ঢাকা: তেমন কোনো চমক ছাড়াই গতানুগতিক নতুন বাজেট (২০১৬-১৭) ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য নেই কোনো দিকনির্দেশনা। দেশীয় শিল্প-কারখানা সুরক্ষায় রাখা হয়নি কোনো বিশেষ প্যাকেজ। পাশাপাশি অর্থসংস্থানে জোর দেয়া হয়েছে রাজস্ব আয়ের ওপর। বিশাল ঘাটতি মেটাতে বাড়ানো হয়েছে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর। আর সাইবার অপরাধীদের আক্রমণ ও রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার শংকা তো আছেই। সবমিলিয়ে নানা উদ্বেগ ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার (২ জুন) জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এটি বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের তৃতীয় এবং অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দশম বাজেট ঘোষণা। প্রস্তাবিত এ বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। বিশাল এ ব্যয় মেটাতে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা (অনুদানসহ)। এ হিসাবে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় প্রস্তাবিত বাজেটের ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৯ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে নানামুখী চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে যেসব বিষয় চিহ্নিত করেছেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বিনিয়োগ বাস্তবায়নের সক্ষমতা ও গুণগতমান, দক্ষতা উন্নয়ন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ কম, উৎপাদনে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির প্রসার। আর আগামীতে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে তিনি অনিশ্চিত স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। এজন্য তিনি স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলেছেন। এটি বাস্তবায়নের জন্য অর্থমন্ত্রী আগামীতে জেলা সরকার প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী এরপরও তার বক্তব্যে বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার আশার কথা শুনিয়েছেন।
বাজটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। ৭ দশমিক ২ শতাংশের প্রবৃদ্ধি অর্জনে আশার বাণী হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের অষ্টম জাতীয় স্কেলে পুরোপুরি ভাতা বাস্তবায়ন করা হবে। এজন্য বাড়বে স্থানীয় পর্যায়ে ভোগ-বিলাস। আশার সঞ্চার দেখিয়েছেন রফতানি আয় ও রেমিটেন্স ব্যবহার বৃদ্ধির কথা।
প্রস্তাবিত বাজেটে দক্ষতা উন্নয়নে ‘ন্যাশনাল হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (এনএইচআরডি)’ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গঠন করা হবে পরিচালক পুল। এর প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য ১০০ কোটি টাকার ফান্ড গঠন করা হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার এনডাওমেন্ট ফান্ড। ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তির জ্বালানি চুল্লি স্থাপন কার্যক্রম সম্প্রসারণে নীতিমালা প্রণয়নে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। আগামী বছর সব শ্রমজীবী মানুষসহ প্রবীণদের জন্য একটি টেকসই পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা দেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
প্রস্তাবিত বাজেটে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে ইন্টারনেট সেফটি স্যলুশন নামক একটি মনিটরিং ও রেগুলেটরি ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি করমুক্ত সীমা গত বছরের ন্যায় এবারও আড়াই লাখ টাকা রাখা হয়েছে। কর্পোরেট কর হার ২৫ শতাংশই রাখা হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসার সহায়তা হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বার্ষিক টার্নওভারের কর অব্যাহতি সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির ক্রমহ্রাসের আভাস দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ওই হিসেবে আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
আগামী বাজেটে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘২০২১’ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারেরর অগ্রাধিকার কার্যক্রমে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার দিকনির্দেশনা রয়েছে বাজেটে।
খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি প্রস্তাবিত বাজেটে। এ বছর বড় ১০টি প্রকল্প নিয়ে কাঠামা রূপান্তর বৃহৎ প্রকল্প প্রবৃদ্ধি সঞ্চারে নতুন মাত্রা নামে আলাদা একটি বাজেট দেয়া হয়েছে।
আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর ব্যবস্থা থেকে আদায় করা হবে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ২৫০ কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। বিদেশী অনুদান ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। এ অনুদান পাওয়া গেলে সরকারের মোট আয় হবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে মোট অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে অনুন্নয়ন রাজস্ব ব্যয় হবে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এ অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৩৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের সুদ দেয়া হবে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। মূলধনী ব্যয় ২৬ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। ঋণ ও অগ্রীম বাবদ ব্যয় হবে ৮ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
এছাড়া উন্নয়ন ব্যয় করা হবে ১ লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের অর্থায়ন ৭০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা নেয়া হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত প্রকল্প ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা।
জিডিপির ৫ শতাংশ ধরেই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। আগামী বছরে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ হচ্ছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা (অনুদান ছাড়া)। তবে বিদেশী অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র খাত থেকে নেয়া হবে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে ৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক উৎসের মধ্যে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৩৮ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে আগের নেয়া বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ হচ্ছে ৮ হাজার ১১৫ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ, মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) বরাদ্দ ২৫ দশমিক ২ শতাংশ, ভৌত অবকাঠামো খাতে ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ, সেবা খাতে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী তার প্রস্তাবিত বাজেটে দারিদ্র্যকে সমূলে উৎপাটন করার কথা বলেছেন। কিন্তু দারিদ্র্য নিরসনে কোনো গাইডলাইন দেননি। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর সম্পদ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়সহ বিদেশী সহায়তার ব্যবহার বাড়াতে বলেছেন। অর্থমন্ত্রী জনপ্রশাসনে সক্ষমতার উন্নয়ন, ই-গভর্ন্যান্স, ভূমি ব্যবহার আধুনিকায়নসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।(দৈনিক যুগান্তর)