‘আমি প্রধানত রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তারপরও ক্যাবীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা ইয়োলো সোসাটির সাথে যুক্ত হই। কতগুলো বিষয়ে মতের অমিল থাকায় নিউইয়র্কে গড়ে উঠা ক্যাবীদের দ্বিতীয় সংগঠন ‘বেঙ্গল’র যাত্র শুরু হয়। সংগঠনটির তিনবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও একবারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে আছি’।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি নাম। কিন্তু একটি নামকে প্রতিষ্ঠিত না করে এতগুলো সংগঠনের গড়ার উদ্দেশ্য কী? এমন প্রশ্নের জবাবে আবু তালেব চান্দু বলেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন আমাদের জাতীয় স্বার্থ চিন্তা করে এসব গড়ে উঠেনি। কমিউনিটিতে এসব সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে মূলত ব্যক্তি এবং আঞ্চলিকতার উপর ভর করে। প্রথমে যিনি উদ্যোগ নেন তিনি প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ের বেশীরভাগ ব্যয়ের যোগানদাতা থাকেন। পরবর্তীতে হয়তো গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। ফলে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। ভেঙ্গে যাওয়ার আরো কারণ হচ্ছে মতের অমিল, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। নির্বাচনে পরাজয় মেনে না নেয়া আমাদের বাংলাদেশীদের একটা নেতিবাচক দিক’।
তিনি আরো বলেন, ‘সব নেতিবাচক নয়। ইতিবাচক দিকও রয়েছে এসব সংগঠনের। আমরা যখন বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এখন এটা সাংগঠনিক কাঠামো চলে আসছে। যেমন ধরুন- আমাদের সদস্যদের মধে ১মাস অসুস্থ থাকলে তার বাড়ি ভাড়া, ১ সপ্তাহের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান, কেউ মারা গেলে প্রতিটি সদস্য থেকে মাথাপিছু ২ হাজার ডলার অনুদান তুলে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর পরিবারকে সহায়তা প্রদান’সহ নানা কাজে আমরা এগিয়ে আসি। এরকম অনেক নজির আমাদের রয়েছে। বহু সদস্যের উপকারে আসতে পেরেছি আমরা। আমাদের মূল টার্গেটই হচ্ছে একে অন্যের সহায্যে এগিয়ে আসা। পাশাপাশি আমাদের সদস্য ক্যাবিদের ডিএমভি সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স এবং মেডেলিয়ন বিষয় নিয়েও কাজ করছে বেঙ্গল ক্যাবি সোসাইটি’।
বাংলাদেশী কমিউনিটির ক্যাবিদের একের অধিক সংগঠন হওয়ায় নিয়ে বাংলা পত্রিকার সাথে কথা বলেন, ‘ইউনাইটেড টেক্সি ড্রাইভার এসোসিয়েশন’-এনওয়াইসি ইউএসএ ইনক.-এর কনভেনার ওসমান চৌধুরী। তিনি জানান, ‘আসলে নব্বই দশকের মাঝামাঝি আমাদের টেক্সি চালকদের স্বার্থ রক্ষায় এখানে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়োলো সোসাইটি। এরপর বেঙ্গল ক্যাবি সেটাও ভেঙ্গে আরেকটি। এভাবেই একের পর এক গড়ে উঠে একটি থেকে কয়েকটি ক্যাবি সংগঠন’।
প্রশ্ন ছিল কেন এমনটি হচ্ছে? আর এতে লাভ-ই বা কী? জবাবে ওসমান চৌধুরী বলেন, ‘আসলে আমাদের ক্যাবি চালকদের সংগঠন অনেকগুলো এটা ঠিক। তবে, সবার যে উদ্দেশ্য খারাপ তা কিন্তু নয়। মূলত এসব সংগঠনগুলো আঞ্চলিকতা এবং পারিবারিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে থাকে। বলতে পারেন অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় একটি ভেঙ্গে আরেকটি গড়ার অন্যতম কারণ। আর আধিপত্য বিস্তারের যে কথাটি বলছেন সেটাও একটি বিষয়। একটি থেকে কয়েকটি গড়লেও অনেকেরই অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বাকী যেগুলোর অবস্থান রয়েছে, তারা অবশ্যই কাজ করছে কেউ মারা গেলে কিংবা দুর্ঘটনার শিকার হলে তার উপকারে। ক্যাবিদের থেকে চাঁদা তুলে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন ক্যাবিরা। আঞ্চলিকতা ও পরিবার নির্ভর হওয়ায় টেক্সি ক্যাবিদের প্রধান স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে পারছে না এসব সংগঠন। তবুও অনেক ভালো দিক রয়েছে’।
শুধু ক্যাবিদের সংগঠন নয় আছে ‘বাংলাদেশ কার এন্ড লিমোজিন এসোসিয়েশন’ ব্ল্যাক, গ্রীন কিংবা উবার চালকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে সংগঠনটি। এ প্রতিষ্ঠানও ভেঙ্গে আরেকটি গঠন হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আসলে একটি ছোট্ট ভুখন্ড ও স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। আমরা জাতি হিসেবে অনেক পরিশ্রমী এবং সাহসী। বলতে পারি দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির প্রধান উৎস প্রবাসীরা। অতিথি পরায়ণ জাতি হিসেবে দেশে-বিদেশে আমাদের কদরও রয়েছে বেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছি। বাস্তবে আমাদের ভেতর কাজ করছে ব্যক্তি কেন্দ্রিক  প্রবণতা। আধিপত্য বিস্তারে নিজের দেশ এবং জাতি ছোট করতে দ্বিধাবোধ করি না। সব কিছুতেই নেতিবাচক মানসিকতাকে প্রাধান্য দেই। মেনে নেয়ার ক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে আমাদের ভালো অর্জনগুলো বৃথা। আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা হেরে যাবো। দেশ হারাবে মেধা ও অর্থনীতি। দেশের নোংরা রাজনীতি ছেড়ে ঐক্যবদ্ধ ফ্লাটফর্ম গড়তে ছাড় দেয়ার প্রবনতা জাগ্রত করতে হবে সবার মাঝে। তাহলেই সোনার বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আগামীর পথে। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

প্রবাসে বাংলাদেশী সংগঠনের চালচিত্র : মতের অমিল, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর আঞ্চলিকতাই প্রধান কারণ

প্রকাশের সময় : ০৮:১৬:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪

নিউইয়র্ক: বলা যায় যুক্তরাষ্ট্র তথা উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ প্রবাসী বাংলাদেশীর আয়ের প্রধান উৎস ট্যাক্সি ক্যাব। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই পেশার সংখ্যাও। পাশাপাশি বিস্তার লাভ করেছে দেশি পণ্যের নানা ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সব কিছুর মাঝেই চলছে সভা-সমিতি। চোখ মেলে ধরলে দেখা মেলে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার আবর্তে প্রায় সব ক’টি বিভাগীয় শহর-উপশহর, জেলা-উপজেলা, থানা এবং গ্রাম নামের আবর্তে একের অধিক সমিতির অবস্থান। আমেরিকায় বসবাসকারী অন্যান্য দেশ ও জাতির অবস্থান আরো বেশী থাকলেও সভা-সমিতি ও সংগঠনের দৌরাতেœ বাংলাদেশ রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। যার প্রভাব এখানে বসবাসকারী অন্যান্য দেশ ও জাতির অভিবাসীদের মধ্যে নেই বললেও চলে। পাশের দেশ ইন্ডিয়া-পাকিস্তান কিংবা নেপাল-ভুটানের প্রবাসীদের কোন সংগঠনের আধিক্য এখানে দেখা যায় না; যতটা না বাংলাদেশীদের মাঝে বিদ্যমান।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রবাসিদের কাছে পারিবারিক তথা সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব যতটা না বেশি তার চেয়ে বেশি হচ্ছে কমিউনিটির নামে বিভিন্ন সংগঠনের আধিপত্য নিয়ে। দেশের প্রায় সবক’টি জেলা-উপজেলার সংগঠনের কার্যক্রম চলছে এলাকা ভিত্তিক কয়েকজন প্রবাসী অভিবাসীদের নিয়ে। মতের অমিল হলে মাত্র কয়েকদিনের মাথায় সেটা ভেঙ্গে গড়ে উঠে নতুন আরেকটি সংগঠন। বিভিন্ন নামে শুরু হওয়ায় এসব সংগঠন আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও অহমিকার দম্ভে ভেঙ্গে এক সংগঠন বেড়ে হচ্ছে কয়েকটি। বাংলা পত্রিকার ধারাবাহিক প্রতিবেদনে পাঠকদের জন্য এবার তুলে ধরা হলো প্রবাসী ট্যাক্সি চালকদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন ক্যাবি সংগঠনের ইতিহাস।
প্রবাসী বাংলাদেশী কয়েকজন ক্যাব চালকদের নিয়ে ১৯৯৪ সালে প্রথম গঠন হয় ‘ইয়োলো সোসাইটি নিউইয়র্ক ইনক’.। মাত্র ৪৭জন ক্যাবীদের নিয়ে গঠিত এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ শাহ আলম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কামাল ইউ. আহমেদ। একবছরের মাথায় মতের অমিল এবং আঞ্চলিকতার প্রভাবে ইয়োলো সোসাইটি ভেঙ্গে গঠন হয় ‘বেঙ্গল ক্যাবি সোসাইটি অব নিউইয়র্ক’। ১৯৯৫ সালে গঠিত ক্যাবীদের দ্বিতীয় সংগঠন ‘বেঙ্গলে’র আহ্বায়ক ছিলেন লুৎফর রহমান। কিছু দিন না যেতেই তা আবার ভেঙ্গে গঠিত মদিনা সোসাইটি, বিজয় বন্ধু’সহ নাম না জানা আরো বেশ কয়েকটি ক্যাবী সংগঠন। এছাড়াও ইয়োলো থেকে বেঙ্গলের পর কাউয়া সোসাইটি নামের আরেকটি সংগঠন গঠন হয়। আঞ্চলিকতার প্রভাবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে ক্যাবীদের সংগঠন।
এছাড়াও একে একে গঠন হয় শাপলা ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশন যা আবার ভেঙ্গে বলাকা ওয়েল ফেয়ার; সেখান থেকে পদ্মা ইয়োলো সোসাইটি। এভাবেই ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় ক্যাবীদের নিয়ে গড়া সংগঠনের নেতাদের কেউ বছরে একবার হলেও সরব উপস্থিতি চোখে পড়ে। অন্যদিকে, সংগঠনের নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছেন অনেকেই।  যার মধ্যে দু’চারটি ছাড়া বাকী গুলোর সাংগঠনিক অবস্থান নেই বললেই চলে। আর যে গুলো রয়েছে এখনো তারা বছরে অন্তত একটি বনভোজন, বার্ষিক পুনর্মিলনী-পুরস্কার বিতরণ তথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নতুন নামে অ্যাসোয়িশেন কিংবা সমিতির দৌরাত্ম এখানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। কে কাকে ঘায়েল করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করবে। বছরে একবার মঞ্চের প্রথম কাতারে দাঁড়িয়ে কথা বলবে। পত্রিকা বিজ্ঞাপন দিয়ে পরবর্তিতে সংবাদের শিরোনামেই সীমাবদ্ধ এসব সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামো। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবতো রয়েছেই। পুরো দেশের ট্যাক্সি ক্যাবীদের প্রতিনিধিত্ব করবে এমন সংগঠন নেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে কথা বলেন, বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ সাখাওয়াত বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আমি এখন রাজনীতি ও আঞ্চলিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। ক্যাবীদের সংগঠনের সময় দেয়া হয়না আগের মত। স্বোচ্ছাসেবক লীগ যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছি। একসময়ে পদ্মা ইয়োলো সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম’।
তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের ক্যাবীদের সংগঠন অনেকগুলো হয়ে গেছে যা কাম্য নয়। নিউইয়র্কের সবচে বড় এবং প্রথম সংগঠন হচ্ছে ইয়োলো সোসাইটি নিউইয়র্ক ইন্ক। আগামীতে ওটার সাথে কাজ করেই বাংলাদেশী ক্যাবীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যাবো। কারণ মতের অমিলে একটা ভেঙ্গে আরেকটা গড়ে ঠিকই। মূলত এগুলো আমাদের বৃহত্তর স্বার্থে কাজে আসেনা। ধরুন নিউইয়র্কে আমাদের সকল ক্যাবীদের যদি একটি সংগঠন থাকে, তাহলে যে কোন সামাজিক কাজে সবার সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ অনেক বড় ভুমিকা রাখতে পারে। বাস্তব হলেও সত্যি। আমরা তা প্রতিষ্ঠায় এখনো উদাসীন। ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আশা করছি সময়ের সাথে মানুষের পরিবর্তনও ঘটবে।
ইয়োলো সোসাইটি থেকে বেরিয়ে গঠিত ‘বেঙ্গল ক্যাবী সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডেন্ট আবু তালেব চৌধুরী চান্দুর সাথে কথা হয়। এতে অধিক ক্যাবি সংগঠন প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা তুলে ধরেন তিনি। জানান, ‘আমি প্রধানত রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তারপরও ক্যাবীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা ইয়োলো সোসাটির সাথে যুক্ত হই। কতগুলো বিষয়ে মতের অমিল থাকায় নিউইয়র্কে গড়ে উঠা ক্যাবীদের দ্বিতীয় সংগঠন ‘বেঙ্গল’র যাত্র শুরু হয়। সংগঠনটির তিনবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও একবারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে আছি’।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি নাম। কিন্তু একটি নামকে প্রতিষ্ঠিত না করে এতগুলো সংগঠনের গড়ার উদ্দেশ্য কী? এমন প্রশ্নের জবাবে আবু তালেব চান্দু বলেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন আমাদের জাতীয় স্বার্থ চিন্তা করে এসব গড়ে উঠেনি। কমিউনিটিতে এসব সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে মূলত ব্যক্তি এবং আঞ্চলিকতার উপর ভর করে। প্রথমে যিনি উদ্যোগ নেন তিনি প্রতিষ্ঠাকালিন সময়ের বেশীরভাগ ব্যয়ের যোগানদাতা থাকেন। পরবর্তীতে হয়তো গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। ফলে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। ভেঙ্গে যাওয়ার আরো কারণ হচ্ছে মতের অমিল, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। নির্বাচনে পরাজয় মেনে না নেয়া আমাদের বাংলাদেশীদের একটা নেতিবাচক দিক’।
তিনি আরো বলেন, ‘সব নেতিবাচক নয়। ইতিবাচক দিকও রয়েছে এসব সংগঠনের। আমরা যখন বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এখন এটা সাংগঠনিক কাঠামো চলে আসছে। যেমন ধরুন- আমাদের সদস্যদের মধে ১মাস অসুস্থ থাকলে তার বাড়ি ভাড়া, ১ সপ্তাহের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান, কেউ মারা গেলে প্রতিটি সদস্য থেকে মাথাপিছু ২ হাজার ডলার অনুদান তুলে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর পরিবারকে সহায়তা প্রদান’সহ নানা কাজে আমরা এগিয়ে আসি। এরকম অনেক নজির আমাদের রয়েছে। বহু সদস্যের উপকারে আসতে পেরেছি আমরা। আমাদের মূল টার্গেটই হচ্ছে একে অন্যের সহায্যে এগিয়ে আসা। পাশাপাশি আমাদের সদস্য ক্যাবিদের ডিএমভি সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স এবং মেডেলিয়ন বিষয় নিয়েও কাজ করছে বেঙ্গল ক্যাবি সোসাইটি’।
বাংলাদেশী কমিউনিটির ক্যাবিদের একের অধিক সংগঠন হওয়ায় নিয়ে বাংলা পত্রিকার সাথে কথা বলেন, ‘ইউনাইটেড টেক্সি ড্রাইভার এসোসিয়েশন’-এনওয়াইসি ইউএসএ ইনক.-এর কনভেনার ওসমান চৌধুরী। তিনি জানান, ‘আসলে নব্বই দশকের মাঝামাঝি আমাদের টেক্সি চালকদের স্বার্থ রক্ষায় এখানে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়োলো সোসাইটি। এরপর বেঙ্গল ক্যাবি সেটাও ভেঙ্গে আরেকটি। এভাবেই একের পর এক গড়ে উঠে একটি থেকে কয়েকটি ক্যাবি সংগঠন’।
প্রশ্ন ছিল কেন এমনটি হচ্ছে? আর এতে লাভ-ই বা কী? জবাবে ওসমান চৌধুরী বলেন, ‘আসলে আমাদের ক্যাবি চালকদের সংগঠন অনেকগুলো এটা ঠিক। তবে, সবার যে উদ্দেশ্য খারাপ তা কিন্তু নয়। মূলত এসব সংগঠনগুলো আঞ্চলিকতা এবং পারিবারিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে থাকে। বলতে পারেন অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় একটি ভেঙ্গে আরেকটি গড়ার অন্যতম কারণ। আর আধিপত্য বিস্তারের যে কথাটি বলছেন সেটাও একটি বিষয়। একটি থেকে কয়েকটি গড়লেও অনেকেরই অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বাকী যেগুলোর অবস্থান রয়েছে, তারা অবশ্যই কাজ করছে কেউ মারা গেলে কিংবা দুর্ঘটনার শিকার হলে তার উপকারে। ক্যাবিদের থেকে চাঁদা তুলে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছেন ক্যাবিরা। আঞ্চলিকতা ও পরিবার নির্ভর হওয়ায় টেক্সি ক্যাবিদের প্রধান স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে পারছে না এসব সংগঠন। তবুও অনেক ভালো দিক রয়েছে’।
শুধু ক্যাবিদের সংগঠন নয় আছে ‘বাংলাদেশ কার এন্ড লিমোজিন এসোসিয়েশন’ ব্ল্যাক, গ্রীন কিংবা উবার চালকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে সংগঠনটি। এ প্রতিষ্ঠানও ভেঙ্গে আরেকটি গঠন হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আসলে একটি ছোট্ট ভুখন্ড ও স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। আমরা জাতি হিসেবে অনেক পরিশ্রমী এবং সাহসী। বলতে পারি দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির প্রধান উৎস প্রবাসীরা। অতিথি পরায়ণ জাতি হিসেবে দেশে-বিদেশে আমাদের কদরও রয়েছে বেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছি। বাস্তবে আমাদের ভেতর কাজ করছে ব্যক্তি কেন্দ্রিক  প্রবণতা। আধিপত্য বিস্তারে নিজের দেশ এবং জাতি ছোট করতে দ্বিধাবোধ করি না। সব কিছুতেই নেতিবাচক মানসিকতাকে প্রাধান্য দেই। মেনে নেয়ার ক্ষমতা যদি না থাকে তাহলে আমাদের ভালো অর্জনগুলো বৃথা। আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা হেরে যাবো। দেশ হারাবে মেধা ও অর্থনীতি। দেশের নোংরা রাজনীতি ছেড়ে ঐক্যবদ্ধ ফ্লাটফর্ম গড়তে ছাড় দেয়ার প্রবনতা জাগ্রত করতে হবে সবার মাঝে। তাহলেই সোনার বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে আগামীর পথে। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)