আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ফারাক্কা সহ বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধান দাবী
- প্রকাশের সময় : ০২:০০:৪৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ নভেম্বর ২০১৫
- / ১০৭৭ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: সার্কের চেতনায় আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ফারাক্কা সহ বাংলাদেশের পানি সমস্যা সমাধানের দাবী জানিয়েছে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি (আইএফসি) নিউইয়র্ক। ৮ নভেম্বর রোববার বিকেলে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস্থ ইত্যাদি পার্টি হলে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই দাবী জানানো হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইএফসি’র মহাসচিব সৈয়দ টিপু সুলতান এবং লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু। এসময় আইএফসি’র সিনিয়র সহ সভাপতি আওলাদ হোসেন খান, সহ সভাপতি এম এ সিদ্দিক পল্লব, যুগ্ম মহাসচিব আবু তালেব চৌধুরী চান্দু, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সহ সভাপতি মনিরুল ইসলাম সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। পরে আইএফসি নেতৃবৃন্দ উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। সাংবাদিক সম্মেলন পরিচালনা করেন আইএফসি’র সাংগঠনিক সম্পাদক আতাউর রহমান আতা। খবর ইউএনএ’র।
সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু বলেন, ‘অতি সম্প্রতি ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের ভেতরে গঙ্গা বাঁধ নির্মান করার প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ভারতের হাই কমিশনার পঙ্কজ শরনের বিদায়ী সাক্ষাতে তিনি এ প্রস্তাব দিয়ে দ্বিপাক্ষিক অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতার জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানান। এমন এক সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাব করেছেন যখন ভারত ব্রহ্মপূত্রের পানির সূষম ব্যবহারের ব্যাপারে উজানের দেশ গণ চীনের সাথে বোঝাপড়ার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতার প্রত্যাশী। জল বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য ব্রহ্মপূত্রের উজানে বাঁধ নির্মান করায় গণ চীনের সাথে বোঝাপড়ায় ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায় ভারত।’
আতিকুর রহমান ইউসুফজাই বলেন, ‘আমরা বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রস্তাবে উজানের দেশ ভারতকে গঙ্গাবাঁধ প্রকল্পের অংশিদার রেখে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার যে ইংগিত রয়েছে তাকে আরো শানিত করা দরকার। ভারত যেমন ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অংশিদার হিসেবে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায়, তেমনি অভিন্ন সকল নদীর সূষম ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে অববাহিকা ভিত্তিক সকল দেশের সহযোগিতা চাইতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে গঙ্গার বাংলাদেশ অংশ মরতে বসেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে একই অবস্থা তিস্তা নদীর। বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৫২ টি অভিন্ন নদীর প্রত্যেকটির উজানে বাঁধ প্রবাহগুলোকে মরনাপন্ন করে তুলেছে। ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ নির্মানের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে ভারত সোচ্চার হওয়ার ভাটির সর্বনিম্নে অবস্থিত বাংলাদেশের কয়েক দশকের কষ্টের কথা স্বীকৃত হয়েছে।’
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়: ‘নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে নদীসৃষ্ট বাংলাদেশ বাঁচবেনা। এই সহজ কথাটা এমনকি ভারতের সংবেদনশীল মানুষেরা যতটা বোঝেন বাংলাদেশের মানুষ ততটা বোঝেনা বা জানেন না। কারণ নদী-পানি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সকল তথ্য-উপাত্ত জনসমক্ষে না এনে বিগত ৪৩ বছর যৌথ নদী কমিশিনে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ভারতে পানি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়। বাংলাদেশে তা হয়না। কাজেই পানির কমতি হলে কি ক্ষতি হতে পারে তা সরাসরি ভুক্তভুগিরা ছাড়া আর কেউ বোঝেন না।
আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, এক্ষনি স্বোচ্চার হয়ে বলতে হবে – আন্তঃনদী সংযোগের ম্যাধ্যমে নদীর পানি সরিয়ে নিলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ নদীহারা হবে। নদীসৃষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বদ্বীপ তার স্বাভাবিক গড়ন-গতিশীলতা হারিয়ে সাগর ভাঙ্গনের শিকার হবে। ভাটিতে নদীগুলো মরে গেলে উজানেও সেগুলো মরে বিরান হয়ে যাবে। কারণ প্লাবন ভূমির স্বাভাবিক প্রকৃতিক প্রবাহ থেকে সরিয়ে শুষ্ক এলাকা দিয়ে প্রবাহিত করলে, শুষ্ক মাটি সম্পুর্ন পানি চুসে নেবে। এই ভূভাগের পানিচক্র ধংস হবে। পুরো হিমালয় অঞ্চলে নেমে আসবে পরিবেশগত বিপর্যয়।’
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়: ‘গঙ্গার পানি উজানে সরিয়ে নেবার ফলে গঙ্গা-কাপোতাক্ষ প্রকল্পটা মাঠে মারা গেছে। রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে চলছে পরিবেশগত বিপর্যয়। একই অবস্থা তিস্তা প্রকল্পের। সেটা শুকনো মওসূমে সুজলা সুফলা আর থাকেনা। পরিবেশগত বিপর্যয় ফুটে উঠতে শুরু করেছে। ভূগর্ভস্থ পানি সেচ কাজে বেশী ব্যবহার করায় দেখা দিয়েছে সারা দেশে আর্সেনিক বিপর্যয়, যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবেশগত বিপর্যয় হিসেবে গণ্য করা হয়।’
আতিকুর রহমান ইউসুফজাই সালু বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন বিমুখ নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে নদীর পানিতে হাত দেয়া যাবেনা, একথা কেউ বলছে না। আমাদের কথা নদীর সার্ভিসগুলো পেতে হলে নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কোথায় কতটুকু পানি দরকার তা নির্ধারনের আগে ঠিক করে নিতে হবে নদীর নিজে বেঁচে থাকার জন্য তার বুকে কতটুকু পানি প্রবাহ অবশ্যই থাকতে হবে। অর্থাৎ নদীর বেসিন-ভিত্তিক সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে, যা এখন সারা পৃথিবীর দাবী। সার্কের চেতনায় আঞ্চলিক সহযোগীতারা ভিত্তিতে বেসিন বা অববাহিকা-ভিত্তিক সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার জন্য দরকার অববাহিকার সকল দেশের অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা। কাজেই গঙ্গা ও ব্রহ্মপূত্রের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য দরকার অববাহিকার সকল দেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত, ভূটান, নেপাল এবং গনচীনের মধ্যে যৌথ পানি ব্যবস্থাপনা। একমাত্র অংশিদারিত্ব এবং সহযোগিতার মাধ্যমেই তা করা সম্ভব। ভাটির সর্বনিম্নে অবস্থিত বাংলাদেশকেই এব্যাপারে উদ্যোগি হতে হবে।
লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতমান এই চার দেশকে নিয়ে মেকং নদীর সমস্যার সমাধানে গঠিত মেকং রিভার কমিশন ও রাইন নদীর সমস্যার সমাধানে ইউরোপের ১১টি দেশকে নিয়ে গঠিত দানিয়ুব কমিশন আঞ্চলিক সহযোগীতার অনন্য নিদর্শন। এই আলোকেই বাংলাদেশের নদী-পানির সমস্যার সমাধান নিহিত।’
সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতে সৈয়দ টিপু সুলতান ইতিপূর্বে আইএফসি নেতৃবৃন্দের চীন সফরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ভারত-বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে চীনের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। প্রসঙ্গত তিনি চীন সফরের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী মরহুম কাজী জাফর আহমদের সার্বিক সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে আইএফসি নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশ ছাড়াও নিউইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীরা আইএফসি’র সাথে যুক্ত। বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পানি সমস্যার ব্যাপারে প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, নিউইয়র্ক ছাড়াও বাংলাদেশে আইএসএফসি’র পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কমিটি রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের ১৬টি জেলায়ও আইএফসির শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে নেতৃবৃন্দ বলেন, ভারতের সাথে এখন বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিরাজমান। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি উদ্যোগ নেন তাহলেই দেশের পানি সমস্যার সমাধান সহজ হবে বলে আমরা মনে করছি।