নিউইয়র্ক ১০:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

‘মানবতা ব্যবসা’, পরেন আড়াই কোটি টাকার ঘড়ি

হককথা ডেস্ক
  • প্রকাশের সময় : ০৬:২৩:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুন ২০২৪
  • / ৭৩ বার পঠিত

শেখ ফয়সাল। হাতে পরেন আড়াই কোটি টাকা দামের ঘড়ি। চলেন দামি গাড়ির বহর নিয়ে। সঙ্গে থাকে সশস্ত্র দেহরক্ষী। মিটিং করেন পাঁচতারকা হোটেলে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেটাকে পুঁজি করে ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। সেবা দেয়ার নাম করে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। সেই টাকা ব্যয় করেন নিজের ভোগ-বিলাসে। কথিত মানবতার ফেরিওয়ালা ফয়সাল শেখ গত কয়েক বছর ধরে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন এমন প্রচারণা চালান নানাভাবে। স্বাস্থ্য সেবা কার্ডের প্রচারণা চালান ফেসবুকে বাংলাদেশে প্রথম ৯৯৯ টাকায় হেলিকপ্টার সেবা দেয়ার কথা বলে দেশের মানুষের সামনে আলোচনায় আসেন তিনি।

আর এসব ভিডিও নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করেন। দীর্ঘদিন এসব প্রচার চালিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও এখন ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস নামের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার অবস্থা! এরই মধ্যে নামিয়ে ফেলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড।

রাজধানীর মিপুর-৬ নম্বরের বাজারের পাশে ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেসের কার্যালয়। কিন্তু যে ফ্লোরে অফিস ছিল সেখানেই এখন ভাড়া হবে সাইনবোর্ড ঝুলছে। মিরপুর-১ নম্বর ঈদগাহ মাঠ এলাকায় ২০২২ সালের ১২ই ডিসেম্বর বিভন্ন তারকাদের এনে বিশাল কনসার্টের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবার প্রচারণার আয়োজন করেছিল ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস। ঈদগাহ মাঠের কাছে এক চায়ের দোকানি মানবজমিনকে বলেন, তার প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য একটি কার্ড করেছিলেন। কথা ছিল ফয়সালের এম্বুলেন্স সেবাসহ সকল চিকিৎসা পাওয়া যাবে। তখন দেশসেরা তারকাদের দিয়ে কনসার্টের আয়োজন করে সেই সময় তাদের কাছ থেকে ৩শ’ টাকার বিনিময়ে একটি স্বাস্থ্যকার্ড বিক্রি করেন ফয়সাল। কিন্তু কখনোই এই কার্ডের সেবা পাননি এই ভুক্তভোগী নারী। শুধু এই নারীই নন, যারাই কার্ড নিয়েছেন এবং যোগাযোগ করেছেন কেউ স্বাস্থ্যসেবা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মিরপুর-১ নম্বর এলাকার আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা কেউ এ পর্যন্ত এই সেবা পাননি।

এদিকে ফরিদপুরে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ১৮৬ জনতা রোড গোপালগঞ্জের নিজ এলাকায় হাতেগোনা কিছুসংখ্যক মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে শেখ ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস। সেখানেও বহু মানুষ ৩০০ টাকা দিয়ে হেল্থ কার্ড নিয়েছেন।

চট্টগ্রামের সাবেক একজন পুলিশ সদস্য ফয়সালের কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিলেন তার প্রচারণা দেখে। পরে যখন প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারেন তখন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ফয়সালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

অভিযোগ রয়েছে- মিরপুরে ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেসের অফিসে আরবি গান ছেড়ে অমানুষিক নির্যাতন করেন তারই ব্যবসায়িক পার্টনার থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী চাকরিজীবীদের। কিন্তু নিজে প্রতিবন্ধী হয়ে কীভাবে তিনি এ কাজ করেন? এ বিষয়ে পুরান ঢাকার ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জালাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় মানবজমিন-এর। তিনি বলেন, অনলাইনে ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন নাফকো রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের সঙ্গে। ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস সার্ভিস লিমিটেডের অফিসের ৬ষ্ঠতলায় তারই বাবার প্রতিষ্ঠান নাফকো অবস্থিত। প্রতারক ফয়সাল এর হেল্থ এক্সপ্রেসে বিনিয়োগ করলে সেই লাভের টাকা দিয়েই ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব এমন আশ্বাসে জালাল ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। পাশাপাশি তার ফ্ল্যাট বাবদ ২৫ লাখ টাকা আগেই তুলে দিয়েছিলেন শেখ ফয়সালের হাতে। কিছুদিন পর ব্যবসার লভ্যাংশ তো দূরের কথা- ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিতে তালবাহানা শুরু করেন। এর কিছুদিন পর জালাল ব্যবসায়িক কাজে বিদেশ গেলে তাকে বিদেশ থেকে গোল্ড বার নিয়ে আসতে বলেন ফয়সাল। গোল্ড বারের টাকার সঙ্গে আগের সকল পাওনা টাকা বুঝিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ঘটে উল্টোটা। এ সময় ব্যবসায়ী জালালকে ফয়সালের অফিসে ডেকে রাতভর উচ্চ ভলিউমে আরবি গান ছেড়ে বন্দুক ও লাঠি-লোহার রড দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন শেষে জালালের সামনে ইয়াবা রেখে ভিডিও চিত্র ধারণ করেন। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে স্বীকারোক্তি নেয়া হয় ফয়সালের কাছে তার কোনো টাকা পাওনা নেই। এরপর ফয়সালের এম্বুলেন্স দিয়ে ব্যবসায়ী জালালকে তার বাসায় নামিয়ে দেন।

এসব ঘটনার পর ফয়সালের বাবা নতুন করে দলিল করে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়ার চুক্তি করেন। কিন্তু এটা ছিল তার নতুন ফাঁদ। গা শিউরে ওঠা ফয়সালের এই নির্যাতনের সাক্ষী বহু মানুষ। মিরপুর-১০ নম্বরে এক ট্রাভেল এজেন্সির মালিকও তার নির্যাতনের শিকার। শেখ ফয়সাল বরাবরই আয়েশি জীবনে অভ্যস্ত। মাঝে-মধ্যে দলবল নিয়ে চলে যান দুবাই। সেখানে থাকেন তারকা হোটেলে। ফয়সালের ভিসাসহ এসব কাজ করে দিতেন মিরপুর-১০ নম্বরের ব্যবসায়ী ইমন। ফয়সালের বিমানের টিকিট, হোটেল ভাড়া সবকিছু তিনিই ঠিক করে দিতেন। সেই টিকিট কাটতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। ৬ লাখ টাকার টিকিট করে দেয়ার পর সেই টাকা নিয়ে তালবাহানা শুরু করেন ফয়সাল। পরে দুবাইয়ে থাকাকালীন ১ লাখ দিরহামের ব্যবস্থা করে দিতে ইমনকে অনুরোধ করেন। সেই দিরহামের ব্যবস্থা করে দিয়ে ফয়সালের মিরপুর অফিসে টাকা আনতে গেলে পাওনা ৪০ হাজার টাকা হাতে দিয়ে সিনেমা স্টাইলে ফয়সালের লোকজন সেই টাকা কেড়ে নেয়। পরে তাকেও আটকে নির্যাতন করা হয়। এরপর তার থেকে ভিডিও বক্তব্য নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পাওনা টাকা ফেরত চাইলে দেশে ফিরে ফয়সাল উল্টো ৪৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ভুয়া মামলা দেয় ইমনের বিরুদ্ধে। তার সঙ্গে মিরপুর-৬ নম্বরের এক স্থানীয় নেতা এবং তারই সহকারী রাসেলও আসামি হন এই মামলায়। তুরাগ থানায় করা ভুয়া মামলাটি পরে খারিজ হয় আদালতে। এ ঘটনায় জড়িত মশিউর ঢাকা ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি নড়াইলে চলে যান। মিরপুর থানায় ৬ লাখ টাকার জিডি করলেও বাকি ৩৪ লাখ টাকার কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেননি তারা।

মো. হারিস ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। তিনিও ফ্ল্যাট কেনার বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন নাফকোতে। কিন্তু পূর্বের মতো তিনিও মোটা লভ্যাংশের লোভে কয়েক ধাপে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেসে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। হারিস মানবজমিনকে বলেন, ফয়সাল বিভিন্ন কৌশলে এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরপর সকল ডকুমেন্ট নিয়ে সেই ৬ নম্বর অফিসে একই কায়দায় রাতভর নির্যাতন করা হয় তার ওপর। পরে এই ঘটনার জন্য অস্ত্রের মুখে ক্ষমা চেয়ে হারিস নিজেই তার টাকার বিপরীতে ফ্ল্যাট লিখে দেয়ার কথা বলেন। এসব ঘটনার পর এই পরিবারটি এখন নিঃস্ব। বিচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে গেলেও ফয়সালের ক্ষমতার কাছে এসব ভুক্তভোগী অসহায়। হারিস বলেন, আমাকে রাতভর মারধর করা হয়। এ সময় তার সহযোগীদের একজন মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পেছন থেকে আরেকজন হকিস্টিক দিয়ে পেটাতে থাকে। তখন একটি ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। যেখানে আমাকে দিয়ে মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশিদসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে বকাঝকা করতে বলা হয়। এবং বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। আমাকে বলা হয়, ফয়সালের কাছে আমি কোনো টাকা পাবো না। তিনি আমার কাছে উল্টো টাকা পাবেন।

ফয়সাল যে শুধুই এসব ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা বা নির্যাতন করেছেন তেমনটি নয়। তার প্রতিষ্ঠানে যারা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেছেন তাদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। অলিফিন বিডি- রাজধানীর মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে সাউন্ড সিস্টেমের কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি। আব্দুল্লাহ আল সাব্বির প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তিনি ফয়সালের জিমে সাউন্ড সিস্টেমের কাজ করতেন। কিন্তু কাজ শেষে সেই টাকা নিয়ে শুরু হয় তালবাহানা। দফায় দফায় যোগাযোগ করা হয় শেখ ফয়সালের সঙ্গে। পরে সেই টাকা আনতে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী ফয়সালের অফিসে গেলে তাকেও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয় ফয়সালের লোকজন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের আইডিইবি ভবনের কম্পিউটার ব্যবসায়ী সুমন। তিনিও প্রতারিত হয়েছেন। শেখ ফয়সালের কাছে ১৫ লাখ টাকার ল্যাপটপ বিক্রি করেন। কিন্তু সেই টাকা আজও পাননি। এই ব্যবসায়ীকেও একই কায়দায় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভুয়া চেক দেন ফয়সাল। সেই টাকা উদ্ধারের জন্য দফায় দফায় যোগাযোগ করেও টাকা পাচ্ছেন না এই ব্যবসায়ী।

শেখ ফয়সালের এমন প্রতারণা নতুন নয়। ২০২১ সালে নিজ জেলা গোপালগঞ্জে নিজেকে ডিবি পরিচয় দিয়ে দুই যুবককে নির্যাতন করেন। পরে ভুয়া ডিবি সাজার অপরাধে গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা হয় শেখ ফয়সালের নামে। আসামি ছিল আর দুইজন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ ফয়সাল বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। যারা অভিযোগ করেছেন তারা প্রত্যেকেই প্রতারক বলে দাবি করেন ফয়সাল। তিনি বলেন, আমার ফেসবুক পেজে প্রায় ১০ মিলিয়ন ফলোয়ার। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমি একজন পঙ্গু মানুষ। আমি কীভাবে মানুষকে নির্যাতন করবো।সূত্র: মানবজমিন।

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

‘মানবতা ব্যবসা’, পরেন আড়াই কোটি টাকার ঘড়ি

প্রকাশের সময় : ০৬:২৩:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুন ২০২৪

শেখ ফয়সাল। হাতে পরেন আড়াই কোটি টাকা দামের ঘড়ি। চলেন দামি গাড়ির বহর নিয়ে। সঙ্গে থাকে সশস্ত্র দেহরক্ষী। মিটিং করেন পাঁচতারকা হোটেলে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেটাকে পুঁজি করে ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। সেবা দেয়ার নাম করে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। সেই টাকা ব্যয় করেন নিজের ভোগ-বিলাসে। কথিত মানবতার ফেরিওয়ালা ফয়সাল শেখ গত কয়েক বছর ধরে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন এমন প্রচারণা চালান নানাভাবে। স্বাস্থ্য সেবা কার্ডের প্রচারণা চালান ফেসবুকে বাংলাদেশে প্রথম ৯৯৯ টাকায় হেলিকপ্টার সেবা দেয়ার কথা বলে দেশের মানুষের সামনে আলোচনায় আসেন তিনি।

আর এসব ভিডিও নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করেন। দীর্ঘদিন এসব প্রচার চালিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও এখন ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস নামের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার অবস্থা! এরই মধ্যে নামিয়ে ফেলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড।

রাজধানীর মিপুর-৬ নম্বরের বাজারের পাশে ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেসের কার্যালয়। কিন্তু যে ফ্লোরে অফিস ছিল সেখানেই এখন ভাড়া হবে সাইনবোর্ড ঝুলছে। মিরপুর-১ নম্বর ঈদগাহ মাঠ এলাকায় ২০২২ সালের ১২ই ডিসেম্বর বিভন্ন তারকাদের এনে বিশাল কনসার্টের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবার প্রচারণার আয়োজন করেছিল ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস। ঈদগাহ মাঠের কাছে এক চায়ের দোকানি মানবজমিনকে বলেন, তার প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য একটি কার্ড করেছিলেন। কথা ছিল ফয়সালের এম্বুলেন্স সেবাসহ সকল চিকিৎসা পাওয়া যাবে। তখন দেশসেরা তারকাদের দিয়ে কনসার্টের আয়োজন করে সেই সময় তাদের কাছ থেকে ৩শ’ টাকার বিনিময়ে একটি স্বাস্থ্যকার্ড বিক্রি করেন ফয়সাল। কিন্তু কখনোই এই কার্ডের সেবা পাননি এই ভুক্তভোগী নারী। শুধু এই নারীই নন, যারাই কার্ড নিয়েছেন এবং যোগাযোগ করেছেন কেউ স্বাস্থ্যসেবা পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মিরপুর-১ নম্বর এলাকার আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা কেউ এ পর্যন্ত এই সেবা পাননি।

এদিকে ফরিদপুরে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ১৮৬ জনতা রোড গোপালগঞ্জের নিজ এলাকায় হাতেগোনা কিছুসংখ্যক মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে শেখ ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস। সেখানেও বহু মানুষ ৩০০ টাকা দিয়ে হেল্থ কার্ড নিয়েছেন।

চট্টগ্রামের সাবেক একজন পুলিশ সদস্য ফয়সালের কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিলেন তার প্রচারণা দেখে। পরে যখন প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারেন তখন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ফয়সালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

অভিযোগ রয়েছে- মিরপুরে ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেসের অফিসে আরবি গান ছেড়ে অমানুষিক নির্যাতন করেন তারই ব্যবসায়িক পার্টনার থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী চাকরিজীবীদের। কিন্তু নিজে প্রতিবন্ধী হয়ে কীভাবে তিনি এ কাজ করেন? এ বিষয়ে পুরান ঢাকার ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জালাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় মানবজমিন-এর। তিনি বলেন, অনলাইনে ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন নাফকো রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারের সঙ্গে। ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেস সার্ভিস লিমিটেডের অফিসের ৬ষ্ঠতলায় তারই বাবার প্রতিষ্ঠান নাফকো অবস্থিত। প্রতারক ফয়সাল এর হেল্থ এক্সপ্রেসে বিনিয়োগ করলে সেই লাভের টাকা দিয়েই ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব এমন আশ্বাসে জালাল ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। পাশাপাশি তার ফ্ল্যাট বাবদ ২৫ লাখ টাকা আগেই তুলে দিয়েছিলেন শেখ ফয়সালের হাতে। কিছুদিন পর ব্যবসার লভ্যাংশ তো দূরের কথা- ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিতে তালবাহানা শুরু করেন। এর কিছুদিন পর জালাল ব্যবসায়িক কাজে বিদেশ গেলে তাকে বিদেশ থেকে গোল্ড বার নিয়ে আসতে বলেন ফয়সাল। গোল্ড বারের টাকার সঙ্গে আগের সকল পাওনা টাকা বুঝিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ঘটে উল্টোটা। এ সময় ব্যবসায়ী জালালকে ফয়সালের অফিসে ডেকে রাতভর উচ্চ ভলিউমে আরবি গান ছেড়ে বন্দুক ও লাঠি-লোহার রড দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন শেষে জালালের সামনে ইয়াবা রেখে ভিডিও চিত্র ধারণ করেন। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে স্বীকারোক্তি নেয়া হয় ফয়সালের কাছে তার কোনো টাকা পাওনা নেই। এরপর ফয়সালের এম্বুলেন্স দিয়ে ব্যবসায়ী জালালকে তার বাসায় নামিয়ে দেন।

এসব ঘটনার পর ফয়সালের বাবা নতুন করে দলিল করে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়ার চুক্তি করেন। কিন্তু এটা ছিল তার নতুন ফাঁদ। গা শিউরে ওঠা ফয়সালের এই নির্যাতনের সাক্ষী বহু মানুষ। মিরপুর-১০ নম্বরে এক ট্রাভেল এজেন্সির মালিকও তার নির্যাতনের শিকার। শেখ ফয়সাল বরাবরই আয়েশি জীবনে অভ্যস্ত। মাঝে-মধ্যে দলবল নিয়ে চলে যান দুবাই। সেখানে থাকেন তারকা হোটেলে। ফয়সালের ভিসাসহ এসব কাজ করে দিতেন মিরপুর-১০ নম্বরের ব্যবসায়ী ইমন। ফয়সালের বিমানের টিকিট, হোটেল ভাড়া সবকিছু তিনিই ঠিক করে দিতেন। সেই টিকিট কাটতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। ৬ লাখ টাকার টিকিট করে দেয়ার পর সেই টাকা নিয়ে তালবাহানা শুরু করেন ফয়সাল। পরে দুবাইয়ে থাকাকালীন ১ লাখ দিরহামের ব্যবস্থা করে দিতে ইমনকে অনুরোধ করেন। সেই দিরহামের ব্যবস্থা করে দিয়ে ফয়সালের মিরপুর অফিসে টাকা আনতে গেলে পাওনা ৪০ হাজার টাকা হাতে দিয়ে সিনেমা স্টাইলে ফয়সালের লোকজন সেই টাকা কেড়ে নেয়। পরে তাকেও আটকে নির্যাতন করা হয়। এরপর তার থেকে ভিডিও বক্তব্য নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পাওনা টাকা ফেরত চাইলে দেশে ফিরে ফয়সাল উল্টো ৪৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ভুয়া মামলা দেয় ইমনের বিরুদ্ধে। তার সঙ্গে মিরপুর-৬ নম্বরের এক স্থানীয় নেতা এবং তারই সহকারী রাসেলও আসামি হন এই মামলায়। তুরাগ থানায় করা ভুয়া মামলাটি পরে খারিজ হয় আদালতে। এ ঘটনায় জড়িত মশিউর ঢাকা ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি নড়াইলে চলে যান। মিরপুর থানায় ৬ লাখ টাকার জিডি করলেও বাকি ৩৪ লাখ টাকার কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেননি তারা।

মো. হারিস ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। তিনিও ফ্ল্যাট কেনার বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন নাফকোতে। কিন্তু পূর্বের মতো তিনিও মোটা লভ্যাংশের লোভে কয়েক ধাপে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন ফয়সাল হেল্থ এক্সপ্রেসে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। হারিস মানবজমিনকে বলেন, ফয়সাল বিভিন্ন কৌশলে এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরপর সকল ডকুমেন্ট নিয়ে সেই ৬ নম্বর অফিসে একই কায়দায় রাতভর নির্যাতন করা হয় তার ওপর। পরে এই ঘটনার জন্য অস্ত্রের মুখে ক্ষমা চেয়ে হারিস নিজেই তার টাকার বিপরীতে ফ্ল্যাট লিখে দেয়ার কথা বলেন। এসব ঘটনার পর এই পরিবারটি এখন নিঃস্ব। বিচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে গেলেও ফয়সালের ক্ষমতার কাছে এসব ভুক্তভোগী অসহায়। হারিস বলেন, আমাকে রাতভর মারধর করা হয়। এ সময় তার সহযোগীদের একজন মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পেছন থেকে আরেকজন হকিস্টিক দিয়ে পেটাতে থাকে। তখন একটি ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। যেখানে আমাকে দিয়ে মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশিদসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে বকাঝকা করতে বলা হয়। এবং বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। আমাকে বলা হয়, ফয়সালের কাছে আমি কোনো টাকা পাবো না। তিনি আমার কাছে উল্টো টাকা পাবেন।

ফয়সাল যে শুধুই এসব ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা বা নির্যাতন করেছেন তেমনটি নয়। তার প্রতিষ্ঠানে যারা বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেছেন তাদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। অলিফিন বিডি- রাজধানীর মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে সাউন্ড সিস্টেমের কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি। আব্দুল্লাহ আল সাব্বির প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তিনি ফয়সালের জিমে সাউন্ড সিস্টেমের কাজ করতেন। কিন্তু কাজ শেষে সেই টাকা নিয়ে শুরু হয় তালবাহানা। দফায় দফায় যোগাযোগ করা হয় শেখ ফয়সালের সঙ্গে। পরে সেই টাকা আনতে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী ফয়সালের অফিসে গেলে তাকেও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয় ফয়সালের লোকজন।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের আইডিইবি ভবনের কম্পিউটার ব্যবসায়ী সুমন। তিনিও প্রতারিত হয়েছেন। শেখ ফয়সালের কাছে ১৫ লাখ টাকার ল্যাপটপ বিক্রি করেন। কিন্তু সেই টাকা আজও পাননি। এই ব্যবসায়ীকেও একই কায়দায় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভুয়া চেক দেন ফয়সাল। সেই টাকা উদ্ধারের জন্য দফায় দফায় যোগাযোগ করেও টাকা পাচ্ছেন না এই ব্যবসায়ী।

শেখ ফয়সালের এমন প্রতারণা নতুন নয়। ২০২১ সালে নিজ জেলা গোপালগঞ্জে নিজেকে ডিবি পরিচয় দিয়ে দুই যুবককে নির্যাতন করেন। পরে ভুয়া ডিবি সাজার অপরাধে গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি মামলা হয় শেখ ফয়সালের নামে। আসামি ছিল আর দুইজন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ ফয়সাল বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। যারা অভিযোগ করেছেন তারা প্রত্যেকেই প্রতারক বলে দাবি করেন ফয়সাল। তিনি বলেন, আমার ফেসবুক পেজে প্রায় ১০ মিলিয়ন ফলোয়ার। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমি একজন পঙ্গু মানুষ। আমি কীভাবে মানুষকে নির্যাতন করবো।সূত্র: মানবজমিন।