নিউইয়র্ক ১২:০১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

না ফুটতেই ঝরে গেল বাংলাদেশী ‘আমিনা’

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:৫৫:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ মে ২০১৫
  • / ১১২৮ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের আরলিংটনের বাসিন্দা শামসুল আহমদের মেয়ে ‘আমিনা আহমেদ’। স্কুল এবং কলেজে বরাবরই ভাল ফলাফল করেছিলেন তিনি। এবছরই কৃতিত্বের সাথে শেষ করেছেন তার ব্যাচেলর ডিগ্রী। কিন্তু বিধির বিধান। নিয়তির খেলায় হেরে যাবেন তা হয়তো কেউ জানতো না। ১৫ মে টেক্সাসে নিজ ইউনিভার্সিতে ‘ব্যাচেলর গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানের দিন অন্য সবার সাথে অংশ নেন সার্টিফিকেট গ্রহণ অনুষ্ঠানে। নিজের উচ্চতর ডিগ্রীর স্বীকৃতি অঙ্গে জড়িয়ে এভাবেই চলে যাবেন না ফেরার দেশে বিষয়টি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আমিনা।
তাই, যাবার আগেই বাবা-মাকে বলেছেন ৩টার মধ্যেই যাতে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছায়। বাবা-মা ও তাদের আদরের মেয়ের কথামত নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মেয়ের সার্টিফিকেট গ্রহণ শেষে বাবা-মা এবং সহপাঠীদের সাথে (সেলফি) ছবিও তোলেন আমেনা। কয়েক মিনিট পরই আমিনা মাথায় হাত দিয়ে অসুস্থ্য অনুভব করেন। বাবা-মাকে তাগিদ দেন দ্রুত বাসায় যেতে। বাসায় গিয়ে পানি খেয়ে বিশ্রামে যান। ঘুমের মধ্যেই আমিনা নিস্তেজ হয়ে যায়। ডাক্তার খবর দিলে তাকে দ্রুত টেক্সাসের ‘ফোর্ট রোথের প্লাজা মেডিকেল সেন্টার’ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে দু’দিন (আইসিইউ) ডীপ কোমায় রাখা হয়। অবশেষে ২০ মে আমিনাকে (ক্লিনিক্যাল ডেথ) মৃত ঘোষণা করে চিকিৎসকরা। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলেন, আমিনার ‘ব্রেইন এনিউরেজাম’ হয়েছে। তা কোন কিছু না বোঝার আগেই ব্রেইন ডেমেজ হয়ে যায়।
আমিনা আহমদের দাদার বাড়ী বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারে। তার বাবা সামসুল আহমদ জানালেন মেয়ে তার সাথে বাংলাদেশ গিয়ে অসহায় সম্বলহীনদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে সব সময়। বিশেষ করে অন্ধদের চোখে আলো ফোটানোর ইচ্ছা ছিল তার সব সময়। আমিনার পিতা শামসুল আহমেদ একজন খ্যাতিমান ব্যবসায়ী। এছাড়াও স্থানীয় মসজিদ আল আজিজের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। পাশাপাশি নামকরা বোম্ব বাজারের স্বত্বাধিকারী শহিদুল আহমদের ভাতিজি ছিলেন আমিনা।
আমিনা হয়তো দীর্ঘদিন ধরেই ‘ব্রেইন এনিউরিজম’-এ ভুগছিলেন। তাই সে যখন ঘুমিয়েছিল তখন তার প্রচন্ড মাথা ব্যথাও ছিল। পরীক্ষা ও গবেষণায় তা’ই উঠে আসে। আমিনা আহমেদ’র শেষ বিদায়ের কর্ত্যবরত চিকিৎসক ওয়েলস জানান, ‘এ ধরনের মাথা ব্যথা বা ‘ব্রেইন এনিউরেজাম’ সাধারনত বয়স্ক তথা ৪০-৬০ বছর বয়সের রোগীদের হয়ে থাকে। পাশাপাশি যারা সাধারণত চেইন স্মোকার তাদের এই রোগের আশঙ্কা বেশী। আমিনার মত এত কম বয়সী রোগীর এ ধরনের অসুখ বিস্ময়কর।’ ওয়েলস আরো বলেন, ‘বাজে রকমের মাথা ব্যথা সঠিক স্কিনিংয়ের মধ্যে থাকতে হয়ে, দ্বৈত ভিশন সহ অনেক আলামত ছিল; যা আমিনা বুঝতে পারে নি তবে এত অল্প বয়সে খুব বিরল ঘটনা। আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে।’
সম্ভাবনাময়ী ও সদ্য প্রয়াত আমিনা আহমেদের জন্ম ১১ নভেম্বর ১৯৯২ সালে। চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউ (ডীপ কোমা থেকে) মৃত ঘোষণা করেন ২০ মে ২০১৫। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। মাত্র ২২ বছর বয়সে না ফুটতেই ঝরে গেল এই ফুটফুটে ফুল আমিনা। অসম্ভব মেধাবী এবং সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত আমিনার শেষ বিদায়েও পরনে ছিল ‘উচ্চতর ডিগ্রির স্বীকৃতি’ তথা টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্রাজুয়েশন গাউন’। যে ছিল বেশ কয়েকটি চ্যারিটি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশী-আমেরিকান আমিনা আহমেদ’র এই অকাল মৃত্যুতে টেক্সাসসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম কমিউনিটি, প্রবাসী বাংলাদেশী ও বৃহত্তর সিলেট কমিউনিটিতে নেমে আসে শোকের ছায়া। এছাড়াও আমিনার অকাল মৃত্যুর খবর মূলধারার গণমাধ্যম, কমিউনিটি টিভি চ্যানেল ও পত্রিকাতেও গুরুত্বসহকারে প্রচার-প্রকাশিত হয়।
গেল ২০ মে বুধবার বাদ জোহর টেক্সাস আরলিংটনের ঐতিহ্যবাহী ‘দারুল এনাম গ্রীন ওকাস মসজিদ’-এ নামাজে জানাযা শেষে ঐদিনই আমিনাকে টেক্সাসের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। আমিনার দাফনকে ঘিরে টেক্সাস’সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে ছুটে আসা মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। ছোট বেলায় ফ্লোরিডায় বেড়ে উঠা আমিনার পরিবার টেক্সাসে চলে আসেন মাত্র কয়েক বছর আগে। সেখানে স্থানীয় বেশ কয়েকটি চ্যারিটি ও মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সামাজিক ও ইসলামিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন আমিনা। ‘বিএসসি ইন বায়োলজি’ ডিগ্রীধারি আমিনার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। বাবা-মাকে সবসময় তার স্বপ্নের কথাও জানাতো সে। বিশেষ করে চক্ষু ডাক্তার হয়ে বাংলাদেশ ও সিলেট এবং সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর গরিব-অসহায় মানুষদের চোখের আলো ফিরিয়ে দেয়ার অদম্য ইচ্ছে ছিল তার।
সরেজমিন তথ্যে উঠে আসে টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর গ্রাজুয়েশন সেরেমনী শেষে সার্টিফিকেট নিয়ে বাসায় এসে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া বাংলাদেশী তরুণী আমিনার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি কেউ। তার এই চলে যাওয়ায় মাঝ পথেই থেমে গেলো আমিনা এবং তার পরিবারে অনেক স্বপ্ন। শোকে মুহ্যমান মা বাবা এখন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। আমিনার প্রতিশ্রুতি মতে অন্ধদের চোখে আলো ফোটাতে চিকিৎসা কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করবে বলে নিউইয়র্ক থেকে সম্প্রচারিত টাইম টেলিভিশন ও বাংলা পত্রিকাকে জানায় তার পরিবার।
২১ মে বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রয়াত আমিনার বাবার সাথে যোগাযোগ করা হয়। টাইম টেলিভিশন ও বাংলা পত্রিকার সাথে আলাপকালে শোকাতুর আমিনার বাবা শামসুল আহমেদ বলেন, ‘আমার মেয়ে অনেক মেধাবী ছিল। সে এখানে মুলধারার পাশাপাশি বাংলাদেশী কমিউনিটি ও বিভিন্ন ইসলামিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামাজিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তাকে নিয়ে শেষবারের মত আমরা যখন দেশে গিয়েছি তখন সে পথ শিশুদের কষ্ট দেখে ব্যথিত হয়। আমাদের কাছে দাবি করে বাংলাদেশে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করবে। বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা দিবে।’
তিনি বলেন, ‘এই যে গত মাসেও আমাকে ডেকে বলে; বাবা সিলেট বিয়ানী বাজারে তো তোমার অনেক জমি আছে তাই না? তখন আমি বলি হ্যাঁ মা। তাহলে হলে এখন থেকেই সেখানে একটা ভবন/দালান তৈরী করো। আমরা ডাক্তার রেখে গ্রামের অসহায়দের চিকিৎসা করাবো।’ মেয়ের স্মৃতিচারণ করে কাঁদতে কাঁদতে এ কথাগুলো বলছিলেন; আমিনার শোকাতুর বাবা শামসুল আহমেদ।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারিনি আমার মেয়ে এভাবে চলে যাবে। ভার্সিটিতে খারাপ লাগছিল বলে বাথরুমে যাবার কথা জানায়। আমরা বল্লাম বাসা অনেক দুরে তুমি এখানেই বাথরুম করে নাও। বাথরুম করলো। এর আগে আমাদের সাথে ছবিও তুলেছে। প্রায় পৌনে ১ঘন্টা হেঁটে পরিচিতজন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওকে গাড়িতে পেছনের সীটে বসালাম। আমরা বাসায় আসার পর বললো; ‘বাবা আই ফিল হেডেক; আই ওয়ান্ট টু রেস্ট।’ ওকে পানি খেতে দিলাম। পানি খেয়ে বিশ্রাম নিতে গেলো। কতক্ষন পর পর আমি গিয়ে দেখি ঘুমিয়ে আছে। বিরক্ত হবে বলে ডাকিনি। আমার নিজেরও খুব ক্লান্ত লাগছিল। তাই একটু ঝিমিয়ে পড়ি। হঠাৎ উঠে পড়ি। এভাবে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আমি ফের ওর কাছে যাই। শরীর নাড়া দিয়ে দেখি কোন সাড়া নেই। সাথে সাথেই ৯১১ কল করি। পরের অবস্থা যা তাই হলো।’
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে বড় আমিনাকে হারিয়ে বাবা বা আর অন্য দুই ভাই এখন শোকে কাতর। তবে মেয়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তারা এখন উদ্যোগ নিচ্ছেন বাংলাদেশে অসহায় অন্ধদের চিকিৎসায় একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার। শুধু পরিবারেই নয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বন্ধু বান্ধবের কাছেও আমিনা আহমেদ ছিলেন সবার প্রিয়মুখ। ফলে তার মৃত্যুর খবরে তারাও শোকাহত। তাই আমিনার নামে চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা ঘোষণার সাথে সাথেই বিপুল সাড়া পাওয়া যায়।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মুসলিম আমিনা আহমেদ’র জন্য সামাজিক যোগাযোগ (টুইটার ও ফেসবুক) মাধ্যমে দোয়া এবং তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিভিন্ন পেইজ খোলেন আমিনার সহপাঠী, শুভানুধ্যায়ী ও মুসলিম স্কলাররা।
বিশিষ্ট মুসলি স্কলার ‘ওমর সোলায়মান’ আমিনার কোমায় চলে যাওয়া থেকে শেষ বিদায় পর্যন্ত ফেসবুকে একটি পেইজের মাধ্যমে স্ট্যাটাস পোষ্ট করেন। আমিনার এ সংবাদ ২৪ ঘন্টায় প্রায় সাত লাখেরও বেশী লাইক ১ লাখে কমেন্ট এবং ৫০ হাজার শেয়ার হয়। ঘটনার পর পুরো মুসলিম কমিউনিটিতে আলোচনায় চলে আসেন বাংলাদেশী আমিনা আহমেদ। সকল মুসলিম স্কলাররা তার জন্য দোয়া করেন। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দোয়া-মাহফিল ও আলোচনায় তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়।
আমিনার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে তার পরিবারের পক্ষে ‘আমিনা সিস’ নামের একটি ফান্ডরেইজিং পেইজ খোলে শাহিনা আহমেদ। ‘ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ.গোফান্ডমি.কম’ সাইটের এই ফান্ডরেইজিং পেইজে মাত্র ৩দিনে ১ হাজার ২শ জন (সাদকায়ে জারিয়া) চ্যারিটি অব্যাহত রেখেছেন। গোফান্ডমি.কম’ সাইটে গিয়ে দেখা যায় ‘আমিনা সিস’ নামের ঐ সাইটে ২৪ মে রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত জমা পড়েছে প্রায় ৪০ হাজার ডলার। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

না ফুটতেই ঝরে গেল বাংলাদেশী ‘আমিনা’

প্রকাশের সময় : ০৮:৫৫:৩৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩১ মে ২০১৫

নিউইয়র্ক: যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের আরলিংটনের বাসিন্দা শামসুল আহমদের মেয়ে ‘আমিনা আহমেদ’। স্কুল এবং কলেজে বরাবরই ভাল ফলাফল করেছিলেন তিনি। এবছরই কৃতিত্বের সাথে শেষ করেছেন তার ব্যাচেলর ডিগ্রী। কিন্তু বিধির বিধান। নিয়তির খেলায় হেরে যাবেন তা হয়তো কেউ জানতো না। ১৫ মে টেক্সাসে নিজ ইউনিভার্সিতে ‘ব্যাচেলর গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানের দিন অন্য সবার সাথে অংশ নেন সার্টিফিকেট গ্রহণ অনুষ্ঠানে। নিজের উচ্চতর ডিগ্রীর স্বীকৃতি অঙ্গে জড়িয়ে এভাবেই চলে যাবেন না ফেরার দেশে বিষয়টি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আমিনা।
তাই, যাবার আগেই বাবা-মাকে বলেছেন ৩টার মধ্যেই যাতে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছায়। বাবা-মা ও তাদের আদরের মেয়ের কথামত নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠানে অংশ নেন। মেয়ের সার্টিফিকেট গ্রহণ শেষে বাবা-মা এবং সহপাঠীদের সাথে (সেলফি) ছবিও তোলেন আমেনা। কয়েক মিনিট পরই আমিনা মাথায় হাত দিয়ে অসুস্থ্য অনুভব করেন। বাবা-মাকে তাগিদ দেন দ্রুত বাসায় যেতে। বাসায় গিয়ে পানি খেয়ে বিশ্রামে যান। ঘুমের মধ্যেই আমিনা নিস্তেজ হয়ে যায়। ডাক্তার খবর দিলে তাকে দ্রুত টেক্সাসের ‘ফোর্ট রোথের প্লাজা মেডিকেল সেন্টার’ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে দু’দিন (আইসিইউ) ডীপ কোমায় রাখা হয়। অবশেষে ২০ মে আমিনাকে (ক্লিনিক্যাল ডেথ) মৃত ঘোষণা করে চিকিৎসকরা। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলেন, আমিনার ‘ব্রেইন এনিউরেজাম’ হয়েছে। তা কোন কিছু না বোঝার আগেই ব্রেইন ডেমেজ হয়ে যায়।
আমিনা আহমদের দাদার বাড়ী বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারে। তার বাবা সামসুল আহমদ জানালেন মেয়ে তার সাথে বাংলাদেশ গিয়ে অসহায় সম্বলহীনদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে সব সময়। বিশেষ করে অন্ধদের চোখে আলো ফোটানোর ইচ্ছা ছিল তার সব সময়। আমিনার পিতা শামসুল আহমেদ একজন খ্যাতিমান ব্যবসায়ী। এছাড়াও স্থানীয় মসজিদ আল আজিজের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। পাশাপাশি নামকরা বোম্ব বাজারের স্বত্বাধিকারী শহিদুল আহমদের ভাতিজি ছিলেন আমিনা।
আমিনা হয়তো দীর্ঘদিন ধরেই ‘ব্রেইন এনিউরিজম’-এ ভুগছিলেন। তাই সে যখন ঘুমিয়েছিল তখন তার প্রচন্ড মাথা ব্যথাও ছিল। পরীক্ষা ও গবেষণায় তা’ই উঠে আসে। আমিনা আহমেদ’র শেষ বিদায়ের কর্ত্যবরত চিকিৎসক ওয়েলস জানান, ‘এ ধরনের মাথা ব্যথা বা ‘ব্রেইন এনিউরেজাম’ সাধারনত বয়স্ক তথা ৪০-৬০ বছর বয়সের রোগীদের হয়ে থাকে। পাশাপাশি যারা সাধারণত চেইন স্মোকার তাদের এই রোগের আশঙ্কা বেশী। আমিনার মত এত কম বয়সী রোগীর এ ধরনের অসুখ বিস্ময়কর।’ ওয়েলস আরো বলেন, ‘বাজে রকমের মাথা ব্যথা সঠিক স্কিনিংয়ের মধ্যে থাকতে হয়ে, দ্বৈত ভিশন সহ অনেক আলামত ছিল; যা আমিনা বুঝতে পারে নি তবে এত অল্প বয়সে খুব বিরল ঘটনা। আমি সত্যিই অবাক হয়েছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে।’
সম্ভাবনাময়ী ও সদ্য প্রয়াত আমিনা আহমেদের জন্ম ১১ নভেম্বর ১৯৯২ সালে। চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউ (ডীপ কোমা থেকে) মৃত ঘোষণা করেন ২০ মে ২০১৫। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন। মাত্র ২২ বছর বয়সে না ফুটতেই ঝরে গেল এই ফুটফুটে ফুল আমিনা। অসম্ভব মেধাবী এবং সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত আমিনার শেষ বিদায়েও পরনে ছিল ‘উচ্চতর ডিগ্রির স্বীকৃতি’ তথা টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্রাজুয়েশন গাউন’। যে ছিল বেশ কয়েকটি চ্যারিটি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশী-আমেরিকান আমিনা আহমেদ’র এই অকাল মৃত্যুতে টেক্সাসসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম কমিউনিটি, প্রবাসী বাংলাদেশী ও বৃহত্তর সিলেট কমিউনিটিতে নেমে আসে শোকের ছায়া। এছাড়াও আমিনার অকাল মৃত্যুর খবর মূলধারার গণমাধ্যম, কমিউনিটি টিভি চ্যানেল ও পত্রিকাতেও গুরুত্বসহকারে প্রচার-প্রকাশিত হয়।
গেল ২০ মে বুধবার বাদ জোহর টেক্সাস আরলিংটনের ঐতিহ্যবাহী ‘দারুল এনাম গ্রীন ওকাস মসজিদ’-এ নামাজে জানাযা শেষে ঐদিনই আমিনাকে টেক্সাসের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। আমিনার দাফনকে ঘিরে টেক্সাস’সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে ছুটে আসা মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। ছোট বেলায় ফ্লোরিডায় বেড়ে উঠা আমিনার পরিবার টেক্সাসে চলে আসেন মাত্র কয়েক বছর আগে। সেখানে স্থানীয় বেশ কয়েকটি চ্যারিটি ও মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সামাজিক ও ইসলামিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন আমিনা। ‘বিএসসি ইন বায়োলজি’ ডিগ্রীধারি আমিনার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। বাবা-মাকে সবসময় তার স্বপ্নের কথাও জানাতো সে। বিশেষ করে চক্ষু ডাক্তার হয়ে বাংলাদেশ ও সিলেট এবং সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর গরিব-অসহায় মানুষদের চোখের আলো ফিরিয়ে দেয়ার অদম্য ইচ্ছে ছিল তার।
সরেজমিন তথ্যে উঠে আসে টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর গ্রাজুয়েশন সেরেমনী শেষে সার্টিফিকেট নিয়ে বাসায় এসে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া বাংলাদেশী তরুণী আমিনার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি কেউ। তার এই চলে যাওয়ায় মাঝ পথেই থেমে গেলো আমিনা এবং তার পরিবারে অনেক স্বপ্ন। শোকে মুহ্যমান মা বাবা এখন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। আমিনার প্রতিশ্রুতি মতে অন্ধদের চোখে আলো ফোটাতে চিকিৎসা কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করবে বলে নিউইয়র্ক থেকে সম্প্রচারিত টাইম টেলিভিশন ও বাংলা পত্রিকাকে জানায় তার পরিবার।
২১ মে বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রয়াত আমিনার বাবার সাথে যোগাযোগ করা হয়। টাইম টেলিভিশন ও বাংলা পত্রিকার সাথে আলাপকালে শোকাতুর আমিনার বাবা শামসুল আহমেদ বলেন, ‘আমার মেয়ে অনেক মেধাবী ছিল। সে এখানে মুলধারার পাশাপাশি বাংলাদেশী কমিউনিটি ও বিভিন্ন ইসলামিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামাজিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তাকে নিয়ে শেষবারের মত আমরা যখন দেশে গিয়েছি তখন সে পথ শিশুদের কষ্ট দেখে ব্যথিত হয়। আমাদের কাছে দাবি করে বাংলাদেশে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করবে। বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা দিবে।’
তিনি বলেন, ‘এই যে গত মাসেও আমাকে ডেকে বলে; বাবা সিলেট বিয়ানী বাজারে তো তোমার অনেক জমি আছে তাই না? তখন আমি বলি হ্যাঁ মা। তাহলে হলে এখন থেকেই সেখানে একটা ভবন/দালান তৈরী করো। আমরা ডাক্তার রেখে গ্রামের অসহায়দের চিকিৎসা করাবো।’ মেয়ের স্মৃতিচারণ করে কাঁদতে কাঁদতে এ কথাগুলো বলছিলেন; আমিনার শোকাতুর বাবা শামসুল আহমেদ।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারিনি আমার মেয়ে এভাবে চলে যাবে। ভার্সিটিতে খারাপ লাগছিল বলে বাথরুমে যাবার কথা জানায়। আমরা বল্লাম বাসা অনেক দুরে তুমি এখানেই বাথরুম করে নাও। বাথরুম করলো। এর আগে আমাদের সাথে ছবিও তুলেছে। প্রায় পৌনে ১ঘন্টা হেঁটে পরিচিতজন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওকে গাড়িতে পেছনের সীটে বসালাম। আমরা বাসায় আসার পর বললো; ‘বাবা আই ফিল হেডেক; আই ওয়ান্ট টু রেস্ট।’ ওকে পানি খেতে দিলাম। পানি খেয়ে বিশ্রাম নিতে গেলো। কতক্ষন পর পর আমি গিয়ে দেখি ঘুমিয়ে আছে। বিরক্ত হবে বলে ডাকিনি। আমার নিজেরও খুব ক্লান্ত লাগছিল। তাই একটু ঝিমিয়ে পড়ি। হঠাৎ উঠে পড়ি। এভাবে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আমি ফের ওর কাছে যাই। শরীর নাড়া দিয়ে দেখি কোন সাড়া নেই। সাথে সাথেই ৯১১ কল করি। পরের অবস্থা যা তাই হলো।’
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে বড় আমিনাকে হারিয়ে বাবা বা আর অন্য দুই ভাই এখন শোকে কাতর। তবে মেয়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তারা এখন উদ্যোগ নিচ্ছেন বাংলাদেশে অসহায় অন্ধদের চিকিৎসায় একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার। শুধু পরিবারেই নয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বন্ধু বান্ধবের কাছেও আমিনা আহমেদ ছিলেন সবার প্রিয়মুখ। ফলে তার মৃত্যুর খবরে তারাও শোকাহত। তাই আমিনার নামে চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা ঘোষণার সাথে সাথেই বিপুল সাড়া পাওয়া যায়।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মুসলিম আমিনা আহমেদ’র জন্য সামাজিক যোগাযোগ (টুইটার ও ফেসবুক) মাধ্যমে দোয়া এবং তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিভিন্ন পেইজ খোলেন আমিনার সহপাঠী, শুভানুধ্যায়ী ও মুসলিম স্কলাররা।
বিশিষ্ট মুসলি স্কলার ‘ওমর সোলায়মান’ আমিনার কোমায় চলে যাওয়া থেকে শেষ বিদায় পর্যন্ত ফেসবুকে একটি পেইজের মাধ্যমে স্ট্যাটাস পোষ্ট করেন। আমিনার এ সংবাদ ২৪ ঘন্টায় প্রায় সাত লাখেরও বেশী লাইক ১ লাখে কমেন্ট এবং ৫০ হাজার শেয়ার হয়। ঘটনার পর পুরো মুসলিম কমিউনিটিতে আলোচনায় চলে আসেন বাংলাদেশী আমিনা আহমেদ। সকল মুসলিম স্কলাররা তার জন্য দোয়া করেন। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দোয়া-মাহফিল ও আলোচনায় তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়।
আমিনার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে তার পরিবারের পক্ষে ‘আমিনা সিস’ নামের একটি ফান্ডরেইজিং পেইজ খোলে শাহিনা আহমেদ। ‘ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ.গোফান্ডমি.কম’ সাইটের এই ফান্ডরেইজিং পেইজে মাত্র ৩দিনে ১ হাজার ২শ জন (সাদকায়ে জারিয়া) চ্যারিটি অব্যাহত রেখেছেন। গোফান্ডমি.কম’ সাইটে গিয়ে দেখা যায় ‘আমিনা সিস’ নামের ঐ সাইটে ২৪ মে রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত জমা পড়েছে প্রায় ৪০ হাজার ডলার। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)