নিউইয়র্ক ০১:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী ২৫ মে : জাতীয় পর্যায়ে কুমিল্লায় অনুষ্ঠান

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:৩৫:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ মে ২০১৫
  • / ১০০১ বার পঠিত

কুমিল্লা: ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে খ্যাত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী ২৫ মে সোমবার। কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদযাপন করা হচ্ছে। ২৫ মে সোমবার নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল চত্বরে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ১৯৯২ সালের পর হতে যাচ্ছে আবারও বিশাল আকারের এ অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে অয়োজিত অনুষ্ঠানের জন্য নগরীজুড়ে চলছে সাজসজ্জা। নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিরাট অধ্যায়জুড়ে রয়েছে কুমিল্লা। কুমিল্লায় নজরুলের স্মৃতিফলকগুলো তারই সত্যতা প্রমাণ করে।
বর্তমানে কুমিল্লা নগরীজুড়ে নজরুলের স্মৃতি বহনকারী ১২টি ফলক রয়েছে, যার মধ্যে ১০টিরই বেহাল দশা। এর মধ্যে কয়েকটা স্মৃতিফলক কবে যে তুলে ফেলা দেয়া হয়েছে, তা কেউ জানে না। অবহেলায় রয়েছে মুরাদনগরের দৌলতপুরে নজরুলের বাসরঘরসহ স্মৃতিফলক ও চিহ্নগুলো।
কুমিল্লায় কবি নজরুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে। তিনি মোট পাঁচবার কুমিল্লায় এসেছিলেন। নজরুলের দাম্পত্য জীবনের বন্ধনও ঘটেছিল কুমিল্লাতেই। দুই মহীয়সী নারীর পাণি গ্রহণ করে কুমিল্লার সঙ্গে তার ঘটেছিল চিরায়ত নারীর সংযোগ। কবি নজরুল ১৯২০ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত পাঁচবারে মোট ১১ মাস কাটিয়েছিলেন কুমিল্লায়। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম কুমিল্লায় আসেন তিনি। সে যাত্রায় দৌলতপুর অবস্থান করেন তিন মাস। দ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর, তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে জুন, চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর, পঞ্চমবার ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে চলে যাওয়ার তারিখ ছিল অজ্ঞাত।
নজরুলের প্রেম, বিয়েবিচ্ছেদ, গ্রেপ্তার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতিচর্চাসহ বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী কুমিল্লা শহর।
অপরদিকে নগরীর ঝাউতলা সড়কের শেষপ্রান্তে রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার বেশ কিছু লাইন সংবলিত ফলক তৈরি করা হয়েছিল; যে কবিতার জন্য কবি ১৯২২ সালের ২৩শে নভেম্বর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই স্থানে এখন মাত্র একটি স্মৃতিফলক রয়েছে।
স্মৃতিফলকের পাশে গড়ে উঠেছে শীতক প্রকৌশলীর দোকান। ওই দোকানের পরিত্যক্ত ফ্রিজ ও এসির মেশিন, বালতিতে ঢাকা রয়েছে নজরুলের ওই স্মৃতিফলক।
নজরুল যতবারই কুমিল্লায় এসেছেন, প্রতিবারই তিনি উঠেছেন কান্দিরপাড়ে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে অর্থাৎ প্রমীলাদের বাড়িতে। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর পর্যন্ত নজরুল এভিনিউটি নজরুলের নামে নামকরণ করে রাখা হয়। প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির সঙ্গে পরিচয় হয়, বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের সঙ্গে। এ সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন। সেখানে স্থাপিত নজরুল ফলকটির পাশেই পৌরসভার ডাস্টবিন!
প্রমীলাদের বাড়ির পুকুরটি ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে, বড় বড় অট্টালিকা। বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। পুকুরপাড় ও রাস্তার পাশের স্মৃতিফলকটি ব্যবসায়ীরা সরিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে বসিয়ে দিয়েছেন। সেখানে স্মৃতিফলকের ওপর পোস্টার সাঁটিয়ে দেয়ার কারণে সেটা আর দেখা যায় না। আর সে কারণে স্মৃতিফলকের সামনে প্রায় সময়ই তরমুজ-আম বিক্রেতা ভ্যানে করে দোকান সাজিয়ে বেচাকেনার কাজ করে।
১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর রাজগঞ্জ বাজারে নজরুল ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানকার স্মৃতিবিজড়িত ফলকটি এখন আর নেই। সেখানে এখন ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন।
নগরীর বজ্রপুরে অবস্থিত বহু পুরাতন কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুল। ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলের কাছেই ছিল অবিনাশ ময়রার দোকান। এই দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়। সেটিও এখন আর নেই।
কবি নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে বেশ কয়েকবার দারোগা বাড়ির মাজারের পার্শ্ববর্তী এই বাড়ির সংগীত জলসায় অংশ নিয়েছেন। ‘নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ’ ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই বাড়ির সামনে একটি ফলক স্থাপন করে। ফলকে উল্লেখ করা হয়, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৩ এখানে গজল গানের মজলিশে যোগ দিয়েছেন। এখানে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুসহ অনেকেই গান গেয়েছেন।
নগরীর দ্বিতীয় মুরাদপুর মহারাজ কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মণ বাহাদুরের রাজবাড়ীতে ১৯২২ সালে অনেকদিন কুমার শচীন্দ্র দেব বর্মণের (এসডি বর্মণ) সঙ্গে বসে সংগীত চর্চা করেছেন নজরুল। বর্তমানে শত বছরের পুরনো বাড়িটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
নানুয়ার দিঘীরপাড়ের সুলতান মাহমুদ মজুমদারের বাড়ি, নবাব বাড়ির নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন ফলকগুলোও অযতেœ, অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
মুরাদনগরেও নজরুল স্মৃতিগুলো: বিয়ের রাতেই নজরুল অজ্ঞাত কারণে দৌলতপুর ছেড়ে চলে গেলেও রেখে গেছেন অনেক স্মৃতিচিহ্ন। সেই সব স্মৃতিময় গাছ, ঘাট, বাসরঘর, খাট মলিন হতে বসেছে। বাসর ঘরের খাটে এখন মানুষ ঘুমায়। সেখানে তার ব্যবহার্য সব জিনিসপত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসরঘরটিও আগের অবস্থায় নেই। পুরোটা প্রায় ভংগুর। যে আম গাছের নিচে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন, সেটি মরে গেছে। আলী আকবর খাঁন মেমোরিয়াল ভবনটিও ধ্বংসের শেষপ্রান্তে।
এদিকে, মুরাদনগরের দৌলতপুরে প্রবেশপথে নজরুল তোরণের দুই পাশে স্থাপিত নজরুলের কবিতা-গান সংবলিত ৫/৬টি ফলক ভেঙে ব্রিজের সঙ্গে ঝুলে রয়েছে।
নজরুল স্মৃতিস্মারক চুরি: নগরীর পার্কের দক্ষিণ পাশে রাণীরকুঠি সংলগ্নস্থানে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। এ কেন্দ্রের তৃতীয়তলায় অবস্থিত পাঠাগার থেকে এক মাস আগে নজরুল স্মৃতিস্মারকটি চুরি হয়ে গেছে, যা নজরুল প্রেমীদের জন্য ঢাকা থেকে আনা হয়েছিল। এটি চুরির পর কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হলেও এখনও সেটা উদ্ধার করা হয়নি।
কুমিল্লার নজরুল প্র্রমীদের মনে কিছুটা আশার আলোও দেখা দিয়েছে। তাদের দাবি অবশেষে পূরণ হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার ২৫ মে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে। ২৫ মে সোমবার থেকে কবির ১১৬তম জন্মবার্ষিকী পালন শুরু হবে।
মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ধরে সামনে এগোলেই দৌলতপুর গ্রাম। এ গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে ‘নজররুল তোরণ’। তোরণের দুই পাশে ইট-সিমেন্টের তৈরি কালো রঙের টুকরো টুকরো বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা কবির পঙ্কিমালা। ওই পথ ধরে আধা কিলোমিটার এগোলেই খানবাড়ি। যে বাড়িকে কেন্দ্র করে নজরুলময় হয়ে ওঠেন ভক্তরা। ওই বাড়ি আর গ্রাম দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত হয়ে ওঠে নজরুল-নার্গিসের গ্রাম হিসেবে। এখানে রয়েছে আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারু কাজে শোভিত দ্বিতল বাড়ি। এ বাড়িতেই কবি ছিলেন। এ বাড়ির পলেস্তারা খসে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না কোন সংস্কার। এ ভবনের পেছনে বাঁশঝাড় পার হলেই কবির বাসরঘর।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কবির বাসরঘরটি আটচালা ছিল। পরে চৌচালা হলেও আয়তন ও ভিটির কোন পরিবর্তন করা হয়নি। ওই ঘরেই ছিল নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুকটি। অযন্ত ও অবহেলার কারণে সে সিন্দুকটি এখন আর নেই। কোথায় আছে এখন তা আর ওই বাড়ির কেউই বলতে পারে না। এক সময় ওই ঘরে বাসরখাটটিও ছিল। এখন সেটি পাশের একটি আধা পাকা ঘরে রাখা হয়েছে।
কবিপতœী নার্গিস বংশের উত্তরসূরি মোনালিসা খান বলেন, এ বাড়ির পুকুরঘাটের আমগাছ তলায় কবি দুপুরে শীতলপাটিতে বসে গান ও কবিতা লিখতেন। খানবাড়ির ছেলেমেয়েদের নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতেন। পুকুরের পানিতে সাঁতার কাটতেন। শখ করে পুকুরে জাল আর পলো দিয়ে মাছ শিকার করতেন। কবির ওই স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য দৌলতপুরে বানানো হয়েছে ‘নজরুল মঞ্চ’। প্রতিবছর কবির জন্মদিনে সেখানে জেলা প্রশাসন ও মুরাদনগর উপজেলা প্রশাসন সাদামাটাভাবে অনুষ্ঠান করে থাকে। এর বাইরে আর কিছুই এখানে হয়নি।
এলাকাবাসী জানান, ওই মঞ্চে বছরের অধিকাংশ সময় গরু চরে। শিশুরা হামাগুড়ি দেয়। মুরাদনগর উপজেলা আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমিটির সভাপতি সৈয়দ রাজিব আহাম্মদ আক্ষেপ করে বলেন, ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবির নামে অনেক কিছু হয়েছে। অথচ দৌলতপুরে কিছুই হলো না। কবি এখানে দুই মাস ১১ দিন ছিলেন। এখানে তিনি যৌবনে প্রেম ও বিয়ে করেছেন। অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছেন। দৌলতপুরে কবির নামে বড় ধরনের কোন স্থাপনা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করা হোক।
রাজনীতিক ও মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ তানভীর আহম্মেদ ফয়সাল বলেন, কবি নজরুলের নামে দৌলতপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিসহ আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বিতল বাড়িটিকে জাদুঘর বানিয়ে কবি পত্মী নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুক ও বাসরখাটটি সংরক্ষণের দাবি জানান।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী ২৫ মে : জাতীয় পর্যায়ে কুমিল্লায় অনুষ্ঠান

প্রকাশের সময় : ১০:৩৫:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ মে ২০১৫

কুমিল্লা: ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে খ্যাত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী ২৫ মে সোমবার। কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদযাপন করা হচ্ছে। ২৫ মে সোমবার নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল চত্বরে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ১৯৯২ সালের পর হতে যাচ্ছে আবারও বিশাল আকারের এ অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে অয়োজিত অনুষ্ঠানের জন্য নগরীজুড়ে চলছে সাজসজ্জা। নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিরাট অধ্যায়জুড়ে রয়েছে কুমিল্লা। কুমিল্লায় নজরুলের স্মৃতিফলকগুলো তারই সত্যতা প্রমাণ করে।
বর্তমানে কুমিল্লা নগরীজুড়ে নজরুলের স্মৃতি বহনকারী ১২টি ফলক রয়েছে, যার মধ্যে ১০টিরই বেহাল দশা। এর মধ্যে কয়েকটা স্মৃতিফলক কবে যে তুলে ফেলা দেয়া হয়েছে, তা কেউ জানে না। অবহেলায় রয়েছে মুরাদনগরের দৌলতপুরে নজরুলের বাসরঘরসহ স্মৃতিফলক ও চিহ্নগুলো।
কুমিল্লায় কবি নজরুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে। তিনি মোট পাঁচবার কুমিল্লায় এসেছিলেন। নজরুলের দাম্পত্য জীবনের বন্ধনও ঘটেছিল কুমিল্লাতেই। দুই মহীয়সী নারীর পাণি গ্রহণ করে কুমিল্লার সঙ্গে তার ঘটেছিল চিরায়ত নারীর সংযোগ। কবি নজরুল ১৯২০ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত পাঁচবারে মোট ১১ মাস কাটিয়েছিলেন কুমিল্লায়। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম কুমিল্লায় আসেন তিনি। সে যাত্রায় দৌলতপুর অবস্থান করেন তিন মাস। দ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর, তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে জুন, চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর, পঞ্চমবার ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে চলে যাওয়ার তারিখ ছিল অজ্ঞাত।
নজরুলের প্রেম, বিয়েবিচ্ছেদ, গ্রেপ্তার, সমাবেশ এবং কাব্য ও সংস্কৃতিচর্চাসহ বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী কুমিল্লা শহর।
অপরদিকে নগরীর ঝাউতলা সড়কের শেষপ্রান্তে রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতার বেশ কিছু লাইন সংবলিত ফলক তৈরি করা হয়েছিল; যে কবিতার জন্য কবি ১৯২২ সালের ২৩শে নভেম্বর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই স্থানে এখন মাত্র একটি স্মৃতিফলক রয়েছে।
স্মৃতিফলকের পাশে গড়ে উঠেছে শীতক প্রকৌশলীর দোকান। ওই দোকানের পরিত্যক্ত ফ্রিজ ও এসির মেশিন, বালতিতে ঢাকা রয়েছে নজরুলের ওই স্মৃতিফলক।
নজরুল যতবারই কুমিল্লায় এসেছেন, প্রতিবারই তিনি উঠেছেন কান্দিরপাড়ে ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে অর্থাৎ প্রমীলাদের বাড়িতে। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর পর্যন্ত নজরুল এভিনিউটি নজরুলের নামে নামকরণ করে রাখা হয়। প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির সঙ্গে পরিচয় হয়, বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের সঙ্গে। এ সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন। সেখানে স্থাপিত নজরুল ফলকটির পাশেই পৌরসভার ডাস্টবিন!
প্রমীলাদের বাড়ির পুকুরটি ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে, বড় বড় অট্টালিকা। বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেছে। পুকুরপাড় ও রাস্তার পাশের স্মৃতিফলকটি ব্যবসায়ীরা সরিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে বসিয়ে দিয়েছেন। সেখানে স্মৃতিফলকের ওপর পোস্টার সাঁটিয়ে দেয়ার কারণে সেটা আর দেখা যায় না। আর সে কারণে স্মৃতিফলকের সামনে প্রায় সময়ই তরমুজ-আম বিক্রেতা ভ্যানে করে দোকান সাজিয়ে বেচাকেনার কাজ করে।
১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর রাজগঞ্জ বাজারে নজরুল ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানকার স্মৃতিবিজড়িত ফলকটি এখন আর নেই। সেখানে এখন ময়লা-আবর্জনা ফেলার ডাস্টবিন।
নগরীর বজ্রপুরে অবস্থিত বহু পুরাতন কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুল। ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলের কাছেই ছিল অবিনাশ ময়রার দোকান। এই দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়। সেটিও এখন আর নেই।
কবি নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে বেশ কয়েকবার দারোগা বাড়ির মাজারের পার্শ্ববর্তী এই বাড়ির সংগীত জলসায় অংশ নিয়েছেন। ‘নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ’ ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই বাড়ির সামনে একটি ফলক স্থাপন করে। ফলকে উল্লেখ করা হয়, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৩ এখানে গজল গানের মজলিশে যোগ দিয়েছেন। এখানে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুসহ অনেকেই গান গেয়েছেন।
নগরীর দ্বিতীয় মুরাদপুর মহারাজ কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মণ বাহাদুরের রাজবাড়ীতে ১৯২২ সালে অনেকদিন কুমার শচীন্দ্র দেব বর্মণের (এসডি বর্মণ) সঙ্গে বসে সংগীত চর্চা করেছেন নজরুল। বর্তমানে শত বছরের পুরনো বাড়িটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
নানুয়ার দিঘীরপাড়ের সুলতান মাহমুদ মজুমদারের বাড়ি, নবাব বাড়ির নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন ফলকগুলোও অযতেœ, অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
মুরাদনগরেও নজরুল স্মৃতিগুলো: বিয়ের রাতেই নজরুল অজ্ঞাত কারণে দৌলতপুর ছেড়ে চলে গেলেও রেখে গেছেন অনেক স্মৃতিচিহ্ন। সেই সব স্মৃতিময় গাছ, ঘাট, বাসরঘর, খাট মলিন হতে বসেছে। বাসর ঘরের খাটে এখন মানুষ ঘুমায়। সেখানে তার ব্যবহার্য সব জিনিসপত্রও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসরঘরটিও আগের অবস্থায় নেই। পুরোটা প্রায় ভংগুর। যে আম গাছের নিচে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন, সেটি মরে গেছে। আলী আকবর খাঁন মেমোরিয়াল ভবনটিও ধ্বংসের শেষপ্রান্তে।
এদিকে, মুরাদনগরের দৌলতপুরে প্রবেশপথে নজরুল তোরণের দুই পাশে স্থাপিত নজরুলের কবিতা-গান সংবলিত ৫/৬টি ফলক ভেঙে ব্রিজের সঙ্গে ঝুলে রয়েছে।
নজরুল স্মৃতিস্মারক চুরি: নগরীর পার্কের দক্ষিণ পাশে রাণীরকুঠি সংলগ্নস্থানে ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। এ কেন্দ্রের তৃতীয়তলায় অবস্থিত পাঠাগার থেকে এক মাস আগে নজরুল স্মৃতিস্মারকটি চুরি হয়ে গেছে, যা নজরুল প্রেমীদের জন্য ঢাকা থেকে আনা হয়েছিল। এটি চুরির পর কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হলেও এখনও সেটা উদ্ধার করা হয়নি।
কুমিল্লার নজরুল প্র্রমীদের মনে কিছুটা আশার আলোও দেখা দিয়েছে। তাদের দাবি অবশেষে পূরণ হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার ২৫ মে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে। ২৫ মে সোমবার থেকে কবির ১১৬তম জন্মবার্ষিকী পালন শুরু হবে।
মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ধরে সামনে এগোলেই দৌলতপুর গ্রাম। এ গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে ‘নজররুল তোরণ’। তোরণের দুই পাশে ইট-সিমেন্টের তৈরি কালো রঙের টুকরো টুকরো বোর্ডে সাদা কালিতে লেখা কবির পঙ্কিমালা। ওই পথ ধরে আধা কিলোমিটার এগোলেই খানবাড়ি। যে বাড়িকে কেন্দ্র করে নজরুলময় হয়ে ওঠেন ভক্তরা। ওই বাড়ি আর গ্রাম দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত হয়ে ওঠে নজরুল-নার্গিসের গ্রাম হিসেবে। এখানে রয়েছে আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারু কাজে শোভিত দ্বিতল বাড়ি। এ বাড়িতেই কবি ছিলেন। এ বাড়ির পলেস্তারা খসে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে না কোন সংস্কার। এ ভবনের পেছনে বাঁশঝাড় পার হলেই কবির বাসরঘর।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কবির বাসরঘরটি আটচালা ছিল। পরে চৌচালা হলেও আয়তন ও ভিটির কোন পরিবর্তন করা হয়নি। ওই ঘরেই ছিল নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুকটি। অযন্ত ও অবহেলার কারণে সে সিন্দুকটি এখন আর নেই। কোথায় আছে এখন তা আর ওই বাড়ির কেউই বলতে পারে না। এক সময় ওই ঘরে বাসরখাটটিও ছিল। এখন সেটি পাশের একটি আধা পাকা ঘরে রাখা হয়েছে।
কবিপতœী নার্গিস বংশের উত্তরসূরি মোনালিসা খান বলেন, এ বাড়ির পুকুরঘাটের আমগাছ তলায় কবি দুপুরে শীতলপাটিতে বসে গান ও কবিতা লিখতেন। খানবাড়ির ছেলেমেয়েদের নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতেন। পুকুরের পানিতে সাঁতার কাটতেন। শখ করে পুকুরে জাল আর পলো দিয়ে মাছ শিকার করতেন। কবির ওই স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য দৌলতপুরে বানানো হয়েছে ‘নজরুল মঞ্চ’। প্রতিবছর কবির জন্মদিনে সেখানে জেলা প্রশাসন ও মুরাদনগর উপজেলা প্রশাসন সাদামাটাভাবে অনুষ্ঠান করে থাকে। এর বাইরে আর কিছুই এখানে হয়নি।
এলাকাবাসী জানান, ওই মঞ্চে বছরের অধিকাংশ সময় গরু চরে। শিশুরা হামাগুড়ি দেয়। মুরাদনগর উপজেলা আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমিটির সভাপতি সৈয়দ রাজিব আহাম্মদ আক্ষেপ করে বলেন, ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবির নামে অনেক কিছু হয়েছে। অথচ দৌলতপুরে কিছুই হলো না। কবি এখানে দুই মাস ১১ দিন ছিলেন। এখানে তিনি যৌবনে প্রেম ও বিয়ে করেছেন। অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছেন। দৌলতপুরে কবির নামে বড় ধরনের কোন স্থাপনা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করা হোক।
রাজনীতিক ও মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ তানভীর আহম্মেদ ফয়সাল বলেন, কবি নজরুলের নামে দৌলতপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিসহ আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বিতল বাড়িটিকে জাদুঘর বানিয়ে কবি পত্মী নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুক ও বাসরখাটটি সংরক্ষণের দাবি জানান।