নিউইয়র্ক ১০:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

অবিশ্বাস্য সেই সাহচর্য

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:২৩:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ অগাস্ট ২০১৫
  • / ৮৯২ বার পঠিত

ঢাকা: ১০ জানুয়ারী ১৯৭২-এর সেই অবিশ্বাস্য সকাল। পালাম বিমানবন্দর। ঘড়িতে আটটা দশ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্য, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ। ‘জয় বাংলা’। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন, তারপর আবেগের অশ্রæতে ঝাপসা স্মৃতি। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দু’পাশের জনতা। রাষ্ট্রপতি ভবন। ঝাপসা স্মৃতিতে আবার ভেসে আসে পালাম বিমানবন্দর। সেই দিন বিমানবন্দরের হাজারও গণ্যমান্য মানুষের ভিড়েও স্মৃতিপটে শুধু ভেসে আসে গাঢ় ধূসর বর্ণের গলাবন্ধ স্যুট আর কালো ওভারকোট পরা নবীন দেশের এই রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি। শীতের হিমেল হাওয়ায় অসংখ্য সম্ভাষণ আর আলিঙ্গনে তার ঘন কালো চুলও কিছুটা অবিন্যস্ত। স্বধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিল্লির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হল আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি। তারপর বঙ্গবন্ধুর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন। তারপর ব্রাসব্যান্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ আর ‘জনগণ মন’ দুটি দেশকে উপহার দেয়া বাংলার এক অমর কবির দুটি গানের রেশ সুমধুর। বিমানবন্দরে তার আনুষ্ঠানিক ভাষণে তিনি ভারত এবং ভারতবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন। ‘আমার এই যাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ।’ তিনি স্মরণ করলেন তার দেশবাসীকে। ‘আমার মানুষের কাছ থেকে যখন আমাকে ছিনিয়ে নেয়া হল, তারা কেঁদেছিল, আমি যখন কারাগারে, তারা চালিয়েছিল সংগ্রাম, আর আজ আমি যখন ফিরছি, তারা বিজয়ী।’ অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে দেখেছিলাম তার অশ্রুসিক্ত চোখ। সেই অশ্রু ছিল ভালোবাসা, গর্ব আর আনন্দের।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতার পর শীতের সেই প্রত্যুষের জনসভাও ছিল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিমানবন্দর থেকে মোটরমিছিলে সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পকেটে রয়েছে জনসভার জন্য প্রণীত একটি ইংরেজি ভাষণ। ভাষণটি তার পকেটেই রয়ে গেল। তিনি বাংলায় করলেন তার ভাষণের শুরু। ‘শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ…।’ তার কথা শেষ না হতেই করতালি, তারপর তার উচ্চারিত প্রতিটি লাইনের সঙ্গে করতালি। জনসভায় বসে আমার মনে হয়েছিল, এটি যেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর করতালির দ্বৈত সঙ্গীত। বক্তৃতা শেষে আবার মোটরমিছিলে জনসমুদ্র ভেদ করে পুষ্পতোরণসজ্জিত রাজপথে আমরা গেলাম নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে।
সেই সকালে আমার প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধানের। আমার পাশে, সেই উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোতে, সর্বাঙ্গীণ সহায়তায় ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রাচারপ্রধান মাহবুব খান। তিনিই আমাকে পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের পূর্বক্ষণে অবহিত করলেন আমাদের নির্ধারিত যাত্রাসূচি। দিল্লি থেকে আমরা সেই সকালেই যাব কলকাতা। কলকাতায় বঙ্গবন্ধু অপরাহ্নে একটি জনসভায় ভাষণ দেবেন। তারপর কলকাতা থেকে ঢাকা, যেখানে সেই অপরাহ্নেই অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জনসভা। মাহবুব খান বললেন, দিল্লি থেকে আমরা সফর করব ব্রিটিশ কমেটে নয়, ভারতের রাষ্ট্রপতির সরকারি বিমান ‘রাজহংসে’। লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের আগেই আমাদের মালামাল রাজহংসে রাখা হল। মাহবুব খান জানালেন, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ কমেটের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু আর তার সহগামীদের মালামাল রাজহংসে স্থানান্তরিত করা হবে। বললেন, সেই দায়িত্বটি হবে তারই।
জনসভার পরপরই রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধী একান্ত বৈঠকে বসলেন। আমরা, পাত্রমিত্ররা পাশের একটি সুসজ্জিত হল কামরায় উর্দি পরা রুপার ট্রেধারী বেয়ারাকুল দ্বারা গরম গরম সমুচা, কাবাব আর ধূমায়িত চা-কফিতে আপ্যায়িত হচ্ছি। হঠাৎ আমাদের সহকর্মী মাহবুব খানের তলব পড়ল সেই কামরায়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর বঙ্গবন্ধুর একান্ত বৈঠক চলছে। কিছুক্ষণ পরই ব্যস্তসমস্তভাবে বেরিয়ে এলেন মাহবুব খান। বললেন, ‘প্রিয় সহকর্মী আমার, সফরসূচি পাল্টে গেছে। সবকিছু পাল্টে গেছে। আপনারা আর কলকাতা যাচ্ছেন না। এখান থেকে সোজা ঢাকা। আর তাও আবার রাজহংসে নয়; ব্রিটিশ কমেটে।’ তারপর বললেন, তাতে তার চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি এখনই বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমাদের মালামাল রাজহংস থেকে আবার কমেটে রেখে দিতে আর ঢাকা ও কলকাতায় তিনি সেই মর্মে এখনই বার্তা প্রেরণ করবেন। আমার শুধু একটি দায়িত্বই রয়েছে। দিল্লিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে নিশ্চিতভাবে অবগত হওয়া যে কমেট বিমানটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরণ করতে পারবে কিনা। তার সূত্র থেকে তিনি জেনেছেন যে তা সম্ভব, তবু সাবধানের মার নেই। আমারই তা সরাসরি জেনে নেয়া উচিত হবে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয় ছিল। মাহবুব খানের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবেই আমি স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিলেন যে, ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে কমেট বিমানটির সম্পূর্ণ নিরাপদ অবতরণ সম্ভব।
বিমানে বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম সিদ্ধান্ত বদলের কারণগুলো। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা প্রথম সুযোগেই তার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে কলকাতায় বিলম্ব ঘটে, শীতের সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি, তাহলে সন্ধ্যায় ঢাকায় জনসভা অনুষ্ঠিত করা, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তায় হয়তো তা অসম্ভব হতো। তৃতীয়ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ আর কলকাতার অধিবাসীরা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে দিয়েছে আশ্রয়। তাদের ঢাকার যাত্রাপথের বিরতিতে ধন্যবাদ না জানিয়ে, বঙ্গবন্ধুর মতে, যথার্থ হবে, একটি বিশেষ সফরে কলকাতা গিয়ে ধন্যবাদ জানানো।
আর দিল্লি-ঢাকার এই যাত্রা ভারতের রাষ্ট্রপতির বিমান রাজহংসে নয় কেন?
বঙ্গবন্ধুর কথায়, ব্রিটিশ সরকার বিশেষ সৌজন্যমূলক ব্যবস্থায় যে বিমানটি দিয়েছে, মাঝপথে অকারণে তা বদল করা সমীচীন হতো না মোটেও।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সেই প্রসন্ন অপরাহ্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধান হিসেবে অনুধাবন করেছিলাম, আমাদের নবীন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে কূটনীতি আর কূটনৈতিক আচরণে দীক্ষা লাভের আমার রয়েছে যথেষ্ট অবকাশ। তার পরের স্মরণীয় দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে তার প্রমাণ পেয়েছিলাম আরও।
যা-ই হোক, আশ্চর্য সেই প্রভাতে হঠাৎ ঢাকাগামী আমরা বিমানে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি।
‘এ কে?’ হঠাৎ অপরিচিত আমাকে দেখে অংগুলি নির্দেশে তার জিজ্ঞাসা।
আমার নাম উচ্চারণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বললেন, আপনার বিমানবন্দরের ভাষণটি এ-ই লিখেছে।
আমার মনের কথাগুলোই তো লিখেছে, বললেন বঙ্গবন্ধু।
আমার ইতিহাস-সচেতন মন হঠাৎ যেন দিল নাড়া। পকেটে রাখা তার ভাষণটি এগিয়ে দিলাম। স্মৃতি হিসেবে আপনার স্বাক্ষরিত ভাষণটি রাখতে চাই, সভয়ে বললাম।
‘নিশ্চয়ই। কলম দাও।’ বললেন তিনি।
শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ভাষণটি আজও রয়েছে আমার কাছে। তার স্মৃতির একান্ত ব্যক্তিগত বাহক। আর রয়েছে ১৯৭২-এর আমার ডায়েরির ১০ জানুয়ারীর পাতাটি। সেটাও সভয়ে এগিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ডায়েরির পাতাটিজুড়ে রয়েছে পুলকজাগানো সেই নামটি, শেখ মুজিব। স্পষ্ট, দৃঢ়, চির অম্লান। (দৈনিক যুগান্তর)
লেখক: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

অবিশ্বাস্য সেই সাহচর্য

প্রকাশের সময় : ০৯:২৩:২১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ অগাস্ট ২০১৫

ঢাকা: ১০ জানুয়ারী ১৯৭২-এর সেই অবিশ্বাস্য সকাল। পালাম বিমানবন্দর। ঘড়িতে আটটা দশ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্য, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ। ‘জয় বাংলা’। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন, তারপর আবেগের অশ্রæতে ঝাপসা স্মৃতি। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দু’পাশের জনতা। রাষ্ট্রপতি ভবন। ঝাপসা স্মৃতিতে আবার ভেসে আসে পালাম বিমানবন্দর। সেই দিন বিমানবন্দরের হাজারও গণ্যমান্য মানুষের ভিড়েও স্মৃতিপটে শুধু ভেসে আসে গাঢ় ধূসর বর্ণের গলাবন্ধ স্যুট আর কালো ওভারকোট পরা নবীন দেশের এই রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি। শীতের হিমেল হাওয়ায় অসংখ্য সম্ভাষণ আর আলিঙ্গনে তার ঘন কালো চুলও কিছুটা অবিন্যস্ত। স্বধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিল্লির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হল আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি। তারপর বঙ্গবন্ধুর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন। তারপর ব্রাসব্যান্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ আর ‘জনগণ মন’ দুটি দেশকে উপহার দেয়া বাংলার এক অমর কবির দুটি গানের রেশ সুমধুর। বিমানবন্দরে তার আনুষ্ঠানিক ভাষণে তিনি ভারত এবং ভারতবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন। ‘আমার এই যাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ।’ তিনি স্মরণ করলেন তার দেশবাসীকে। ‘আমার মানুষের কাছ থেকে যখন আমাকে ছিনিয়ে নেয়া হল, তারা কেঁদেছিল, আমি যখন কারাগারে, তারা চালিয়েছিল সংগ্রাম, আর আজ আমি যখন ফিরছি, তারা বিজয়ী।’ অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে দেখেছিলাম তার অশ্রুসিক্ত চোখ। সেই অশ্রু ছিল ভালোবাসা, গর্ব আর আনন্দের।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতার পর শীতের সেই প্রত্যুষের জনসভাও ছিল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিমানবন্দর থেকে মোটরমিছিলে সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পকেটে রয়েছে জনসভার জন্য প্রণীত একটি ইংরেজি ভাষণ। ভাষণটি তার পকেটেই রয়ে গেল। তিনি বাংলায় করলেন তার ভাষণের শুরু। ‘শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ…।’ তার কথা শেষ না হতেই করতালি, তারপর তার উচ্চারিত প্রতিটি লাইনের সঙ্গে করতালি। জনসভায় বসে আমার মনে হয়েছিল, এটি যেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর করতালির দ্বৈত সঙ্গীত। বক্তৃতা শেষে আবার মোটরমিছিলে জনসমুদ্র ভেদ করে পুষ্পতোরণসজ্জিত রাজপথে আমরা গেলাম নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে।
সেই সকালে আমার প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধানের। আমার পাশে, সেই উত্তেজনাময় মুহূর্তগুলোতে, সর্বাঙ্গীণ সহায়তায় ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রাচারপ্রধান মাহবুব খান। তিনিই আমাকে পালাম বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের পূর্বক্ষণে অবহিত করলেন আমাদের নির্ধারিত যাত্রাসূচি। দিল্লি থেকে আমরা সেই সকালেই যাব কলকাতা। কলকাতায় বঙ্গবন্ধু অপরাহ্নে একটি জনসভায় ভাষণ দেবেন। তারপর কলকাতা থেকে ঢাকা, যেখানে সেই অপরাহ্নেই অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জনসভা। মাহবুব খান বললেন, দিল্লি থেকে আমরা সফর করব ব্রিটিশ কমেটে নয়, ভারতের রাষ্ট্রপতির সরকারি বিমান ‘রাজহংসে’। লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের আগেই আমাদের মালামাল রাজহংসে রাখা হল। মাহবুব খান জানালেন, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ কমেটের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু আর তার সহগামীদের মালামাল রাজহংসে স্থানান্তরিত করা হবে। বললেন, সেই দায়িত্বটি হবে তারই।
জনসভার পরপরই রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধু আর ইন্দিরা গান্ধী একান্ত বৈঠকে বসলেন। আমরা, পাত্রমিত্ররা পাশের একটি সুসজ্জিত হল কামরায় উর্দি পরা রুপার ট্রেধারী বেয়ারাকুল দ্বারা গরম গরম সমুচা, কাবাব আর ধূমায়িত চা-কফিতে আপ্যায়িত হচ্ছি। হঠাৎ আমাদের সহকর্মী মাহবুব খানের তলব পড়ল সেই কামরায়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর বঙ্গবন্ধুর একান্ত বৈঠক চলছে। কিছুক্ষণ পরই ব্যস্তসমস্তভাবে বেরিয়ে এলেন মাহবুব খান। বললেন, ‘প্রিয় সহকর্মী আমার, সফরসূচি পাল্টে গেছে। সবকিছু পাল্টে গেছে। আপনারা আর কলকাতা যাচ্ছেন না। এখান থেকে সোজা ঢাকা। আর তাও আবার রাজহংসে নয়; ব্রিটিশ কমেটে।’ তারপর বললেন, তাতে তার চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি এখনই বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমাদের মালামাল রাজহংস থেকে আবার কমেটে রেখে দিতে আর ঢাকা ও কলকাতায় তিনি সেই মর্মে এখনই বার্তা প্রেরণ করবেন। আমার শুধু একটি দায়িত্বই রয়েছে। দিল্লিতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে নিশ্চিতভাবে অবগত হওয়া যে কমেট বিমানটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরণ করতে পারবে কিনা। তার সূত্র থেকে তিনি জেনেছেন যে তা সম্ভব, তবু সাবধানের মার নেই। আমারই তা সরাসরি জেনে নেয়া উচিত হবে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয় ছিল। মাহবুব খানের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবেই আমি স্যার টেরেন্স গারভির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিলেন যে, ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে কমেট বিমানটির সম্পূর্ণ নিরাপদ অবতরণ সম্ভব।
বিমানে বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনেছিলাম সিদ্ধান্ত বদলের কারণগুলো। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা প্রথম সুযোগেই তার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে কলকাতায় বিলম্ব ঘটে, শীতের সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি, তাহলে সন্ধ্যায় ঢাকায় জনসভা অনুষ্ঠিত করা, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তায় হয়তো তা অসম্ভব হতো। তৃতীয়ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গ আর কলকাতার অধিবাসীরা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে দিয়েছে আশ্রয়। তাদের ঢাকার যাত্রাপথের বিরতিতে ধন্যবাদ না জানিয়ে, বঙ্গবন্ধুর মতে, যথার্থ হবে, একটি বিশেষ সফরে কলকাতা গিয়ে ধন্যবাদ জানানো।
আর দিল্লি-ঢাকার এই যাত্রা ভারতের রাষ্ট্রপতির বিমান রাজহংসে নয় কেন?
বঙ্গবন্ধুর কথায়, ব্রিটিশ সরকার বিশেষ সৌজন্যমূলক ব্যবস্থায় যে বিমানটি দিয়েছে, মাঝপথে অকারণে তা বদল করা সমীচীন হতো না মোটেও।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সেই প্রসন্ন অপরাহ্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রাচারপ্রধান হিসেবে অনুধাবন করেছিলাম, আমাদের নবীন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে কূটনীতি আর কূটনৈতিক আচরণে দীক্ষা লাভের আমার রয়েছে যথেষ্ট অবকাশ। তার পরের স্মরণীয় দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে তার প্রমাণ পেয়েছিলাম আরও।
যা-ই হোক, আশ্চর্য সেই প্রভাতে হঠাৎ ঢাকাগামী আমরা বিমানে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি।
‘এ কে?’ হঠাৎ অপরিচিত আমাকে দেখে অংগুলি নির্দেশে তার জিজ্ঞাসা।
আমার নাম উচ্চারণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বললেন, আপনার বিমানবন্দরের ভাষণটি এ-ই লিখেছে।
আমার মনের কথাগুলোই তো লিখেছে, বললেন বঙ্গবন্ধু।
আমার ইতিহাস-সচেতন মন হঠাৎ যেন দিল নাড়া। পকেটে রাখা তার ভাষণটি এগিয়ে দিলাম। স্মৃতি হিসেবে আপনার স্বাক্ষরিত ভাষণটি রাখতে চাই, সভয়ে বললাম।
‘নিশ্চয়ই। কলম দাও।’ বললেন তিনি।
শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ভাষণটি আজও রয়েছে আমার কাছে। তার স্মৃতির একান্ত ব্যক্তিগত বাহক। আর রয়েছে ১৯৭২-এর আমার ডায়েরির ১০ জানুয়ারীর পাতাটি। সেটাও সভয়ে এগিয়ে দিয়েছিলাম। আমার ডায়েরির পাতাটিজুড়ে রয়েছে পুলকজাগানো সেই নামটি, শেখ মুজিব। স্পষ্ট, দৃঢ়, চির অম্লান। (দৈনিক যুগান্তর)
লেখক: সাবেক পররাষ্ট্র সচিব