নিউইয়র্কে গভীর শ্রদ্ধায় অমর একুশে পালন
- প্রকাশের সময় : ১২:৫৮:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৫
- / ১০৩৩ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: নিউইয়র্কের বাংলাদেশী-আমেরিকান নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা ও বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর ঐহিত্য তুলে ধরা এবং চর্চার দৃঢ় প্রত্যয়ে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অমর একুশে, মহান শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। এইউপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্্ক নিউইয়র্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন ইন্্ক, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও বাঙালী চেতনা মঞ্চ, জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইন্্ক, জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশী বিজনেস এসোসিয়েশন নিউইয়র্ক (জেবিবিএ-নিউইয়র্ক), শরয়িতপুর সমিতি অব নর্থ আমেরিকা ইন্্ক সহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করে। নিউইয়র্কে অমর একুশের উল্লেখ্যযোগ্য কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো শিশু-কিশোর-কিশোরীদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, একুশে ভিত্তিক নাটিকা, দেশাত্ববোধক সঙ্গীত, আলোচনা, স্মরণিকা প্রকাশ সহ একুশের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত ১২টা এক মিনিটে অস্থায়ী শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন সংগঠনের পুষ্পস্তবক অর্পণ। বিভিন্ন সংগঠনের আলোচনা সভায় ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে নিউইয়র্কে স্থায়ী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার দাবী উঠে। এজন্য সম্মিলিতভাবে উদ্যোগের উপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা। একুশের অনুষ্ঠানসমূহে অতিথি হিসেবে যোগদেন জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আব্দুল মোমেন ও নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে নিযুক্ত কনসাল জেনারেল শামীম আহসান। উল্লেখ্য, চলতি বছর নিউজার্সী প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্যোগে এবং স্থানীয় সিটি প্রশাসনের আর্থিক সহযোগিতাসহ সার্বিক সহযোগিতায় প্রথমবারের মতো এই অঙ্গরাজ্যে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিারের আদলে স্থায়ী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী এই শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নিউইয়র্কস্থ কনসাল জেনারেল শামীম আহসান।
এদিকে নিউইয়র্ক ষ্টেট গভর্ণর প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবছর আনুষ্ঠানিকভাবে অমর একুশে মহান শহীদ দিবস তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এজন্য ষ্টেট সিনেটে একটি বিলও পাস হয়েছে। এই স্বীকৃতি লাভে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বিশেষ উদ্যোগ প্রশংসার দাবী রাখে।
বাংলাদেশ সোসাইটি ইন্্ক নিউইয়র্ক একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করে সানিসাইড কমিউনিটি সেন্টারে। অনুষ্ঠানটি আয়োজনের জন্য সোসাইটির সিনিয়র সহ সভাপতি মহিউদ্দিন দেওয়ানকে আহ্বায়ক, যুগ্ম সম্পাদক ওসমান চৌধুরীকে সদস্য সচিব, সহ সভাপতি ফারুক হোসেন মজুমদারকে প্রধান সমন্বয়ক ও নাসির আহমেদকে সমন্বয়কারী করে সম্মিলিত একুশ উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়। সোসাইটির একুশের অনুষ্ঠানে সভাপতি করেন সভাপতি আজমল হোসেন কুনু এবং অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহীম হাওলাদার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন ইন্্ক প্রতিবছরের মতো এবছরও সম্মিলিত একুশ উদযাপন অনুষ্ঠান আয়োজন করে সিটির এস্টোরিয়াস্থ এনটিভি ভবনে।
মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও বাঙালী চেতনা মঞ্চ প্রতিবছরের মতো একুশের মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ম্যানহাটানস্থ জাতিসংঘ ভবনের সামনে ফাস্ট এভিনিউ ও ৪৭ স্টীট সংলগ্ন পার্কে। এছাড়া একুশ উপলক্ষে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন গ্রন্থমেলারও আয়োজন করছে।
জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা ইন্্ক ও জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশী বিজনেস এসোসিয়েশন নিউইয়র্ক (জেবিবিএ-নিউইয়র্ক) যৌথভাবে প্রথমবারের মতো একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করে সিটির জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায়। সহযোগিতায় ছিলো জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশ ক্লাব। ডাইভারসিটি প্লাজার সম্মিলিত একুশ উদযাপনে জালালাবাদ এসোসিয়েশনের আতাউল গনি আসাদকে আহ্বায়ক, জেবিবিএ নিউইয়র্ক-এর রাশেদ রহমানকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং আকবর হোসেন স্বপনকে সদস্য সচিব ও এম এ রহমানকে যুগ্ম সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সভাপতি বদরুল হোসেন খান ও সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চৌধুরী এবং জেবিবিএ নিউইয়র্ক-এর সভাপতি মোহাম্মদ মহসিন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আবুল ফজল দিদারুল ইসলাম।
শরয়িতপুর সমিতি অব নর্থ আমেরিকা ইন্্ক এই প্রথমবারের মতো ব্যাপকারে একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করে সিটির উডসাইডস্থ কুইন্স প্যালেসে। সমিতির একুশের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি রতন শরীফ সরকার এবং অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান রুবেল।
এছাড়া ব্রুকলীন সর্বজনীন কমিটির উদ্যোগে স্থানীয় চার্চ/ম্যাকডোনাল্ডে একুশের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ব্রুকলীনে আয়োজিত একুশের অনুষ্ঠানের জন্য গঠিত কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ মজিবুল মওলা, সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল পাশা মানিক এবং প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ এল আলী।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে সর্বস্তরের প্রবাসীদের পুষ্পস্তবক অর্পন চলছিলো। প্রচন্ড ঠান্ডা উপক্ষো করো শিশু-কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরাও একুশের অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ প্রবাসীরা। তারা সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে একুশের প্রথম প্রহরে বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি’…..অমর সঙ্গীত উচ্চারণ করে শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও শহীদ বেদীতে ফুল অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান। ফলে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শহীদ বেদী। এছাড়া উত্তর আমেরিকার কানাডা সহ পেনসেলভেনিয়া, নিউজার্সী, ফিলাডেলফিয়া, জর্জিয়া, মিশিগান, টেক্সাস, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশন: নিউইয়র্কে জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হয়। একুশের প্রথম প্রহর রাত ১২ টা এক মিনিটে মিশনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে মিশনের পক্ষে স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাংলাদেশ মিশনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়: নিউইয়র্ক কনস্যুলেট জেনারেল ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মিশনে স্থাপিত শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনসহ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মিডিয়া প্রতিনিধিগণ শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। এ উপলক্ষ্যে ২০ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার সন্ধ্যায় মিশনে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের শোকের প্রতীক, শক্তির প্রতীক, ঐক্যের প্রতীক এবং গৌরবের প্রতীক। যার মাধ্যমে বাঙালী জাতির স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। তিনি বলেন, শহীদ দিবস আমাদেরকে ন্যায় ও মানবতা রক্ষায় দৃঢ় থাকতে এবং প্রতিকূলতার কাছে মাথা নত না করতে শিখিয়েছে। এজন্যই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। একুশের চেতনাই বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদমুক্ত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়তে উদ্বুদ্ধ করছে।
মিশনের কাউন্সিলর ও দূতালয় প্রধান রকিবুল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির বাণী পাঠ করে শোনান মিশনের উপস্থায়ী প্রতিনিধি সাদিয়া ফয়জুননেসা। প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করে শোনান মিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম আখতারউজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাণী পাঠ করে শোনান মিশনের প্রেস সচিব বিজন লাল দেব এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাণী পাঠ করে শোনান মিশনের কাউন্সিলর মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান।
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল ক্রিস্টিনা গ্যালাচ, রাশিয়ার উপস্থায়ী প্রতিনিধি পেত্রে ভ ইলিচেভ, ইউনেস্কো পরিচালক মোওফিদা গুচা এবং ভারতের উপস্থায়ী প্রতিনিধি ভগয়ান্ত শিং ভিশনী দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বক্তব্য দেন। বক্তারা জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় দেশে দেশে মাতৃভাষার চর্চা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অনুষ্ঠানে সৌদি আরব, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবসের পটভূমি তুলে ধরেন। পরে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রবাসী শিল্পীরা সঙ্গীত ও আবৃতি পরিবেশন করেন। সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।