হাসিনার ‘কৌশল’ বনাম ‘খালেদার ভুল’
- প্রকাশের সময় : ১১:০৩:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০১৫
- / ৭৭৫ বার পঠিত
ঢাকা: সর্বশেষ পাওয়া খবরগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ -ইন্টারনেট, কেবল সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ৩০ জানুয়ারী শুক্রবার মাঝরাত থেকে শুরু হয়েছে এই অবস্থা। আশঙ্কা রয়েছে আরও কঠোর উদ্যোগের। তার গ্রেপ্তারের আশঙ্কাও করছেন অনেকে। শুক্রবার দিনের বেলাতেই একটি সভায় নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খান এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
তার বক্তব্যের সত্যতা ফলতে দেখে, বিএনপিপন্থিদের কেউ কেউ দিশেহারা হচ্ছেন। আর কেউ কেউ ভাবছেন, এতে সরকারের প্রতি মানুষ বিরক্ত হবে। খালেদার প্রতি আবারও সহমর্মিতা জাগবে। কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা দিতে আসা প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে যে সমালোচনায় খালেদা পড়েছেন, তা এবার কাটা পড়বে। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে বিএনপি আরও শেষ হয়ে যাবে। আন্দোলনের আত্মবিশ্বাস গড়বে না আর তাদের মাঝে।
‘হাসিনার কৌশল’ বনাম ‘খালেদার ভুল’
টেকসই’ শব্দটিই প্রয়োগযোগ্য ভাবছেন অনেকে! কারণ তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ প্রধান ও সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার ‘কৌশল’গুলো তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করবে। ভিন্ন মতও রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, হাসিনার কৌশল সফলে হাসিনা নন, বড় অবদান রয়েছে তারই বড় প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার (বিএনপি চেয়ারপারসন)।
বাংলাদেশের সচেতন প্রায় প্রতিটি মানুষই খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে জানেন।
মোটামুটি নিরপেক্ষতার ধার ঘেঁষে যারা কথা বলছেন, তাদের অনেকেরই মন্তব্য- খালেদার নানা ‘ভুলে’ই রঙিন হচ্ছে শেখ হাসিনার ‘কৌশল’গুলো!
খালেদা জিয়ার কিছু সিদ্ধান্তকে তার অনেক শুভাকাঙংক্ষীও সরাসরি ‘ভুল’ বলে অভিহিত করছেন। তারা বলছেন, রাজনীতিতে তাদের এই নাজুক মুহূর্তে খালেদার ভুলগুলোর খেসারত কঠিনভাবে দিতে হবে। এতে নিঃসন্দেহে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন হাসিনার অনুসারীরা। ক্ষমতায় থেকেই ক্ষমতার সীমা বাড়তে দেখা নিশ্চয়ই আনন্দেরই। কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বিরোধীদল, বিশেষ করে বিএনপির। সেই কারণও দেশের মানুষের জানা- বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে দেখা গেছে, এই দুই দলের যেকোনো একটি যতটা এগিয়েছে, অন্যটি ততটাই পিছিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একে অন্যের বিকল্প হিসেবে এসেছে মানুষের কাছে।
এ দেশের ভোট-রসায়ন সম্পর্কে মোটামুটি যারা অবগত, তাদের বলতে দেখা যায়, ‘এদেশের মানুষ বিএনপি’তে ‘ত্যক্ত’ হয়ে আ.লীগ’কে বেছে নেয়, আবার আওয়ামী লীগে ‘ত্যক্ত’ হয়ে বিএনপি’কে বেছে নেয়।’ দুই দলের প্রতি অবিরাম ভালোবাসা ধরে রাখা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়ে।
সে কারণেই দু’টি প্রধান দলের ভুল-কৌশল নিয়ে চলে নিত্য আলোচনা।
কৌশল বনাম ভুল-১
সবচে কাছাকাছি সময়ের উদাহরণ টানতে চাইলে ২৪ জানুয়ারী’র কথাই ধরা যায়। খালেদার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো’র অকাল মৃত্যু বিএনপি’র ঘোরশত্রুকেও স্তম্ভিত করেছে। এদেশের মানুষ অন্যের কষ্টে এখনো কষ্ট পায়। স্বাভাবিকভাবেই শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন খালেদা। আর সেটি বুঝেই একজন মায়ের প্রতি সমবেদনায় খালেদার দিকে এগিয়ে যান শেখ হাসিনা।
কিন্তু হল না। শেষ মুহূর্তে খালেদার একান্ত সহকারী শিমুল বিশ্বাস জানালেন, শোকে কাতর খালেদাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। যারা সেই সময়টিতে গুলশানে বা টেলিভিশনের সামনে ছিলেন, তাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না এই খবরে।
তবু শেখ হাসিনা চলে এলেন খালেদার কার্যালয়ের সামনে। অপেক্ষা শেষে ফিরেও গেলেন। সেই সঙ্গে কোটি মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা গেল তার ঝুড়িতে। অপরদিকে সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি ও খালেদা জিয়া।
যাত্রাবাড়ীতে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় খালেদাসহ দলের নেতাদের আসামী করে মামলার খবর পরদিনই মিডিয়ায় আসে। বিএনপি নেতাদের দাবী, যাত্রাবাড়ীর ঘটনার পেছনে সরকারের হাত রয়েছে। নাটক সাজিয়ে খালেদাকে আসামি করা হয়েছে। এরপর শেখ হাসিনার এই আগমনকে তারা ‘ছলনা’, ‘কৌশল’ বলে অভিহিত করেন। তবে অবস্থা বেগতিক দেখেই হোক, বা সম্বিত ফিরেই হোক, খালেদা জিয়া তার বিবৃতিতে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনাকে। কিন্তু দোষ পুরোপুরি কাটা পড়লো না। বরং খালেদা জিয়া ও বিএনপি’র ভুলে লাভবান হলেন শেখ হাসিনা ও তার দল।
কৌশল বনাম ভুল-২
এবার আরেকটু পেছনে যাওয়া যায়। ৩ জানুয়ারী রাত থেকে শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া (বিএনপি চেয়ারপারসন) তার গুলশান কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’।
৫ জানুয়ারীকে কেন্দ্র করে গুলশান থেকে নয়াপল্টন অফিসে যাবেন ও সেখানে অবস্থান নেবেন খালেদা- এমন ‘পরিকল্পনা’ ‘ফাঁস’ হয়ে যায়। ‘অবরুদ্ধ’ হন তিনি। যদিও খালেদা অবরুদ্ধ নন বলে জোর দাবি তোলেন আওয়ামী নেতারা।
প্র্রধানমন্ত্রীও তার বক্তব্যে বলেন, খালেদা চাইলেই বাসায় যেতে পারেন। কিন্তু জাতি দেখলো- খালেদা কার্যালয়েই রয়েছেন। এভাবে দুই নেত্রীই নিজেদের অবস্থানে অটল রইলেন। অবরোধ চলতে থাকে, মানুষও পুড়তে থাকে।
শুরু হলো বিশ্ব ইজতেমার আসর। ইজতেমার কারণে খালেদা অবরোধ তুলতে বাধ্য হবেন বলে সরকার দলের নেতাদের অনেকেই ধরে নিলেন। আওয়ামী নেতাদের অভিসন্ধি বুঝেই হয়তো খালেদা অবরোধ তুললেন না। যার খেসারত দিতে হল সাধারণ মানুষকে। ইজতেমায় অংশ নেওয়া মানুষগুলোর ভোগান্তির চিত্র মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের মানুষ জানলো। আর যা হওয়ার তাই হল। এটি খালেদা জিয়ার আরেকটি ভুল বলে গণ্য হল।
ইজতেমার মতো গুরুত্বপূর্ণ আসরের প্রতি অবমাননা অনেকেই মানতে পারেন নি। এদিক দিয়ে আবারো শেখ হাসিনাকে লাভের সুযোগ করে দিলেন খালেদা।
কৌশল বনাম ভুল-৩
খালেদা আসলেই অবরুদ্ধ কিনা সেই তর্ক চলেছে দীর্ঘসময়। শেখ হাসিনার কৌশলের সঙ্গে খালেদা পেরে উঠছেন না বলে অনেকেই গুঞ্জন করছিলেন। সব দেখে-শুনে চলতি সংসদের পয়েন্ট অব অর্ডারে (২০ জানুয়ারী) দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বলেন, শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে হেরে গেছেন খালেদা জিয়া। নাসিমসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা শেখ হাসিনার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গর্ব করেন। নিজেদের আন-অফিসিয়াল আড্ডায় এ নিয়ে আলোচনাও জমে ওঠে।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত খালেদার ভুল হিসেবে ‘তিনটি’ বিষয়কে সম্প্রতি (২৬ জানুয়ারি, একটি সভায়) ব্যাখ্যা করেন। তার বক্তব্যের সারমর্ম কিছুটা এমন, ‘৫ জানুয়ারী নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, নির্বাচনের পরে আলোচনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া এবং সর্বশেষ কোকো’র মৃত্যুর পরে শেখ হাসিনা দেখা করতে গেলেও দেখা না করা খালেদার বড় ধরনের ভুল হয়েছে।’
‘হাসিনা-খালেদা’র তুলনা নিজেরাই
এ দুই নেতার পারস্পরিক তুলনা বছরের পর বছর ধরেই চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরে দেশের সবচে’ জনপ্রিয় নেতা হিসেবে দুই নেত্রীকে ধরা হয়। তাই তাদের তুলনা সঙ্গতভাবেই এসে যায়। একজন পিতার ও অন্যজন স্বামীর আদর্শের অনুসারী দাবিতে রাজনীতি করলেও বর্তমান অবস্থানের পেছনে নিজেদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মিশেল রয়েছে, আর তা স্বীকার করবেন সমালোচকরাও।
দুই নেত্রীকে নিয়ে অব্যাহত এই তুলনারীতি পছন্দ করেন না শেখ হাসিনা। কারণ হিসেবে তার অনুসারীদের কেউ কেউ বলছেন, সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছেন এই মানুষটি। একই সঙ্গে চীন, মালয়েশিয়া, ভারতসহ কয়েকটি দেশের ইতিহাস ও বর্তমানে চোখ রেখেছেন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী। দেশের স্বার্থেই তার সব কার্যকলাপ।
তিনি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছেন বলেও অনেকের মন্তব্য। বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষে নিজের সংগঠন ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে অন্য অনেক দিকের ‘দুষ্টু’শঙ্কা নিয়ন্ত্রণ করছেন শেখ হাসিনা। কারও কারও পর্যবেক্ষণ, স্বজনপ্রীতির ধার ধারছেন না তিনি। ‘উন্নয়ন ও শান্তিময় পরিবেশ পেলে এদেশের মানুষ আর বিকল্প খুঁজবে না’- এমন বিশ্বাস থেকে প্রতিটি মুহূর্তে নিজেই সোচ্চার থেকে দেশ চালাচ্ছেন। এভাবেই ক্ষমতার সময় বাড়বে তার!
রাজনীতির নতুন মোড়
এভাবেই অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছে ও চলবে। অতীতের মতো এখনও সবাইকে সময়ের অপেক্ষাতেই থাকতে হচ্ছে। দেশের রাজনীতির মোড় কোনদিকে ঘুরছে- সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায় নিত্য-কষ্টভোগী জনগণ। এখনো বাংলার মানুষ স্বপ্ন দেখেন- নেতানেত্রীরা তাদের কষ্ট বুঝবেন, ভালো একটি সমাধানে আসবেন! (বাংলানিউজটেয়েন্টিফোর.কম)