বিএনপি নেতা পিন্টুর দীর্ঘ কারাবাস …অত:পর মৃত্যু : চিকিৎসায় অবহেলা ও হত্যার অভিযোগ : খালেদার শোক
- প্রকাশের সময় : ১২:১৬:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ মে ২০১৫
- / ১৯৯৭ বার পঠিত
ঢাকা: ২০০৯ সালে গ্রেফতার হবার পর আর মুক্তি মেলেনি। টানা সাত বছর কারাগারে থেকেই আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রাক্তন সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন পিন্টু। মৃত্যুর সময় আদরের সন্তান, মা আত্মীয় স্বজন কিংবা স্ত্রীর মুখটা দেখারও সৌভাগ্য হয়নি সাবেক এই এমপির। রবিবার (৩ মে) রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যুর খবর শোনার পর পরিবারসহ বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। পিন্টুর মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এদিকে পিন্টুর পরিবার দাবি করেছেন চিকিৎসাজনিত অবহেলার কারনেই মারা গেছেন পিন্টু। তার স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা অভিযোগ করেছেন, ‘আমার স্বামী মারা যাননি, সরকার পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসায় অবহেলা করে তাকে হত্যা করেছে’। পিন্টুর ভাই রিন্টু দাবি করেন, অসুস্থ্যতার কারনে পিন্টুকে কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে না নেয়ার ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিলো। কিন্তু এ নির্দেশনা মানা হয়নি। অবহেলার কারনেই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। কান্না জড়িত কণ্ঠে রিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, একজন ফাঁসির আসামীরও সুযোগ হয় স্ত্রী সন্তানদের সাথে সাক্ষাত করার। আমাদের দুর্ভাগ্য ঢাকার বাইরের কারাগারে নেয়ার কারনে শেষ সময়ে তার সাথে সাক্ষাত বা কথা বলার সে সুযোগ ছিলো না।
পিন্টুর মৃত্যুর জন্য শেখ হাসিনা দায়ী-খালেদা জিয়া: নাসির উদ্দিন পিন্টুর মৃত্যুতে খালেদা জিয়া গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, পিন্টুকে হত্যা করো হয়েছে, এর বিচার করতে হবে। আদালত পিন্টুকে শেখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা না করে তাকে রাজশাহী কারাগারে স্থানান্তর করে। কেনো কোর্টের আদেশ মানা হলো না। কোর্টের আদেশ অমান্য করে কেন পিন্টুকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হলো। এ হত্যার জন্য শেখ হাসিনাকেও ছাড় দেয়া হবে না।
দৈনিক যুগান্তরের খবরে বলা হয়েছে: ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ কয়েকশ জোয়ান নিহত হয়। বিডিআর হত্যা মামলায় আসামী করা হয় বিএনপি নেতা নাসির উদ্দীন পিন্টু ও আ’লীগ নেতা তোরাব আলীকে। অভিযোগে একই বছরের পহেলা জুন তোরাব আলী ও নাসির উদ্দীন পিন্টু গ্রেফতার হন। ২ জুন আদালতের মাধ্যমে পিন্টু বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় কারাগারে যান।
দীর্ঘ দিন শুনানীর পর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পিলখানা হত্যা মামলায় নাসির উদ্দীন আহমেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। কারাগারে আটক থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসা একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, পিলখানা হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার রায়ের পর অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে পড়েন পিন্টু। প্রায় সময়ই আনমনা হয়ে কি যেন ভাবতেন। আবার কখনো কখনো তার মধ্যে ক্ষুব্ধ আচরণও লক্ষ্য করা গেছে। রোজার মাসে নিয়মিত রোজা ও নামাজ আদায়সহ কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অধিকাংশ সময় পার করতে দেখা গেছে পিন্টুকে।
দীর্ঘদিন কারাবাসের কারণে আচার-আচরণে অনেকটা নরম ভাব লক্ষ্য করা গেলেও একদিন এক কারারক্ষীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে ওই কারারক্ষীকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর প্রিজন সেলে বেশ কড়াকড়ি আরোপও করা হয়।
কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার জানান, মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রিজন সেলে নাসির উদ্দীন পিন্টুর দিগম্বর হওয়ার ঘটনা ঘটে।
প্রিজন সেলে বন্দি থাকা অবস্থায় নাসির উদ্দিন পিন্টু গোপনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেছেন এমন অভিযোগে কারারক্ষীরা তার কাছে মোবাইলের খোঁজ করতে গেলে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি সবার সামনে দিগম্বর হয়ে বলেন, ‘দেখ কোথায় আছে মোবাইল, খুঁজে নে।
দীর্ঘ কারা জীবনের কারনে শরীরে রোগ বাসা বাধায় পিন্টুকে বঙ্গবন্ধু প্রিজন সেলে থাকতে হয়। ডাক্তারদের পরামর্শ মতো খাবারের তালিকায় ভাত, মাছ, সবজি, ডাল, গোশত, ডিম থাকত। রোজার সময় ছোলা, পেয়াজু, খেজুর ও মুড়ি দিয়ে ইফতার করেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী জানান, আদালতের রায়ের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নারায়নগঞ্জ কারাগারে প্রেরণ করা হয়। এরপর সেখান থেকে কাশিমপুর কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পিন্টুকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে রাজশাহী সেন্ট্রাল কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
রাজশাহী কারাগারের ডেপুটি জেলার মিজানুর রহমান জানান, নাসির উদ্দিন পিন্টু দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। এর মধ্যে বুকে ব্যাথা, হার্টের রোগসহ নানা রোগে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কয়েকদিন আগে হাসপাতাল থেকে কারাগারে নেওয়া হয়। রোববার ভোরে তার বুকে ব্যথা অনুভূত হলে সকাল ১০টার দিকে আবারো হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর বেলা সোয়া ১২টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক পিন্টুকে মৃত ঘোষণা করেন।
কারা জীবন থেকে মুক্তি না পাওয়ায় জীবনের শেষ ইচ্ছাটিও পূরণ হলো না নাসির উদ্দিন পিন্টুর। সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করে। এজন্যএ বেশী হতাশ হয়ে পড়েন তিনি।
পিন্টুকে হত্যা করা হয়েছে-পরিবার: বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা অভিযোগ করেছেন, আমার স্বামী মারা যাননি, সরকার পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসায় অবহেলা করে তাকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন,পিন্টুকে মারার জন্য ঢাকা থেকে রাজশাহী নেয়া হয়েছে। তিনি জনপ্রিয় নেতা। তার জনপ্রিয়তা দেখে সরকার সিটি নির্বাচনের আগে রাজশাহী নিয়ে হত্যা করেছে। তিনি মারা যাননি। রবিবার দুপুরে পিন্টুর লালবাগের বাসায় সাংবাদিকদের কাছে এমন অভিযোগ করেন নাসিমা আক্তার কল্পনা।
পিন্টুর স্ত্রীর দাবি, হাইকোর্টের একটি আদেশ ছিল তাকে (পিন্টু) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেলে রেখে চিকিৎসা করানোর। আমরা আইজি প্রিজনকে এই আদেশ দিলেও তা রাখেননি। অনুরোধ সত্বেও পিন্টুকে ঢাকা থেকে রাজশাহী নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে পিন্টুর স্ত্রী যারা এই ঘটনায় জড়িত তাদের বিাংদ্ধে হত্যা মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এদিকে পিন্টুর মৃত্যুর খবর শুনে তার সহকর্মী, সমর্থকরা পিন্টুর লালবাগের বাসায় ছুটে যান। দুপুরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, দলের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা তার লালবাগের বাসায় যান। তারা পিন্টুর স্ত্রী সন্তানদের সমবেদনা জানান।
পিন্টুর মৃত্যুর জন্য কারা কর্তৃপক্ষ দায়ী-বিএনপি: কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। রোববার বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন এ অভিযোগ করেন।
আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, পিন্টুর চিকিৎসায় আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি। পিন্টুর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলেও তাকে হাসপাতালে না নিয়ে বার বার কারাগার পরিবর্তন করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশনা ছিলো ঢাকার দু’টি বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার। আদালতের নির্দেশ অমান্য করে পিন্টুকে নারায়ণগঞ্জ, পরে রাজশাহী কারাগারে নেওয়া হয়েছে। এটাকে সহজভাবে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, এরআগে পিন্টুর আইনজীবী আদালতকে জানিয়েছিলেন তার শারীরীক সমস্যার কথা। ওই প্রেক্ষিতে আদালত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পিন্টুর চিকিৎসার নির্দেশ দেন। কিন্ত কারা কর্তৃপক্ষ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে তাকে রাজশাহী কারাগারে স্থনান্তর করে।
ড. রিপন আরো বলেন, পিন্টু রাজশাহী কারা হাসপাতালে ছিলেন। কারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেছিলেন। কিন্তু সেটা করা হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করেছেন। কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই পিন্টুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।