নিউইয়র্ক ০৮:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

নারায়ণগঞ্জে ওসমানীয় শাসন!

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:২২:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ মে ২০১৬
  • / ৮৮৪ বার পঠিত

প্রথমেই শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুুদ্ধে প্রতিবাদী দেশের সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জবাসীকে এ কারণে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই যে তাঁরা শিক্ষক লাঞ্ছনাকারী এমপি সেলিম ওসমানের প্রচারণাকে একেবারেই আমলে নেননি। গত বৃহস্পতিবার (১৯ মে) নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে সদলবলে সংবাদ সম্মেলন করে ওই ব্যবসায়ী কাম এমপি কাম সাবেক স্বৈরাচারের সহযোগী পবিত্র ধর্ম নিয়ে যেসব উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেছেন, তাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশটা পাকিস্তান নয়। আর নারায়ণগঞ্জের মানুষও ধর্মীয় উন্মাদনার হীন চেষ্টাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ কারণে তাঁদের অভিবাদন জানাই।
সেলিম ওসমান দাবি করেছেন, পিয়ার সাত্তার লতিফ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন এবং জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি স্বেচ্ছায় কান ধরে ওঠবস করেছেন। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে লাখ লাখ মানুষ দেখেছেন, এমপি সেলিম ওসমান আঙুল উঁচিয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কয়েক শ লোকের সামনে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন। শ্যামল কান্তি অসুস্থ ছিলেন। তারপরও সেলিম ওসমানের শাস্তি থেকে তিনি রেহাই পাননি। ছবি মিথ্যা বলে না বলে এখন সেই ছবি দেখানোকে সেলিম ওসমান তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তাঁর বক্তব্যটি স্ববিরোধিতায় ভরা। একবার তিনি বলেছেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তি স্বেচ্ছায় কান ধরে ওঠবস করেছেন। আবার বলেছেন, সাজা দিয়ে তিনিই (সেলিম ওসমান) তাঁকে বাঁচিয়েছেন। সকাল ১০টায় স্কুল প্রাঙ্গণে কয়েক হাজার লোক জড়ো হলেও সেলিম ওসমান সেখানে গিয়েছেন বিকেল চারটায়। এই ছয় ঘণ্টা কিন্তু শ্যামল কান্তি পুলিশ প্রহরায় নিরাপদেই ছিলেন। তিনি সেখানে যাওয়ার পরই পরিস্থিতি কেন উত্তপ্ত হয়ে উঠল? শ্যামল কান্তি বলেছেন, তিনি ধর্মকে কটূক্তি করে কিছু বলেননি। পুরো বিষয়টি ছিল সাজানো এবং তাঁকে ফাঁসানোর জন্যই এই নাটক করা হয়েছে।
এই ফাঁসানোর ঘটনায় সেলিম ওসমানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ভূমিকা ছিল কি না, সেটিও তদন্ত করে দেখা দরকার। তাঁর দাবি অনুযায়ী শ্যামল কান্তি যদি ধর্ম নিয়ে কোনো কটূক্তি করেও থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কেন এমপি আইনের আশ্রয় নিলেন না? কেন তিনি নিজের হাতে আইন তুলে নিলেন? রাষ্ট্র তাঁকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিলেও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়নি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন বলেছেন, শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে মানহানি কিংবা অন্য ধারায় মামলা করা যায়। লাঞ্ছিত শিক্ষক আইনি সহায়তা চাইলে দেবেন বলে জানিয়েছেন এই প্রবীণ আইনজীবী।
সেলিম ওসমান বলেছেন, ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে তিনি শ্যামল কান্তিকে সাজা দিয়েছেন। তিনি সাজা দেওয়ার কে? দেশে কি আইন-আদালত নেই? সরকারি তদন্ত কমিটি শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পায়নি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাঁকে স্বপদে বহাল করার পাশাপাশি ওই স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে দিয়েছেন। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি অন্যায়ভাবে শ্যামল কান্তিকে বরখাস্ত করেছিল। তিনি ১৭ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ওই স্কুলে শিক্ষকতা করলেও নতুন কমিটি এসেই তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করে বলে অভিযোগ আছে। বাতিল হওয়া কমিটির সভাপতি বলেছেন, এমপি’র নির্দেশে শ্যামল কান্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। সেলিম ওসমান আসলে শ্যামল কান্তিকে বাঁচাতে যাননি, চাকরিচ্যুত করতে গিয়েছিলেন।
তাঁর দাবি, শ্যামল কান্তি ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। আর সরকারের তদন্ত কমিটি বলছে, কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সেলিম ওসমান বলেছেন, তদন্ত করার সময় নাকি শিক্ষামন্ত্রী বা কমিটি তাঁর সঙ্গে কথা বলেননি। শিক্ষার বিষয়াদি শিক্ষামন্ত্রীরই দেখার কথা। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু স্থানীয় এমপি হিসেবে সেলিম ওসমান কি শিক্ষামন্ত্রীকে সমস্যাটি জানিয়েছিলেন? না, তিনি জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। নারায়ণগঞ্জে তাঁরা যা বলবেন, সেটাই আইন। সেলিম ওসমান যে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে আজ এমপি হয়েছেন, সেই উপনির্বাচনের দিন কী ঘটেছিল, তাও সবার জানা। এএসপি বসির পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেদিন আরেক ওসমানের রোষানলে পড়েছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সেলিম ওসমান তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে না পারলেও শ্যামল কান্তি নিজেই সাংবাদিকদের ঘটনা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘সেদিন সেলিম ওসমান আমার দুই গালে দুটি করে চারটি চড় মারেন। এরপর বলেন, “শালা কান ধর। ১০ বার কান ধরে ওঠবস কর।”
শ্যামল কান্তি ভক্ত পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা বানোয়াট। তিনি বলেছেন, ‘আমার সম্মান আর নেই। ওই স্মৃতি এখন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আবার নতুন করে বরখাস্তের নোটিশ পেয়ে এখন মানসিকভাবে অনেকটা অসুস্থ। ১৭ বছর ধরে ওই স্কুলে শিক্ষকতা করলেও কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা হলো নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি তাঁর বোনকে এই পদে বসাতে চান।’
কয়েক শ লোকের সামনে সংঘটিত ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ এখন ঘরে ঘরে। আরও একটি অডিও ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে এমপি সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নাফিজ আশরাফের টেলিফোন কথোপকথন, যার সবটা মুদ্রিত ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সেলিম ওসমান টেলিফোন সংলাপে প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি আসিফ হোসেনের নাম ধরে বলেছেন, তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে আসিফ বেঁচে থাকতে পারত না। এর মাধ্যমে তিনি কি বলতে চাইছেন যে আসিফ বেঁচে আছেন তাঁর কৃপায়? একজন ব্যক্তি যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন, তিনি কি প্রকাশ্যে এভাবে একজন সাংবাদিককে হুমকি দিতে পারেন? দিলে সেটি কি ফৌজদারি অপরাধ নয়?
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ত্বরিত সিদ্ধান্তে শ্যামল কান্তি তাঁর চাকরি ফিরে পেয়েছেন। এর মাধ্যমে তাঁর (শ্যামল কান্তি) ওপর সংঘটিত প্রথম অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়া গেল। এ জন্য শিক্ষামন্ত্রী ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু ওই শিক্ষকের ওপর সংঘটিত দ্বিতীয় অপরাধের প্রতিকার তিনি এখনো পাননি। দ্বিতীয়ত, শ্যামল কান্তি চাকরি ফিরে পেলেও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্যামল কান্তি মনে করেন, সেলিম ওসমান এমপি থাকা অবস্থায় তাঁর জীবন নিরাপদ নয়। একজন শিক্ষক ও নাগরিক যদি তাঁর এলাকার এমপি সম্পর্কে এ রকম আশঙ্কা ব্যক্ত করেন, তখন রাষ্ট্রের করণীয় কী? প্রথম কর্তব্য ওই শিক্ষকের নিরাপত্তা বিধান। দ্বিতীয় কর্তব্য তাঁর ওপর সংঘটিত অন্যায়ের বিচার করা। একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ যত গুরুতরই হোক না কেন, সেটি তদন্তের আগে তাঁকে শাস্তি দেওয়া যায় না। অথচ এখানে এমপি সেলিম ওসমান তদন্তের আগেই তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন।
ঘটনাটি এতই ঘৃণ্য যে দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সরকারি দলের নেতারাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ঘটনার জন্য শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন ওই এমপিকে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহউল আলম লেনিন বলেছেন, ওই এমপি’র অপকর্মের দায় শেখ হাসিনার সরকার নেবে না। সরকারের অন্তত চারজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাকে নিন্দনীয় বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সেলিম ওসমান বলেছেন, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। ক্ষমা তাঁরাই চান, যাঁরা অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখেন। কোনো ভুল করলে সংশোধনের চেষ্টা করেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার তো কখনো ভুল করে না। সেলিম ওসমান ফাঁসির শাস্তি নিতে রাজি আছেন, কিন্তু ক্ষমা চাইবেন না।
শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে যেভাবে বাংলাদেশ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে, সেখানে ক্ষমার বিষয়টি এখন আর শ্যামল কান্তির ওপরও নির্ভর করছে না। শিক্ষক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষই ধিক্কার জানিয়েছেন যেই শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদের, এখন তাঁদের ওই শিক্ষকের পক্ষেও ক্ষমা করে দেওয়া সম্ভব হবে না।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে এক বন্ধু টেলিফোনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, কী হয় না হয়। নানা উসকানি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত গতকাল নারায়ণগঞ্জ শান্তিপূর্ণই ছিল। নারায়ণগঞ্জবাসীর অভিযোগ, সারা দেশে শেখ হাসিনার শাসন চললেও নারায়ণগঞ্জে চলছে ওসমানীয় শাসন। সেখানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিতে কোনো ফারাক নেই। অথচ দুটি দলের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি আলাদা। আওয়ামী লীগ বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলার রাজনীতির কথা বলে। জাতীয় পার্টি বিএনপির মতো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ মনে করেন, সেখানে শান্তি আনতে হলে ওসমানীয় শাসন থেকে মুক্ত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করবেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে লাঞ্ছনার ঘটনায় এভাবে কেন ফুঁসে উঠল বাংলাদেশ? সমাজে নিয়তই অন্যায়-অনাচারের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ এত জোরালো হয় না। সম্ভবত একটি কারণ এখানে অনাচারের সঙ্গে ঔদ্ধত্য যোগ হয়েছে। একজন প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি যখন সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, কাউকে মানুষ জ্ঞান করেন না, তখন তা সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখে না। এখানে একজন এমপি’র হাতে একজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হননি কেবল, লাঞ্ছিত হয়েছে মানবতা। অপমানিত হয়েছে শিক্ষকসত্তা। এ কারণেই যাঁরা শ্যামল কান্তিকে কখনো দেখেননি, তাঁরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।
আমাদের সমাজ এখনো যে শিক্ষকদের সম্মান দেয়, শ্রদ্ধা ও সমীহ করে, শ্যামল কান্তির ঘটনায় সেটিই আবার প্রমাণিত হলো। তিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কোন ধর্মের অনুসারী, সেসব ছাপিয়ে তাঁদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে একজন অসহায় শিক্ষকের বেদনা ও লাঞ্ছনা। একজন পীড়িত মানুষের কষ্টকে তাঁরা নিজেদের কষ্ট হিসেবেই নিয়েছেন।
আমাদের সমাজে এখনো যে অর্থ ও দম্ভের কাছে মানবতাবোধ লুপ্ত হয়ে যায়নি, সেটাই বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ তথা তরুণ প্রজন্ম আবারও সুউচ্চ কণ্ঠে জানিয়ে দিল। এই তরুণেরাই বাংলাদেশের শেষ ভরসা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

নারায়ণগঞ্জে ওসমানীয় শাসন!

প্রকাশের সময় : ০৮:২২:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ মে ২০১৬

প্রথমেই শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুুদ্ধে প্রতিবাদী দেশের সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জবাসীকে এ কারণে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই যে তাঁরা শিক্ষক লাঞ্ছনাকারী এমপি সেলিম ওসমানের প্রচারণাকে একেবারেই আমলে নেননি। গত বৃহস্পতিবার (১৯ মে) নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে সদলবলে সংবাদ সম্মেলন করে ওই ব্যবসায়ী কাম এমপি কাম সাবেক স্বৈরাচারের সহযোগী পবিত্র ধর্ম নিয়ে যেসব উসকানিমূলক কথাবার্তা বলেছেন, তাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাওয়াও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশটা পাকিস্তান নয়। আর নারায়ণগঞ্জের মানুষও ধর্মীয় উন্মাদনার হীন চেষ্টাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ কারণে তাঁদের অভিবাদন জানাই।
সেলিম ওসমান দাবি করেছেন, পিয়ার সাত্তার লতিফ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন এবং জীবন বাঁচানোর জন্য তিনি স্বেচ্ছায় কান ধরে ওঠবস করেছেন। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে লাখ লাখ মানুষ দেখেছেন, এমপি সেলিম ওসমান আঙুল উঁচিয়ে শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কয়েক শ লোকের সামনে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন। শ্যামল কান্তি অসুস্থ ছিলেন। তারপরও সেলিম ওসমানের শাস্তি থেকে তিনি রেহাই পাননি। ছবি মিথ্যা বলে না বলে এখন সেই ছবি দেখানোকে সেলিম ওসমান তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তাঁর বক্তব্যটি স্ববিরোধিতায় ভরা। একবার তিনি বলেছেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তি স্বেচ্ছায় কান ধরে ওঠবস করেছেন। আবার বলেছেন, সাজা দিয়ে তিনিই (সেলিম ওসমান) তাঁকে বাঁচিয়েছেন। সকাল ১০টায় স্কুল প্রাঙ্গণে কয়েক হাজার লোক জড়ো হলেও সেলিম ওসমান সেখানে গিয়েছেন বিকেল চারটায়। এই ছয় ঘণ্টা কিন্তু শ্যামল কান্তি পুলিশ প্রহরায় নিরাপদেই ছিলেন। তিনি সেখানে যাওয়ার পরই পরিস্থিতি কেন উত্তপ্ত হয়ে উঠল? শ্যামল কান্তি বলেছেন, তিনি ধর্মকে কটূক্তি করে কিছু বলেননি। পুরো বিষয়টি ছিল সাজানো এবং তাঁকে ফাঁসানোর জন্যই এই নাটক করা হয়েছে।
এই ফাঁসানোর ঘটনায় সেলিম ওসমানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ভূমিকা ছিল কি না, সেটিও তদন্ত করে দেখা দরকার। তাঁর দাবি অনুযায়ী শ্যামল কান্তি যদি ধর্ম নিয়ে কোনো কটূক্তি করেও থাকেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কেন এমপি আইনের আশ্রয় নিলেন না? কেন তিনি নিজের হাতে আইন তুলে নিলেন? রাষ্ট্র তাঁকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিলেও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়নি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন বলেছেন, শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদের বিরুদ্ধে মানহানি কিংবা অন্য ধারায় মামলা করা যায়। লাঞ্ছিত শিক্ষক আইনি সহায়তা চাইলে দেবেন বলে জানিয়েছেন এই প্রবীণ আইনজীবী।
সেলিম ওসমান বলেছেন, ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে তিনি শ্যামল কান্তিকে সাজা দিয়েছেন। তিনি সাজা দেওয়ার কে? দেশে কি আইন-আদালত নেই? সরকারি তদন্ত কমিটি শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পায়নি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাঁকে স্বপদে বহাল করার পাশাপাশি ওই স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে দিয়েছেন। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি অন্যায়ভাবে শ্যামল কান্তিকে বরখাস্ত করেছিল। তিনি ১৭ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ওই স্কুলে শিক্ষকতা করলেও নতুন কমিটি এসেই তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করে বলে অভিযোগ আছে। বাতিল হওয়া কমিটির সভাপতি বলেছেন, এমপি’র নির্দেশে শ্যামল কান্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। সেলিম ওসমান আসলে শ্যামল কান্তিকে বাঁচাতে যাননি, চাকরিচ্যুত করতে গিয়েছিলেন।
তাঁর দাবি, শ্যামল কান্তি ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। আর সরকারের তদন্ত কমিটি বলছে, কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সেলিম ওসমান বলেছেন, তদন্ত করার সময় নাকি শিক্ষামন্ত্রী বা কমিটি তাঁর সঙ্গে কথা বলেননি। শিক্ষার বিষয়াদি শিক্ষামন্ত্রীরই দেখার কথা। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু স্থানীয় এমপি হিসেবে সেলিম ওসমান কি শিক্ষামন্ত্রীকে সমস্যাটি জানিয়েছিলেন? না, তিনি জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। নারায়ণগঞ্জে তাঁরা যা বলবেন, সেটাই আইন। সেলিম ওসমান যে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে আজ এমপি হয়েছেন, সেই উপনির্বাচনের দিন কী ঘটেছিল, তাও সবার জানা। এএসপি বসির পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেদিন আরেক ওসমানের রোষানলে পড়েছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে সেলিম ওসমান তাঁর বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে না পারলেও শ্যামল কান্তি নিজেই সাংবাদিকদের ঘটনা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘সেদিন সেলিম ওসমান আমার দুই গালে দুটি করে চারটি চড় মারেন। এরপর বলেন, “শালা কান ধর। ১০ বার কান ধরে ওঠবস কর।”
শ্যামল কান্তি ভক্ত পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা বানোয়াট। তিনি বলেছেন, ‘আমার সম্মান আর নেই। ওই স্মৃতি এখন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আবার নতুন করে বরখাস্তের নোটিশ পেয়ে এখন মানসিকভাবে অনেকটা অসুস্থ। ১৭ বছর ধরে ওই স্কুলে শিক্ষকতা করলেও কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা হলো নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি তাঁর বোনকে এই পদে বসাতে চান।’
কয়েক শ লোকের সামনে সংঘটিত ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ এখন ঘরে ঘরে। আরও একটি অডিও ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে এমপি সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নাফিজ আশরাফের টেলিফোন কথোপকথন, যার সবটা মুদ্রিত ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সেলিম ওসমান টেলিফোন সংলাপে প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি আসিফ হোসেনের নাম ধরে বলেছেন, তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে আসিফ বেঁচে থাকতে পারত না। এর মাধ্যমে তিনি কি বলতে চাইছেন যে আসিফ বেঁচে আছেন তাঁর কৃপায়? একজন ব্যক্তি যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন, তিনি কি প্রকাশ্যে এভাবে একজন সাংবাদিককে হুমকি দিতে পারেন? দিলে সেটি কি ফৌজদারি অপরাধ নয়?
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ত্বরিত সিদ্ধান্তে শ্যামল কান্তি তাঁর চাকরি ফিরে পেয়েছেন। এর মাধ্যমে তাঁর (শ্যামল কান্তি) ওপর সংঘটিত প্রথম অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়া গেল। এ জন্য শিক্ষামন্ত্রী ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু ওই শিক্ষকের ওপর সংঘটিত দ্বিতীয় অপরাধের প্রতিকার তিনি এখনো পাননি। দ্বিতীয়ত, শ্যামল কান্তি চাকরি ফিরে পেলেও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শ্যামল কান্তি মনে করেন, সেলিম ওসমান এমপি থাকা অবস্থায় তাঁর জীবন নিরাপদ নয়। একজন শিক্ষক ও নাগরিক যদি তাঁর এলাকার এমপি সম্পর্কে এ রকম আশঙ্কা ব্যক্ত করেন, তখন রাষ্ট্রের করণীয় কী? প্রথম কর্তব্য ওই শিক্ষকের নিরাপত্তা বিধান। দ্বিতীয় কর্তব্য তাঁর ওপর সংঘটিত অন্যায়ের বিচার করা। একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ যত গুরুতরই হোক না কেন, সেটি তদন্তের আগে তাঁকে শাস্তি দেওয়া যায় না। অথচ এখানে এমপি সেলিম ওসমান তদন্তের আগেই তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন।
ঘটনাটি এতই ঘৃণ্য যে দেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রী-এমপি, সরকারি দলের নেতারাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ঘটনার জন্য শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন ওই এমপিকে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহউল আলম লেনিন বলেছেন, ওই এমপি’র অপকর্মের দায় শেখ হাসিনার সরকার নেবে না। সরকারের অন্তত চারজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাকে নিন্দনীয় বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু সেলিম ওসমান বলেছেন, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। ক্ষমা তাঁরাই চান, যাঁরা অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখেন। কোনো ভুল করলে সংশোধনের চেষ্টা করেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার তো কখনো ভুল করে না। সেলিম ওসমান ফাঁসির শাস্তি নিতে রাজি আছেন, কিন্তু ক্ষমা চাইবেন না।
শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে যেভাবে বাংলাদেশ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে, সেখানে ক্ষমার বিষয়টি এখন আর শ্যামল কান্তির ওপরও নির্ভর করছে না। শিক্ষক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষই ধিক্কার জানিয়েছেন যেই শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদের, এখন তাঁদের ওই শিক্ষকের পক্ষেও ক্ষমা করে দেওয়া সম্ভব হবে না।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে এক বন্ধু টেলিফোনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, কী হয় না হয়। নানা উসকানি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত গতকাল নারায়ণগঞ্জ শান্তিপূর্ণই ছিল। নারায়ণগঞ্জবাসীর অভিযোগ, সারা দেশে শেখ হাসিনার শাসন চললেও নারায়ণগঞ্জে চলছে ওসমানীয় শাসন। সেখানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিতে কোনো ফারাক নেই। অথচ দুটি দলের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি আলাদা। আওয়ামী লীগ বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলার রাজনীতির কথা বলে। জাতীয় পার্টি বিএনপির মতো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ মনে করেন, সেখানে শান্তি আনতে হলে ওসমানীয় শাসন থেকে মুক্ত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করবেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে লাঞ্ছনার ঘটনায় এভাবে কেন ফুঁসে উঠল বাংলাদেশ? সমাজে নিয়তই অন্যায়-অনাচারের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ এত জোরালো হয় না। সম্ভবত একটি কারণ এখানে অনাচারের সঙ্গে ঔদ্ধত্য যোগ হয়েছে। একজন প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি যখন সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, কাউকে মানুষ জ্ঞান করেন না, তখন তা সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখে না। এখানে একজন এমপি’র হাতে একজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হননি কেবল, লাঞ্ছিত হয়েছে মানবতা। অপমানিত হয়েছে শিক্ষকসত্তা। এ কারণেই যাঁরা শ্যামল কান্তিকে কখনো দেখেননি, তাঁরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।
আমাদের সমাজ এখনো যে শিক্ষকদের সম্মান দেয়, শ্রদ্ধা ও সমীহ করে, শ্যামল কান্তির ঘটনায় সেটিই আবার প্রমাণিত হলো। তিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কোন ধর্মের অনুসারী, সেসব ছাপিয়ে তাঁদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে একজন অসহায় শিক্ষকের বেদনা ও লাঞ্ছনা। একজন পীড়িত মানুষের কষ্টকে তাঁরা নিজেদের কষ্ট হিসেবেই নিয়েছেন।
আমাদের সমাজে এখনো যে অর্থ ও দম্ভের কাছে মানবতাবোধ লুপ্ত হয়ে যায়নি, সেটাই বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ তথা তরুণ প্রজন্ম আবারও সুউচ্চ কণ্ঠে জানিয়ে দিল। এই তরুণেরাই বাংলাদেশের শেষ ভরসা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।