নিউইয়র্ক ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

জগলুল আহমেদ চৌধুরী: গুরু ও সহকর্মী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৩৭:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪
  • / ১০৭৬ বার পঠিত

পরিচিত কেউ মারা গেলে জগলুল আহমেদ চৌধুরী শোক সংবাদটি নিজেই লিখতেন। জুনিয়র কাউকে নির্দেশ দিতেন না সেটি লিখার জন্য। আমি অফিসে থাকলে অনিবার্যভাবেই তার লিখা শোক সংবাদটি আমাকেই এডিট করতে দিতেন। তার রিপোর্টে এডিট করার কিছু নেই। নির্ভুল ইংরেজি তার। শুধু হেডলাইন, ডেটলাইন ঠিক করে আমার ইনিশিয়াল দিয়ে ছেড়ে দেয়া। তার পরিচিতির আওতা ছিল ব্যাপক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও মাঝারি ও অধস্তন পর্যায়ের লোকজনও তার পরিচিত ছিল। শুধু পরিচয় নয়, তার সাথে সবার ঘনিষ্টতা ছিল। জাতীয় সংসদের কোন এলাকায় সদস্য কে এবং কোন্ দলের তা প্রায় ব্যতিক্রম ছাড়াই জানা ছিল তার। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) আমার যোগদানের অনেক আগে থেকেই তিনি বাসসের স্পেশাল করেসপন্ডেন্টা। বাসস এর ইংরেজি ভিাগের একজন  নিউজ এডিটর হিসেবে যোগ দেয়ার আগে আমি বরাবর বাংলা সাংবাদিকতা করেছি। কাজেই সেখানে যারা আমার উর্ধতন ছিলেন, তাদের প্রায় সকলের একটু অবজ্ঞার ভাব ছিল যে, আমি আদৌ সামলাতে পারবো কিনা। তাদের এ মনোভাবকে আমি আমলে নেইনি। রিপোর্ট এডিট করতে গিয়ে দেখতে পেলাম যে, বাসসের ইংরেজি রিপোর্টারদের উল্লেখযোগ্য অংশের রিপোর্টই সুলিখিত নয় এবং এডিট করাও কঠিণ নয়। অল্প সময়ের মধ্যেই বাসসের সিনিয়র রিপোর্টাররা ছাড়াও স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট জগলুল আহমেদ চৌধুরী, ইহসানুল করিম হেলাল, হামিদুজ্জামান রবি, আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, সফিকুল করিম সাবু’র আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলাম এবং তারা আমাকে তাদের রিপোর্ট এডিট করতে দিতেন।  বাসসের অভ্যন্তরীণ কিছু দ্বন্দ্বের কারণেও সিনিয়রদের অনেকেই তাদের পছন্দের নিউজ এডিটরকে দিয়ে তাদের রিপোর্ট এডিট করাতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন।
যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের মধ্যে জগলুল আহমেদ চৌধুরী ছাড়া অন্য সবার সাথে বাসসে যোগ দেয়ার আগেই আমার ঘনিষ্টতা ছিল। জগলু ভাই এর সাথে সালাম বিনিময় ছাড়া আগে তেমন কথাও হয়নি। কিন্তু অল্প দিনেই সখ্যতা হয়েছিল তার সাথে। পাকিস্তানের শেষ দিক থেকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস অফ পাকিস্তান (এপিপি)তে কাজ করেছেন মোফাখখারুল আনাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এপিপি বাসস এ রূপান্তরিত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে কেয়ারটেকার সরকারের সময় তাকে বাসসের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আমানউল্লাহ কবীরকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর আনাম ভাই তার পূর্ব অবস্থান ম্যানেজিং এডিটরের দায়িত্বে ফিরে যান। এর কিছুদিন পরই তিনি বাসস থেকে অবসর নেন। ম্যানেজিং এডিটরের পদটি শুন্য ছিল। জগলু ভাই আশা করছিলেন, তাকেই দায়িত্বটি দেয়া হবে। তার এ আশা পোষণ করাটা অমূলক ছিল না। সিনিয়রিটি ও যোগ্যতার বিচারে ওই পদে তাকে নিয়োগ দেয়াই সঙ্গত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের কবলে পড়েছে স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই এবং দিনে দিনে তা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। ছাত্রজীবনে জগলু ভাই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে ছিলেন। পরবর্তীতে সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকলেও ছাত্রজীবনে তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার যতোটুকু পরিচয় ছিল সম্ভবত সে কারণেই বিএনপি সরকারের আমলে বাসসের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে তাকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াও কঠিণ ছিল। পেশাগত যোগ্যতার মূল্যায়নের চেয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতার মূখ্য হয়ে উঠায় নিদারুণ মনোকষ্টে ছিলেন তিনি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিভাগ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং তিনি যে হলে এটাচড ছিলেন আমিও সেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম বলে আমার সাথে এক ধরণের নৈকট্য বোধ করতেন। এসএম হলের এক রিইউনিয়নে  বাসস অফিস থেকে ধানমন্ডিতে সুলতানা কামাল মহিলা ষ্টেডিয়ামে এক সাথে যাওয়া আসার পথে তিনি তার অন্তর্দহনের কথা আমার কাছে ব্যক্ত করেছিলেন।
আমানুল্লাহ কবীরের পর প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন গাজীউল হাসান খান। আমাকে পদোন্নতি দেয়া হলো ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর হিসেবে। চিফ রিপোর্টার জহুরুল আলমকে চিফ নিউজ এডিটর পদে উন্নীত করায় চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দেয়া হলো কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে কামরুলকে দু’এক মাস পরই পরিবেশ বিষয়ক সেমিনার, কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্য বিদেশে যেতে হতো। কাজের বিঘœ ঘটছিল। গাজীউল হাসান খান আমাকে ডেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। এটি আমার জন্য বিব্রতকর। কামরুল যে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান, আমি সেই ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান। তদুপরি কামরুল তখন বিদেশে। কিন্তু গাজীউল হাসান খান নাছোড়বান্দা। গাজীউল হাসান খান দায়িত্ব নেয়ার পর দীর্ঘ দুই বছর যাবত শুন্য থাকা ম্যানেজিং এডিটরের পদে নিয়োগ দিলেন হামিদুজ্জামান রবিকে। এতে জগলু ভাইয়ের কষ্টের বোঝা আরো ভারী হলো। চিফ রিপোর্টার হিসেবে আমাকে বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের প্রায় ৪০ জনের অধিক  রিপোর্টারের প্রতিদিনের দায়িত্ব বন্টন, ঢাকার বাইরে বাসসের ৬টি ব্যুরো অফিস এবং প্রতিটি জেলার সংবাদদাতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা, রিপোর্টারদের ছুটি মঞ্জুর ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন তৈরির মতো বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে হতো। প্রধান সম্পাদকের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করাও আমার দায়িত্বের অংশ ছিল।
কথা বলায় গাজীউল হাসান খানের মধ্যে কোন রাখঢাক ছিল না এবং চিফ রিপোর্টার হিসেবে আমার এখতিয়ারের বাইরেও আমাকে এখতিয়ার খাটাতে বলতেন। তিনি বলতেন, ‘জগলুকে এসাইনমেন্ট দেন না কেন? ওতো কোন কাজই করে না। আধ ঘন্টা, এক ঘন্টার অফিসে আসে, আর সারাক্ষণ ওর চোখ এমই’র (ম্যানেজিং এডিটর) রুমের দিকে। বিএনপি কি আমাকে বাসসের প্রধান করেছে জগলুকে এমই’র দায়িত্ব দিতে?’ আমি বলি, অতো সিনিয়র মানুষকে আমি কি করে এসাইনমেন্ট দেই। আপনি বললেই ভালো হয়।’ উনারও হয়তো জগলু বলা হয়নি কখনো। কারণ তার আগের প্রধান সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীরকেও দেখেছি জগলু ভাইকে শুধু জুনিয়রদের কিছু রিপোর্ট দেখে দিতে এবং দেখা হলেই দুর্বোধ্য কারণে জগলু ভাইকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন। এমনকি প্রতি সপ্তাহে দায়িত্বশীলদের যে বৈঠক হতো তাতেও কবীর ভাই তাকে ‘স্যার’ বলতেন।
২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপির ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার দিনে ও পরবর্তীতে উদ্ভুত পরিস্থিতি পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। বিএনপি আমলে বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ জলিল প্রায় প্রতিদিন তাদের নামের তালিকা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতেন অবিলম্বে নিয়োগ বাতিল করার জন্য, যার একটি কপি বাসসেও আসতো। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় বিলম্ব না করে নিয়োগগুলো বাতিল করে নামের তালিকা ফ্যাক্সে বাসসে পাঠাতো। আমাদেরকে এমএ জলিলের নিয়োগ বাতিল দাবীর তালিকা ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ বাতিল আদেশের তালিকা দু’টিই ইংরেজি অনুবাদ করে গণমাধ্যমে পাঠাতে হচ্ছিল। বাসসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে গাজীউল হাসান খানের দু’বছরের চুক্তির মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছিল। কাজেই তাকে এমএ জলিলের তালিকাভুক্ত হতে হয়নি। প্রধান সম্পাদক না থাকায় ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে রবি ভাই নিয়মিত কাজগুেেলা করে যাচ্ছিলেন। চিফ রিপোর্টার হিসেবে এ সময় আমাকে প্রচুর খাটতে হচ্ছিল। কিন্তু সকলেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মোফাখখারুল আনাম ভাই অবসরে গেলেও আমানুল্লাহ কবীর তার মেয়াদের শেষ দিকে আনাম ভাইকে ইংরেজি বিভাগে কনসালট্যান্ট হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন এবং গাজীউল হাসান খানও তার নিয়োগ নবায়ন করেন। ২০০৭ এর জানুয়ারীর এক সন্ধ্যায় আনাম ভাই, বেলাল, মনোজ কান্তি রায় আমার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। অন্যদিনের চেয়ে একটু ব্যস্তভাবে জগলু ভাই নিউজ রুমে প্রবেশ করেই আমার রুমে এসে আমার দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “মঞ্জু, এটি একটু জলদি ছেড়ে দিন। ভেরি আরজেন্ট।” প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, কোন শোক সংবাদ হবে। পড়ে দেখি বাসসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে তার নিয়োগ আদেশ। আমি উঠে হাত বাড়িয়ে তাকে কংগ্রেচুলেট করলাম। রুমে বসা সবাই বুঝে গেছেন ব্যাপারটি কি। সবাই উঠে তাকে অভিনন্দন জানালেন। তার নিয়োগের রিপোর্টটি আমি অন্য কোন রিপোর্টারকে না দিয়ে নিজেই তৈরি করলাম এবং আনাম ভাই সেটি দেখে দিলেন। ততোক্ষণে সবাই এসে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। সে রাতেই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
রাজনৈতিক সরকারের সময়ে বাসস সরকার সমর্থক সাংবাদিকদের জন্য কাজ করা অথবা না করার অনুকূল একটি প্রতিষ্ঠান এবং বিরোধী দলের সমর্থক সাংবাদিকরা সারাক্ষণ নানা শঙ্কা ও চাপের মধ্যে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের অনুপস্থিতিতে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো বাসসে। তা সত্বেও আওয়ামী লীগ সমর্থক রিপোর্টারদের কাজে যতো তৎপর ও নিষ্ঠা দেখা যাচ্ছিল, বিএনপি সমর্থক রিপোর্টারদের মধ্যে তা পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। জগলু ভাই প্রতিদিন আমাকে ডেকে বলছেন, ‘কোন ধরণের কন্ট্রোভার্সিয়াল রিপোর্ট যাতে না যায়। বি কেয়ারফুল।’ আমিও সাধ্যমতো সতর্কতার সাথে প্রতিটি রাজনৈতিক রিপোর্ট দেখি। জগলু ভাই বাসসের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পর আরেক দফা পরিবর্তন আসে। ম্যানেজিং এডিটর পদে হামিদুজ্জামান রবির নিয়োগ  তিনি মেনে নিতে পারেননি, তা উল্লেখ করেছি। তিনি রবি ভাইকে ম্যানেজিং এডিটরের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে সেখানে নিয়োগ দিলেন চিফ নিউজ এডিটর জহুর ভাইকে। তার দায়িত্ব নেয়ার সপ্তাহ দু’য়েক পর ২০০৭ সালের ২৬ জানুয়ারী আমার মেয়ের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। দিনটি ভারতের ‘রিপাবলিক ডে’ হওয়ায় ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন বড় ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সিনিয়র সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে যারা কূটনীতি কভার করেন নিশ্চিতভাবেই সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। জগলু ভাই শুধু কূটনৈতিক রিপোর্টারই ছিলেন না। সত্তরের দশকে তিনি দিল্লিতে বাসসের প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। সেজন্য ভারতীয় হাইকমিশনে তার বিশেষ মর্যাদা ছিল। আমি কার্ড দেয়ার পর জগলু ভাই তার পিএ শিরিনকে ডেকে বললেন, ক্যান্সেল অল আদার অ্যাপয়েন্টমেন্টস অন দি টুয়েন্টি সিক্সথ অফ জানুয়ারী। জাষ্ট কিপ ওয়ান অন দ্যাট ডে, ওয়েডিং রিসেপশন অফ মঞ্জু’স ডটার।” তিনি যথাসময়ে অনুষ্ঠানস্থল বিএএফ শাহীন অডিটরিয়ামে এসে শুধু দাওয়াত রক্ষা নয়, বরং আমার হয়ে কিছু তদারকিও করেছেন। আড্ডা পছন্দ করতেন জগলু ভাই এবং ভোজনবিলাসী ছিলেন। অতএব আমার মেয়ের বিয়ের রিসেপশনে আমন্ত্রিত আমার বন্ধু আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আড্ডা জমিয়ে তুলতে তার সময় লাগেনি।
সেনা সমর্থিত সরকারের কর্মকান্ড ও হম্বিতম্বিতেই বুঝা যাচ্ছিল যে, এ সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত হতে যাচ্ছে। অন্তবর্তী সময়ে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলের সমর্থক সাংবাদিকরা আমাকে চিফ রিপোর্টার হিসেবে পরবর্তী নির্বাচন দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও আমি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জগলু ভাইকে বললাম, ‘ইউ ক্যারী অন। আই অ্যাম বিহাইন্ড ইউ।’ আমি মাথা আমতা আমতা করছিলাম। তিনি আবার বরলেন, ‘ইফ ইউ রিজাইন, ইট উইল বি কনসিডারড অ্যাজ ট্যান্টামাউন্ট টু ভায়োলেশন অফ মাই অর্ডার।’ আরো কয়েকদিন পর আমি চিফ রিপোর্টাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। দিন তিনেক পর জগলু ভাই ডাকলেন। তার রুমে এপি’র ব্যুরো চিফ ফরিদ ভাই। জগলু ভাই বললেন, ‘আই বিলং নেইদার টু আওয়ামী লীগ নর টু বিএনপি এন্ড আই বিলিভ ইউ ডু নট হ্যাভ এনি প্রবলেম ওয়ার্কিং উইথ মি। ইফ ইউ ডু নট উইথড্র ইওর রেসিগনেশন লেটার, দ্যান আই হ্যাভ টু অ্যাকসেপ্ট ইট। বাট বিফোর দ্যাট, সাজেষ্ট মি, হু শ্যাল বি ইওর সাকসেসর?’ কাউকে প্রেফারেন্স দিয়ে নাম বলাটা সঠিক বিবেচনা করলাম না। জগলু ভাই নিজেই আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও সফিকুল করিম সাবুর মধ্যে কাকে চিফ রিপোর্টার করা ঠিক হবে, নিজেই ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর বিইং উইথ মি এন্ড কোঅপারেট মি ইন মাই ব্যাটল এগেনইষ্ট দি টাইড। ইউ উইল গেট অ্যান এপ্রিসিয়েশন লেটার ফ্রম ওর চিফ এডিটর এন্ড আই থিঙ্ক ইউ ডিজার্ভ ইট।’
চিফ রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ পেলেন আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া। আমি আমার আগের অবস্থানে ফিরে গেলাম। চিফ নিউজ এডিটর পদে নিয়োগ দেয়া হলো সফিকুল করিম সাবুকে। প্রধান সম্পাদক হিসেবে জগলু ভাইয়ের দায়িত্ব পালনকালে বাসসে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছিল। ডিপ্লোমেটিক সার্কেলে তার ব্যাপক পরিচিতির কারণে  অতিথি হিসেবে বাসসে কূটনীতিকদের পদচারণা বেড়ে গিয়েছিল। তাদের সাথে সাংবাদিকদের মতবিনিময়েরও আয়োজন করতেন তিনি। চীনের রাষ্ট্রদূত চাই শি ও চীনা দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, ষ্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণরত বিভিন্ন দেশের সামরিক প্রতিনিধি, ইউএনডিপি’র প্রতিনিধিদলের সাথে মতবিনিময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম।  জগলু ভাই আরেকটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটান। তিনি দলনিরপেক্ষ ছিলেন বলে বাসসে ইতিপূর্বে প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জীবিত সকলকে সংবর্ধনা দেন ও ভোজে আপ্যায়িত করেন। আমি জানতাম সকল ক্ষেত্রের উপরের মহলে তার পরিচিতি সত্বেও তিনি কারো জন্য তদবির করেন না। আমার ছেলে মেধাবী, কিন্তু প্রচন্ড জেদী, অগোছালো। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করলো। অন্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে বললাম। কিন্তু নর্থ সাউথ ছাড়া সে পড়বে না। পরের সেমিষ্টারের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললাম। তাতেও সে রাজী নয়। এবার ভর্তি না হলে সে আর পড়বেই না। জগলু ভাইকে বললাম। উনি অপারেটরকে বললেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদকে কানেক্ট করতে। তারা পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ট। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি প্রয়োজনের কথা বললেন এবং বেনজীর আহমেদ আমার ছেলেকে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বললেন। আমার ছেলে এভাবে যথাসময়ে নর্থ সাউথে ভর্তি হয়ে বিবিএ শেষ করে।
বাসসের সাপ্তাহিক বৈঠকগুলোতে নিউজের কোয়ালিটি, নাম্বার এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় কভারেজ ছাড়া নিউজ এডমিনিষ্ট্রেশন ও কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্টের বিষয় প্রাধান্য পেত। একদিনের বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিস। সেখানে জনশক্তির মধ্যে ছিল একজন পার্ট টাইমারসহ চারজন সাংবাদিক, দু’জন অপারেটর, একজন টেকনিশিয়ান, একজন হিসাবরক্ষক ও দু’জন পিয়ন। অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় রুম ছাড়াও একটি বা দু’টি অতিরিক্ত রুম ছিল। এক রুমে একটি বিছানাও ছিল। অফিসের সার্বিক উন্নয়নের সাথে অতিরিক্ত রমে আসবাবপত্র, বিছানা, পর্দা ইত্যাদির চাহিদা জানিয়ে ব্যুরো অফিস থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, যাতে ঢাকা থেকে কেউ গেলে হোটেল বা রেষ্ট হাউজে থাকার চেয়ে অফিসেই থাকতে পারেন। আগের বৈঠকে এ নিয়ে কিছু আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি। সেদিনের বৈঠকে জগলু ভাইকে একটু উত্তেজিত মনে হলো। জগলু ভাই তার পরিচিত শিক্ষিতজনদের সাথে বাংলায় কমই কথা বলতেন। উত্তেজিত হলে ইংরেজি ছাড়া কিছুই বলতেন না। ঢাকায় সাংবাদিকদের মধ্যে তার মতো অনর্গল শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলার দ্বিতীয় কাউকে পাইনি। তিনি বললেন যে, চট্টগ্রাম অফিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে হবে। কারণ সেখান থেকে একজন চিঠি দিয়ে সেখানে নারীঘটিত কিছু ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ গুরুতর। তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি নিজেই তদন্ত কমিটির নাম প্রস্তাব করলেন। কিন্তু বৈঠকে উপস্থিত অধিকাংশই স্বয়ং জগলু ভাইকে চট্টগ্রাম গিয়ে ঘটনা তদন্তের জন্য বললেন, যাতে কোন পক্ষ থেকে তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠে। তিনি সম্মত হয়ে বললেন, ‘ইয়েস, আই উইল ডেফিনিটলি গো। বাট আই নীড সামওয়ান টু একম্প্যানি মি। ইফ ইউ ডু নট হ্যাভ এনি রিজার্ভেশন এবাউট মঞ্জু, হি উইল হেলপ মি ইন দি এনকোয়ারি।’
সিদ্ধান্ত হলো, তদন্তে আমি তাকে সহযোগিতা করবো। চট্টগ্রাম অফিসকে জানিয়ে দেয়া হলো। জেনারেল ম্যানেজারকে ডেকে তিনি অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে নির্দেশ দিলেন, ‘উই উইল ট্রাভেল বাই ট্রেন। আই নো, আই অ্যাম এনটাইটেলড টু ট্রাভেল বাই প্লেন অ্যাট গভর্নমেন্ট’স এক্সপেন্স। বাট আই ডেন্ট ওয়ান্ট মঞ্জু টু ফিল এবানডোনড।’ নির্দিষ্ট দিনে সকালে আমরা কমলাপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। এয়ারপোর্ট ষ্টেশন থেকে আমাদের কম্পার্টমেন্টে জনাদশেক নারীপুরুষ উঠলেন। তাদের বেশ ক’জন জগলু ভাইয়ের পরিচিত। একজনের সাথে বেশী আন্তরিক। ‘তুমি’ সম্পর্ক তাদের। সিট থেকে উঠে তিনি তাদের সিটের দিকে এগিয়ে গেলেন। দীর্ঘক্ষণ উচ্চকন্ঠে কথা বলে ফিরে এসে বললেন, ‘ডু ইউ নো, হু দ্য ওম্যান ওয়াজ?’ আমি না বলায় তিনি বললেন, ‘রাফিয়া আক্তার ডলি, প্রমিনেন্ট ষ্টুডেন্ট লিডার অফ দি সিক্সটিজ।’ চট্টগ্রাম যাচ্ছেন কোন আত্মীয়ের বিয়েতে। ডলি নামটা ভালোভাবে জানি। ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুখোড় নেত্রী ছিলেন। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন তার নামে শ্লোগান দিতো, ‘তোমার আমার ঠিকানা, ডলি আপার বিছানা।’ সত্তর সালে একবার দেখেছিলাম বক্তৃতা দিতে। বেশ সুন্দরী ছিলেন। এখন মুটিয়ে গেছেন। ছয় ঘন্টার জার্নিতে জগলু ভাইয়ের সাথে অনেক কথা হলো। সুখ দু:খ ও আনন্দের কথা। তিনি কাজে ব্যস্ত না থাকলে গুনগুন করতেন। অফিসে বা প্রেস ক্লাবে প্রবেশের পথে তার কন্ঠে কোন না কোন গানের সুর থাকতোই। রবীন্দ্র সঙ্গীতের দারুণ ভক্ত। ট্রেনে অনেকগুলো গান গাইলেন। ষ্টেশনে ভারপ্রাপ্ত ব্যুরো চিফ শাহনেওয়াজ ও রিপোর্টার কাশেম মাহমুদ ছিলেন। ষ্টেশন থেকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গিয়ে রেষ্ট নিয়ে বাসস ব্যুরো অফিসে গেলাম। জগলু ভাই আগেই আমাকে বলেছিলেন যে, প্রত্যেককে জেরা করার এবং তদন্ত রিপোর্ট লিখার কাজ আমাকেই করতে হবে। অফিসে সবাইকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমি প্রত্যেককে একান্তে ডেকে জেরা করে নোট নিলাম। দেখা গেল অভিযোগ সত্য। অফিস শেষ হওয়ার পর সেখানে দুই তরুণীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তবে এর সাথে সাংবাদিকদের সং¯্রব ছিল না। কিন্তু বাসসের মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অফিসে এধরণের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য অতিরিক্ত রুমগুলো পুনরায় সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তালাবন্ধ করে রাখার নির্দেশ দিলেন জগলু ভাই। জগলু ভাই সার্কিট হাউজে উঠেছেন তা সেখানে গেষ্টদের মধ্যে রটে গেছে। আমরা অফিস থেকে ফিরে আসার পর দেখা গেল অনেকে তার সাথে দেখা করতে অপেক্ষা করছেন। তিনি সবার সাথে কথা বললেন। রাতে ডিনারের সময় সার্কিট হাউজের অনেক আমলা গেষ্ট তার সাথে বসলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন। পরদিন আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। যথাসময়ে আমি তদন্ত রিপোর্ট তার কাছে জমা দিলাম। তিনি তার পর্যবেক্ষণ যোগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
গুজরাট ভিত্তিক অল ইন্ডিয়া ডিজাষ্টার ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের এক ওয়ার্কশপে অংশ নিতে ২০০৮ সালের আগষ্ট মাসে চেন্নাই যাওয়ার জন্য ছুটি চাইলাম। জগলু ভাই বললেন, ‘ব্রিং তাজমহল টি ফর মি। মাই ফেভারিট। দিল্লিতে থাকতে একটা ব্র্যান্ডের চা-ই খেতাম, তাজমহল।’ আমি এনেছিলাম। খুব খুশী হয়েছিলেন জগলু ভাই। ২০০৯ সালের এপ্রিলে ওই একই ইন্সটিটিউটের এক প্রোগ্রামে আবারও আমাকে চেন্নাই যেতে হয় এবং আগষ্টে পন্ডিচেরিতে। আমি দু’বারই তার জন্য তাজমহল টি এনেছিলাম। কিন্তু তখন তিনি আর বাসস এ ছিলেন না। ২০০৮ এর ডিসেম্বরে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ২০০৯ এর জানুয়ারীতে সরকার গঠণ করার পর প্রধান সম্পাদক হিসেবে তার নিয়োগ বাতিল হয়। নতুন প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ইহসানুল করিম হেলালকে। জগলু ভাই বাসস থেকে পদত্যাগ করে বসুন্ধরা গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক দি সান এ যোগ দেন। দৈনিকটি তখনো প্রকাশিত হয়নি। প্রস্ততি চলছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জগলু ভাই এবং বাসস থেকে পদত্যাগ করে দি সান যোগ দেয়া সাংবাদিক নেতা এমএ আজিজসহ বেশ ক’জন সিনিয়র সাংবাদিক দি সান থেকে চলে আসেন। এরপর জগলু ভাই আর কোথাও স্থায়ী চাকুরিতে যোগ দেননি। লিখছিলেন নিয়মিত এবং টিভি টক শোতে নিয়মিত অংশ নি্িচ্ছলেন। ২০০৯ এর আগষ্ট মাসে আমার স্ত্রী ও মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসায় ঢাকায় আমার ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল। ২০১০ সালে আমাকে একাধিবার যুক্তরাষ্ট্রে আসতে হয়। এর ফলে আমি ঢাকায় অবস্থানের শেষ দিনগুলোতে জগলু ভাইয়ের সাথে তেমন দেখা হয়নি। তার অপঘাত মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছে।
জগলুল আহমেদ চৌধুরী এক আলোকিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার পিতা নাসিরউদ্দিন চৌধুরী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক আইন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি নেজামে ইসলামের নেতা এবং অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দালাল আইনে নাসিরউদ্দিন চৌধুরীকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি মুক্তি লাভ করেন। পিতার রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীত অবস্থান ছিল জগলু ভাইয়ের। কিন্তু আদর্শের বৈপরীত্য সত্বেও পিতার প্রতি কখনো অশ্রদ্ধা পোষণ করেননি। আমি যখন বাংলাবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলাম তখন পত্রিকাটির মালিক সম্পাদক জাকারিয়া খানের কাছে নিয়মিত আসতেন জগলু ভাই এবং নিয়মিত লিখতেন। জগলু ভাই জাকারিয়া খানের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। একদিন জগলু ভাই সম্পর্কে কথা উঠতেই বাবার প্রতি জগলু ভাইয়ের দুর্বলতা সম্পর্কে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জগলু ওর আব্বাকে নিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। কখন কি অঘটন ঘটে। আমাকে ফোন করে বললো, আব্বাকে কোথায় রাখি। আমরা আরো কয়েক বন্ধুর সাথে আলোচনা করে ঠিক করলাম, জেলখানাই তার জন্য নিরাপদ। শেষে এক সন্ধ্যায় তাকে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রেখে এলাম।” জগলু ভাইয়ের শ্বশুর হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীও মুসলিম লীগের খ্যাতিমান নেতা, বেঙ্গল রেজিসলেটিভ এসেম্বলির সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক মন্ত্রী সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলেন। জগলু ভাই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সক্রিয় থাকলেও পরবর্তীতে কোন দলমতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পোষণ করেননি বলেই আমার মনে হয়েছে। কারো সাথে তাকে কখনো রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িত হতে দেখিনি। সকল দলের লোকজনই তাকে ভালোবাসতো সাংবাদিক হিসেবে পেশার প্রতি তার নিষ্ঠা ও তার সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতার কারণে। তিনি আজ নেই। তার স্মৃতি দীর্ঘদিন আমাকে আপ্লুত রাখবে। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। (সাপ্তাহিক বাংলাদেশ)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

জগলুল আহমেদ চৌধুরী: গুরু ও সহকর্মী

প্রকাশের সময় : ০১:৩৭:০৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

পরিচিত কেউ মারা গেলে জগলুল আহমেদ চৌধুরী শোক সংবাদটি নিজেই লিখতেন। জুনিয়র কাউকে নির্দেশ দিতেন না সেটি লিখার জন্য। আমি অফিসে থাকলে অনিবার্যভাবেই তার লিখা শোক সংবাদটি আমাকেই এডিট করতে দিতেন। তার রিপোর্টে এডিট করার কিছু নেই। নির্ভুল ইংরেজি তার। শুধু হেডলাইন, ডেটলাইন ঠিক করে আমার ইনিশিয়াল দিয়ে ছেড়ে দেয়া। তার পরিচিতির আওতা ছিল ব্যাপক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও মাঝারি ও অধস্তন পর্যায়ের লোকজনও তার পরিচিত ছিল। শুধু পরিচয় নয়, তার সাথে সবার ঘনিষ্টতা ছিল। জাতীয় সংসদের কোন এলাকায় সদস্য কে এবং কোন্ দলের তা প্রায় ব্যতিক্রম ছাড়াই জানা ছিল তার। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) আমার যোগদানের অনেক আগে থেকেই তিনি বাসসের স্পেশাল করেসপন্ডেন্টা। বাসস এর ইংরেজি ভিাগের একজন  নিউজ এডিটর হিসেবে যোগ দেয়ার আগে আমি বরাবর বাংলা সাংবাদিকতা করেছি। কাজেই সেখানে যারা আমার উর্ধতন ছিলেন, তাদের প্রায় সকলের একটু অবজ্ঞার ভাব ছিল যে, আমি আদৌ সামলাতে পারবো কিনা। তাদের এ মনোভাবকে আমি আমলে নেইনি। রিপোর্ট এডিট করতে গিয়ে দেখতে পেলাম যে, বাসসের ইংরেজি রিপোর্টারদের উল্লেখযোগ্য অংশের রিপোর্টই সুলিখিত নয় এবং এডিট করাও কঠিণ নয়। অল্প সময়ের মধ্যেই বাসসের সিনিয়র রিপোর্টাররা ছাড়াও স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট জগলুল আহমেদ চৌধুরী, ইহসানুল করিম হেলাল, হামিদুজ্জামান রবি, আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, সফিকুল করিম সাবু’র আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলাম এবং তারা আমাকে তাদের রিপোর্ট এডিট করতে দিতেন।  বাসসের অভ্যন্তরীণ কিছু দ্বন্দ্বের কারণেও সিনিয়রদের অনেকেই তাদের পছন্দের নিউজ এডিটরকে দিয়ে তাদের রিপোর্ট এডিট করাতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন।
যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের মধ্যে জগলুল আহমেদ চৌধুরী ছাড়া অন্য সবার সাথে বাসসে যোগ দেয়ার আগেই আমার ঘনিষ্টতা ছিল। জগলু ভাই এর সাথে সালাম বিনিময় ছাড়া আগে তেমন কথাও হয়নি। কিন্তু অল্প দিনেই সখ্যতা হয়েছিল তার সাথে। পাকিস্তানের শেষ দিক থেকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস অফ পাকিস্তান (এপিপি)তে কাজ করেছেন মোফাখখারুল আনাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এপিপি বাসস এ রূপান্তরিত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে কেয়ারটেকার সরকারের সময় তাকে বাসসের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আমানউল্লাহ কবীরকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর আনাম ভাই তার পূর্ব অবস্থান ম্যানেজিং এডিটরের দায়িত্বে ফিরে যান। এর কিছুদিন পরই তিনি বাসস থেকে অবসর নেন। ম্যানেজিং এডিটরের পদটি শুন্য ছিল। জগলু ভাই আশা করছিলেন, তাকেই দায়িত্বটি দেয়া হবে। তার এ আশা পোষণ করাটা অমূলক ছিল না। সিনিয়রিটি ও যোগ্যতার বিচারে ওই পদে তাকে নিয়োগ দেয়াই সঙ্গত ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের কবলে পড়েছে স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকেই এবং দিনে দিনে তা আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। ছাত্রজীবনে জগলু ভাই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে ছিলেন। পরবর্তীতে সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকলেও ছাত্রজীবনে তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার যতোটুকু পরিচয় ছিল সম্ভবত সে কারণেই বিএনপি সরকারের আমলে বাসসের দ্বিতীয় শীর্ষ পদে তাকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াও কঠিণ ছিল। পেশাগত যোগ্যতার মূল্যায়নের চেয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতার মূখ্য হয়ে উঠায় নিদারুণ মনোকষ্টে ছিলেন তিনি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিভাগ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং তিনি যে হলে এটাচড ছিলেন আমিও সেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম বলে আমার সাথে এক ধরণের নৈকট্য বোধ করতেন। এসএম হলের এক রিইউনিয়নে  বাসস অফিস থেকে ধানমন্ডিতে সুলতানা কামাল মহিলা ষ্টেডিয়ামে এক সাথে যাওয়া আসার পথে তিনি তার অন্তর্দহনের কথা আমার কাছে ব্যক্ত করেছিলেন।
আমানুল্লাহ কবীরের পর প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন গাজীউল হাসান খান। আমাকে পদোন্নতি দেয়া হলো ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর হিসেবে। চিফ রিপোর্টার জহুরুল আলমকে চিফ নিউজ এডিটর পদে উন্নীত করায় চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দেয়া হলো কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে কামরুলকে দু’এক মাস পরই পরিবেশ বিষয়ক সেমিনার, কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্য বিদেশে যেতে হতো। কাজের বিঘœ ঘটছিল। গাজীউল হাসান খান আমাকে ডেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। এটি আমার জন্য বিব্রতকর। কামরুল যে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান, আমি সেই ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান। তদুপরি কামরুল তখন বিদেশে। কিন্তু গাজীউল হাসান খান নাছোড়বান্দা। গাজীউল হাসান খান দায়িত্ব নেয়ার পর দীর্ঘ দুই বছর যাবত শুন্য থাকা ম্যানেজিং এডিটরের পদে নিয়োগ দিলেন হামিদুজ্জামান রবিকে। এতে জগলু ভাইয়ের কষ্টের বোঝা আরো ভারী হলো। চিফ রিপোর্টার হিসেবে আমাকে বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের প্রায় ৪০ জনের অধিক  রিপোর্টারের প্রতিদিনের দায়িত্ব বন্টন, ঢাকার বাইরে বাসসের ৬টি ব্যুরো অফিস এবং প্রতিটি জেলার সংবাদদাতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা, রিপোর্টারদের ছুটি মঞ্জুর ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন তৈরির মতো বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে হতো। প্রধান সম্পাদকের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করাও আমার দায়িত্বের অংশ ছিল।
কথা বলায় গাজীউল হাসান খানের মধ্যে কোন রাখঢাক ছিল না এবং চিফ রিপোর্টার হিসেবে আমার এখতিয়ারের বাইরেও আমাকে এখতিয়ার খাটাতে বলতেন। তিনি বলতেন, ‘জগলুকে এসাইনমেন্ট দেন না কেন? ওতো কোন কাজই করে না। আধ ঘন্টা, এক ঘন্টার অফিসে আসে, আর সারাক্ষণ ওর চোখ এমই’র (ম্যানেজিং এডিটর) রুমের দিকে। বিএনপি কি আমাকে বাসসের প্রধান করেছে জগলুকে এমই’র দায়িত্ব দিতে?’ আমি বলি, অতো সিনিয়র মানুষকে আমি কি করে এসাইনমেন্ট দেই। আপনি বললেই ভালো হয়।’ উনারও হয়তো জগলু বলা হয়নি কখনো। কারণ তার আগের প্রধান সম্পাদক আমানুল্লাহ কবীরকেও দেখেছি জগলু ভাইকে শুধু জুনিয়রদের কিছু রিপোর্ট দেখে দিতে এবং দেখা হলেই দুর্বোধ্য কারণে জগলু ভাইকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন। এমনকি প্রতি সপ্তাহে দায়িত্বশীলদের যে বৈঠক হতো তাতেও কবীর ভাই তাকে ‘স্যার’ বলতেন।
২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপির ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার দিনে ও পরবর্তীতে উদ্ভুত পরিস্থিতি পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। বিএনপি আমলে বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ জলিল প্রায় প্রতিদিন তাদের নামের তালিকা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতেন অবিলম্বে নিয়োগ বাতিল করার জন্য, যার একটি কপি বাসসেও আসতো। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় বিলম্ব না করে নিয়োগগুলো বাতিল করে নামের তালিকা ফ্যাক্সে বাসসে পাঠাতো। আমাদেরকে এমএ জলিলের নিয়োগ বাতিল দাবীর তালিকা ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ বাতিল আদেশের তালিকা দু’টিই ইংরেজি অনুবাদ করে গণমাধ্যমে পাঠাতে হচ্ছিল। বাসসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে গাজীউল হাসান খানের দু’বছরের চুক্তির মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছিল। কাজেই তাকে এমএ জলিলের তালিকাভুক্ত হতে হয়নি। প্রধান সম্পাদক না থাকায় ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে রবি ভাই নিয়মিত কাজগুেেলা করে যাচ্ছিলেন। চিফ রিপোর্টার হিসেবে এ সময় আমাকে প্রচুর খাটতে হচ্ছিল। কিন্তু সকলেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মোফাখখারুল আনাম ভাই অবসরে গেলেও আমানুল্লাহ কবীর তার মেয়াদের শেষ দিকে আনাম ভাইকে ইংরেজি বিভাগে কনসালট্যান্ট হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন এবং গাজীউল হাসান খানও তার নিয়োগ নবায়ন করেন। ২০০৭ এর জানুয়ারীর এক সন্ধ্যায় আনাম ভাই, বেলাল, মনোজ কান্তি রায় আমার রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। অন্যদিনের চেয়ে একটু ব্যস্তভাবে জগলু ভাই নিউজ রুমে প্রবেশ করেই আমার রুমে এসে আমার দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “মঞ্জু, এটি একটু জলদি ছেড়ে দিন। ভেরি আরজেন্ট।” প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, কোন শোক সংবাদ হবে। পড়ে দেখি বাসসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে তার নিয়োগ আদেশ। আমি উঠে হাত বাড়িয়ে তাকে কংগ্রেচুলেট করলাম। রুমে বসা সবাই বুঝে গেছেন ব্যাপারটি কি। সবাই উঠে তাকে অভিনন্দন জানালেন। তার নিয়োগের রিপোর্টটি আমি অন্য কোন রিপোর্টারকে না দিয়ে নিজেই তৈরি করলাম এবং আনাম ভাই সেটি দেখে দিলেন। ততোক্ষণে সবাই এসে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। সে রাতেই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
রাজনৈতিক সরকারের সময়ে বাসস সরকার সমর্থক সাংবাদিকদের জন্য কাজ করা অথবা না করার অনুকূল একটি প্রতিষ্ঠান এবং বিরোধী দলের সমর্থক সাংবাদিকরা সারাক্ষণ নানা শঙ্কা ও চাপের মধ্যে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের অনুপস্থিতিতে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো বাসসে। তা সত্বেও আওয়ামী লীগ সমর্থক রিপোর্টারদের কাজে যতো তৎপর ও নিষ্ঠা দেখা যাচ্ছিল, বিএনপি সমর্থক রিপোর্টারদের মধ্যে তা পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। জগলু ভাই প্রতিদিন আমাকে ডেকে বলছেন, ‘কোন ধরণের কন্ট্রোভার্সিয়াল রিপোর্ট যাতে না যায়। বি কেয়ারফুল।’ আমিও সাধ্যমতো সতর্কতার সাথে প্রতিটি রাজনৈতিক রিপোর্ট দেখি। জগলু ভাই বাসসের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পর আরেক দফা পরিবর্তন আসে। ম্যানেজিং এডিটর পদে হামিদুজ্জামান রবির নিয়োগ  তিনি মেনে নিতে পারেননি, তা উল্লেখ করেছি। তিনি রবি ভাইকে ম্যানেজিং এডিটরের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে সেখানে নিয়োগ দিলেন চিফ নিউজ এডিটর জহুর ভাইকে। তার দায়িত্ব নেয়ার সপ্তাহ দু’য়েক পর ২০০৭ সালের ২৬ জানুয়ারী আমার মেয়ের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। দিনটি ভারতের ‘রিপাবলিক ডে’ হওয়ায় ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন বড় ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সিনিয়র সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে যারা কূটনীতি কভার করেন নিশ্চিতভাবেই সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। জগলু ভাই শুধু কূটনৈতিক রিপোর্টারই ছিলেন না। সত্তরের দশকে তিনি দিল্লিতে বাসসের প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। সেজন্য ভারতীয় হাইকমিশনে তার বিশেষ মর্যাদা ছিল। আমি কার্ড দেয়ার পর জগলু ভাই তার পিএ শিরিনকে ডেকে বললেন, ক্যান্সেল অল আদার অ্যাপয়েন্টমেন্টস অন দি টুয়েন্টি সিক্সথ অফ জানুয়ারী। জাষ্ট কিপ ওয়ান অন দ্যাট ডে, ওয়েডিং রিসেপশন অফ মঞ্জু’স ডটার।” তিনি যথাসময়ে অনুষ্ঠানস্থল বিএএফ শাহীন অডিটরিয়ামে এসে শুধু দাওয়াত রক্ষা নয়, বরং আমার হয়ে কিছু তদারকিও করেছেন। আড্ডা পছন্দ করতেন জগলু ভাই এবং ভোজনবিলাসী ছিলেন। অতএব আমার মেয়ের বিয়ের রিসেপশনে আমন্ত্রিত আমার বন্ধু আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আড্ডা জমিয়ে তুলতে তার সময় লাগেনি।
সেনা সমর্থিত সরকারের কর্মকান্ড ও হম্বিতম্বিতেই বুঝা যাচ্ছিল যে, এ সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত হতে যাচ্ছে। অন্তবর্তী সময়ে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলের সমর্থক সাংবাদিকরা আমাকে চিফ রিপোর্টার হিসেবে পরবর্তী নির্বাচন দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও আমি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জগলু ভাইকে বললাম, ‘ইউ ক্যারী অন। আই অ্যাম বিহাইন্ড ইউ।’ আমি মাথা আমতা আমতা করছিলাম। তিনি আবার বরলেন, ‘ইফ ইউ রিজাইন, ইট উইল বি কনসিডারড অ্যাজ ট্যান্টামাউন্ট টু ভায়োলেশন অফ মাই অর্ডার।’ আরো কয়েকদিন পর আমি চিফ রিপোর্টাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। দিন তিনেক পর জগলু ভাই ডাকলেন। তার রুমে এপি’র ব্যুরো চিফ ফরিদ ভাই। জগলু ভাই বললেন, ‘আই বিলং নেইদার টু আওয়ামী লীগ নর টু বিএনপি এন্ড আই বিলিভ ইউ ডু নট হ্যাভ এনি প্রবলেম ওয়ার্কিং উইথ মি। ইফ ইউ ডু নট উইথড্র ইওর রেসিগনেশন লেটার, দ্যান আই হ্যাভ টু অ্যাকসেপ্ট ইট। বাট বিফোর দ্যাট, সাজেষ্ট মি, হু শ্যাল বি ইওর সাকসেসর?’ কাউকে প্রেফারেন্স দিয়ে নাম বলাটা সঠিক বিবেচনা করলাম না। জগলু ভাই নিজেই আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও সফিকুল করিম সাবুর মধ্যে কাকে চিফ রিপোর্টার করা ঠিক হবে, নিজেই ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর বিইং উইথ মি এন্ড কোঅপারেট মি ইন মাই ব্যাটল এগেনইষ্ট দি টাইড। ইউ উইল গেট অ্যান এপ্রিসিয়েশন লেটার ফ্রম ওর চিফ এডিটর এন্ড আই থিঙ্ক ইউ ডিজার্ভ ইট।’
চিফ রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ পেলেন আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া। আমি আমার আগের অবস্থানে ফিরে গেলাম। চিফ নিউজ এডিটর পদে নিয়োগ দেয়া হলো সফিকুল করিম সাবুকে। প্রধান সম্পাদক হিসেবে জগলু ভাইয়ের দায়িত্ব পালনকালে বাসসে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছিল। ডিপ্লোমেটিক সার্কেলে তার ব্যাপক পরিচিতির কারণে  অতিথি হিসেবে বাসসে কূটনীতিকদের পদচারণা বেড়ে গিয়েছিল। তাদের সাথে সাংবাদিকদের মতবিনিময়েরও আয়োজন করতেন তিনি। চীনের রাষ্ট্রদূত চাই শি ও চীনা দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, ষ্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণরত বিভিন্ন দেশের সামরিক প্রতিনিধি, ইউএনডিপি’র প্রতিনিধিদলের সাথে মতবিনিময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম।  জগলু ভাই আরেকটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটান। তিনি দলনিরপেক্ষ ছিলেন বলে বাসসে ইতিপূর্বে প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জীবিত সকলকে সংবর্ধনা দেন ও ভোজে আপ্যায়িত করেন। আমি জানতাম সকল ক্ষেত্রের উপরের মহলে তার পরিচিতি সত্বেও তিনি কারো জন্য তদবির করেন না। আমার ছেলে মেধাবী, কিন্তু প্রচন্ড জেদী, অগোছালো। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করলো। অন্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে বললাম। কিন্তু নর্থ সাউথ ছাড়া সে পড়বে না। পরের সেমিষ্টারের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললাম। তাতেও সে রাজী নয়। এবার ভর্তি না হলে সে আর পড়বেই না। জগলু ভাইকে বললাম। উনি অপারেটরকে বললেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদকে কানেক্ট করতে। তারা পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ট। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি প্রয়োজনের কথা বললেন এবং বেনজীর আহমেদ আমার ছেলেকে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বললেন। আমার ছেলে এভাবে যথাসময়ে নর্থ সাউথে ভর্তি হয়ে বিবিএ শেষ করে।
বাসসের সাপ্তাহিক বৈঠকগুলোতে নিউজের কোয়ালিটি, নাম্বার এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় কভারেজ ছাড়া নিউজ এডমিনিষ্ট্রেশন ও কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্টের বিষয় প্রাধান্য পেত। একদিনের বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিস। সেখানে জনশক্তির মধ্যে ছিল একজন পার্ট টাইমারসহ চারজন সাংবাদিক, দু’জন অপারেটর, একজন টেকনিশিয়ান, একজন হিসাবরক্ষক ও দু’জন পিয়ন। অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় রুম ছাড়াও একটি বা দু’টি অতিরিক্ত রুম ছিল। এক রুমে একটি বিছানাও ছিল। অফিসের সার্বিক উন্নয়নের সাথে অতিরিক্ত রমে আসবাবপত্র, বিছানা, পর্দা ইত্যাদির চাহিদা জানিয়ে ব্যুরো অফিস থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, যাতে ঢাকা থেকে কেউ গেলে হোটেল বা রেষ্ট হাউজে থাকার চেয়ে অফিসেই থাকতে পারেন। আগের বৈঠকে এ নিয়ে কিছু আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি। সেদিনের বৈঠকে জগলু ভাইকে একটু উত্তেজিত মনে হলো। জগলু ভাই তার পরিচিত শিক্ষিতজনদের সাথে বাংলায় কমই কথা বলতেন। উত্তেজিত হলে ইংরেজি ছাড়া কিছুই বলতেন না। ঢাকায় সাংবাদিকদের মধ্যে তার মতো অনর্গল শুদ্ধ ইংরেজিতে কথা বলার দ্বিতীয় কাউকে পাইনি। তিনি বললেন যে, চট্টগ্রাম অফিসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে হবে। কারণ সেখান থেকে একজন চিঠি দিয়ে সেখানে নারীঘটিত কিছু ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ গুরুতর। তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি নিজেই তদন্ত কমিটির নাম প্রস্তাব করলেন। কিন্তু বৈঠকে উপস্থিত অধিকাংশই স্বয়ং জগলু ভাইকে চট্টগ্রাম গিয়ে ঘটনা তদন্তের জন্য বললেন, যাতে কোন পক্ষ থেকে তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠে। তিনি সম্মত হয়ে বললেন, ‘ইয়েস, আই উইল ডেফিনিটলি গো। বাট আই নীড সামওয়ান টু একম্প্যানি মি। ইফ ইউ ডু নট হ্যাভ এনি রিজার্ভেশন এবাউট মঞ্জু, হি উইল হেলপ মি ইন দি এনকোয়ারি।’
সিদ্ধান্ত হলো, তদন্তে আমি তাকে সহযোগিতা করবো। চট্টগ্রাম অফিসকে জানিয়ে দেয়া হলো। জেনারেল ম্যানেজারকে ডেকে তিনি অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে নির্দেশ দিলেন, ‘উই উইল ট্রাভেল বাই ট্রেন। আই নো, আই অ্যাম এনটাইটেলড টু ট্রাভেল বাই প্লেন অ্যাট গভর্নমেন্ট’স এক্সপেন্স। বাট আই ডেন্ট ওয়ান্ট মঞ্জু টু ফিল এবানডোনড।’ নির্দিষ্ট দিনে সকালে আমরা কমলাপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। এয়ারপোর্ট ষ্টেশন থেকে আমাদের কম্পার্টমেন্টে জনাদশেক নারীপুরুষ উঠলেন। তাদের বেশ ক’জন জগলু ভাইয়ের পরিচিত। একজনের সাথে বেশী আন্তরিক। ‘তুমি’ সম্পর্ক তাদের। সিট থেকে উঠে তিনি তাদের সিটের দিকে এগিয়ে গেলেন। দীর্ঘক্ষণ উচ্চকন্ঠে কথা বলে ফিরে এসে বললেন, ‘ডু ইউ নো, হু দ্য ওম্যান ওয়াজ?’ আমি না বলায় তিনি বললেন, ‘রাফিয়া আক্তার ডলি, প্রমিনেন্ট ষ্টুডেন্ট লিডার অফ দি সিক্সটিজ।’ চট্টগ্রাম যাচ্ছেন কোন আত্মীয়ের বিয়েতে। ডলি নামটা ভালোভাবে জানি। ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুখোড় নেত্রী ছিলেন। প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন তার নামে শ্লোগান দিতো, ‘তোমার আমার ঠিকানা, ডলি আপার বিছানা।’ সত্তর সালে একবার দেখেছিলাম বক্তৃতা দিতে। বেশ সুন্দরী ছিলেন। এখন মুটিয়ে গেছেন। ছয় ঘন্টার জার্নিতে জগলু ভাইয়ের সাথে অনেক কথা হলো। সুখ দু:খ ও আনন্দের কথা। তিনি কাজে ব্যস্ত না থাকলে গুনগুন করতেন। অফিসে বা প্রেস ক্লাবে প্রবেশের পথে তার কন্ঠে কোন না কোন গানের সুর থাকতোই। রবীন্দ্র সঙ্গীতের দারুণ ভক্ত। ট্রেনে অনেকগুলো গান গাইলেন। ষ্টেশনে ভারপ্রাপ্ত ব্যুরো চিফ শাহনেওয়াজ ও রিপোর্টার কাশেম মাহমুদ ছিলেন। ষ্টেশন থেকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গিয়ে রেষ্ট নিয়ে বাসস ব্যুরো অফিসে গেলাম। জগলু ভাই আগেই আমাকে বলেছিলেন যে, প্রত্যেককে জেরা করার এবং তদন্ত রিপোর্ট লিখার কাজ আমাকেই করতে হবে। অফিসে সবাইকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমি প্রত্যেককে একান্তে ডেকে জেরা করে নোট নিলাম। দেখা গেল অভিযোগ সত্য। অফিস শেষ হওয়ার পর সেখানে দুই তরুণীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তবে এর সাথে সাংবাদিকদের সং¯্রব ছিল না। কিন্তু বাসসের মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অফিসে এধরণের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য অতিরিক্ত রুমগুলো পুনরায় সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তালাবন্ধ করে রাখার নির্দেশ দিলেন জগলু ভাই। জগলু ভাই সার্কিট হাউজে উঠেছেন তা সেখানে গেষ্টদের মধ্যে রটে গেছে। আমরা অফিস থেকে ফিরে আসার পর দেখা গেল অনেকে তার সাথে দেখা করতে অপেক্ষা করছেন। তিনি সবার সাথে কথা বললেন। রাতে ডিনারের সময় সার্কিট হাউজের অনেক আমলা গেষ্ট তার সাথে বসলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেন। পরদিন আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম। যথাসময়ে আমি তদন্ত রিপোর্ট তার কাছে জমা দিলাম। তিনি তার পর্যবেক্ষণ যোগ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
গুজরাট ভিত্তিক অল ইন্ডিয়া ডিজাষ্টার ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের এক ওয়ার্কশপে অংশ নিতে ২০০৮ সালের আগষ্ট মাসে চেন্নাই যাওয়ার জন্য ছুটি চাইলাম। জগলু ভাই বললেন, ‘ব্রিং তাজমহল টি ফর মি। মাই ফেভারিট। দিল্লিতে থাকতে একটা ব্র্যান্ডের চা-ই খেতাম, তাজমহল।’ আমি এনেছিলাম। খুব খুশী হয়েছিলেন জগলু ভাই। ২০০৯ সালের এপ্রিলে ওই একই ইন্সটিটিউটের এক প্রোগ্রামে আবারও আমাকে চেন্নাই যেতে হয় এবং আগষ্টে পন্ডিচেরিতে। আমি দু’বারই তার জন্য তাজমহল টি এনেছিলাম। কিন্তু তখন তিনি আর বাসস এ ছিলেন না। ২০০৮ এর ডিসেম্বরে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ২০০৯ এর জানুয়ারীতে সরকার গঠণ করার পর প্রধান সম্পাদক হিসেবে তার নিয়োগ বাতিল হয়। নতুন প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ইহসানুল করিম হেলালকে। জগলু ভাই বাসস থেকে পদত্যাগ করে বসুন্ধরা গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক দি সান এ যোগ দেন। দৈনিকটি তখনো প্রকাশিত হয়নি। প্রস্ততি চলছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জগলু ভাই এবং বাসস থেকে পদত্যাগ করে দি সান যোগ দেয়া সাংবাদিক নেতা এমএ আজিজসহ বেশ ক’জন সিনিয়র সাংবাদিক দি সান থেকে চলে আসেন। এরপর জগলু ভাই আর কোথাও স্থায়ী চাকুরিতে যোগ দেননি। লিখছিলেন নিয়মিত এবং টিভি টক শোতে নিয়মিত অংশ নি্িচ্ছলেন। ২০০৯ এর আগষ্ট মাসে আমার স্ত্রী ও মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসায় ঢাকায় আমার ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল। ২০১০ সালে আমাকে একাধিবার যুক্তরাষ্ট্রে আসতে হয়। এর ফলে আমি ঢাকায় অবস্থানের শেষ দিনগুলোতে জগলু ভাইয়ের সাথে তেমন দেখা হয়নি। তার অপঘাত মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়েছে।
জগলুল আহমেদ চৌধুরী এক আলোকিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার পিতা নাসিরউদ্দিন চৌধুরী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক আইন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি নেজামে ইসলামের নেতা এবং অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দালাল আইনে নাসিরউদ্দিন চৌধুরীকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি মুক্তি লাভ করেন। পিতার রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীত অবস্থান ছিল জগলু ভাইয়ের। কিন্তু আদর্শের বৈপরীত্য সত্বেও পিতার প্রতি কখনো অশ্রদ্ধা পোষণ করেননি। আমি যখন বাংলাবাজার পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলাম তখন পত্রিকাটির মালিক সম্পাদক জাকারিয়া খানের কাছে নিয়মিত আসতেন জগলু ভাই এবং নিয়মিত লিখতেন। জগলু ভাই জাকারিয়া খানের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। একদিন জগলু ভাই সম্পর্কে কথা উঠতেই বাবার প্রতি জগলু ভাইয়ের দুর্বলতা সম্পর্কে বললেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জগলু ওর আব্বাকে নিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। কখন কি অঘটন ঘটে। আমাকে ফোন করে বললো, আব্বাকে কোথায় রাখি। আমরা আরো কয়েক বন্ধুর সাথে আলোচনা করে ঠিক করলাম, জেলখানাই তার জন্য নিরাপদ। শেষে এক সন্ধ্যায় তাকে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রেখে এলাম।” জগলু ভাইয়ের শ্বশুর হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীও মুসলিম লীগের খ্যাতিমান নেতা, বেঙ্গল রেজিসলেটিভ এসেম্বলির সদস্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক মন্ত্রী সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলেন। জগলু ভাই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সক্রিয় থাকলেও পরবর্তীতে কোন দলমতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পোষণ করেননি বলেই আমার মনে হয়েছে। কারো সাথে তাকে কখনো রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িত হতে দেখিনি। সকল দলের লোকজনই তাকে ভালোবাসতো সাংবাদিক হিসেবে পেশার প্রতি তার নিষ্ঠা ও তার সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতার কারণে। তিনি আজ নেই। তার স্মৃতি দীর্ঘদিন আমাকে আপ্লুত রাখবে। আমি তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি। (সাপ্তাহিক বাংলাদেশ)