নিউইয়র্ক: বাংলাদেশী আমেরিকান পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ফ্রন্ট (বাপাফ) আয়োজিত ‘ট্যাক্স ও ইমিগ্রেশন’ বিষয়ক টাউন হল সভায় ট্যাক্স ও ইমিগ্রেশন বিষয়ক অভিজ্ঞ বক্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইমিগ্র্যান্টদের দেশ। ইমিগ্র্যান্টরাই এই দেশ গড়ে তুলেছেন। আর ইমিগ্র্যান্টদের জন্য থাকা সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই নিয়মিত ট্যাক্স ফাইলিং করা জরুরী। পাশাপাশি ইমিগ্রেশন বিষয়ক যেকোন আবেদনের ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য না দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বক্তারা বলেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাম্প্রতিক নির্বাহী আদেশের ফলে গ্রীন কার্ড হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে যারা আনডকুমেন্টেড হিসেবে এদেশে অবস্থান করছেন তাদের (শর্ত পূরণ সাপেক্ষে) তিন বছরের জন্য ওয়ার্কপারমিট পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর যেকোন ইমিগ্রেশন বিষয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদানের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার জন্য কঠিন শাস্তিও ভোগ করতে হতে পারে। সভায় বক্তারা আরো বলেন, মেয়র ব্লাজিও প্রশাসনের নতুন নিউইয়র্ক সিটি আইডি যে কেউ গ্রহণ করতে পারবেন। ২০১০ সালের পহেলা জানুয়ারীর আগে যারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন বা অবস্থান করছেন তারা এই আইডির জন্য আবেদন করতে পারবেন। সিটি আইডি নিউইয়র্কের জীবন যাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যায়ণ করা হবে।
জ্যামাইকার হিলসাইডস্থ স্টার কাবাব রেষ্টুরেন্টে গত ২০ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় আয়োজিত বাপাফ’র টাউন হল সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী ওয়েলকেয়ার-এর সিনিয়র ম্যানেজার সালেহ আহমেদ। সভায় কী নোট স্পীকার ছিলেন এটনী শেখ সেলিম। এছাড়া আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন এটর্নী মঈন চৌধুরী, এডভোকেট এন মজুমদার, ইয়াকুব এ খান সিপিএ এবং বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্ক নিউইয়র্কের বিদায়ী সভাপতি কামাল আহমেদ। সভায় আরো বক্তব্য রাখেন জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি) পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী আকতার হোসেন।
সভার শুরুতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও গত সপ্তাহে পাকিস্তানে জঙ্গীদের হামলায় শতাধিক স্কুল শিক্ষার্থী নিহতদের বিদেহী আতœার শান্তি কামনায় এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রবাসের তিন মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে মনির হোসেন, ছদরুন নূর ও ওমর ফারুককে ফুল দিয়ে এবং কমিউনিটিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে ফুলের তোড়া দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এছাড়া বাপাফ’র কর্মকর্তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সভাটি পরিচালনা করেন বাপাফ’র সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার।
সভায় এটর্নী শেখ সেলিম বলেন, নিউইয়র্ক সিটি আইডি গ্রহণ করলে কোন অসুবিধা হবে না। তিনি বলেন, আয় যেভাবেই হোক তা ট্যাক্সের আওতায় আনা জরুরী। আইডি নম্বর ছাড়াও নামের উপর ট্যাক্স ফাইল করা যেতে পারে। ট্যাক্স ফাঁকীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। এজন্য প্রয়োজনে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সাম্প্রতিক নির্বাহী আদেশের ফলে আনডকুমেন্ডেট অভিবাসীদের তিন বছরের জন্য ওয়ার্কপারমিট দেয়া হবে। তবে এই আদেশের আইনের আওতাধীনদের ছয় মাসের বেশী অবৈধ থাকা যাবে না। তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিসা প্রসেস শিথিল করা হচ্ছে। আর সব কিছু নির্ভর করছে ইউএস সরকারের মর্জির উপর। সংশ্লিষ্টরা চাইলে ভিসা দেবেন, ভিসা বাতিল করবেন, প্রয়োজনে ডিপোর্ট করবেন বা ডিপোর্ট বাতিল করবেন। তিনি বলেন, অভিবাসীদের সবকিছুই ডিজিলাইজেশন করা হচ্ছে। নাম, ফিঙ্গার প্রিন্ট, ছবি সহ সবকিছুই ডাটাবেজের আওতায় আনা হচ্ছে। এই কাজ সহজ করতে এজন্য বিশ্বব্যাপী প্রি ইন্সপেকশন সেন্টার বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই আবুধাবীতে প্রি ইন্সপেকশন সেন্টার বসানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, অ্যাসাইলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তথ্যাদিতে ফ্রড পাওয়া গেলে বা ফ্রট প্রমাণিত হলে তারা সারাজীবনের জন্য ইমিগ্র্যান্ট সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তাই সকল ক্ষেত্রেই সতর্কতা আর সততার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রসঙ্গত তিনি বলেন, আমাদের কমিউনিটিতে সংগঠনের অভাব নেই। এসব সংগঠনগুলোর জন্য আমাদের মেধা, শ্রম অর্থ ব্যয়ের শেষ নেই। কিন্তু মূলধারায় আমাদের প্রতিনিধি নেই। মূলধারায় বাংলাদেশীদের প্রতিষ্ঠিত করতে সকল সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে মূলধারায় সময় দেয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এটর্নী মঈন চৌধুরী বলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সাম্প্রতিক নির্বাহী আদেশের ফলে আনডকুমেন্ডেট অনেকেই ভাবছেন গ্রীন কার্ড (রেসিডেন্সিয়াল কার্ড) পাওয়া যাবে। এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া দালালদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দু’টি শর্ত সাপেক্ষে প্রেসিডেন্টের আদেশের আওতায় সংশ্লিষ্টরা ওয়ার্কপারমিট পাবেন। তিনি বলেন, মেডিকেড ফ্রড-এর ব্যাপারে আইআরএস থেকে চিঠি আসছে। এই ফ্রড প্রমাণিত হলে জেল পর্যন্ত হতে পারে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সুবিধা নিতে গিয়ে এদেশের সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার করা ঠিক হবে না। এই দেশকে ভালবাসতে হবে, এদেশের নিয়ম-কানুন মানতে হবে। তিনি বলেন, সিটি আইডি সংশ্লিষ্টদের জন্য ফ্রি ইস্যু করা হবে। আর এই আইডি’র ফলে কারো ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস পরিবর্তন হবে না।
এডভোকেট এন মজুমদার বলেন, কুইন্স থেকে নির্বাচিত সিটি কাউন্সিলম্যান ড্যানিয়েল ড্রমের প্রস্তাবেই নিউইয়র্ক সিটি হলে সিটিআইডি বিল পাস হয়েছে। এখনো এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও হোমলেসসহ যেকেউ এই আইডি গ্রহণ করতে পারবেন। এজন্য তথ্যাদি গোপন রাখার কথা বলা হলেও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এজেন্টকে তথ্য সরবরাহ করা হতে পারে। তবে যাদের ভুয়া তথ্য নেই বা তথ্যে গরমিল থাকবে না তাদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, সিটি আইডি নিউইয়র্কের জীবন যাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যায়ণ করা হবে। ২০১০ সালের পহেলা জানুয়ারীর আগে যারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন বা অবস্থান করছেন তারা এই আইডির জন্য আবেদন করতে পারবেন। তিনি সিটি আইডি গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
ইয়াকুব এ খান সিপিএ বলেন, ৮০ বাই ২০ রুলের আওতায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়। এতে দেখা যায় ৮০ ভাগ ক্রেতাদের মধ্যে ২০ ভাগ ক্রেতার কাছ থেকে ব্যবসা পাওয়া যাচ্ছে। তাই ২০ ভাগ ক্রেতার ব্যাপারে মালিক পক্ষকে বেশী নজর দিতে হবে, তাদের ব্যাপারে বেশী সজাগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, সকল ব্যবসাতেই সফল্যের সুযোগ রয়েছে। এজন্য ব্যবসা শুরুর আগে জানতে হবে। তিনি আরো বলেন, কাস্টমার সার্ভিস ছাড়া ব্যবসায় সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাই কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দরকার, ব্যবসার সফল্যের জন্য গবেষণা দরকার। যা বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য জরুরী। প্রসঙ্গত তিনি আরো বলেন, ট্যাক্স ফাইলিং করা সবার জন্য জরুরী। আর এজন্য সঠিক তথ্য দেয়াই ভালো। নিম্ন আয় দেখিয়ে যারা ট্যাক্স ফাইলিং করে স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিয়েছেন তাদের ব্যাপারে ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস (আইআরএস) চিঠি প্রদান করছেন এবং বেনিফিট গ্রহণের ব্যাপারে ভুয়া তথ্য পেলে প্রয়োজনে পেনাল্টি সহ অর্থ ফেরৎ দিতে হতে পারে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সাম্প্রতিক নির্বাহী আদেশের ফলে আনডকুমেন্ডেট ব্যবসায়ীরা আই-১০ এন আবেদন করতে পারেন। এজন্য ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকা দরকার।
পরে এটর্নী ও সিপিএগণ উপস্থিত প্রবাসীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
সভায় সালেহ আহমদ বলেন, আমরা সমাজিক সংগঠন যতই করি না কেন, কমিউনিটির জন্য ভালো কিছু করতে হলে মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি এই দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। সব ক্ষেত্রেই সততাকে অবলম্বন হিসেবে এগুতে হবে।
ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার বলেন, আমরা মুখে মুখে মূলধারার রাজনীতির কথা বললেও মনে-প্রাণে মূলধারার রাজনীতি নেই। মূলধারার রাজনীতি ছাড়া কমিউনিটিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, মূলধারায় নির্বাচন করেন নিউইয়র্কে আর পোষ্টার লাগান বাংলাদেশে নিজ জেলায়। এভাবে মূলধারায় বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব পাওয়া যাবে না। প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।
বাপাফ’র টাউন হল সভায় কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু তাহের, আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি নাজমুল আহসান, জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির অন্যতম উপদেষ্টা ডা. ওয়াজেদ এ খান, এবিএম ওসমান গণি, রেজাউল করীম চৌধুরী, সভাপতি বিলাল চৌধুরী, সহ সভাপতি মুক্তার হোসেন, শেখ হায়দার আলী, আতিকুর রহমান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এএফ মিসবাহউজ্জামান, সাহিত্য সম্পাদক মোহাম্মদ আলম শাহেদ, মূলধারার রাজনীতিক সাবুল উদ্দিন, কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট জসিম উদ্দিন মিঠু, দরুদ মিয়া রনেল, বাপাফ কর্মকর্তাদের মধ্যে এবিএম সালাহউদ্দিন আহমেদ, একেএম সফিকুল ইসলাম, সেলিনা শারমিন সহ বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী উপস্থিত ছিলেন।