নিউইয়র্ক ১১:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:৪৫:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ এপ্রিল ২০১৫
  • / ৭২৮ বার পঠিত

ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড অবশেষে কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হলো।
নিয়ম অনুসারে ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন কারা প্রশাসনের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্ণেল মোহাম্মদ ফজলুল কবীর, উপ-কারা মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার, জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী, কারাধ্যক্ষ নেচার আলম, ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিঞা, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক, কারা চিকিৎসক আহসান হাবিব প্রমুখ।
জানা গেছে, দন্ড কার্যকর করতে প্রধান জল্লাদ ছিলেন রানা। তার সঙ্গে ছিলেন জল্লাদ ফল্টু, রাজু ও শামছুসহ আরেকজন। এর আগে রাত ৯টার পর কামারুজ্জামানকে তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন।
রাত ৯ টার দিকে মাওলানা মনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার কনডেম সেলে যান। ওই সময় একজন ডিআইজি উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে জানিয়ে দেন যে, এটাই আপনার শেষ রাত। এই রাতেই আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে। এর আগেই কামারুজ্জামান ওজু ও খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন। এরপর তিনি এশার নামাজ আদায়ের পর নফল নামাজ আদায় করেন।
কারা মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন তাকে প্রথমে বলেন, আপনার কৃত কর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। কিন্তু আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃত কর্মের জন্য তওবা করেন।
এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট দশেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন।
এর আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক আহসান হাবীব।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি শনিবার রাতে কার্যকরের কারণে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশ এলাকাতে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। এর আগে বিকেলে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। প্রায় এক ঘণ্টা সাক্ষাৎ শেষে শনিবার বিকাল ৫টা ২৫ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান তারা। এসময় কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ ভি চিহ্ন দেখান। আবার কারো চোখে পানিও দেখা যায়।
শনিবার বেলা ৪টা ১০ মিনিটে কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার, ভাই কামরুল ইসলাম, শ্যালক রুম্মান, ছেলে হাসান ইমাম ও হাসান ইকবাল, মেয়ে আতিয়া নূরসহ ২৪ জন সদস্য কারাগারে পৌঁছান। কামারুজ্জামানের ছোট দুই ছেলে হাসান ইকরাম এবং হাসান জামান বিদেশে থাকায় তারা দেখা করতে আসেননি।
শনিবার দুপুরে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পরিবারের কাছে পাঠানো হয় বলে জানান কামারুজ্জামানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। তিনি জানান, চিঠিতে বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তাদের দেখা করতে বলা হয়েছে।
এর আগে কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করতে শুক্রবার বিকালেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার সন্ধ্যার কিছু আগে ফাঁসি কার্যকরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। পাশাপাশি সন্ধ্যায় কারাগার ঘিরে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়। ফাঁসি কার্যকর হতে যাচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়াও এ খবর প্রচার করে। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা অব্যাহত থাকে এ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। রাত ৯টার কিছু পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। হঠাৎ করেই কারাগারের ভেতরে যাওয়া কর্মকর্তারা বের হয়ে আসেন। আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ফাঁসি নিয়ে নানা গুঞ্জনের।
ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়: রাজধানীর পল্লবী থানায় করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ তার বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেন।
২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত উল্লেখ করে এ রায় দেয়া হয়। এর মধ্যে দুটিতে মৃত্যুদন্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন।
আপিলের শুনানি শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল রাখেন। বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
আপিল বিভাগের রায়ে কামারুজ্জামানকে এক নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আনা একাত্তরে বদিউজ্জামানকে হত্যার ঘটনা সংবলিত এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন দন্ড দিয়েছিলেন। ২ নম্বর অভিযোগ যথা- শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় তাকে ১০ বছর কারাদন্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এই সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগ বহাল রাখেন।
তার বিরুদ্ধে তিন নম্বর অভিযোগটি ছিল সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে গণহত্যা ও ধর্ষণের। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১৪৪ জন ব্যক্তিকে হত্যা এবং বহু নারীকে ধর্ষণের দায়ে একাত্তরে ময়মনসিংহের আলবদর নেতা কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত।
এ অভিযোগে তার মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার ব্যাপারে বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী একমত পোষণ করেন। আর বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদানের পক্ষে রায় দিয়েছেন।
চতুর্থ অভিযোগ গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের সাজা কমিয়ে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন করেন। সপ্তম অভিযোগে দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের আনা পাঁচ ও ছয় নম্বর অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালই তাকে খালাস দেন।
রিভিউ দায়ের ও শুনানি : ১৮ ফেব্রুয়ারী আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পরদিন ট্রাইব্যুনাল-২ তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠালে সেখানে কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ৫ মার্চ আবেদন করেন কামারুজ্জামান। ৫ এপ্রিল এ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। সকাল ৯টা ৫ মিনিটে আপিল বিভাগের চার বিচারপতি এজলাসে আসার পর প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা শুধু ‘ডিসমিসড’ (খারিজ) শব্দটি উচ্চারণ করেন।
রিভিউ আবেদন খারিজের মধ্য দিয়ে বিচারের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর রিভিউ খারিজের রায়ের কপি ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছায়। পরে ওই দিনেই রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদন্ড বহালের রায় তাকে পড়ে শোনান কারা কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা জানতে চান। কিন্তু কামারুজ্জামান পরের দিন আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা জানান। ৯ এপ্রিল ৫ জন আইনজীবী তার সঙ্গে দেখা করেন।
তিন মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি: কামারুজ্জামানের মামলার বিচারের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে তিনটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল। এর আগে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দিলেও আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ডের আদেশ দেন। এছাড়া দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদন্ড দেন যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর কার্যকর হয়। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর

প্রকাশের সময় : ১১:৪৫:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ এপ্রিল ২০১৫

ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ড অবশেষে কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হলো।
নিয়ম অনুসারে ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন কারা প্রশাসনের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্ণেল মোহাম্মদ ফজলুল কবীর, উপ-কারা মহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার, জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী, কারাধ্যক্ষ নেচার আলম, ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিঞা, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম, ঢাকার সিভিল সার্জন আবদুল মালেক, কারা চিকিৎসক আহসান হাবিব প্রমুখ।
জানা গেছে, দন্ড কার্যকর করতে প্রধান জল্লাদ ছিলেন রানা। তার সঙ্গে ছিলেন জল্লাদ ফল্টু, রাজু ও শামছুসহ আরেকজন। এর আগে রাত ৯টার পর কামারুজ্জামানকে তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন।
রাত ৯ টার দিকে মাওলানা মনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার কনডেম সেলে যান। ওই সময় একজন ডিআইজি উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে জানিয়ে দেন যে, এটাই আপনার শেষ রাত। এই রাতেই আপনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাকে তওবা পড়তে হবে। এর আগেই কামারুজ্জামান ওজু ও খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন। এরপর তিনি এশার নামাজ আদায়ের পর নফল নামাজ আদায় করেন।
কারা মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন তাকে প্রথমে বলেন, আপনার কৃত কর্মের জন্য আদালত আপনাকে ফাঁসির রায় দিয়েছেন। কিন্তু আপনি একজন মুসলমান ব্যক্তি। এ কারণে আপনি আল্লাহ’র এই দুনিয়ায় কৃত কর্মের জন্য তওবা করেন।
এরপর ইমাম সাহেব তাকে তওবা পড়ান। তওবা পড়ার মিনিট দশেক পর কনডেম সেলে জল্লাদরা আসেন।
এর আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করেন কারা চিকিৎসক আহসান হাবীব।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি শনিবার রাতে কার্যকরের কারণে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশ এলাকাতে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। এর আগে বিকেলে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। প্রায় এক ঘণ্টা সাক্ষাৎ শেষে শনিবার বিকাল ৫টা ২৫ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে যান তারা। এসময় কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ ভি চিহ্ন দেখান। আবার কারো চোখে পানিও দেখা যায়।
শনিবার বেলা ৪টা ১০ মিনিটে কামারুজ্জামানের স্ত্রী নুরুন্নাহার, ভাই কামরুল ইসলাম, শ্যালক রুম্মান, ছেলে হাসান ইমাম ও হাসান ইকবাল, মেয়ে আতিয়া নূরসহ ২৪ জন সদস্য কারাগারে পৌঁছান। কামারুজ্জামানের ছোট দুই ছেলে হাসান ইকরাম এবং হাসান জামান বিদেশে থাকায় তারা দেখা করতে আসেননি।
শনিবার দুপুরে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পরিবারের কাছে পাঠানো হয় বলে জানান কামারুজ্জামানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। তিনি জানান, চিঠিতে বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তাদের দেখা করতে বলা হয়েছে।
এর আগে কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করতে শুক্রবার বিকালেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার সন্ধ্যার কিছু আগে ফাঁসি কার্যকরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। পাশাপাশি সন্ধ্যায় কারাগার ঘিরে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়। ফাঁসি কার্যকর হতে যাচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়াও এ খবর প্রচার করে। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা অব্যাহত থাকে এ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। রাত ৯টার কিছু পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। হঠাৎ করেই কারাগারের ভেতরে যাওয়া কর্মকর্তারা বের হয়ে আসেন। আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ফাঁসি নিয়ে নানা গুঞ্জনের।
ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়: রাজধানীর পল্লবী থানায় করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল-২ তার বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেন।
২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত উল্লেখ করে এ রায় দেয়া হয়। এর মধ্যে দুটিতে মৃত্যুদন্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন।
আপিলের শুনানি শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল রাখেন। বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
আপিল বিভাগের রায়ে কামারুজ্জামানকে এক নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আনা একাত্তরে বদিউজ্জামানকে হত্যার ঘটনা সংবলিত এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন দন্ড দিয়েছিলেন। ২ নম্বর অভিযোগ যথা- শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় তাকে ১০ বছর কারাদন্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এই সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে আপিল বিভাগ বহাল রাখেন।
তার বিরুদ্ধে তিন নম্বর অভিযোগটি ছিল সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে গণহত্যা ও ধর্ষণের। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১৪৪ জন ব্যক্তিকে হত্যা এবং বহু নারীকে ধর্ষণের দায়ে একাত্তরে ময়মনসিংহের আলবদর নেতা কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত।
এ অভিযোগে তার মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার ব্যাপারে বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী একমত পোষণ করেন। আর বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদানের পক্ষে রায় দিয়েছেন।
চতুর্থ অভিযোগ গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদন্ডের সাজা কমিয়ে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন করেন। সপ্তম অভিযোগে দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের আনা পাঁচ ও ছয় নম্বর অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালই তাকে খালাস দেন।
রিভিউ দায়ের ও শুনানি : ১৮ ফেব্রুয়ারী আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পরদিন ট্রাইব্যুনাল-২ তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠালে সেখানে কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ৫ মার্চ আবেদন করেন কামারুজ্জামান। ৫ এপ্রিল এ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। সকাল ৯টা ৫ মিনিটে আপিল বিভাগের চার বিচারপতি এজলাসে আসার পর প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা শুধু ‘ডিসমিসড’ (খারিজ) শব্দটি উচ্চারণ করেন।
রিভিউ আবেদন খারিজের মধ্য দিয়ে বিচারের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর রিভিউ খারিজের রায়ের কপি ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছায়। পরে ওই দিনেই রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদন্ড বহালের রায় তাকে পড়ে শোনান কারা কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা জানতে চান। কিন্তু কামারুজ্জামান পরের দিন আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা জানান। ৯ এপ্রিল ৫ জন আইনজীবী তার সঙ্গে দেখা করেন।
তিন মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি: কামারুজ্জামানের মামলার বিচারের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে তিনটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল। এর আগে জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় দিলেও আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদন্ডের আদেশ দেন। এছাড়া দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদন্ড দেন যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর কার্যকর হয়। (দৈনিক যুগান্তর)