২০ জনের প্রাণহানি, থমকে আছে ওয়াশিংটন : সর্বত্রই চলছে তুষার পরিষ্কার অভিযান তুষার সাগর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে নিউইয়র্ক
- প্রকাশের সময় : ০১:৪২:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী ২০১৬
- / ৯১৩ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ তুষার ঝড়ের পর পূর্বাঞ্চলের শহরগুলো ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত হতে শুরু করেছে। বিশ্বের মধ্যে সদা জেগে থাকা নিউইয়র্ক সিটিতে চলাচলের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ভয়াবহ তুষার ঝড়ের পর তা তুলে নেয়া হয়েছে। তবে অতীব জরুরী প্রয়োজন না হলে গাড়ী নিয়ে রাস্তায় বের না হতে সতর্ক করে দিয়েছে নিউইয়র্ক কর্তৃপক্ষ। ঝড়ে কয়েক ফুট পর্যন্ত জমে থাকা তুষার পরিষ্কার করতেই এখন ব্যস্ত নগরবাসী।
যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা বহুল নিউইয়র্কে এবারের তুষার ঝড়ে এতটাই বরফ জমেছে, যা ১৮৬৯ সালের পরে আর কখনোই দেখা যায়নি। ইতিহাসে নজির বিহীন তুষার ঝড়ে লন্ড ভন্ড ‘ইস্ট কোস্ট’র কয়েকটি অঙ্গ রাজ্য; এই প্রথম সাপ্তাহিক খোলার দিন ‘সোমবার’ ওয়াশিংটন ডিসিতে বন্ধ থাকছে ফেডারেল ও স্থানীয় সরকারের সব অফিস-আদালত
তিন-চার ফুট বরফ খুঁড়ে নিজেদের গাড়ি, ঘর থকে বেরুনোর রাস্তা, মূল সড়কে ওঠার পথ বের করার কাজে এখন ব্যস্ত লাখ লাখ আমেরিকান।
তুষার সরাতে গিয়ে অনেক মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, আবার অনেকের হাড় ভেঙে গেছে। তুষার ঝড়ে পূর্ব উপকূলে জনজীবন বিপর্যস্ত হযে পড়লেও এখন প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে। ঝড়ে এখন পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে তুষার পরিষ্কার করতে প্রতিবেশীরা একে অপরকে সহায়তা করছেন।
এই ঝড়ে পূর্ব উপকূলের ৫টি রাজ্যে কোথাও তিন ফুট আবার কোথাও তার চেয়েও বেশি তুষার জমেছে। ঝড়ে যে ২০ জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে অন্তত ৬ জনই নিহত হয়েছে বরফ সরানোর কাজ করতে গিয়ে। আর বাকি ১৪জন তুষার সংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, নিউ জার্সিতে কার্বন মনো-অক্সাইড বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এক নারী ও তার এক বছর বয়সী শিশু।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের জনজীবন সাময়িক স্থবির করে দিয়ে এই তুষার ঝড়টির এখন আটলান্টিক মুখী।
আক্রান্ত অঞ্চলে বসবাসকারি বিপর্যস্ত মানুষের জীবনে স্বস্তির বিষয় ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। তাই জরুরি অবস্থা জারির ফলে অনেকটা ঘরে বসেই সময় পার করেছেন তারা। ধেয়ে আসা এই বৈরী তুষারঝড়ে নিউইয়র্ক-নিউজার্সি এবং ইস্ট কোস্ট অঞ্চলের ওয়াশিংটন ডিসি’সহ প্রায় ২০টি রাজ্য অচল হয়ে পড়ে। শনিবার মধ্যরাতের পর স্বাভাবিকতা ফিরে আসে নিউইয়র্ক সিটির জনজীবনে। রোববার সকাল থেকে বরফ কাটার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে ছুটছেনে অনেকে। জীবিকার টানেই ঘর থেকে বের হওয়া ট্যাক্সি চালকরা বলছেন, কষ্ট হলেও সিটির প্রধান সড়কগুলোর পরিস্কারের ক্ষেত্রে মেয়র ব্লাজিও সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
শুক্রবার মধ্যরাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলে আঘাত হানা রেকর্ড পরিমান এই তুষার ঝড় অভিবাসী বান্ধব নিউইয়র্ক সিটির জনজীবনেও নেমে আসে বিপর্যয়। তবে, ছুটির দিন হওয়া প্রশাসনের জারি করা নির্দেশনা মানতে তেমন বেগ পেতে হয়নি সিটির অধিবাসীদের।
ভয়ঙ্কর তুষার ঝড়ের রেশ কাটতে না কাটতেই প্রায় ২৪ ঘন্টার বন্দী জীবনের অবসানে সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বের হন অনেকে। রোববার ছুটির দিন হওয়ায় সিটি মেয়র বাসভবনের ঠিক পেছনের ‘গ্রেসী ম্যানশন’ উৎসুক মানুষের ভীড় জমে।
সকাল থেকেই বাসাবাড়ির কিংবা অফিসের সামনে জমানো বরফ কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সিটির বাসিন্দারা। বরফের চাদরে ডুবন্ত গাড়ি ও বন্ধ হওয়া বাড়ির ফটক পরিচ্ছন্ন করতেই বেগ পেতে হয়। এতে, কোদাল-কাস্তের সাথে যুক্ত করা হয় আধুনিক ¯েœা কার্টার মেশিনও।
গাড়ি বের করা ও পার্কিং জটিলতার কথা উঠে আসের অনেকর মুখে। পর্যটক নির্ভর সিটিতে বেড়াতে আসা আশিয়ান নামের ইউক্রেনিয়ানদের মতে, রাশিয়ান অঞ্চলের দেশের চাইতে এখানকার ঠান্ডার প্রকোপ উপভোগ করার মতো।
যান চলাচল’সহ নিউইয়র্ক সিটির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সিটি প্রশাসনের কর্মযজ্ঞও ছিল চোখে পড়ার মতো।
রোববার ভোররাতের কিছু আগে থেমে যায় টানা প্রায় ২৪ ঘণ্টার এ দুর্যোগ। তবে ততক্ষণে তুষারপাতকবলিত রাজ্যগুলোর রাস্তাঘাট, খোলা জায়গা সব গড়ে ৩০ ইঞ্চি সাদা বরফের নিচে ঢাকা পড়ে। অচল হয়ে যায় অন্তত ১২টি রাজ্যের স্বাভাবিক কার্যক্রম। ১১টি রাজ্যে পৃথকভাবে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। দক্ষিণে আরকানসাস থেকে উত্তরে ম্যাসচুসেটস পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষ তুষারঝড়ের সতর্কবার্তার কারণে নিজ নিজ ঘরে আটকা পড়েন। ওয়াশিংটন ডিসি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরী নিউ ইয়র্কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় নগরীর সবগুলো সেতু ও টানেল। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহাসড়ক এবং স্থানীয় সড়কগুলোতে জমাট বরফের মধ্যে আটকা পড়ে হাজার হাজার গাড়ি। এসব রাজ্যের বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে অন্তত ৭ হাজার পূর্বনির্ধারিত ফ্লাইট বাতিল করা হয়। তীব্র ঝড়ের কারণে নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের কয়েকটি এলাকায় লক্ষাধিক বাড়ি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিউ জার্সির উপকূলীয় কয়েকটি অঞ্চলে সৃষ্টি হয় বন্যার। দুর্যোগকবলিত রাজ্যগুলোর জনজীবন স্বাভাবিক হতে কয়েক দিন লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯২২ সালে টানা দুই দিনের তুষারঝড়ে পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি রাজ্যে গড়ে ২৮ ইঞ্চি বরফ জমেছিল। এ ছাড়া ২০০৬ সালের তুষারঝড়ে নিউ ইয়র্ক রাজ্যের অল্প কয়েকটি স্থানে ২৬ ইঞ্চি বরফ জমে। কিন্তু এবার একদিনের তুষারঝড়েই গড়ে ৩০ ইঞ্চির বেশি বরফ জমেছে এবং ওয়াশিংটন ডিসি ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে জমে থাকা বরফের উচ্চতা ছিল আরও বেশি। তীব্র ঠান্ডার কারণে জমাটবাঁধা বরফ সহসাই গলছে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সে কারণে দুর্যোগকবলিত রাজ্যগুলোতে জনজীবন স্বাভাবিক হতে কয়েক দিন সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক সতর্কবার্তা ও পূর্বপ্রস্তুতির মধ্যেই গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১২টি অঙ্গরাজ্যে হালকা তুষারপাত শুরু হয়। শুক্রবার মধ্যরাতের পর তুষারপাতের তীব্রতা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং শনিবার ভোররাত থেকে শুরু হয় প্রচন্ত তুষারঝড়া বা স্নো ব্লিজার্ড। শনিবার ভোরের আলো ফোটার আগেই সবকিছু সাদা বরফের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। এরপর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হতে থাকে। নিউ ইয়র্কের গভর্নর এন্ডু কুমো শনিবার সকালেই তার রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তবে নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাজিও সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যেই সিটির কার্যক্রম যতটা সম্ভব সচল রাখার চেষ্টা করেন। স্নো রিমুভার ভেহিক্যালের সাহায্যে রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি নগরীর প্রধান গণপরিবহন ব্যবস্থা সাবওয়ে বা পাতাল রেলব্যবস্থা চালু রাখার জন্য নিয়োজিত করেন আপদকালীন ১৮ হাজার কর্মী। কিন্তু পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র ব্লাজিও শনিবার বেলা আড়াইটা থেকে নগরীতে সব ধরনের চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কয়েক ঘন্টার জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় সাবওয়ে, নগরীর সব সেতু ও টানেল।
রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র মিউরেল বাউসার শনিবার সকালেই সেখানকার গণপরিবহনসহ সব ধরনের জনচলাচল বন্ধ ঘোষণা করেন। ফেডারেল সরকারের যেসব অফিস সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও চালু থাকে, সেগুলো গতকাল সকাল থেকেই বন্ধ করে দেয়া হয়। নিউ জার্সির গভর্নর ও রিপাবলিকান দল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের মনোনীনয় প্রত্যাশী ক্রিস ক্রিস্টি নিউ হ্যাম্পশায়ারে তার প্রচারণা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলার কাজে সর্বাত্মক মনোনিবেশ করেন।
পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে টেনিসি, জর্জিয়া, কেন্টাকি, নর্থ ক্যারোলাইনা, নিউ জার্সি, ভার্জিনিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড, কানেকটিকাট, পেনসিলভানিয়া, ম্যাসাচুসেটস ও নিউ ইয়র্ক রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। টেনিসি, নর্থ ক্যারোলাইনা, কেন্টাকি ও ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের বিভিন্নস্থানে তুষাড়ঝড়ের ফলে সৃষ্ট বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২০ ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)