নিউইয়র্ক ১০:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

যমুনায় পানি নেই : চারিদিকে শুধু ধু ধু বালুর চর

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৫৮:১০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৫
  • / ১৮৬৮ বার পঠিত

ঢাকা: ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কটের কবলে যমুনা নদী। চারিদিকে শুধু ধু ধু বালুর চর। বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল থেকে শুরু করে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত শুধু চর আর চর। শুষ্ক মৌসুমের এক মাস না যেতেই (১ জানুয়ারী থেকে ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম) যমুনার পানির সমতল (লেভেল) স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। নদীর পানি এভাবে কমে যাওয়ায় শঙ্কিত পানি বিশেষজ্ঞরা। আর পরিবেশবীদরা বলছেন, যমুনার বুকে যে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাতে ভয়াবহ মরুকরণের কবলে পড়বে বাংলাদেশ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় যেসব এলাকায় গত বছরও লোলিফট পাম্প ব্যবহার করে সেচ কাজ চালানো হতো; এই শুষ্ক মৌসুমে তাও সম্ভব হচ্ছে না। মাটির নিচের পানির স্তরও নেমে যাচ্ছে। এতে করে অগভীর নলকূপেও এখন ঠিকমত পানি উঠছে না। সেচের এই অসহায়ত্ব নিয়ে শঙ্কিত কৃষি মন্ত্রণালয়। উদ্বিগ্ন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও। এমন পরিস্থিতিতে ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কাটা সরকারের বুকে বিঁধছে দারুণভাবে। ইরি-বোরো মৌসুমে যমুনা নদী অববাহিকার মানুষ ক্ষেতে ঠিকমত পানি দিতে না পারার যে যন্ত্রনা-তা শুধু কৃষককেই ভোগাবে না; দেশে খাদ্য সঙ্কটও প্রকট করবে-এমনটা আঁচ করছে সরকারও। এই নদীর নাব্যতা রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাইলট ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে ১২শ’ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও তা এখনও সমীক্ষা পর্যায়েই রয়ে গেছে। কোনো সুফল মেলেনি। বরং টাঙ্গাইলের নলীনে আড়াই কিলোমিটার এবং সিরাজগঞ্জে ২০ কিলোমিটার নদী খনন নিয়ে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যমুনা নদীর নাব্যতা রক্ষায় উজান থেকে যেসব নদীর মাধ্যমে পানি আসে-তার সবগুলো পথ দিয়েই পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্রে ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যার বিরূপ প্রভাবে শুকিয়ে গেছে যমুনা নদী। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পানির লেভেল স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। জামালপুরে শুষ্ক মৌসুমে যমুনায় সর্বনি¤œ পানির রেকর্ড লেভেল মার্চে থাকে ১৩ দশমিক ৪ মিটার। আর এবার ১ ফেব্রুয়ারি পানির লেভেল সর্বনিম্ন রেকর্ডেরও নিচে নেমে গেছে। এব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার বলেন, যমুনা নদীর পানির লেভেল এভাবে কমতে থাকলে পদ্মা নদীর মত এই নদীর পানিতেও লবণাক্ততা দেখা দেবে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। একইসাথে মাটির নিচের পানির স্তরও নেমে যাবে আশঙ্কাজনকভাবে। তিনি বলেন, যমুনা নদীতে এবার যেভাবে চর জেগে উঠেছে এবং পানির লেভেল যে হারে নামছে, তাতে করে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে।
এদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম যমুনা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে চিত্র তুলে ধরেছে, বাস্তবতা তার চেয়েও করুণ। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর যেদিকেই দু’চোখ যায় শুধু ধু-ধু বালুচর। এই ভয়াবহ দুরবস্থার জন্য প্রকৃতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দায়ভার বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের। দেশটির পানি কূটনীতির কবলে পড়েই বাংলাদেশের জলবায়ুতে এই বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে শত শত নদী হারিয়ে গেছে। আর শুষ্ক মৌসুম এলেই অসংখ্য নদী মরা গাঙে পরিণত হচ্ছে। এডিবি ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পানি সঙ্কট সবচেয়ে ভয়াবহ। বাংলাদেশে পানি সঙ্কটের কারণে প্রায়ই বন্যা, খরা, জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও হ্রদের দূষণ, নগরায়ন এবং ভূ-উপরিস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। উপরন্তু ভারতের মতো দেশ জলবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ায় বাংলাদেশের পানি সঙ্কট তীব্র হয়েছে।
এছাড়াও ভারত শুষ্ক মৌসুমে উজানের পানি প্রত্যাহার করে নিতে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানি বাঁধ, মহুরি নদীর উপর কলসী বাঁধ, উমিয়াম ও ধালা নদীর উপর মাওপু ড্যাম এবং সারী ও গোয়াইন নদীর উপর মাইন্ডু ড্যাম নির্মাণ করেছে। মাওপু ও মাইন্ডু ড্যাম নিয়েও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবাদে বলা হয়েছে, মাওপু এবং মাইন্ডু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদী। এই নদীর উপর ড্যাম নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে কি ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। এটা নিরূপণ না হওয়া পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্য সরকারকে ড্যাম নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই আহ্বানে সারা দেয়নি ভারত।
যমুনা বিধৌত এলাকায় ভারতের পানি আগ্রাসন নীতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, নয়-দশ বছর ধরে যমুনা নদীর পানির স্তর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেরও অনেক নিচে নেমে গেছে। আগে শুষ্ক মৌসুমে ভূখ- থেকে ৩০ ফুট গভীরে পানির স্তর পাওয়া গেলেও বর্তমানে পানির স্তর নেমে গেছে ৬০/৬৫ ফুট গভীরে। সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে যমুনার শাখা নদী ও নালাগুলোতে।
টাঙ্গাইল
বর্ষা মৌসুমে যে যমুনা নদী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে কেড়ে নিয়েছে সবকিছু গৃহহারা করে দিয়েছে মানুষের বর্তমানে সেই যমুনার বুকে জেগে উঠেছে বিশাল চর। মাঝ নদীতে বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন ক্রমশই ঢুকে পড়ছে ভূঞাপুরের দিকে। যা যমুনার পুর্ব পাড়ের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অশনি সংকেত।
নদীর পানি শুকিয়ে চর জেগে ওঠায় এলাকার ৩ শতাধিক জেলের ভাগ্যে নেমে এসেছে দারিদ্র্যের খড়গ। যাদের মূল পেশাই ছিল নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা। নদীতে পানি না থাকায় মাছ আহরণ করতে পারছে না এসব জেলে। ফলে পরিবার নিয়ে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। সংসারের তাগিদে কেউ কেউ আবার বেছে নিয়েছে দিনমজুরের কাজ।
স্থানীয় জেলে সুভাষ হালদার বলেন, নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ ধরা পড়ছে না। যেখানে প্রতিদিন কয়েকজন জেলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মাছ ধরতো সেখানে হাজার টাকার মাছও মেলে না। এছাড়াও জেগে ওঠা চরের পূর্ব ও পশ্চিমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় নৌকা চলাচলে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। যমুনার দুই পাড় সিরাজগঞ্জ ও ভূঞাপুরের লোকজনের যাতায়াতের অন্যতম বাহন হচ্ছে নৌকা। লোকজনের বিশাল একটি অংশ তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য যাতায়াত করে থাকে এ নদী দিয়ে। নাব্যতা সংকটের কারণে যাতায়াতের পাশাপাশি বালুমহালের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। চর জেগে ওঠায় বালুবাহী নৌকাও তেমন ভিড়ছে না ঘাটে এসে।
জামালপুর
এক সময়ের গভীর যমুনার বুকে এখন খ- খ- অসংখ্য চরের সৃষ্টি হয়েছে। চাকুরিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা আজিজুল হক জানান, ভারতের যত্রতত্র বাঁধ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে যমুনা নদীতে বালু পড়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে নদীটি। ফলে বাহাদুরাবাদ-বালাসীর মধ্যে সকল প্রকার ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ছোট ছোট স্যালো মেশিন চালিত নৌকাযোগে একাধিক ঘাট থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ নদী পারাপার হচ্ছে।
জানা যায়, ’৯০-এর দশকের দিকে ফ্রান্স ও জার্মান সরকারের অর্থায়নে ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গুঠাইল বাজার ও কুলকান্দী টেস্ট-স্ট্রাকচার (হার্ডপয়েন্ট) দুটি নির্মাণ করা হয়। এতে কয়েক জেলার কৃষি পণ্যের একমাত্র হাট গুঠাইল বাজার, কুলকান্দী মাগন মিয়া বাজারসহ উপজেলা সদর ও শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যমুনার ভাঙন থেকে রক্ষা পেলেও দীর্ঘ প্রায় দুই যুগে কোন সংস্কার হয়নি। গত বন্যায় গুঠাইল হার্ডপয়েন্টের ২০০ মিটার ও কুলকান্দী হার্ডপয়েন্টের ১০০ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ২০১১ সালে যমুনার তীর সংরক্ষণ বাধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড সাড়ে ৪শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। বর্তমানে ১০০ কোটি টাকার বালুর বস্তা ও বোল্ডার ড্রাম্পিং কাজ চলছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিম্নমানের পাথর ও যমুনা থেকে উত্তোলন করা বালি দিয়ে নিম্নমানের বোল্ডার তৈরি করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ
এক সময়ের প্রমত্তা খরস্রোত যমুনা নদী এখন তার নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। শাখা নদী এখন মানুষ হেঁটে হেঁটেই পার হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই কচ্ছপের পীঠের মত অসংখ্য ছোট-বড় ডুবো চর জেগে উঠেছে। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় যমুনা নদীর জেলেরা বিপাকে পড়েছে। জেলে পরিবার কর্মশূন্য হওয়ায় বর্তমানে তাদের দুর্দিন চলছে। যমুনা শাখা নদীতে নৌকা না চলায় সংশ্লিষ্ট মাঝি মাল্লারা হা-পিতেশ করছে। সিরাজগঞ্জ জগন্নাথগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল, ভূয়াপুর, টাঙ্গাইল-বেলকুচি নৌপথে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও নৌরুট বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও অনেক পথ ঘুরে চর পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে নৌযান। সিরাজগঞ্জের যমুনার কাছে আভ্যন্তরীণ শাখা নদীগুলোর পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে নদীতে পানি স্বল্পতার অশনি সংকেত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
করালগ্রাসী রাক্ষুসী যমুনা নদীতে এখন মাইলের পর মাইল অসংখ্য চর ও ডুবোচর জেগেছে। নদীর অনেক স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেও এক ফোটা পানির দেখা মেলে না নদী অববাহিকায়। নদীতে দীর্ঘদিন খনন কাজ না করায় পলি মাটি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে অনেক শাখা নদী। এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়, কিছুদিন আগেও যমুনা নদী ছিল প্রমত্তা ও খরস্্েরাতা। এই নদীর বুক দিয়ে চলাচল করতো যাত্রীবাহী লঞ্চ, মালবাহী ট্রলার ও কার্গো। বর্তমানে উত্তরের পাবনার বেড়া খোলা থেকে দক্ষিনের কাউলিয়া পর্যন্ত ১৩৫ মাইল প্রবাহমান নদী নাব্যতা হারিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে মাল ও যাত্রীবাহী লঞ্চ, ট্রলার, কার্গো ও নৌকা চলাচল। বেশিরভাগ লোক হেটেই এখন যমুনা নদী পাড়ি দিচ্ছে।
পাউবোর বক্তব্য এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মহাপরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কট কাটাতে সরকার ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই কাজ শুরু হলে আশা করি যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কট কেটে যাবে। এছাড়াও সরকার তিস্তার নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছে। এই চুক্তি হলেও শুষ্ক মৌসুমে যমুনার পানি প্রবাহ অনেকটাই বাড়বে। (দৈনিক ইনকিলাব)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

যমুনায় পানি নেই : চারিদিকে শুধু ধু ধু বালুর চর

প্রকাশের সময় : ০৭:৫৮:১০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৫

ঢাকা: ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কটের কবলে যমুনা নদী। চারিদিকে শুধু ধু ধু বালুর চর। বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল থেকে শুরু করে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত শুধু চর আর চর। শুষ্ক মৌসুমের এক মাস না যেতেই (১ জানুয়ারী থেকে ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম) যমুনার পানির সমতল (লেভেল) স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। নদীর পানি এভাবে কমে যাওয়ায় শঙ্কিত পানি বিশেষজ্ঞরা। আর পরিবেশবীদরা বলছেন, যমুনার বুকে যে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাতে ভয়াবহ মরুকরণের কবলে পড়বে বাংলাদেশ। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় যেসব এলাকায় গত বছরও লোলিফট পাম্প ব্যবহার করে সেচ কাজ চালানো হতো; এই শুষ্ক মৌসুমে তাও সম্ভব হচ্ছে না। মাটির নিচের পানির স্তরও নেমে যাচ্ছে। এতে করে অগভীর নলকূপেও এখন ঠিকমত পানি উঠছে না। সেচের এই অসহায়ত্ব নিয়ে শঙ্কিত কৃষি মন্ত্রণালয়। উদ্বিগ্ন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও। এমন পরিস্থিতিতে ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কাটা সরকারের বুকে বিঁধছে দারুণভাবে। ইরি-বোরো মৌসুমে যমুনা নদী অববাহিকার মানুষ ক্ষেতে ঠিকমত পানি দিতে না পারার যে যন্ত্রনা-তা শুধু কৃষককেই ভোগাবে না; দেশে খাদ্য সঙ্কটও প্রকট করবে-এমনটা আঁচ করছে সরকারও। এই নদীর নাব্যতা রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাইলট ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে ১২শ’ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও তা এখনও সমীক্ষা পর্যায়েই রয়ে গেছে। কোনো সুফল মেলেনি। বরং টাঙ্গাইলের নলীনে আড়াই কিলোমিটার এবং সিরাজগঞ্জে ২০ কিলোমিটার নদী খনন নিয়ে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যমুনা নদীর নাব্যতা রক্ষায় উজান থেকে যেসব নদীর মাধ্যমে পানি আসে-তার সবগুলো পথ দিয়েই পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তা এবং ব্রহ্মপুত্রে ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যার বিরূপ প্রভাবে শুকিয়ে গেছে যমুনা নদী। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পানির লেভেল স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। জামালপুরে শুষ্ক মৌসুমে যমুনায় সর্বনি¤œ পানির রেকর্ড লেভেল মার্চে থাকে ১৩ দশমিক ৪ মিটার। আর এবার ১ ফেব্রুয়ারি পানির লেভেল সর্বনিম্ন রেকর্ডেরও নিচে নেমে গেছে। এব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার বলেন, যমুনা নদীর পানির লেভেল এভাবে কমতে থাকলে পদ্মা নদীর মত এই নদীর পানিতেও লবণাক্ততা দেখা দেবে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। একইসাথে মাটির নিচের পানির স্তরও নেমে যাবে আশঙ্কাজনকভাবে। তিনি বলেন, যমুনা নদীতে এবার যেভাবে চর জেগে উঠেছে এবং পানির লেভেল যে হারে নামছে, তাতে করে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেবে।
এদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম যমুনা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যে চিত্র তুলে ধরেছে, বাস্তবতা তার চেয়েও করুণ। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর যেদিকেই দু’চোখ যায় শুধু ধু-ধু বালুচর। এই ভয়াবহ দুরবস্থার জন্য প্রকৃতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দায়ভার বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের। দেশটির পানি কূটনীতির কবলে পড়েই বাংলাদেশের জলবায়ুতে এই বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে শত শত নদী হারিয়ে গেছে। আর শুষ্ক মৌসুম এলেই অসংখ্য নদী মরা গাঙে পরিণত হচ্ছে। এডিবি ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পানি সঙ্কট সবচেয়ে ভয়াবহ। বাংলাদেশে পানি সঙ্কটের কারণে প্রায়ই বন্যা, খরা, জলবায়ু পরিবর্তন, নদী ও হ্রদের দূষণ, নগরায়ন এবং ভূ-উপরিস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। উপরন্তু ভারতের মতো দেশ জলবিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ায় বাংলাদেশের পানি সঙ্কট তীব্র হয়েছে।
এছাড়াও ভারত শুষ্ক মৌসুমে উজানের পানি প্রত্যাহার করে নিতে স্থায়ীভাবে গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানি বাঁধ, মহুরি নদীর উপর কলসী বাঁধ, উমিয়াম ও ধালা নদীর উপর মাওপু ড্যাম এবং সারী ও গোয়াইন নদীর উপর মাইন্ডু ড্যাম নির্মাণ করেছে। মাওপু ও মাইন্ডু ড্যাম নিয়েও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবাদে বলা হয়েছে, মাওপু এবং মাইন্ডু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন নদী। এই নদীর উপর ড্যাম নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে কি ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। এটা নিরূপণ না হওয়া পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্য সরকারকে ড্যাম নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই আহ্বানে সারা দেয়নি ভারত।
যমুনা বিধৌত এলাকায় ভারতের পানি আগ্রাসন নীতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, নয়-দশ বছর ধরে যমুনা নদীর পানির স্তর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেরও অনেক নিচে নেমে গেছে। আগে শুষ্ক মৌসুমে ভূখ- থেকে ৩০ ফুট গভীরে পানির স্তর পাওয়া গেলেও বর্তমানে পানির স্তর নেমে গেছে ৬০/৬৫ ফুট গভীরে। সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে যমুনার শাখা নদী ও নালাগুলোতে।
টাঙ্গাইল
বর্ষা মৌসুমে যে যমুনা নদী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে কেড়ে নিয়েছে সবকিছু গৃহহারা করে দিয়েছে মানুষের বর্তমানে সেই যমুনার বুকে জেগে উঠেছে বিশাল চর। মাঝ নদীতে বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন ক্রমশই ঢুকে পড়ছে ভূঞাপুরের দিকে। যা যমুনার পুর্ব পাড়ের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অশনি সংকেত।
নদীর পানি শুকিয়ে চর জেগে ওঠায় এলাকার ৩ শতাধিক জেলের ভাগ্যে নেমে এসেছে দারিদ্র্যের খড়গ। যাদের মূল পেশাই ছিল নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা। নদীতে পানি না থাকায় মাছ আহরণ করতে পারছে না এসব জেলে। ফলে পরিবার নিয়ে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। সংসারের তাগিদে কেউ কেউ আবার বেছে নিয়েছে দিনমজুরের কাজ।
স্থানীয় জেলে সুভাষ হালদার বলেন, নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ ধরা পড়ছে না। যেখানে প্রতিদিন কয়েকজন জেলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মাছ ধরতো সেখানে হাজার টাকার মাছও মেলে না। এছাড়াও জেগে ওঠা চরের পূর্ব ও পশ্চিমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় নৌকা চলাচলে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। যমুনার দুই পাড় সিরাজগঞ্জ ও ভূঞাপুরের লোকজনের যাতায়াতের অন্যতম বাহন হচ্ছে নৌকা। লোকজনের বিশাল একটি অংশ তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য যাতায়াত করে থাকে এ নদী দিয়ে। নাব্যতা সংকটের কারণে যাতায়াতের পাশাপাশি বালুমহালের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। চর জেগে ওঠায় বালুবাহী নৌকাও তেমন ভিড়ছে না ঘাটে এসে।
জামালপুর
এক সময়ের গভীর যমুনার বুকে এখন খ- খ- অসংখ্য চরের সৃষ্টি হয়েছে। চাকুরিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা আজিজুল হক জানান, ভারতের যত্রতত্র বাঁধ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে যমুনা নদীতে বালু পড়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে নদীটি। ফলে বাহাদুরাবাদ-বালাসীর মধ্যে সকল প্রকার ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ছোট ছোট স্যালো মেশিন চালিত নৌকাযোগে একাধিক ঘাট থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ নদী পারাপার হচ্ছে।
জানা যায়, ’৯০-এর দশকের দিকে ফ্রান্স ও জার্মান সরকারের অর্থায়নে ৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গুঠাইল বাজার ও কুলকান্দী টেস্ট-স্ট্রাকচার (হার্ডপয়েন্ট) দুটি নির্মাণ করা হয়। এতে কয়েক জেলার কৃষি পণ্যের একমাত্র হাট গুঠাইল বাজার, কুলকান্দী মাগন মিয়া বাজারসহ উপজেলা সদর ও শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যমুনার ভাঙন থেকে রক্ষা পেলেও দীর্ঘ প্রায় দুই যুগে কোন সংস্কার হয়নি। গত বন্যায় গুঠাইল হার্ডপয়েন্টের ২০০ মিটার ও কুলকান্দী হার্ডপয়েন্টের ১০০ মিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ২০১১ সালে যমুনার তীর সংরক্ষণ বাধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড সাড়ে ৪শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। বর্তমানে ১০০ কোটি টাকার বালুর বস্তা ও বোল্ডার ড্রাম্পিং কাজ চলছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিম্নমানের পাথর ও যমুনা থেকে উত্তোলন করা বালি দিয়ে নিম্নমানের বোল্ডার তৈরি করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ
এক সময়ের প্রমত্তা খরস্রোত যমুনা নদী এখন তার নাব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। শাখা নদী এখন মানুষ হেঁটে হেঁটেই পার হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই কচ্ছপের পীঠের মত অসংখ্য ছোট-বড় ডুবো চর জেগে উঠেছে। পানিশূন্য হয়ে পড়ায় যমুনা নদীর জেলেরা বিপাকে পড়েছে। জেলে পরিবার কর্মশূন্য হওয়ায় বর্তমানে তাদের দুর্দিন চলছে। যমুনা শাখা নদীতে নৌকা না চলায় সংশ্লিষ্ট মাঝি মাল্লারা হা-পিতেশ করছে। সিরাজগঞ্জ জগন্নাথগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল, ভূয়াপুর, টাঙ্গাইল-বেলকুচি নৌপথে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও কোথাও নৌরুট বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও অনেক পথ ঘুরে চর পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে নৌযান। সিরাজগঞ্জের যমুনার কাছে আভ্যন্তরীণ শাখা নদীগুলোর পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে নদীতে পানি স্বল্পতার অশনি সংকেত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
করালগ্রাসী রাক্ষুসী যমুনা নদীতে এখন মাইলের পর মাইল অসংখ্য চর ও ডুবোচর জেগেছে। নদীর অনেক স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেও এক ফোটা পানির দেখা মেলে না নদী অববাহিকায়। নদীতে দীর্ঘদিন খনন কাজ না করায় পলি মাটি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে অনেক শাখা নদী। এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়, কিছুদিন আগেও যমুনা নদী ছিল প্রমত্তা ও খরস্্েরাতা। এই নদীর বুক দিয়ে চলাচল করতো যাত্রীবাহী লঞ্চ, মালবাহী ট্রলার ও কার্গো। বর্তমানে উত্তরের পাবনার বেড়া খোলা থেকে দক্ষিনের কাউলিয়া পর্যন্ত ১৩৫ মাইল প্রবাহমান নদী নাব্যতা হারিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে মাল ও যাত্রীবাহী লঞ্চ, ট্রলার, কার্গো ও নৌকা চলাচল। বেশিরভাগ লোক হেটেই এখন যমুনা নদী পাড়ি দিচ্ছে।
পাউবোর বক্তব্য এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মহাপরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কট কাটাতে সরকার ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই কাজ শুরু হলে আশা করি যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কট কেটে যাবে। এছাড়াও সরকার তিস্তার নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছে। এই চুক্তি হলেও শুষ্ক মৌসুমে যমুনার পানি প্রবাহ অনেকটাই বাড়বে। (দৈনিক ইনকিলাব)