যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট র্নিবাচনের কয়েকটি মৌলিক দিক

- প্রকাশের সময় : ০৯:২৫:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ নভেম্বর ২০১৬
- / ৯৯০ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: তিরিশে এপ্রিল, ১৭৮৯ সাল। সকালের ঊষার আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে একেক করে তের বার তোপধ্বনি হলো। নিউইয়র্কে লয়্যার ম্যানহাটানে (নিউইয়র্ক তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী) আবস্থিত ফেডারেল হলে আমেরিকার প্রথম প্রেসডেন্ট হিসাবে শপথ নিবেন জর্জ ওয়াসিংটন। সেই থেকে শুরু। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বারাক ওবামা হলেন ৪৪তম প্রেসিডেন্ট। আর এক সপ্তাহ পরেই নির্বাচিত হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট। আর এবারের নির্বাচন হচ্ছে ৫৮তম নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সি স¤পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন সরকারের প্রধান নির্বাহী এবং সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ। তিনি সিনেটের পরামর্শ ক্রমে অন্য দেশের সাথে চুক্তি করতে পারেন, ডিপ্লোমেট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ করতে পারেন। পররাষ্ট্র নীতি কি হবে সেটাও তিনিই ঠিক করেন।
ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার সংবিধান অনুসারে একজন প্রেসিডেন্ট চার বছরের জন্য র্নিবাচিত হন। গোড়াতে সংবিধানে এরকম কোন বিধান ছিল না তবে কোন প্রেসিডেন্টই দুই টার্মের অধিক প্রেসিডেন্ট থাকেননি এবং এটাই ছিল প্রথা কিন্তু প্রেসিডেন্ট ফেঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট চার টার্মের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠত থাকেন (দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ছিল একটি কারণ)। এই নিয়ে বিতর্কের জন্ম হয় এরপর ১৯৫১ সালে সংবিধানের ২২তম এমেন্ডমেন্ট-এর মাধ্যমে একজন প্রেসিডেন্টের জন্য সর্বোচ্চ দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকার বিধান চালু করা হয়। যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট হতে হলে জন্মগতভাবে যুক্তরাষ্টের নাগরিক হতে হবে বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৩৫ বছর এবং একাদিক্রমে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বছর বাস করতে হবে। ১৮৭০ সলের আগে শুধু মাত্র সাদা পুরুষরাই প্রেসিডেন্ট হিসাবে মনোনয়ন পেতে পারতো। ঐ বছর সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী পাশ হবার পর আফ্রিকান আমেরিকান সহ সকল পুরুষকেই ভোটাধিকার সহ ঐ পদের জন্য উপযুক্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯২০ সালে সংবিধানের ১৯তম এমেন্ডমেন্ট পাশ হবার আগ পর্যন্ত মহিলারা কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহনের যোগ্য বিবেচিত হতেন না। ঐ সংশোধনীতেই মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়।
প্রাথমিক ভাবে প্রেসিডেন্ট এর বেতন ছিল বছরে ২৫,০০০ ডলার। সর্বশেষ ২০০০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে তা হয়েছে ৩,৯০,০০০ ডলার এবং এই সাথে অন্যান্য খরচের জন্য ৫০,০০০ ডলার প্রদান করা হয়। প্রাক্তন প্রেসিডেন্টরা এখন অবসর ভাতা পেয়ে থাকেন যার পরিমান ২০০১ সালে ছিল ১,৬১,২০০ ডলার। এছাড়াও তিনি দেড় বছরের জন্য চারজন ষ্টাফসহ অফিস পেয়ে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মূলত: চারটি ধাপে সমাপ্ত হয়। সেগুলো হলো ১) প্রইমারি ইলেকশন, ২) পার্টি কনভেনশন, ৩)সাধারন র্নিবাচন এবং ৪) ইলেকটরল কলেজের ভোট।
প্রাইমারি:
রাজনৈতিক দলগুলি প্রইমারি ইলেকশন এবং পার্টি ককাস (মিটিং)-এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট র্নিবাচনের প্রার্থী বাছাই করে। আসলে ষ্টেট ভিত্তিক এই প্রাইমারিগুলোর মাধ্যমে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান পার্টি কর্মীরা পার্টি কনভেনশনের জন্য ডেলিগেটদের নির্বাচিত করেন। যারা পার্টি কনভেনশনে দলীয় কর্মীর পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দেন। আমেরিকার নাগরিকরা সাধারনত রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্রেটিক পাটির্র পক্ষে কোন একটিকে বেছে নিয়ে নিজেদেরকে রেজিষ্টার করেন। কেউ ইচেছ করলে নিজেকে কোন পার্টির পক্ষে রেজিষ্টার নাও করতে পারেন। বেশিরভাগ ষ্টেটেই শুধু পার্টির রেজিষ্ট্রার্ড ভোটাররাই প্রাইমারিতে ডেলিগেট নির্বাচনে ভোট দেবার সুযোগ পায়। প্রাইমারিই হলো প্রেসিডেন্ট র্নিবাচনের প্রথম স্তর।
পার্টি কনভেনশন:
ঐতিহাসিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পার্টি কনভেনশন খুবই গুরত্ত্বপূর্ণ। সাধারনত যে বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, সেবছর আগষ্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাসে কোন একটি বড় শহরে রাজনৈতিক দলগুলোর কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। সারাদেশ থেকে প্রাইমারির মাধ্যমে র্নিবাচিত ডেলিগেটরা কনভেনশনে সমবেত হয়ে ভোটভুটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট র্নিবাচনের জন্য আগ্রহী প্রার্থীকে চুড়ান্ত মনোনয়ন দেন। খুব জাকজমকভাবে এই কনভেনশনের আয়োজন করা হয়। কনভেনশনে পার্টির বড় বড় নেতারা তাদের ব্যক্তব্য দেন। এই কনভেনশনের পর পরই প্রার্থীরা চুড়ান্তভাবে তাদের প্রচারনার কাজ শুরু করেন। এবছর ডেমোক্রেট দলীয় কনভেনশন হয়েছে পেনসিলভানিয়ায় যেখানে ইতিহাসে প্রথমবারের মত একজন নারী অর্থাৎ হিলারি ক্লিনটনকে অফিসিয়ালী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এবং রিপাবলিকান দলীয় ঐতিহাসিক কনভেনশন হয়েছে ওহাইও রাজ্যে। যেখানে রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
সাধারন নির্বাচন:
সাধারনত: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নবেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার। সে হিসাবে এবছর প্রথম সোমবার হলো ৭ নবেম্বর আর তাই নির্বাচন হবে মঙ্গলবার ৮ নবেম্বর। সেদিন রাতের মধ্যেই ফলাফল জানা যায়, যদিও অফিসিয়ালী ফলাফল ঘোষনা করা হয় ইলেকটরাল কলেজের ভোটাভুটির পর। ইলেকটরাল কলেজের ভোট হয় ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় বুধবারের পরের প্রথম সোমবার। প্রতিটি ষ্টেটে ইলেকটরদের ভোটের ফলাফল পাঠানো হয় সেক্রেটারি অফ ষ্টেটের কাছে। তিনি জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে এই ফলাফল (ইলেকটরাল কলেজের ভোটের) ঘোষনা করেন। সংবিধান অনুসারে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শপথ নেন নির্বাচনের পরের বছর জানুয়ারীর ২০ তারিখ।
ইলেকটরোল কলেজ:
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলক্টটরোল কলেজ হচ্ছে একটি স¤পূর্ন ভিন্ন পদ্ধতি। ভোটারগণ আসলে সরাসরি প্রেসিডেন্টকে ভোট দেন কিনা সেটা কিছুটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ চুড়ান্তভাবে প্রেসিডেন্ট র্নিবাচিত হন এই ইলেকটরালদের ভোটে। ২০০০ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট আল গোর তার প্রতিদ্বন্দ্বি রিপাবলিকান বুশের চেয়ে বেশি মানুষের (পপুলার) ভোট পেয়েও কিন্তু কম ইলেকটোরাল ভোট পাওয়ায় প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। সে সময় আল গোর পেয়েছিলেন ৫,০৯,৯৪,০৮২ ভোট আর বুশ পেয়েছিলেন ৫,০৪,৬১,০৮০ ভোট।
ইলেকটোরাল কলেজ কি?
যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট হচেছ দুই কক্ষ বিশিষ্ট। একটি হলো হাউস অফ কংগ্রেস এবং আরেকটি হলো হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভ (সিনেট)। এখানকার ৫০ টি ষ্টেটের প্রতিটিতে দুই জন করে সিনেটর আছেন। এই সংখ্যা নির্দৃষ্ট। জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিটি ষ্টেটের হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভ-এর প্রতিনিধি থাকে। প্রতি দশকে জনসংখ্যার অনুপাতে এই সংখ্যার পরিবর্তন হয়। প্রতিটি ষ্টেটের ইলেকটোরলের সংখ্যা হলো কংগ্রেসের দুই কক্ষে সেই ষ্টেটের মোট প্রতিনিধিদের সংখ্যার সমান। প্রতিটি রাজনৈতিক দল প্রাইমারি নির্বাচনের সময় তাদের ইলেক্টরদের তালিকা ষ্টেটের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবরে দাখিল করে। সবচেয়ে বেশি ইলেকটরালের সংখ্যা হলো ক্যালিফোর্নিয়ায়, ৫৫ জন। নিউইয়র্কে এই সংখ্যা হলো ৩১ জন। ইলেকটরালের সংখ্যা কোন ষ্টেটেই ৩ জনের কম হয়না। ইলেকটরদের দলকেই বলা হয় ইলেকটরাল কলেজ। যে ষ্টেটে যিনি পপুলার ভোট বেশি পান, সেই ষ্টেটের সবগুলো ইলেকটরাল ভোটই তিনি পেয়ে থাকেন। ইলেক্টরালের মোট সংখ্যা হলো ৫৩৮টি। যিনি ম্যাজরিটি ইলেক্টরাল ভোট পান অর্থাৎ কম পক্ষে ২৭০টি তিনিই প্রেসিডেন্ট র্নিবাচিত হন। এর উদ্দেশ্য হলো শুধুমাত্র পপুলার ভোট পেয়ে যাতে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে না পারেন। কারণ আমেরিকায় কোন কোন ষ্টেটে জনসংখ্যা খুব বেশি আবার কোন কোন ষ্টেটে জনসংখ্যা অনেক কম। কেউ যাতে শুধুমাত্র বেশি জনসংখ্যা সম্বলিত ষ্টেটে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট না হতে পারেন, তাই এই পদ্ধতি।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যে কারণে অনন্য:
যেভাবেই হোক এবারের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যে ইতিহাস সৃষ্টি করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে সমস্ত ক্ষেত্রে এই নির্বাচন অনন্য তার কয়েকটি নীচে তুলে ধরা হল।
বয়স:
ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ১৪ জুন তার ৭০ তম জন্মদিন পালন করেছেন। তিনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তবে তিনিই হবেন আমেরিকার সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট। এরআগে শুধু রোনাল্ড রেগান ৬৯ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে হিলারি ক্লিনটন-এর বয়স হবে ৬৯।
নিউ ইয়র্কার বনাম নিউ ইয়র্কার:
৭১ বছর বছর পর আবার দুই নিউ ইয়র্কারের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-এর লড়াই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর পূর্বে ১৯৪৪ সালে দুই নিউ ইয়র্কবাসী নিউ ইয়র্কের গভর্নর থমাস ডুই এবং ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এর মাঝে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই হয়েছিল।
অর্থ সংগ্রহ:
যদি ট্রাম্প নির্বাচিত হল তবে বেশ অনেক সময় পরে একজন এত কম অর্থ সংগ্রহ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। ফেডারেল ইলেকশন কমিশনের হিসাব অনুসারে ট্রাম্প এর অর্থের পরিমাণ হবে ৪৯ মিলিয়ন। এরমধ্য ৩৬ মিলিয়নই তার নিজের অর্থ। আর হিলারি ক্লিনটনের সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ ১৮৭ মিলিয়ন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৫৬ মিলিয়ন।
অভিজ্ঞতা:
ট্রাম্প যদি নির্বাচিত হন তবে গত ৬০ বছর পর তিনি হবেন একজন প্রেসিডেন্ট যার সরাসরি সরকারে থাকার কোন অভিজ্ঞতা নেই। ইতিপূর্বে ১৯৫৩ সালে আইজেন হাওয়ার সামরিক বাহিনী থেকে এসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরও আগে ১৯২৯ সালে প্রেসিডেন্ট হুবার ছিলেন একজন প্রকৌশলী যার সরকারে থাকার কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা।
প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট:
আমেরিকার ইতিহাসে কোন মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত তো হননি শুধু তাইনা, ইতিপূর্বে কোন মহিলা এই পদের জন্য ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান পার্টি থেকে মনোনয়ন পাননি। সেদিক থেকে সাবেক ফাস্ট লেডী, সাবেক সিনেটর ও সাবেক সেক্রেটারী অব ষ্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন ইতিহাসের পাতায় নাম লিখালেন। আর ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি জয়ী হলে আমেরিকার ইতিহাস নতুন করে লিখা হবে। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার স্বামী বিল ক্লিনটন পর পর দু দফায় যুক্তরষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ফলে তিনি দু’বার ফাস্ট লেডীর মর্যাদা লাভ করেন।