নিউইয়র্ক ০৭:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

একজন শহীদ ও তার পরিবারের বিড়ম্বনা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:৩৯:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
  • / ১১৫৮ বার পঠিত

সামসুল ইসলাম মজনু: বাংলাদেশের শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস সামনে এলেই আমার মানষপটে অনেক স্মৃতি, অনেক সুখ দুঃখের বিষয় ভেসে উঠে। কখনো কখনো এ সকল বিষয় নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করি আর চোখের পানিতে বুক ভেসে যায়। চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লাখ শহীদের তালিকায় আমার পিতা হাজী মোহাম্মদ আব্দুর রউফও একজন। আমার বাবা ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অনেক পরিশ্রমী এবং পরোপকারী। যৌবন কালে নিজের মেধা বা শ্রম ব্যয় করে প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে পৌছার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে তাকে চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে। একজন মানুষ বা সফল ব্যক্তির কথা যুতটুকু শুনেছি আমার আম্মার কাছ থেকে তা হলো প্রায় চৌদ্দ বছর বয়সে দাদার ব্যবসার দায়িত্ব তার হাতে পড়ে। নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলেন। বৃহত্তর সিলেটের কারমগানূর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম। ব্যবসার প্রয়োজনে সেসময় গৌহাটি, কলকাতা সহ ভারতের বড় বড় শহরে তাকে যেতে হয়েছে। জীবনের দুঃখ নিয়ে একসময় প্রয়োজনের তাগিতে তাকে সিলেট ছেড়ে চট্টগ্রামে আবাস গড়তে হয়েছে। ছিলেন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চাশের কোটায় পড়ার পূর্ব মুহুর্তেই তাকে চলে যেতে হয়েছে এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আগেই যা বলছিলাম। চট্টগ্রামের অভিবাসী হয়েও নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামে। উঠা বসা করেছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সাথে। গড়ে তুলেছেন আত্মীয়তা। প্রতিষ্ঠা করেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা। সবই ঠিক ছিল। খুবই ধর্মপরায়ণ ছিলেন বলেই ১৮ বছর পুরা হওয়ার আগেই বিয়ে দেন বড় মেয়েকে। দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হলো। চারিদিকে সংগ্রাম চলছিল। ব্যক্তিগত জীবনে পুরোদমে একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন আমার বাবা। তবে ছিলেন সামাজিক, রাজনীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না, তবে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তার বিরোধীতাও করেননি। বরঞ্চ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন। দুঃখজনক হলো একজন নির্ভেজাল মানুষের ভাগ্য এমন হবে তা কি কখনও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও বিষয়টাকে এভাবে না দেখে জবাবে বলেছেন আমি কারও ক্ষতি করি নাই। চেষ্টা করেছি উপকার করতে। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রবিন্দু লালখান বাজারে আমাদের বসবাস। একটি অনুন্নত এলাকাকে চেষ্টা করেছেন উন্নত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। এই এলাকায় কোন ইমারত ছিলনা। প্রথম দুটা ইমারত ছিল যা আমার বাবা তৈরী করেন মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য অবসর সময় ব্যয় করেছেন। তারই জন্য আত্ম বিশ্বাস ছিল কেহই তার ক্ষতি করবে না। নিয়তির যা লিখা তাই হলো, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এলাকা ছেড়ে কোথাও না গিয়ে এলাকায় রয়ে যান। হঠাৎ আমাদের পরিবারের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এটা কেউ বুঝতে পারে নাই। পরিবারের সবচাইতে দায়িত্ববান ব্যক্তির এ করুণ অবস্থা কেহ টের পায় নাই। দিনটি ছিল শুক্রবার ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল। সকাল ৯টায় সবাই নাস্তা করছিলাম। হঠাৎ দরজার কড়া নাড়ার শব্দ, পাশের বাড়ীর বিহারী ছেলেটা এসে উর্দুতে হাজী সাহেবকে ডাকছে। দরজা খোলার সাথে সাথে বাবা সহ আমরা দেখতে পাই তিনজন পাক আর্মি গেটের সামনে ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলেই চিৎকার করে বলে উঠে। তাড়াতাড়ি আস তোমাকে সার্কিট হাউজে আমাদের সাথে যেতে হবে। কি আর করা কোন কথা না বলে তাদের সাথে গেলেন। আমার আব্বা আর আমরা সবাই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম।
সকাল গড়িয়ে দুপুর যায়, রাত হয়। আব্বা আর ফিরে আসেন না। আমার আম্মা ছিলেন একটু সাহসী। উনি নিজে পরের দিন আমাকে নিয়ে এসপির বাংলোয় একজন ক্যাপ্টেনের কাছে গেলেন (আমাদের প্রতিবেশী এসপির বাংলো) ঐ পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন জবাবে বলল হাজীকে মেরে ফেলেছি শুনেছি। আমরা বললাম যদি মেরেও ফেলে তবুও তার দেহটা আমাদের দিয়ে দাও। দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা আমার বাবার দেহটা পর্যন্ত পাই নাই। কেউ বলল আমার আব্বার দেহ সাগরে ফেলে দিয়েছে। কেউ বলল তার দেহ পুলিশ লাইনের ফায়ারিং স্কোয়াডে দেখা গেছে পড়ে থাকতে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য না পেয়েছি কারও সহযোগিতা না পেয়েছি সঠিক তথ্য। ১দিন, ২দিন করে করে বছরের পর বছর চলে গেলেও আমার বাবা আসলেন না। পেলাম না কোন সঠিক সংবাদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। অনেক বন্দী মুক্ত হলেও আমার বাবার মুক্তি হলনা। ধরেই নিয়েছি আমার আব্বা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রাব্বুল আলামিনের কাছে সর্বদা এই দোয়া করি হে আল্লাহ আমার বাবাকে তুমি শহীদের দরজা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করিও। আমিন।
একটা পরিবারের প্রধান ব্যক্তির যখন দুর্ঘটনাজনিত কারণে অথবা অকস্মাৎ মারা যান তবে তার কোন পরিকল্পনা ঠিক মত চলে না। আমার আব্বা সম্পদ রেখে গেছেন। কিন্তু সম্পদের সুষ্টু ব্যবহারের যে ব্যবস্থা রেখে যাওয়ার কথা তা পারেননি। আব্বার মৃত্যুর পর আমরা কঠিন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হই অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে। ঠিক মত চলছিলনা পরিবার। একের পর এক সমস্যা পরিবারের উপর আসছিল। আমার আম্মা তার ন্যূনতম যোগ্যতা দিয়ে হাল ধরেছেন। তাকে সহযোগিতা বা পরামর্শ দিয়েছেন আমার একমাত্র চাচা। চাচাও ব্যক্তিগত জীবনে পরোপকারী ছিলেন। তার নিজের ছিল অনেক সমস্যা। তার উপর স্বাধীনতার ৪/৫ বছর আগে আব্বাই তাকে এক প্রকার জোর করে চট্টগ্রামে আনান। তিনি ব্যবসায় তেমন সফলকাম হতে পারছিলেন না। নিজেই ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন হতাশাগ্রস্থ। তার উপর ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে পড়েন। আমার আম্মা সব সময় পরামর্শ নিয়ে আগানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা সাধারণত অপরকে দোষারোপ করি কিছু না পারলে বা বুঝলে। কিন্তু একটা বিষয় সত্য, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব যোগ্যতা বা কর্মদক্ষতা বলতে একটা কথা আছে তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। চাচার ব্যাপারে পারিবারিক কেহ কেহ বিরূপ সমালোচনা করলেও আমাদের পরিবারের দিক থেকে তাকে কখনই অসম্মান করিনি। যাক সে কথা। আমি মূল বিষয়ে আসার চেষ্টা করছি। আম্মা চেষ্টা করেছেন আমাদের স্কুলে পাঠাতে। চেষ্টা করেছেন ভাল কাপড় কিনে দিতে। একজন মা হিসাবে যতটুকু করার দায়িত্ব ছিল তিনি তার থেকে অনেক বেশী করেছেন। কারণ তিনি ছিলেন মা, তিনি ছিলেন বাবা। আগেই বলেছি বাবা সম্পদ রেখে গেছেন তার নগদ অর্থ রেখে যেতে পারেন নাই। যৎসামান্য যা ব্যাংকে ছিল তা হয়ত বছর খানেক চলত। এলাকার সম্মানী পরিবার হিসাবে ভিতরের খবর কাউকেই বলা হয়ে উঠে নাই। আমার নিউইয়র্কের পরিবারের সাথে ঘরোয়া আলাপের সময় যখন বলি বিদুৎ বিল সময়মত পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় তারা আশ্চর্য হয়ে যায়। তার পর দ্বিতীয়ত বাড়ীর সংস্কারের জন্য এবং সরকারী খাজনা দেয়ার জন্য। আমার আম্মা টাকা হাওলাত নিলে পরবর্তীতে জমির বিনিময়ে টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। উল্লেখীত সমস্যাগুলো কিছুই না। স্বাভাবিক কিন্তু পরিবারের মূল পরিচালকের অকাল প্রয়ানে এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে ছিল অনেক সমস্যার ব্যক্তিগত ভাবে আমি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে জড়িত থাকার কারণে পার্শ্ব সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পেরেছি। মেধাবী ছাত্র ছিলাম না তার পরেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়ে অকৃতকার্য হয়েছি। পরবর্তী মানবিক নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাই। ঘাত প্রতিঘাত মোকাবেলা করে সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাই। সম্মানের সাথে স্নাতকোত্তর সমাপনের আগেই বিদেশ যাওয়ার চেষ্টার মত্ত্ব হলেও একটি স্পন্সরের জন্য যাওয়া হয় নাই। তদানিন্তন একজন মন্ত্রীর সম্মুখীন হলেও আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠেন, আমি কেন বিদেশ যাব। দেশে ব্যবসা, বাণিজ্য করার জন্য পরামর্শ দিলেন। পরবর্তীতে এক আত্মীয়ের কাছে ব্যবসা করার জন্য টাকা চাইলেও সদউত্তর পাই নাই। সেই ভদ্রলোকের সাথে এখনও ভাল সম্পর্ক এবং পরবর্তীতে আমার আম্মার অনুরোধে অন্য আত্মীয়কে খুবই সহযোগিতা করেছেন। আমি এখন ঠিকই বুঝতে পেরেছি কেন এবং কি কারণে আমি বা আমরা ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়েছি। এখানে যদি আমার আব্বা থাকত তার হয়ত সঠিক বিষয় নিয়ে পড়তে পারতাম অথবা অপরের কাছে কিছু বলার আগে পারিবারিক সমস্যা নিয়ে পরামর্শ করতে পারতাম। তবে হয়ত আমার জন্য ভাল হত। খুব কম বয়সে পারিবারিক দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আমার আম্মার সহযোগিতায় এক এক করে এগিয়ে যাই। প্রয়োজনের তাগিদে স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করে ফলাফল বের হওয়ার আগেই একটি বেসরকারী সংস্থায় যোগদান করি। দুঃসম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের সাহায্য চাকুরীতে যোগদান করলে দীর্ঘ সময়ও কম বেতন থাকায় সেটা চালিয়ে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করে চাকুরী ছেড়ে দিই। ইতোমধ্যে অন্যদিকে চেষ্টা করতে থাকি তখন অন্য একটি বহুজাতিক সংস্থায় যোগ দেই। বিক্রয় কর্মকর্তা হিসাবে ট্রনিংকালীন সময় পুরো বিষয়টা গোপন রাখি। এমনকি পণ্য বিক্রির জন্য বন্ধুর স্টোরে গেলেও সে বুঝতে পারেনি। পরবর্তীতে যখন দায়িত্ব পাই তখন তারা জানতে পারে এবং আমার আম্মা সহ পরিবারের অন্যরা জানতে পারেন যখন প্রথম বেতনটা আম্মার হাতে দেই। উনি ঐ টাকার কিছু দান করেন আর কিছু আমাকে দিয়েছেন। ওভাবে চলার পথ শুরু। পরবর্তীতে আমেরিকা আসার পর প্রথম আয়ের পর মাস তিনেক পর আম্মাকে হজ্বে পাঠাই। জীবনের শুরুটা যেভাবে ছিল সে অবস্থা কাটিয়ে উঠলেও পারিবারিক বিড়ম্বনা থেমে থাকেনি। সিদ্ধান্তহীনতা, দূরদর্শীতা এগুলো কিছুই রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। পুথিগত জ্ঞানের বাইরে বাস্তবতা বা বাহ্যিক জ্ঞান প্রয়োজন তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই। যা বলছিলাম চাকুরী করতে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছিল তা অন্য লিখায় বলব। তবে এতটুকু বলব চাকুরী ছিল দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এম এম ইস্পাহানি। প্রথমে দায়িত্ব পাই বরিশালে। সেখানে এক বছর দায়িত্বে থাকার পর খুলনার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পাই। বাড়ী, গাড়ী সব ছিল।
আমেরিকার অপি ওয়ান লটারি ভিসা পাওয়ার পর বিষয়টা গোপন রাখি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘ সময়ের ছুটি চাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা খুব শক্ত করে ধরলে বলতে বাধ্য হই আমেরিকার ভিসা পাওয়ার কথা। প্রতি উত্তরে আমার উর্ধ্বতন কর্তা মহাদয় বললেন আপনি পদত্যাগ করুন এতে আপনি ঝামেলা মুক্ত থাকবেন এবং আমেরিকা গেলে কেউ ফিরে আসেন না। সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা তার উত্তর আজও পাই না। ব্যক্তিগতভাবে মানুষের জীবনটা রিসাইকেল হয় না তাই এর উত্তর পাই না। আমি সঠিক কিনা, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কেহ কেহ সচিব বা উর্দ্ধতন কর্মকর্তা অথবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কেহ বা অর্থকষ্টে আছেন। বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করে যাচ্ছি। আমেরিকা আসার পর এমন কোন কাজ নাই যা করিনি। ডিসওয়াসার হতে শুরু করে স্টক ব্রোকার, হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার কোথাও মনস্থির করতে পারিনি। সর্বশেষ ব্যবসায় সফলতা আসলেও সেখানে রিস্ক ফ্যাক্টর যদি সমস্যা হয় তবে পরামর্শ শোনার অভ্যাস থাকলেও কার্যকরী করতে গিয়ে হোচট খাই। আমি আমার পরিবারের সমস্যা এবং আব্বার অকাল প্রয়াণের কারণে একটু বেশি সচেতন। মুসলমান হিসাবে মহান আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস থাকলেও পাশাপাশি চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এটা বিশ্বাস করি। পরিবারের ভিতরে এবং বাইরে অনেকের সাথে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে দন্দ্ব হলেও পরবর্তীতে যখন বিষয়টা নিয়ে নিজে নিজে গবেষণা করি তখন উত্তর পেয়ে যাই। এর একটা সুন্দর উত্তর হলো প্রত্যেক ব্যক্তির সমস্যা ভিন্ন, প্রত্যেক পরিবারের সমস্যা ভিন্ন তবে পরিবারকে নিয়া পরিবারের সমস্যা সবচাইতে উত্তম। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে পরিবারের কার সাথে কোন বিষয়টা নিয়ে আলাপ করছেন সে সেই বিষয়ে কতটুকু জ্ঞান রাখে। ভুল পরামর্শ শোনা থেকে পরামর্শ না নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। বন্ধুর পথ কঠিন তবে তাতে রয়েছে আনন্দ সুখ। অপরকে দায়ী করার চেয়ে নিজে সেটার উত্তর খুঁজে পাওয়া শ্রেষ্ঠ। একজন পিতা কখনই তার সন্তানকে ভুল পরামর্শ দিবে না তার বুঝতে হবে পিতার কর্মদক্ষতা গর্ভীরতা যোগ্যতা আমার আব্বা সব সময় আমার কাছে একজন আদর্শ ব্যক্তি। যিনি শুধু অর্থের জন্য সিলেট থেকে চট্টগ্রামে অভিবাসন হন নাই, ঠিক একই পন্থায় আমিও শুধু অর্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসি নাই। তাই শুরুতে বলেছি আজও উত্তর খুঁজে পাই না। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা যথাযথ ছিল কিনা। নিজের সন্তানদের সাথে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হলেও কোন উত্তর খুঁজে পাই না। যখন চিন্তা করি ওদের সন্তানরা বাংলাদেশ বা বাঙ্গালিত্ব অথবা মুসলমানিত্ব কতটুকু ঠিক রাখতে পারবো আমাকে এ বিষয়ে কেউ বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞান দিলে তখন হয়ত ভিন্নভাবে নিজেকে তৈরী করতাম। এদেশে এত এত সুযোগ সুবিধা তার পরেও আমার নিজের জানামতে দু তিন বন্ধুর বাবা দেশে ফিরে গেছে। সন্তানদের পরামর্শ দিয়ে গেছে কাজ কাম কর তবে স্থায়ী বসবাস চিন্তা করিও না। জানি না আমার আব্বা কি বলতেন? এ প্রশ্ন রেখে আজকের লিখা শেষ করছি।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র সাবেক সহ সভাপতি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

একজন শহীদ ও তার পরিবারের বিড়ম্বনা

প্রকাশের সময় : ০৬:৩৯:৪২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

সামসুল ইসলাম মজনু: বাংলাদেশের শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস সামনে এলেই আমার মানষপটে অনেক স্মৃতি, অনেক সুখ দুঃখের বিষয় ভেসে উঠে। কখনো কখনো এ সকল বিষয় নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করি আর চোখের পানিতে বুক ভেসে যায়। চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লাখ শহীদের তালিকায় আমার পিতা হাজী মোহাম্মদ আব্দুর রউফও একজন। আমার বাবা ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অনেক পরিশ্রমী এবং পরোপকারী। যৌবন কালে নিজের মেধা বা শ্রম ব্যয় করে প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে পৌছার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে তাকে চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে। একজন মানুষ বা সফল ব্যক্তির কথা যুতটুকু শুনেছি আমার আম্মার কাছ থেকে তা হলো প্রায় চৌদ্দ বছর বয়সে দাদার ব্যবসার দায়িত্ব তার হাতে পড়ে। নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলেন। বৃহত্তর সিলেটের কারমগানূর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম। ব্যবসার প্রয়োজনে সেসময় গৌহাটি, কলকাতা সহ ভারতের বড় বড় শহরে তাকে যেতে হয়েছে। জীবনের দুঃখ নিয়ে একসময় প্রয়োজনের তাগিতে তাকে সিলেট ছেড়ে চট্টগ্রামে আবাস গড়তে হয়েছে। ছিলেন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চাশের কোটায় পড়ার পূর্ব মুহুর্তেই তাকে চলে যেতে হয়েছে এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আগেই যা বলছিলাম। চট্টগ্রামের অভিবাসী হয়েও নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামে। উঠা বসা করেছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সাথে। গড়ে তুলেছেন আত্মীয়তা। প্রতিষ্ঠা করেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা। সবই ঠিক ছিল। খুবই ধর্মপরায়ণ ছিলেন বলেই ১৮ বছর পুরা হওয়ার আগেই বিয়ে দেন বড় মেয়েকে। দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হলো। চারিদিকে সংগ্রাম চলছিল। ব্যক্তিগত জীবনে পুরোদমে একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন আমার বাবা। তবে ছিলেন সামাজিক, রাজনীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না, তবে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তার বিরোধীতাও করেননি। বরঞ্চ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন। দুঃখজনক হলো একজন নির্ভেজাল মানুষের ভাগ্য এমন হবে তা কি কখনও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও বিষয়টাকে এভাবে না দেখে জবাবে বলেছেন আমি কারও ক্ষতি করি নাই। চেষ্টা করেছি উপকার করতে। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রবিন্দু লালখান বাজারে আমাদের বসবাস। একটি অনুন্নত এলাকাকে চেষ্টা করেছেন উন্নত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। এই এলাকায় কোন ইমারত ছিলনা। প্রথম দুটা ইমারত ছিল যা আমার বাবা তৈরী করেন মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য অবসর সময় ব্যয় করেছেন। তারই জন্য আত্ম বিশ্বাস ছিল কেহই তার ক্ষতি করবে না। নিয়তির যা লিখা তাই হলো, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এলাকা ছেড়ে কোথাও না গিয়ে এলাকায় রয়ে যান। হঠাৎ আমাদের পরিবারের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এটা কেউ বুঝতে পারে নাই। পরিবারের সবচাইতে দায়িত্ববান ব্যক্তির এ করুণ অবস্থা কেহ টের পায় নাই। দিনটি ছিল শুক্রবার ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল। সকাল ৯টায় সবাই নাস্তা করছিলাম। হঠাৎ দরজার কড়া নাড়ার শব্দ, পাশের বাড়ীর বিহারী ছেলেটা এসে উর্দুতে হাজী সাহেবকে ডাকছে। দরজা খোলার সাথে সাথে বাবা সহ আমরা দেখতে পাই তিনজন পাক আর্মি গেটের সামনে ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলেই চিৎকার করে বলে উঠে। তাড়াতাড়ি আস তোমাকে সার্কিট হাউজে আমাদের সাথে যেতে হবে। কি আর করা কোন কথা না বলে তাদের সাথে গেলেন। আমার আব্বা আর আমরা সবাই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম।
সকাল গড়িয়ে দুপুর যায়, রাত হয়। আব্বা আর ফিরে আসেন না। আমার আম্মা ছিলেন একটু সাহসী। উনি নিজে পরের দিন আমাকে নিয়ে এসপির বাংলোয় একজন ক্যাপ্টেনের কাছে গেলেন (আমাদের প্রতিবেশী এসপির বাংলো) ঐ পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন জবাবে বলল হাজীকে মেরে ফেলেছি শুনেছি। আমরা বললাম যদি মেরেও ফেলে তবুও তার দেহটা আমাদের দিয়ে দাও। দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা আমার বাবার দেহটা পর্যন্ত পাই নাই। কেউ বলল আমার আব্বার দেহ সাগরে ফেলে দিয়েছে। কেউ বলল তার দেহ পুলিশ লাইনের ফায়ারিং স্কোয়াডে দেখা গেছে পড়ে থাকতে। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য না পেয়েছি কারও সহযোগিতা না পেয়েছি সঠিক তথ্য। ১দিন, ২দিন করে করে বছরের পর বছর চলে গেলেও আমার বাবা আসলেন না। পেলাম না কোন সঠিক সংবাদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। অনেক বন্দী মুক্ত হলেও আমার বাবার মুক্তি হলনা। ধরেই নিয়েছি আমার আব্বা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রাব্বুল আলামিনের কাছে সর্বদা এই দোয়া করি হে আল্লাহ আমার বাবাকে তুমি শহীদের দরজা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করিও। আমিন।
একটা পরিবারের প্রধান ব্যক্তির যখন দুর্ঘটনাজনিত কারণে অথবা অকস্মাৎ মারা যান তবে তার কোন পরিকল্পনা ঠিক মত চলে না। আমার আব্বা সম্পদ রেখে গেছেন। কিন্তু সম্পদের সুষ্টু ব্যবহারের যে ব্যবস্থা রেখে যাওয়ার কথা তা পারেননি। আব্বার মৃত্যুর পর আমরা কঠিন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হই অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে। ঠিক মত চলছিলনা পরিবার। একের পর এক সমস্যা পরিবারের উপর আসছিল। আমার আম্মা তার ন্যূনতম যোগ্যতা দিয়ে হাল ধরেছেন। তাকে সহযোগিতা বা পরামর্শ দিয়েছেন আমার একমাত্র চাচা। চাচাও ব্যক্তিগত জীবনে পরোপকারী ছিলেন। তার নিজের ছিল অনেক সমস্যা। তার উপর স্বাধীনতার ৪/৫ বছর আগে আব্বাই তাকে এক প্রকার জোর করে চট্টগ্রামে আনান। তিনি ব্যবসায় তেমন সফলকাম হতে পারছিলেন না। নিজেই ব্যক্তিগত ভাবে ছিলেন হতাশাগ্রস্থ। তার উপর ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে পড়েন। আমার আম্মা সব সময় পরামর্শ নিয়ে আগানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা সাধারণত অপরকে দোষারোপ করি কিছু না পারলে বা বুঝলে। কিন্তু একটা বিষয় সত্য, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব যোগ্যতা বা কর্মদক্ষতা বলতে একটা কথা আছে তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। চাচার ব্যাপারে পারিবারিক কেহ কেহ বিরূপ সমালোচনা করলেও আমাদের পরিবারের দিক থেকে তাকে কখনই অসম্মান করিনি। যাক সে কথা। আমি মূল বিষয়ে আসার চেষ্টা করছি। আম্মা চেষ্টা করেছেন আমাদের স্কুলে পাঠাতে। চেষ্টা করেছেন ভাল কাপড় কিনে দিতে। একজন মা হিসাবে যতটুকু করার দায়িত্ব ছিল তিনি তার থেকে অনেক বেশী করেছেন। কারণ তিনি ছিলেন মা, তিনি ছিলেন বাবা। আগেই বলেছি বাবা সম্পদ রেখে গেছেন তার নগদ অর্থ রেখে যেতে পারেন নাই। যৎসামান্য যা ব্যাংকে ছিল তা হয়ত বছর খানেক চলত। এলাকার সম্মানী পরিবার হিসাবে ভিতরের খবর কাউকেই বলা হয়ে উঠে নাই। আমার নিউইয়র্কের পরিবারের সাথে ঘরোয়া আলাপের সময় যখন বলি বিদুৎ বিল সময়মত পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় তারা আশ্চর্য হয়ে যায়। তার পর দ্বিতীয়ত বাড়ীর সংস্কারের জন্য এবং সরকারী খাজনা দেয়ার জন্য। আমার আম্মা টাকা হাওলাত নিলে পরবর্তীতে জমির বিনিময়ে টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। উল্লেখীত সমস্যাগুলো কিছুই না। স্বাভাবিক কিন্তু পরিবারের মূল পরিচালকের অকাল প্রয়ানে এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে ছিল অনেক সমস্যার ব্যক্তিগত ভাবে আমি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে জড়িত থাকার কারণে পার্শ্ব সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পেরেছি। মেধাবী ছাত্র ছিলাম না তার পরেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়ে অকৃতকার্য হয়েছি। পরবর্তী মানবিক নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাই। ঘাত প্রতিঘাত মোকাবেলা করে সময়ের সাথে এগিয়ে যাওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাই। সম্মানের সাথে স্নাতকোত্তর সমাপনের আগেই বিদেশ যাওয়ার চেষ্টার মত্ত্ব হলেও একটি স্পন্সরের জন্য যাওয়া হয় নাই। তদানিন্তন একজন মন্ত্রীর সম্মুখীন হলেও আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠেন, আমি কেন বিদেশ যাব। দেশে ব্যবসা, বাণিজ্য করার জন্য পরামর্শ দিলেন। পরবর্তীতে এক আত্মীয়ের কাছে ব্যবসা করার জন্য টাকা চাইলেও সদউত্তর পাই নাই। সেই ভদ্রলোকের সাথে এখনও ভাল সম্পর্ক এবং পরবর্তীতে আমার আম্মার অনুরোধে অন্য আত্মীয়কে খুবই সহযোগিতা করেছেন। আমি এখন ঠিকই বুঝতে পেরেছি কেন এবং কি কারণে আমি বা আমরা ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়েছি। এখানে যদি আমার আব্বা থাকত তার হয়ত সঠিক বিষয় নিয়ে পড়তে পারতাম অথবা অপরের কাছে কিছু বলার আগে পারিবারিক সমস্যা নিয়ে পরামর্শ করতে পারতাম। তবে হয়ত আমার জন্য ভাল হত। খুব কম বয়সে পারিবারিক দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আমার আম্মার সহযোগিতায় এক এক করে এগিয়ে যাই। প্রয়োজনের তাগিদে স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করে ফলাফল বের হওয়ার আগেই একটি বেসরকারী সংস্থায় যোগদান করি। দুঃসম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের সাহায্য চাকুরীতে যোগদান করলে দীর্ঘ সময়ও কম বেতন থাকায় সেটা চালিয়ে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করে চাকুরী ছেড়ে দিই। ইতোমধ্যে অন্যদিকে চেষ্টা করতে থাকি তখন অন্য একটি বহুজাতিক সংস্থায় যোগ দেই। বিক্রয় কর্মকর্তা হিসাবে ট্রনিংকালীন সময় পুরো বিষয়টা গোপন রাখি। এমনকি পণ্য বিক্রির জন্য বন্ধুর স্টোরে গেলেও সে বুঝতে পারেনি। পরবর্তীতে যখন দায়িত্ব পাই তখন তারা জানতে পারে এবং আমার আম্মা সহ পরিবারের অন্যরা জানতে পারেন যখন প্রথম বেতনটা আম্মার হাতে দেই। উনি ঐ টাকার কিছু দান করেন আর কিছু আমাকে দিয়েছেন। ওভাবে চলার পথ শুরু। পরবর্তীতে আমেরিকা আসার পর প্রথম আয়ের পর মাস তিনেক পর আম্মাকে হজ্বে পাঠাই। জীবনের শুরুটা যেভাবে ছিল সে অবস্থা কাটিয়ে উঠলেও পারিবারিক বিড়ম্বনা থেমে থাকেনি। সিদ্ধান্তহীনতা, দূরদর্শীতা এগুলো কিছুই রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। পুথিগত জ্ঞানের বাইরে বাস্তবতা বা বাহ্যিক জ্ঞান প্রয়োজন তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই। যা বলছিলাম চাকুরী করতে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছিল তা অন্য লিখায় বলব। তবে এতটুকু বলব চাকুরী ছিল দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এম এম ইস্পাহানি। প্রথমে দায়িত্ব পাই বরিশালে। সেখানে এক বছর দায়িত্বে থাকার পর খুলনার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পাই। বাড়ী, গাড়ী সব ছিল।
আমেরিকার অপি ওয়ান লটারি ভিসা পাওয়ার পর বিষয়টা গোপন রাখি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘ সময়ের ছুটি চাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা খুব শক্ত করে ধরলে বলতে বাধ্য হই আমেরিকার ভিসা পাওয়ার কথা। প্রতি উত্তরে আমার উর্ধ্বতন কর্তা মহাদয় বললেন আপনি পদত্যাগ করুন এতে আপনি ঝামেলা মুক্ত থাকবেন এবং আমেরিকা গেলে কেউ ফিরে আসেন না। সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা তার উত্তর আজও পাই না। ব্যক্তিগতভাবে মানুষের জীবনটা রিসাইকেল হয় না তাই এর উত্তর পাই না। আমি সঠিক কিনা, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কেহ কেহ সচিব বা উর্দ্ধতন কর্মকর্তা অথবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কেহ বা অর্থকষ্টে আছেন। বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করে যাচ্ছি। আমেরিকা আসার পর এমন কোন কাজ নাই যা করিনি। ডিসওয়াসার হতে শুরু করে স্টক ব্রোকার, হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার কোথাও মনস্থির করতে পারিনি। সর্বশেষ ব্যবসায় সফলতা আসলেও সেখানে রিস্ক ফ্যাক্টর যদি সমস্যা হয় তবে পরামর্শ শোনার অভ্যাস থাকলেও কার্যকরী করতে গিয়ে হোচট খাই। আমি আমার পরিবারের সমস্যা এবং আব্বার অকাল প্রয়াণের কারণে একটু বেশি সচেতন। মুসলমান হিসাবে মহান আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস থাকলেও পাশাপাশি চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এটা বিশ্বাস করি। পরিবারের ভিতরে এবং বাইরে অনেকের সাথে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে দন্দ্ব হলেও পরবর্তীতে যখন বিষয়টা নিয়ে নিজে নিজে গবেষণা করি তখন উত্তর পেয়ে যাই। এর একটা সুন্দর উত্তর হলো প্রত্যেক ব্যক্তির সমস্যা ভিন্ন, প্রত্যেক পরিবারের সমস্যা ভিন্ন তবে পরিবারকে নিয়া পরিবারের সমস্যা সবচাইতে উত্তম। এক্ষেত্রে বুঝতে হবে পরিবারের কার সাথে কোন বিষয়টা নিয়ে আলাপ করছেন সে সেই বিষয়ে কতটুকু জ্ঞান রাখে। ভুল পরামর্শ শোনা থেকে পরামর্শ না নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। বন্ধুর পথ কঠিন তবে তাতে রয়েছে আনন্দ সুখ। অপরকে দায়ী করার চেয়ে নিজে সেটার উত্তর খুঁজে পাওয়া শ্রেষ্ঠ। একজন পিতা কখনই তার সন্তানকে ভুল পরামর্শ দিবে না তার বুঝতে হবে পিতার কর্মদক্ষতা গর্ভীরতা যোগ্যতা আমার আব্বা সব সময় আমার কাছে একজন আদর্শ ব্যক্তি। যিনি শুধু অর্থের জন্য সিলেট থেকে চট্টগ্রামে অভিবাসন হন নাই, ঠিক একই পন্থায় আমিও শুধু অর্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসি নাই। তাই শুরুতে বলেছি আজও উত্তর খুঁজে পাই না। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা যথাযথ ছিল কিনা। নিজের সন্তানদের সাথে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হলেও কোন উত্তর খুঁজে পাই না। যখন চিন্তা করি ওদের সন্তানরা বাংলাদেশ বা বাঙ্গালিত্ব অথবা মুসলমানিত্ব কতটুকু ঠিক রাখতে পারবো আমাকে এ বিষয়ে কেউ বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞান দিলে তখন হয়ত ভিন্নভাবে নিজেকে তৈরী করতাম। এদেশে এত এত সুযোগ সুবিধা তার পরেও আমার নিজের জানামতে দু তিন বন্ধুর বাবা দেশে ফিরে গেছে। সন্তানদের পরামর্শ দিয়ে গেছে কাজ কাম কর তবে স্থায়ী বসবাস চিন্তা করিও না। জানি না আমার আব্বা কি বলতেন? এ প্রশ্ন রেখে আজকের লিখা শেষ করছি।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র সাবেক সহ সভাপতি।