নিউইয়র্ক ০৭:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

নিজামীর ফাঁসি বহাল

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:৫৬:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ জানুয়ারী ২০১৬
  • / ৯৭৬ বার পঠিত

ঢাকা: বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানের অভিযোগসহ পৃথক তিনটি অপরাধে একাত্তরে আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ বুধবার (৬ জানুয়ারী) এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হচ্ছেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। সকাল ৯টা ৫ মিনিটে বিচারপতিরা বেঞ্চে বসার পর মাত্র এক মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে নিজামীকে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয় এবং ২, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তার সাজা বহাল রাখা হয়।
এর আগে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জামায়াতে ইসলামীর এ আমীরকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ডের রায় দেন। ওই রায়ে নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। আর ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। প্রসিকিউশনের আনা মোট ১৬ অভিযোগের মধ্যে বাকি ৮টি প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলো থেকে তাকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৩ নভেম্বর সুপ্রিমকোটের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক এ মর্ন্ত্রী। আপিলে ৭৩ বছর বয়সী নিজামীর খালাস চাওয়া হয়। গতবছরের ৯ সেপ্টেম্বর আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ৮ ডিসেম্বর ওই আপিলের ওপর আসামিপক্ষ ও সরকারপক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে আপিল বিভাগ ৬ জানুয়ারী রায়ের দিন ধার্য করেন।
বুধবার রায় ঘোষণার পর নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী যারা মূল হোতা তাদের ছেড়ে দিয়ে নিজামীর বিচার করা হয়েছে। তাদের সহযোগী হিসেবে নিজামীর মৃত্যুদন্ড হতে পারে না। অপরদিকে নিজামীর চরম দন্ড হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রায়ে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এছাড়া আপিলে নিজামীর ফাঁসির দন্ড বহাল থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি ষষ্ঠ মামলা, যার ওপর আপিল আদালতের চূড়ান্ত রায় হল। এর আগে পাঁচটি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল।
যেসব অভিযোগে ফাঁসি বহাল: আপিল বিভাগ নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ২ নম্বর অভিযোগে ফাঁসি বহাল রেখেছেন। এ অভিযোগে বলা হয়- একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানী সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করে।
৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
ফাঁসি বহাল থাকা ৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে ধুলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আউয়ালের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে, এমন খবর আসে নিজামীর কাছে। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজামীসহ একদল পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা গ্রামের পথে নেমে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি ওই বাড়ি ঘেরাও করার নির্দেশ দেন। এ সময় ওই বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩০ জনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে ইছামতি নদীর পাড়ে নেয়া হয়। সেখানে দাঁড় করিয়ে উপর্যুপরি বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। নির্মমভাবে হত্যার পর একই এলাকায় ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগও ঘটানো হয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা তল্লাশির নামে কয়েকটি বাড়ি ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ করে তাদের হত্যা করা হয়। ফাঁসি বহাল থাকা ১৬ নম্বর অভিযোগটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা সংক্রান্ত। এতে বলা হয়, জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। সে সময় ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। এটি জামায়াতে ইসলামীর প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে গঠিত হয়। এ সংগঠনের প্রধান ছিলেন নিজামী। বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য শান্তি কমিটির ও ছাত্রসংঘের সদস্য ছিলেন। এরা পরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদরের প্রধান হিসেবে দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে নিজামী জড়িত ছিলেন।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত নিজামী চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত।
যাবজ্জীবন বহাল: বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এ দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
যেসব অভিযোগে খালাস: নিজামীর বিরুদ্ধে আনা চার নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ ওই অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দিয়েছেন। এ অভিযোগে বলা হয়েছিল, একাত্তরের ৮ মে ভোরে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমচা গ্রামে নিজামীর নির্দেশে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে হামলা চালায় রাজাকার আলবদর বাহিনী। ঠাকুরবাড়ি ও পাশের বাড়ির লোকজনকে ধরে এনে সেখানকার এক মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। এছাড়া তারই নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় রাজাকার বাহিনী একই গ্রামের হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করে। পাশাপাশি নিজামীর নির্দেশে ওই এলাকার বাসিন্দা আজগর মিয়ার স্ত্রীকে ধর্ষণ ও আহেদ প্রামাণিকের বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া শিবানী ও পাশের গ্রামের হালদারের বোনকেও ধর্ষণ করা হয়। আর মেঘা ঠাকুরের ঘরের সব মালামাল লুট করে নিয়ে যায় রাজাকাররা। এ গ্রামে তারা অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে এক নম্বর অভিযোগটি ছিল পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা সংক্রান্ত। আর তিন নম্বর অভিযোগটি ছিল ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে পাকিস্তানী সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্রের। এ দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। দুটি অভিযোগ থেকেই আপিল বিভাগ নিজামীকে খালাস দিয়েছেন। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগ এবং ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলোতে ট্রাইব্যুনাল থেকেই খালাস পান তিনি।
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করার পর ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর ২০১৩ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে জামায়াত আমীরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খানসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।
নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছেলে মোহাম্মদ নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

নিজামীর ফাঁসি বহাল

প্রকাশের সময় : ১১:৫৬:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৬ জানুয়ারী ২০১৬

ঢাকা: বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানের অভিযোগসহ পৃথক তিনটি অপরাধে একাত্তরে আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ বুধবার (৬ জানুয়ারী) এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হচ্ছেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। সকাল ৯টা ৫ মিনিটে বিচারপতিরা বেঞ্চে বসার পর মাত্র এক মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ে নিজামীকে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয় এবং ২, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তার সাজা বহাল রাখা হয়।
এর আগে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ জামায়াতে ইসলামীর এ আমীরকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ডের রায় দেন। ওই রায়ে নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। আর ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। প্রসিকিউশনের আনা মোট ১৬ অভিযোগের মধ্যে বাকি ৮টি প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলো থেকে তাকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৩ নভেম্বর সুপ্রিমকোটের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক এ মর্ন্ত্রী। আপিলে ৭৩ বছর বয়সী নিজামীর খালাস চাওয়া হয়। গতবছরের ৯ সেপ্টেম্বর আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ৮ ডিসেম্বর ওই আপিলের ওপর আসামিপক্ষ ও সরকারপক্ষের শুনানি গ্রহণ শেষে আপিল বিভাগ ৬ জানুয়ারী রায়ের দিন ধার্য করেন।
বুধবার রায় ঘোষণার পর নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী যারা মূল হোতা তাদের ছেড়ে দিয়ে নিজামীর বিচার করা হয়েছে। তাদের সহযোগী হিসেবে নিজামীর মৃত্যুদন্ড হতে পারে না। অপরদিকে নিজামীর চরম দন্ড হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, রায়ে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এছাড়া আপিলে নিজামীর ফাঁসির দন্ড বহাল থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি ষষ্ঠ মামলা, যার ওপর আপিল আদালতের চূড়ান্ত রায় হল। এর আগে পাঁচটি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল।
যেসব অভিযোগে ফাঁসি বহাল: আপিল বিভাগ নিজামীর বিরুদ্ধে আনা ২ নম্বর অভিযোগে ফাঁসি বহাল রেখেছেন। এ অভিযোগে বলা হয়- একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী বলেন, শিগগিরই পাকিস্তানী সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে। ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে ১৪ মে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করে।
৩০-৪০ জন নারীকে সেদিন ধর্ষণ করে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।
ফাঁসি বহাল থাকা ৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে ধুলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আউয়ালের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে, এমন খবর আসে নিজামীর কাছে। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজামীসহ একদল পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা গ্রামের পথে নেমে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি ওই বাড়ি ঘেরাও করার নির্দেশ দেন। এ সময় ওই বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাসহ ৩০ জনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করে ইছামতি নদীর পাড়ে নেয়া হয়। সেখানে দাঁড় করিয়ে উপর্যুপরি বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। নির্মমভাবে হত্যার পর একই এলাকায় ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগও ঘটানো হয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা তল্লাশির নামে কয়েকটি বাড়ি ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ করে তাদের হত্যা করা হয়। ফাঁসি বহাল থাকা ১৬ নম্বর অভিযোগটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা সংক্রান্ত। এতে বলা হয়, জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। সে সময় ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। এটি জামায়াতে ইসলামীর প্রাইভেট বাহিনী হিসেবে গঠিত হয়। এ সংগঠনের প্রধান ছিলেন নিজামী। বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্য শান্তি কমিটির ও ছাত্রসংঘের সদস্য ছিলেন। এরা পরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদরের প্রধান হিসেবে দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে নিজামী জড়িত ছিলেন।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত নিজামী চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত।
যাবজ্জীবন বহাল: বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এ দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
যেসব অভিযোগে খালাস: নিজামীর বিরুদ্ধে আনা চার নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ ওই অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দিয়েছেন। এ অভিযোগে বলা হয়েছিল, একাত্তরের ৮ মে ভোরে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার করমচা গ্রামে নিজামীর নির্দেশে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে হামলা চালায় রাজাকার আলবদর বাহিনী। ঠাকুরবাড়ি ও পাশের বাড়ির লোকজনকে ধরে এনে সেখানকার এক মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়। এছাড়া তারই নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় রাজাকার বাহিনী একই গ্রামের হাবিবুর রহমান নামে একজনকে হত্যা করে। পাশাপাশি নিজামীর নির্দেশে ওই এলাকার বাসিন্দা আজগর মিয়ার স্ত্রীকে ধর্ষণ ও আহেদ প্রামাণিকের বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া শিবানী ও পাশের গ্রামের হালদারের বোনকেও ধর্ষণ করা হয়। আর মেঘা ঠাকুরের ঘরের সব মালামাল লুট করে নিয়ে যায় রাজাকাররা। এ গ্রামে তারা অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে এক নম্বর অভিযোগটি ছিল পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন হত্যা সংক্রান্ত। আর তিন নম্বর অভিযোগটি ছিল ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে পাকিস্তানী সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্রের। এ দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। দুটি অভিযোগ থেকেই আপিল বিভাগ নিজামীকে খালাস দিয়েছেন। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগ এবং ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সেগুলোতে ট্রাইব্যুনাল থেকেই খালাস পান তিনি।
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করার পর ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর ২০১৩ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে জামায়াত আমীরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খানসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।
নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছেলে মোহাম্মদ নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন। (দৈনিক যুগান্তর)