লেখায় আশা-আলো প্রত্যাশার কথা থাকলেও সমস্যার সমাধান নেই
- প্রকাশের সময় : ০৩:২৯:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ মে ২০১৫
- / ১৩৭৩ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: প্রবাসের বিশিষ্ট লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীর ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ শীর্ষক নতুন গ্রন্থের উপর আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা প্রবাসে বসবাস করে দেশ, দেশের মা-মাটি ও রাজনীতি, সমাজনীতি, হরতাল-ধর্মঘট, শ্রমজীবি মানুষের ঘামে ঝড়া অর্থনীতি নিয়ে লিখা তথা বই প্রকাশের যৌক্তিকতা তুলে ধরে আতœসমালোচনার পাশাপাশি বলেন, লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীর নতুন বইয়ে আশা-আলো ও প্রত্যাশার কথা যেমন রয়েছে তেমনী তার লেখায় উঠে আসা অনেক সমস্যার সমাধান নেই। বইটির বিভিন্ন পর্বে দেশ, দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ের পাশাপাশি দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সফলতা-ব্যর্থতার কথাও স্থান পেয়েছ। যা পাঠকদের আলোড়িত করবে।
সিটির জ্যাকসন হাইটস্থ জুইস সেন্টারে গত ১৬ মে শনিবার অপরাহ্নে এই আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ। গ্রন্থের উপর আলোচনায় অংশ নেন নির্ধারিত আলোচক অধ্যাপক দেওয়ান শামসুল আরেফীন, কলামিস্ট হাসান ফেরদৌস, লেখক ফেরদৌস সাজেদীন ও অধ্যাপক ড. ধনঞ্জয় সাহা। অনুষ্ঠানে লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরী ছাড়াও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ডা. মোহাম্মদ জামান ও নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও আবৃত্তিকার জি এইচ আরজু।
‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ শীর্ষক গ্রন্থটির উপর আলোচনাকালে অধ্যাপক দেওয়ান শামসুল আরেফীন লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীকে একজন ‘অপ্টিমেস্টিক লেখক’ আখ্যায়িত করে বলেন, তার সকল লেখা বাংলাদেশ ঘিরে। তার লেখায় তথ্য-উপাত্ত রয়েছে, গণতন্ত্র, জবাবদিহীতা, আইনের শাসনের প্রসঙ্গসহ দেশের বড় বড় ইস্যূও উঠে এসেছে। যার সমাধান নেই। তিনি লেখকের লেখার অধিকাংশ বিষয়ের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, আমাদেকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। প্রসঙ্গত তিনি একজন লেখককে অন্য লেখক বা তার লেখা সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য থাকা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
হাসান ফেরদৌস তার বক্তব্যে গ্রন্থটির বিভিন্ন লেখার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, বিদেশে থেকে দেশের কথা বলা অন্যায়। কেননা, আমরা দেশের হরতাল-ধর্মঘট দেখিনি, শ্রমিকের ঘাম দেখিনি। অথচ আমরা বড় বড় উপদেশ দেই, কিন্তু কিভাবে সমাধান হবে তা বলি না। তাই দেশ সম্পর্কে লেখার আগে বিশ্বাস ও আস্থা দরকার। তিনি বলেন, লেখকের লেখার মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে, ভাষা বুঝা মুশকিল আর বাক্য অসম্পূর্ণ। লেখকের চিন্তাচেতনাও বাস্তবসম্মত নয়। তার (লেখক) লেখার একদিকে হ্যাঁ, অন্যদিকে না থাকায় দন্দ্ব প্রতিয়মান হয়েছে। আর এই দন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে একই সাথে প্রবাসে থেকে দেশ নিয়ে লিখার জন্য। লেখকের গ্রন্থে কোন আলো দেখিনি, উদ্বেগ-ব্যকুলতা দেখেছি। তিনি বলেন, লেখা এক জিনিস আর বই প্রকাশ করা আরেক জিনিস। তাই ভেবে-চিন্তে গ্রন্থ প্রকাশ করা উচিৎ।
ফেরদৌস সাজেদীন বলেন, মাহমুদ রেজা চৌধুরীর লেখায় দেশ-কাল-পাত্র ভেদে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতার কথা, স্বদেশ-সমাজের সাম্প্রতিক কথা উঠে এসেছে। তার লেখায় প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা, ছড়িয়ে আছে। এজন্য লেখককে সাধুবাদ, অভিনন্দন জানাই। এমন গ্রন্থ পাঠকসমাজে কম দেখা যায়। তিনি বলেন, আমরা দেশের সরকার ও বিরোধীদলসহ কোথায় নৈতিকতা দেখিনা কিন্তু লেখকের লেখায় নৈতিকতা রয়েছে। অনেক সমস্যার গলদ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তার লেখায় আশাবাদ দেখতে পাই, কিন্তু কিভাবে আশা পূরণ হবে তার কোন নির্দেশনা নেই। পাশাপাশি লেখকের গদ্য রীতিতে হোঁচট খেতে হয়। তবে লেখকের লেখাগুলো পাঠকের বিবেক জাগ্রত করবে।
ড. ধনঞ্জয় সাহা লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীকে বাস্তববাদী দার্শনিক অখ্যায়িত করে বলেন, তার লেখায় দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে। চিন্তা-চেতনায় দার্শনিক ভাব রয়েছে, যা আমাদের মাধ্যে নেই। তবে লেখকের লেখার সাথে সামগ্রিক অবস্থার দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেন, যেকোন লেখায় ‘রেজুলেশন এন্ড সল্যুশন’ থাকা উচিৎ।
বক্তারা গ্রন্থটির ব্যাপক প্রচার ও পাঠক প্রিয়তা কামনা করেন।
সবশেষে লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরী তার ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’ গ্রন্থের উপর আলোচকদের সুচিন্তিত অভিমত, বিশ্বাস, যুক্ত ও আবেগকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে বলেন, পৃথিবীতে প্রতিটি ঘটনার পেছনে ‘সময়’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক বা বিষয় থাকে। কখন, কেন, কিভাবে কোন ঘটনা ঘটে। তার বাস্তবতা নির্ভর করে সময় কাল, ব্যক্তি-গোষ্ঠী এইসব কিছুর আর্থ-সমাজিক ও রাজনৈতিক শ্রেনী চরিত্র এবং এর মূল্যবোধের উপরও। একজন সাধারণ নাগরিক যেভাবে যে ঘটনাকে দেখে কিম্বা বোঝে একজন মিডিয়া রিপোর্টার সেভাবে নাও দেখতে পারেন। আবার একই ঘটনা একজন রাজনীতিবীদ, একজন অর্থনীতিবীদ, কবি, নাট্যকার, বিশ্লেষক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, গৃহবধু তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকেও আলাদা আরাদাভাবে দেখতেই পারেন। এইসব দেখার বৈচিত্রতা, সভ্যতা এবং মানুষের সামনে অগ্রযাত্রার মহাসড়কে কালের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। তিনি বলেন, গতকালের জাগতিক সত্যাসত্য অনেক বিষয় আজকের প্রেক্ষপটে একইভাবে সত্য থাকে না। আবার আজকের সত্যও আগামীকাল পরিবর্তন হয়ে যেতেই পারে।
মাহমুদ রেজা চৌধুরী বলেন, আমাদের যাদেরকে সময়ের এই পরিবর্তনের অপরবির্তনীয় বিষয়গুলো নাড়া দেয় বা আমরা যারা চলমান সময়ে বসে কোন ঘটনা বা দূর্ঘটনা দেখি, ভাবি বা বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করি। এই দেখা, ব্যাখ্যা ও চিন্তার মাঝেও না দেখা, না বোঝা বা বোঝার চেষ্টা করবার চেষ্টা থাকবে। পাশাপাশি এই বিভিন্ন ঐক্য এবং মতের দ্বিধাকেও আমরা গুরুত্ব সহকারে যে বিবেচনায় রাখি সেভাবে লিখি বা বলি। এটাও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্তর্গত। তিনি আলোচকদের মতামত, দ্বি-মত, ভিন্নমত, রাগ-অনুরাগ-ভালোবাসা ও প্রশংসাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, নিজেকে জানার তাগিদের কথাই সক্রেটিস বলেছেন ‘নো দাই সেলফ’। তিনি বলেন, সমাজ ও সভ্যতা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া এই জগতে অনন্ত। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সাথে যে মানব জাতি জড়িত, সেই মানুষ অনিবার্য নয়। আজ আমি, কাল নেই। এটাও সত্যের এক রূপ এবং এই মূল্যবোধের প্রতি সচেতনতাও এক ধরনের গণতান্ত্রিক আধ্যাত্বিকতার কৃষ্টি। আমরা আমাদের জাগতিক কৃষ্টির প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল থাকবো, এই ব্যাপারে অপরের মতামতকে প্রকাশের স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করবো। তেমনী সামগ্রীক কৃষ্টি, বিশ্বাস ও এর আচার-আচরণকেও সমানভাবে শ্রদ্ধা জানাবো ততক্ষন যতক্ষণ, মানুষ হিসেবে আমার বা আমাদের কারো বিশ্বাস বা কাজ অন্য কাউকে যেকোন প্রকার হত্যা খুন বা গুম না করে।