বঙ্গবন্ধু হত্যা ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা
- প্রকাশের সময় : ০২:২৪:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ অগাস্ট ২০১৫
- / ২৪৩৯ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীর ৪০ বছরের মাথায় এসে মুখ খুললেন ওই নির্মম ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আকিব হাসান ওরফে আবুল। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের সেই দিনে তিনি ছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। টাইম টেলিভিশন ও বাংলা পত্রিকার সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে তুলে ধরলেন ইতিহাসের নির্মম ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের ঘটনা। সেই কালো রাতের কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শোকে হতবিহল হয়ে পড়েন আবুল। নিজের দেয়া জবানন্দীতে তিনি বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ছিল শুক্রবার। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কিন্তু জাতির ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। যে জাতিকে আলোর পথ দেখানোর জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে দেশের আগামীর পরিকল্পনা তুলে ধরতেন; তার আগেই একদল বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের হাতে জীবন দিতে হয় তিনি’সহ পুরো পরিবারকে। শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি তারা।
কী ঘটেছিল সেইদনি? ওইদিনের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী আকিব হাসান আবুলের কথা তুলে ধরা হলো:
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট। ভোররাত। ধানমন্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে যান। আকিব হাসান আবুল বলেন, এদিন ৩২ নম্বর বাড়ির নীচতলার ১১ নম্বর রুমে আমি (আবুল), আবদুল’সহ আরো একজন মোট তিনজন ঘুমিয়ে ছিলাম।
ভোর রাত ৪ টা কী ৫ টা বাজে। চারদিকে কেবল গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার একটু ঘুম কম হয়। তাই আমি শব্দ শুনতে পাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু নীচে নেমে আসেন। আমাদের ডাক দিয়ে বলেন, এই তোরা কে কে আছিস? আমি দ্রুত লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে বলি স্যার আমরা তিনজন। বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেন, তোরা সাবধানে চারদিক দিয়ে ঘুরে দেখ কী ঘটতে যাচ্ছে। কোত্থেকে গুলি আসছে, আমি উপরে গিয়ে দেখছি। এই বলে বঙ্গবন্ধু উপরে চলে গেলেন। আমরা তিনজন নীচে দাঁড়িয়ে একটু পরেই শেখ কামাল ভাই নীচে নেমে আসেন। আমি ছিলাম তখন কামাল ভাইয়ের সাথে, উপস্থিত ছিলেন মহিতুল ভাইও। যিনি এই হত্যাকান্ডের মামলা করেছেন। তখনই আমরা দেখি ৪-৫জন লোক শুয়ে বন্দুক তাক করে আছে আমাদের দিকে।
তারপর কী ঘটেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে আকিব হাসান আবুল বলেন, মুহুর্তেই তারা উঠে দাঁড়িয়ে কামাল ভাইকে বলে হ্যান্ডস-আপ। কামাল ভাই তখন বলেন মুহিত ওদের বল আমি শেখ কামাল, রাষ্ট্রপতির ছেলে। ওরা মুহিতকে সরে যেতে বলে সাথে সাথেই কামাল ভাইকে কয়েকটা গুলি করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আমরা তখনও দাঁড়িয়ে। এরপর ওরা চলে যায়। আমি উপরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বললাম স্যার শেখ কামাল ভাইকে ওরা মেরে ফেলেছে। তিনি আমার মুখ চেপে ধরলেন। বললেন আস্তে বল। এরা কারা? স্যার আমি চিনি না।
বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল হত্যার কথা শুনার পর তিনি কেমন ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সেই দিনের অন্যতম এই প্রত্যক্ষদর্শী আকিব হাসান আবুল বলেন, স্যার এতটুকুও বিচলিত হননি। তিনি শুধু আমাকে প্রশ্ন করলেন কারা কামালকে গুলি করেছে আর্মি? আমি বললাম জি স্যার আর্মি পোশাক পরা লোকজন।
আমার সামনেই বঙ্গবন্ধু তিন জায়গায় ফোন করলেন। প্রথমে তখনকার সেনা প্রধান সফিউল্যাহকে, দ্বিতীয়ত নাইন ডিভিশনের জিওসি এবং তৃতীয় ফোনটি করেন বঙ্গভনের প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) তথা স্যারের দায়িত্ব পালনকারি কর্ণেল জামিলকে। জেনারেল শফি উল্লাহর সাথে কথা বলে তিনি হতাশ হলেন।
এদিকে গুলির শব্দ কেবল বাড়তে থাকে। জানালার কাঁচ ভেঙ্গে গুলি ঘরের ভেতরেও ভেদ করছে। স্যার দফা দফায় ফোন করছেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুম, সেনা প্রধানের কার্যালয় কোথায়ও কোন সাড়া পাননি তিনি। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্ল্যাহকেও ফোন করে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘শফিউল্ল্যাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে যা বুঝলাম তিনি তেমন আশার বাণী শোনাননি বঙ্গবন্ধুকে। স্যার তখন সম্ভবত বলছিলেন তুমি হেলপলেস কেন? শফিউল্ল্যাহর সেই ফোনালাপের পর বঙ্গবন্ধু খুব নাখোশ হন তার ওপর।
এরপর কী ঘটেছিল? বাংলা পত্রিকার প্রশ্নের জবাবে আবুল বলেন, স্যার তখন আবারো পিজিআরের দায়িত্বে থাকা কর্ণেল জামিলকে ফোন করে বলেন তোমার এখানে কেমন ফোর্স আছে? তিনি উত্তর দিলেন স্যার ২শ ৫০জন। স্যার বললেন আমার বাসায় অ্যাটাক হয়েছে। তাড়াতাড়ি তুমি ফোর্স নিয়ে এদিকে মুভ করো। আমরা পরে জানতে পারলাম কর্ণেল জামিল ধানমন্ডির ২৮ নম্বর পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। সোবহানবাগের মিরপুর রোডের ওপরে একটি মসজিদ আছে ওখানে তাকে হত্যা করা হয়।
কিছুক্ষণ পরেই দরজার সামনে বুটের আয়োজ শুনতে পাই আমরা। তারা দরজা খুলতে বললে বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। ওরা বঙ্গবন্ধুকে স্যার সম্বোধন করে বলে স্যার আপনি এইদিকে আসেন। এদের মধ্যে একজনকে আমি চিনতে পেরেছি। তবে তারা স্যারের সাথে কথা বলছে বলে আমি তাদের দিকে তাকাইনি। বঙ্গবন্ধু ওদের বললেন, তোরা আমার কামালকে মেরে ফেলছস? ওরা স্যারের কাছাকাছি একটা রেকর্ডার বাক্স’র মাইক সামনে এগিয়ে দিলেন; এরপর তারা স্যারকে একটা কাগজে সই করতে বলেন। বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে আঙুল স্বভাবসূলভ ভাবে বলেন, তোমরা জানো পাকিস্তানিদের কাছে আমি মাথা নত করিনি। কি হইছে তা বলো? তখন উনাকে তারা একবার তিনতলায় আবার নীচ তলায় উঠা নামানো করে। এদিকে বাইরে থেকে প্রচন্ড গুলি বাড়ির দিকে আসছে। জানালা ভেদ করে ভেতরেও প্রবেশ করছে। স্যার তাদের উদ্দেশ্যে আঙুল তুলে বললেন ওদের গুলি বন্ধ করতে বলো। কোন বুঝে উঠার আগেই স্যারকে তারা আঙ্গুল’সহ বুকের ওপর একের পর এক গুলি করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েন। পাশেই ছিলেন বেগম মুজিব, তাকেও তারা গুলি করে। এরপর তারা কামাল ভাইয়ের রুমে ঢুকে তার স্ত্রী ভাবীকেও গুলি করে।
এই প্রতিবেদকের কাছে আকিব হাসান আবুল কথাগুলো বলতে বলেতে খানিকটা স্তব্ধ হয়ে যান। ১৫ আগষ্টের সেই ভয়াল রাতের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী আবুল বলেন, শেখ জামাল ভাই আর্মির ইউনিফর্ম তখন পড়ছিলেন। পুরোটা পড়তে পারেননি। এলোপাতাড়ি গুলি করে জামাল ভাই ও ভাবীকে হত্যা করা হয়।
তারপর তারা আমাকে’সহ গৃহকর্মী আবদুল ও রমাকে বাইরে নিয়ে যায়। সাথে রাসেল ভাইকেও। রাসেল ভাইয়ের বয়স মাত্র দেড় বছর ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে মহিতুল, নুরুল ইসলাম, শেখ নাসের আঙ্কেল, আব্দুল মতিন, পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ অন্য সদস্যদের সারি করে দাঁড় করানো হয়। এর মধ্যে ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যকে গুলি করলে তিনি পড়ে যান। শেখ জামাল ভাইকে গুলি করার সময় একটা গুলি ফেরত এসে আবদুলের পেটে লাগে তখন সে আহত হয়। আমরা বাইরে দেখি কয়েকজনের লাশ পড়ে আছে।
এরপর মেজর ডালিম একটি জীপে করে আসেন। তিনি একে একে আমাদের পরিচয় জানতে চান। তারপর একজন পরিচয় করিয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ডালিম’সহ কয়েকজন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। বিয়ের সময়ের গহনা’সহ উপহার পাওয়া অস্ত্র সবকিছু লুট করে নিয়ে যায় তারা। শিশু শেখ রাসেলকেও প্রাণে বাঁচতে দেয়নি। শেখ নাসের আঙ্কেলকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। এভাবে একে একে পরিবারের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দু’ মেয়ে ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানাও বড় বোনের সাথে ছিলেন।
আকিব হাসান আবুল বলেন, ওই ঘটনার সময় আবদুলের গা থেকে রক্ত পড়ছিল। আমরা সবাই কমবেশী কাঁচের টুকরোর আঘাতে রক্তাক্ত। তারা আমাদের ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়। আমাকে ও আবদুলকে হাসপাতালের দায়িত্বতে নার্সরা সেবা দিতে থাকে। এক নার্স আমাকে তাওয়াল দিয়ে রক্তা মাখা জামা পরিবর্তন করতে বলে। আমি রুমের দরজা লাগিয়ে মেডিকেলের জানালা দিয়ে পালিয়ে যাই। কার্জন হলের পেছন দিয়ে প্রেস ক্লাবের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসি। ফোন করি বঙ্গভবনের কম্পট্রোলারকে তিনি তখন গৃহবন্দি। তিনি আমাকে বললেন তার কাছে যেতে। কী ভাবে যাবো জানতে চাইলে তিনি বললেন ওমুক জায়গা তুমি দাড়িয়ে থাকবে একটি আর্মি জীপ তোমাকে তুলে নিবে। তার কথামত আমি যাই। এর আগে উনাকে ফোনেই সব বলি যে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে।
আবুল বলেন, এতদিন পর আমি মুখ খুলেছি। আসলে আমরা চাকুরি করতাম ঠিকই। বঙ্গবন্ধু পরিবার কোন সরকারের মতো আচরণ করতেন না। তারা যে কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তা বলে শেষ করা যাবে না। আজকে ৪০ বছর পর এই কথা বলতে গিয়েও খারাপ লাগছে।
এর আগে আমি বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাজ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী হতে বলেছিলেন। কিন্তু তখন মাত্র আমি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছি। যার জন্য যেতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সেই নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে এই সান্তনা নিয়েই এখন বেঁচে আছি। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)