নিউইয়র্ক ০২:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

পার্শ্ব নায়ক থেকে নায়ক, অতঃপর মহানায়ক মাহামুদুল্লাহ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:৩৬:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ মার্চ ২০১৫
  • / ৯৬০ বার পঠিত

অ্যাডিলেড (অস্ট্রেলিয়া): স্টুয়ার্টব্র্রডকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে মাহামুদুল্লাহ’র সিঙ্গলের সঙ্গে সঙ্গেই এক দৌড়ে মাঠের মাঝখানে গিয়ে দুই ভায়রা জড়িয়ে ধরলেন পরস্পরকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডিলেড ওভালের সব দর্শক উঠল দাঁড়িয়ে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের দেখা পেয়ে প্রেস বক্স থেকে পড়ল হাততালি। ইনিংসের চতুর্থ বলে এন্ডারসনের সুইং অনুমান করতে না পেরে ইমরুল থার্ড স্কিপে এবং তৃতীয় ওভারে সেই এন্ডারসনের বলে তামিম সেকেন্ড স্কিপে ক্যাচ দিয়ে বরং বাংলাদেশের দুর্যোগ এনেছিলেন ডেকে। ওই পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তুলতে, চ্যালেঞ্জিং স্কোরে কি লড়াই ই না করেছেন মাহামুদুল্লাহ। ধ্বংসস্তুপ থেকে দলকে টেনে তুলতে দরকার ছিল একটা পার্টনারশিপ। তরুণ সৌম্য’র সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ৮৬ রানের পার্টনারশিপে সেই নেতৃত্বটাই দিয়েছেন মাহামুদুল্লাহ।
শুরুটা তার স্টুয়ার্ট ব্রডকে থার্ডম্যানে বাউন্ডারি দিয়ে। জর্ডানকে যেভাবে মেরেছেন কাভার ড্রাইভে শট, তাতে জর্ডান একাই নয়, মাহামুদুল্লাহর হাতে যেন বড় ধরনের চড় খেলো ইংল্যান্ডও! ওয়াকাসকে পুল কিংবা জর্ডানডে লং অনের উপর দিয়ে মাহামুদুল্লাহর বিশাল দু’টি ছক্কার কথাই ভাবুন? প্রথম ফিফটিতে খেলতে হয়েছে ৬৯টি বল, সেঞ্চুরির জন্য অবশিষ্ট ফিফটিতে সেখানে লেগেছে ৬২টি বল। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নেলসনে ৬২ রানের ইনিংসটিই ছিল মাহামুদুল্লাহর বিশ্বকাপে প্রথম ফিফটি। ওই ইনিংস থেকে টনিক নিয়ে আগেরদিন উদযাপন করলেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি! একটার পর একটা ল্যান্ডমার্কে নিজেকে নিজে গেছেন ছাড়িয়ে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইতিপূর্বেও ৭টি ইনিংসের একটিতেও ছিল না তার ফিফটি, ৮ম ইনিংসটি সেখানে সুরভিত করেছেন সেঞ্চুরি দিয়ে।
এর আগেও রেখেছেন দলের জয়ে বেশ ক’বার অবদান। তবে ওইসব ম্যাচের চিত্রনাট্যে নায়ক নয়, ছিলেন তিনি পার্শ্ব নায়ক। ৪ বছর আগে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ২ উইকেটের জয়টির কথাই ভাবুন, ইমরুল কায়েসের ৬০ রানের ইনিংসের পাশে নবম জুটিতে ৫৮ রানের অবিচ্ছিন্ন পার্টনারশিপে নেতৃত্বটা কিন্তু দিয়েছিলেন কিন্তু মাহামুদুল্লাহই। সেই মাহামুদুল্লাহর পার্শ্ব নায়ক থেকে নায়ক হওয়ার গল্পটা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। বদলে যাওয়া চরিত্রে আত্মপ্রকাশটা তার ৩ মাস আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজ থেকে। স্কোরশিটে ৩২/৪ এ দলকে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে টেনে তুলে ৮২ রানের হার না মানা ইনিংসে পার্শ্ব নায়ক থেকে হয়ে গেলেন নায়ক, সেই থেকে অন্য এক মাহামুদুল্লাহকে এখন দেখছে ক্রিকেট বিশ্ব।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলেন তামিম, ৪ দিন আগে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ইতিহাস রচনা করতে পারতেন তামিম। তবে নেলসনে মাত্র ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরি ফসকে যাওয়ায় এই ইতিহাস রচনায় অপেক্ষা বাড়েনি বাংলাদেশের। ১৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে অ্যাডিলেডে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেলেন মাহামুদুল্লাহ। যে ছেলেটি ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১১৪টি ম্যাচ কাটিয়েছেন সেঞ্চুরিহীন, সেই ছেলেটির প্রথম সেঞ্চুরিটিই এলো কি না বিশ্বকাপ থেকে (১০৩)! ক্যারিয়ারের প্রথম, বিশ্বকাপেও প্রথম সেঞ্চুরি- অথচ কি জানেন, নাইনটিজে এসে নার্ভাস দেখায়নি মাহামুদুল্লাহকে। ৮৬ থেকে ৯০-এ গেছেন এন্ডারসনকে থার্ডম্যানে বাউন্ডারি শটে, ৯০-এর ঘরে শেষ ১০টি রানে লেগেছে সমসংখ্যক বল।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই ম্যাচের প্রেক্ষাপটের সাথে অনেকটাই মিল খুঁজে পাবেন এই ম্যাচের। সেই ম্যাচে ৫ম জুটিতে ২ ভায়রা মাহামুদুল্লাহ-মুশফিকুরের পার্টনারশিপটি ছিল ১৩৪ রানের, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ২ ভায়রা’র দারুণ বোঝাপড়ায় ৫ম জুটি থেকে এসেছে ১৪১ রান। জানেন, বিশ্বকাপ ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের ইনিংসে এই ১৪১ রানের পার্টনারশিপটিই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যে কোন পার্টনারশিপে সর্বোচ্চ! বিশ্বকাপ ইতিহাসে সকল জুটিতে এর আগের সেরা পার্টনারশিপ ছিল ১৩৯, নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সেই পার্টনারশিপে তামিমের সঙ্গী ছিলেন এই মাহামুদুল্লাহই। ৫ম জুটিতে বাংলাদেশের সেরা পার্টনারশিপের মধ্যে আবার এটি দ্বিতীয়, সেরা এখনো জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে সাকিব-মুশফিকুরের ১৪৮।
জানেন, ১৩৮ বলে ৭ চার ২ ছক্কায় মাহামুদুল্লার ইতিহাসময় সেঞ্চুরির দিনে সেঞ্চুরি প্রাপ্য ছিল মুশফিকুর রহিমেরও। তাহলে অ্যাডিলেডে ইতিহাসটা যে আরো সমৃদ্ধ করতে পারতো বাংলাদেশ দল। ৭১, ৩৬, ৬০’র পর থেমেছেন মুশফিকুর ৮৯-এ! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ম ম্যাচে দ্বিতীয় ফিফটির ইনিংসটি থেমেছে ব্রডের অফ কাটারে কভারে ক্যাচে। তবে ১১ রান দূরে থেকে থেমে যাওয়া মুশফিকুরের ব্যাটিংয়েই শেষ ১০ ওভারকে প্রকৃত শ্লট বানিয়ে ৭৮ রান যোগ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। পেরেছে ব্যাটিং পাওয়ার প্লে তে উইকেটহীন ৩৭ রান যোগ করতে। যার মধ্যে এন্ডারসনকে এক ওভারে ২টি চারের প্রথমটি দর্শনীয় পুলে, কি নিখুঁত টাইমিংয়ে। পরেরটির সৌন্দর্য আরো বেশি-এক্সা কভার দিয়ে বুলেট গতিতে! মাহামুদুল্লাহ পেরেছেন, পারেননি মুশফিকুর। তবে এই জুটির ব্যাটিংয়ে বিশ্বকাপে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোর (২৭৫/৭) পেয়েছে বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নেলসনে ৩২২/৪, কিংবা ভারতের বিপক্ষে ২৮৩/৯-এই স্কোর ২টি কিন্তু প্রথমে ব্যাট করে নয়। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৭৫/৭ কিন্তু প্রথমে ব্যাট করে।
বিশ্বকাপে অভিষেকের পর প্রথম সেঞ্চুরির দর্শন পেতে প্রতীক্ষা ১৬ বছরের। অ্যাডিলেড ওভালের প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে মাহামুদুল্লাহর এই ইনিংসে শুধু মুগ্ধই হননি, নিজেও গর্ববোধ করছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি- ‘অসাধারণ ইনিংস। একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমি নিজেই গর্বিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে মাহামুদুল্লাহকে অভিনন্দন বার্তা পৌঁছে দিতে বলেছেন। জানবাজি দিয়ে ফিল্ডিং করতে হবে এই বার্তাও মাশরাফিদের পৌঁছে দিতে বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।’ তবে মাহাদুল্লাহ’র সেঞ্চুরির দিনে মুশফিকুর সেঞ্চুরি না পাওয়ায় মর্মাহত তিনি- ‘সেঞ্চুরি পাওয়ার কথা ছিল মুশফিকুরের। আমি সে প্রত্যাশাই করেছিলাম।’ তবে এই দু’জনের দারুণ বোঝাপড়া এবং দায়িত্ববোধের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন পাপন- ‘এই দু’টি ছেলে অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড। দলের জন্য, দেশের জন্য একেই বলে কমিটমেন্ট। মাহামুদুল্লাহ, মুশফিকুর দু’জনের প্রতিই আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল, দল যতো বিপদেই পড়–ক না কেন, দলকে তারা টেনে তুলবে, সে আশায় হাল ছাড়িনি। দেখুন অনেকের নজর তো মাহামুদুল্লাহর দিকে তেমন ছিল না। অথচ, ছেলেটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ থেকে কি উচ্চতায়ই না নিজেকে তুলে আনল। আমি শুধু অনুপ্রেরণা দিয়েছি মাত্র।’
আসলেই জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে বদলে গেছেন মাহামুদুল্লাহ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ উইনিং হার না মানা ৮২ রানের ইনিংস থেকে সেই যে নতুন অধ্যায় শুরু তার, সর্বশেষ ৬ ইনিংসের ৩টিতে ফিফটি একটিতে সেঞ্চুরি উপহার দিয়ে নিজের এই বদলে যাওয়া রূপটিই ধরেছেন মেলে। নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের ছেলে হয়েও ব্রাডম্যানকে নিয়ে গর্ব করে সাউথ ওয়েলশ। অ্যাডিলেড ওভালে টেস্টে সর্বোচ্চ ২৯৯ রানের ইনিংসে এখনো সবার উপরে বব্রডম্যান থাকায়। অ্যাডিলেড ওভালের মিউজিয়ামে ব্রাডম্যানের সব স্মৃতি চিহ্ন ধরে রেখেছে সাউথ অস্ট্রেলিয়া। ব্রাডম্যানের কীর্তিগাথা ভেন্যু থেকেই কি তাহলে টনিক পেয়েছেন মাহামুদুল্লাহ?

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

পার্শ্ব নায়ক থেকে নায়ক, অতঃপর মহানায়ক মাহামুদুল্লাহ

প্রকাশের সময় : ০৯:৩৬:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ মার্চ ২০১৫

অ্যাডিলেড (অস্ট্রেলিয়া): স্টুয়ার্টব্র্রডকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে মাহামুদুল্লাহ’র সিঙ্গলের সঙ্গে সঙ্গেই এক দৌড়ে মাঠের মাঝখানে গিয়ে দুই ভায়রা জড়িয়ে ধরলেন পরস্পরকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডিলেড ওভালের সব দর্শক উঠল দাঁড়িয়ে, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের দেখা পেয়ে প্রেস বক্স থেকে পড়ল হাততালি। ইনিংসের চতুর্থ বলে এন্ডারসনের সুইং অনুমান করতে না পেরে ইমরুল থার্ড স্কিপে এবং তৃতীয় ওভারে সেই এন্ডারসনের বলে তামিম সেকেন্ড স্কিপে ক্যাচ দিয়ে বরং বাংলাদেশের দুর্যোগ এনেছিলেন ডেকে। ওই পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তুলতে, চ্যালেঞ্জিং স্কোরে কি লড়াই ই না করেছেন মাহামুদুল্লাহ। ধ্বংসস্তুপ থেকে দলকে টেনে তুলতে দরকার ছিল একটা পার্টনারশিপ। তরুণ সৌম্য’র সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে ৮৬ রানের পার্টনারশিপে সেই নেতৃত্বটাই দিয়েছেন মাহামুদুল্লাহ।
শুরুটা তার স্টুয়ার্ট ব্রডকে থার্ডম্যানে বাউন্ডারি দিয়ে। জর্ডানকে যেভাবে মেরেছেন কাভার ড্রাইভে শট, তাতে জর্ডান একাই নয়, মাহামুদুল্লাহর হাতে যেন বড় ধরনের চড় খেলো ইংল্যান্ডও! ওয়াকাসকে পুল কিংবা জর্ডানডে লং অনের উপর দিয়ে মাহামুদুল্লাহর বিশাল দু’টি ছক্কার কথাই ভাবুন? প্রথম ফিফটিতে খেলতে হয়েছে ৬৯টি বল, সেঞ্চুরির জন্য অবশিষ্ট ফিফটিতে সেখানে লেগেছে ৬২টি বল। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নেলসনে ৬২ রানের ইনিংসটিই ছিল মাহামুদুল্লাহর বিশ্বকাপে প্রথম ফিফটি। ওই ইনিংস থেকে টনিক নিয়ে আগেরদিন উদযাপন করলেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি! একটার পর একটা ল্যান্ডমার্কে নিজেকে নিজে গেছেন ছাড়িয়ে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইতিপূর্বেও ৭টি ইনিংসের একটিতেও ছিল না তার ফিফটি, ৮ম ইনিংসটি সেখানে সুরভিত করেছেন সেঞ্চুরি দিয়ে।
এর আগেও রেখেছেন দলের জয়ে বেশ ক’বার অবদান। তবে ওইসব ম্যাচের চিত্রনাট্যে নায়ক নয়, ছিলেন তিনি পার্শ্ব নায়ক। ৪ বছর আগে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ২ উইকেটের জয়টির কথাই ভাবুন, ইমরুল কায়েসের ৬০ রানের ইনিংসের পাশে নবম জুটিতে ৫৮ রানের অবিচ্ছিন্ন পার্টনারশিপে নেতৃত্বটা কিন্তু দিয়েছিলেন কিন্তু মাহামুদুল্লাহই। সেই মাহামুদুল্লাহর পার্শ্ব নায়ক থেকে নায়ক হওয়ার গল্পটা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। বদলে যাওয়া চরিত্রে আত্মপ্রকাশটা তার ৩ মাস আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজ থেকে। স্কোরশিটে ৩২/৪ এ দলকে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে টেনে তুলে ৮২ রানের হার না মানা ইনিংসে পার্শ্ব নায়ক থেকে হয়ে গেলেন নায়ক, সেই থেকে অন্য এক মাহামুদুল্লাহকে এখন দেখছে ক্রিকেট বিশ্ব।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলেন তামিম, ৪ দিন আগে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ইতিহাস রচনা করতে পারতেন তামিম। তবে নেলসনে মাত্র ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরি ফসকে যাওয়ায় এই ইতিহাস রচনায় অপেক্ষা বাড়েনি বাংলাদেশের। ১৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে অ্যাডিলেডে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেলেন মাহামুদুল্লাহ। যে ছেলেটি ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১১৪টি ম্যাচ কাটিয়েছেন সেঞ্চুরিহীন, সেই ছেলেটির প্রথম সেঞ্চুরিটিই এলো কি না বিশ্বকাপ থেকে (১০৩)! ক্যারিয়ারের প্রথম, বিশ্বকাপেও প্রথম সেঞ্চুরি- অথচ কি জানেন, নাইনটিজে এসে নার্ভাস দেখায়নি মাহামুদুল্লাহকে। ৮৬ থেকে ৯০-এ গেছেন এন্ডারসনকে থার্ডম্যানে বাউন্ডারি শটে, ৯০-এর ঘরে শেষ ১০টি রানে লেগেছে সমসংখ্যক বল।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওই ম্যাচের প্রেক্ষাপটের সাথে অনেকটাই মিল খুঁজে পাবেন এই ম্যাচের। সেই ম্যাচে ৫ম জুটিতে ২ ভায়রা মাহামুদুল্লাহ-মুশফিকুরের পার্টনারশিপটি ছিল ১৩৪ রানের, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ২ ভায়রা’র দারুণ বোঝাপড়ায় ৫ম জুটি থেকে এসেছে ১৪১ রান। জানেন, বিশ্বকাপ ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানের ইনিংসে এই ১৪১ রানের পার্টনারশিপটিই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যে কোন পার্টনারশিপে সর্বোচ্চ! বিশ্বকাপ ইতিহাসে সকল জুটিতে এর আগের সেরা পার্টনারশিপ ছিল ১৩৯, নেলসনে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সেই পার্টনারশিপে তামিমের সঙ্গী ছিলেন এই মাহামুদুল্লাহই। ৫ম জুটিতে বাংলাদেশের সেরা পার্টনারশিপের মধ্যে আবার এটি দ্বিতীয়, সেরা এখনো জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে সাকিব-মুশফিকুরের ১৪৮।
জানেন, ১৩৮ বলে ৭ চার ২ ছক্কায় মাহামুদুল্লার ইতিহাসময় সেঞ্চুরির দিনে সেঞ্চুরি প্রাপ্য ছিল মুশফিকুর রহিমেরও। তাহলে অ্যাডিলেডে ইতিহাসটা যে আরো সমৃদ্ধ করতে পারতো বাংলাদেশ দল। ৭১, ৩৬, ৬০’র পর থেমেছেন মুশফিকুর ৮৯-এ! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ম ম্যাচে দ্বিতীয় ফিফটির ইনিংসটি থেমেছে ব্রডের অফ কাটারে কভারে ক্যাচে। তবে ১১ রান দূরে থেকে থেমে যাওয়া মুশফিকুরের ব্যাটিংয়েই শেষ ১০ ওভারকে প্রকৃত শ্লট বানিয়ে ৭৮ রান যোগ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। পেরেছে ব্যাটিং পাওয়ার প্লে তে উইকেটহীন ৩৭ রান যোগ করতে। যার মধ্যে এন্ডারসনকে এক ওভারে ২টি চারের প্রথমটি দর্শনীয় পুলে, কি নিখুঁত টাইমিংয়ে। পরেরটির সৌন্দর্য আরো বেশি-এক্সা কভার দিয়ে বুলেট গতিতে! মাহামুদুল্লাহ পেরেছেন, পারেননি মুশফিকুর। তবে এই জুটির ব্যাটিংয়ে বিশ্বকাপে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোর (২৭৫/৭) পেয়েছে বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নেলসনে ৩২২/৪, কিংবা ভারতের বিপক্ষে ২৮৩/৯-এই স্কোর ২টি কিন্তু প্রথমে ব্যাট করে নয়। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৭৫/৭ কিন্তু প্রথমে ব্যাট করে।
বিশ্বকাপে অভিষেকের পর প্রথম সেঞ্চুরির দর্শন পেতে প্রতীক্ষা ১৬ বছরের। অ্যাডিলেড ওভালের প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে মাহামুদুল্লাহর এই ইনিংসে শুধু মুগ্ধই হননি, নিজেও গর্ববোধ করছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি- ‘অসাধারণ ইনিংস। একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমি নিজেই গর্বিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে মাহামুদুল্লাহকে অভিনন্দন বার্তা পৌঁছে দিতে বলেছেন। জানবাজি দিয়ে ফিল্ডিং করতে হবে এই বার্তাও মাশরাফিদের পৌঁছে দিতে বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।’ তবে মাহাদুল্লাহ’র সেঞ্চুরির দিনে মুশফিকুর সেঞ্চুরি না পাওয়ায় মর্মাহত তিনি- ‘সেঞ্চুরি পাওয়ার কথা ছিল মুশফিকুরের। আমি সে প্রত্যাশাই করেছিলাম।’ তবে এই দু’জনের দারুণ বোঝাপড়া এবং দায়িত্ববোধের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন পাপন- ‘এই দু’টি ছেলে অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড। দলের জন্য, দেশের জন্য একেই বলে কমিটমেন্ট। মাহামুদুল্লাহ, মুশফিকুর দু’জনের প্রতিই আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল, দল যতো বিপদেই পড়–ক না কেন, দলকে তারা টেনে তুলবে, সে আশায় হাল ছাড়িনি। দেখুন অনেকের নজর তো মাহামুদুল্লাহর দিকে তেমন ছিল না। অথচ, ছেলেটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ থেকে কি উচ্চতায়ই না নিজেকে তুলে আনল। আমি শুধু অনুপ্রেরণা দিয়েছি মাত্র।’
আসলেই জিম্বাবুয়ে সিরিজ থেকে বদলে গেছেন মাহামুদুল্লাহ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ উইনিং হার না মানা ৮২ রানের ইনিংস থেকে সেই যে নতুন অধ্যায় শুরু তার, সর্বশেষ ৬ ইনিংসের ৩টিতে ফিফটি একটিতে সেঞ্চুরি উপহার দিয়ে নিজের এই বদলে যাওয়া রূপটিই ধরেছেন মেলে। নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের ছেলে হয়েও ব্রাডম্যানকে নিয়ে গর্ব করে সাউথ ওয়েলশ। অ্যাডিলেড ওভালে টেস্টে সর্বোচ্চ ২৯৯ রানের ইনিংসে এখনো সবার উপরে বব্রডম্যান থাকায়। অ্যাডিলেড ওভালের মিউজিয়ামে ব্রাডম্যানের সব স্মৃতি চিহ্ন ধরে রেখেছে সাউথ অস্ট্রেলিয়া। ব্রাডম্যানের কীর্তিগাথা ভেন্যু থেকেই কি তাহলে টনিক পেয়েছেন মাহামুদুল্লাহ?