‘নাও আই অ্যাম এ ডেড হর্স’ আমরা দেশ দিয়েছি আর চান কেন?
- প্রকাশের সময় : ১২:০৪:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ অগাস্ট ২০১৫
- / ৯৪৫ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকারী, মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনেতা, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি’র কেন্দ্রীয় সভাপতি আসম আব্দুর রব বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক পায়ে চলছে, দেশ এক ব্যক্তির শাসনাধীন, জাতীয় সংসদে বিরোধী দল নেই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত ও চুরি হচ্ছে আর সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন উপযোগী নয়। আজ দেশের ১৬ কোটি মানুষ বাকরুদ্ধ। জনগণের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, নাগরিক, মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রিত। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ১৬ কোটি মানুষ না হয়ে আওয়ামী লীগ দেশের মালিক হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার বিরোধ সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু আর জিয়ার নাম মুছে ফেলা যাবে না। আমিত্ব বিলুপ্ত ছাড়া দেশের সঠিক ইতিহাস লিখা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, লিবিয়ার সঠিক ইতিহাস লিখতে ১০০ বছর লেগেছে। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান, গণতন্ত্র আর জণগনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে ‘মিথ্যা কথা বলার সংবিধান, ঠক সংবিধান’ পরিবর্তণ করতে হবে। দেশের জনগণ রাজনীতিতে দুই দলের বিকল্প শক্তি চায়। আসম রব আবেগ-আপ্লুত কন্ঠে বলেন, ‘নাও আই অ্যাম এ ডেড হর্স বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমি-আমরা দেশ দিয়েছি। আমাদের কাছে আপনারা আর চান কেন?’। তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, শেখ কামাল, মরহুম আব্দুর রাজ্জাক, মরহুম আব্দুল কদ্দুস মাখন প্রমুখকে স্মরণ করে বলেন স্বাধীনতার পর আমাদেরকে ‘বীর অধম’-এরও মর্যাদা দেয়া হয়নি। আমার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নেই। আমাকে কে দেবে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট?
নিউইয়র্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষস্থানীয় সংগঠক আসম আব্দুর রব উপরোক্ত কথা বলেন। সিটির জ্যাকসন হাইটসস্থ সাপ্তাহিক দেশ বাংলা ও বাংলা টাইমস মিলনায়তনে গত ৪ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাপ্তাহিক দেশবাংলা সম্পাদক ডা. চৌধুরী এস হাসান। এরপর আসম আব্দুর রব নি¤œলিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সাংবাদিক সম্মেলন সঞ্চালনায় ছিলেন সাপ্তাহিক বাংলা টাইমস সম্পাদক তাসের মাহমুদ। সাংবাদিক সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন জেএসডি ইউএস’র শাখার সভাপতি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন লিটন ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দীন আহমদ শামীম সহ এডভোকেট মুজিবুর রহমান, জাফর চৌধুরী, সারোয়ার হোসেন, আহসান মাসুদ প্রমুখ। খবর ইউএনএ’র।
সাংবাদিক সম্মেলনে আসম আব্দুর রব তার লিখিত বক্তব্যে উপস্থিত সাংবাদিকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, প্রবাসে থেকেও দেশকে হৃদয়ে ধারণ ও দেশের উন্নয়ন আগ্রগতিতে ব্যাপক অবদান রাখার উদ্যোগী বাংলাদেশী, বাঙালী, ভাই-বোনদের সাথে ঈদ উদযাপন ও মিলিত হতে পেরে আমি আনন্দিত এবং ঈদেও তাদের আন্তরিকতায় আমি কৃতজ্ঞ। এছাড়া ঈদের রাত থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোর পজেটিভ নিউজ করার জন্যও আপনাদেরকে ধন্যবাদ। তিনি বলেন, আমার নিউইয়র্ক আসার উদ্দেশ্য হলো হার্টসহ শারীরিক আনুসাঙ্গিক রুটিন চেক আপ। ৬ আগষ্ট বৃহস্পতিবার সর্বশেষ চেক আপটা শেষ হলে ১০ আগস্ট মিউনিক (জার্মানী)-এর প্রবাসী বাঙালীদের আমন্ত্রণে একটি গেট-টুগেদার এবং সেখান থেকে প্যারিস (ফ্রান্স)-এ দুটি অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে দেশে ফিরে যাবো।
আসম রব বলেন, আমার জীবনে ফুলটাইম পলিটিক্স ছাড়া বৈষয়িক স্বার্থে আমি কোন ব্যবসা-বানিজ্য-শিল্প কারখানা করাতো দূরের কথা-চিন্তাও করিনি। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি, স্ত্রীর খামার ও একটি রাবার ফার্ম দিয়ে সংসার চলে। নেতা-কর্মীদের অনুদান ও শুভাকাক্সখীদের সাহায্য-সহযোগীতায় দল চলে। আমার মত ফুলটাইম রাজনীতিবিদ বর্তমানে বেঁচে আছে হাতগোনা কয়েকজন মাত্র। বাকী জীবন জনগণের জন্যই কাটিয়ে দিতে চাই।
তিনি বলেন, রাজনীতিকে বলা হয় ‘আর্ট অব পসিবিলিটি’। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের স্বপ্ন ছিল, একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। প্রয়োজনে তার জন্য জীবন দেয়। যে রাষ্ট্রে প্রশাসন, বিচার বিভাগে উপনিবেশিক কাঠামোর পরিবর্তন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক এবং জনগণের নিকট সরকারের জবাবদিহিতা থাকবে।
** বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মাথা খুব মোটা। শরীরে কোন পুষ্টি নেই। তাই চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার লিপ্সাই প্রধান। এক একটা খাই খাই রোগ।
** জনগণকে বাদ দিয়ে দল বা জোট দিয়ে ‘পাওয়ার’ চেঞ্জ করা যাবে না, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোতে কোন পরিবর্তন আসবে না।
** ওদের দেখতে হাতির মত মনে হলেও চোখ দুটি ছোট। ওরা উপনিবেশায়িত রাষ্ট্র, সমাজ, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও পুঁজিবাদী সমাজ দেখে না। তারা সবসময় এ প্রসঙ্গগুলোকে চাপা দিতে চায়।
** এরা ভূয়া অপ্রয়োজনীয় কিছু ইস্যু সৃষ্টি করে। পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করে জনগণকে মাতিয়ে রাখতে চায়।
**এই ইডিয়ট বক্স-এ যে ঢুকে, সেও নির্বোধ হয়ে যায়। তাই জনগণের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে হতাশা বিদ্যমান। একদল সব ব্যর্থতার দায়িত্ব অন্যদলের ঘাড়ে তুলে দিতে চায়। এরা কামারের মত-দা, খুন্তা, কুড়াল বানাতে পারে। কিন্তু স্বর্ণালংকার বানাতে পারে না।
** গণতন্ত্র কখনো একপায়ে হাঁটতে পারেনা। সংসদে বিরোধী দল নেই।
** ডেমোক্রেসী ইজ এ প্র্যাকটিস। চর্চায় এটা সমৃদ্ধ হয়।
** আজ ১৬ কোটি মানুষ বাকরুদ্ধ। জনগণের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, নাগরিক, মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রিত।
** মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত ও চুরি হচ্ছে।
** মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হলে এ অবস্থা হতো না।
** দেশ একব্যক্তির শাসন ব্যবস্থার অধীন।
** এটা জনগণের ভোটাধিকারহরণ করা, এক ধরনের রাজতন্ত্র বা তথাকথিত পার্লামেন্টারী স্বৈরাচার।
** জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই হলো স্বাধীনতা।
** গতন্ত্র চর্চার অভাবে ভিন্নমত ও পথকে ধ্বংস করার রাজনীতি দেশকে দীর্ঘস্থায়ী সংকটে ফেলবে।
** উপনিবেশিক পদ্ধতির রাজনীতির মাধ্যমে, সমস্ত মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে দেয়া যাবে না।
** এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না।
** রাজনৈতিক শূণ্যতার কারণে সংঘাত-সংকট সমগ্রজাতির জন্য হুমকী হয়ে পড়ছে-জন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। জনগণ শংকিত ও উদ্বিগ্ন।
** ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল/অকেজো। জনগণের ক্ষমতায়ন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
** ঘুষ, দুর্নীতি, নিয়োগ ও ভর্তি বানিজ্য, দখলীকরণ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি-সম্পদ লুট, ব্যাংক-স্টক এক্সচেঞ্জের টাকা লুট ও পাচার-বিদেশে বাড়ী ক্রয় ও পাচার, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন চুক্তি ও বিনিয়োগে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের কমিশন বানিজ্য এবং আগমী ৫০ বছরের আকাশ-মাটির উপরে ও মাটির নীচের সকল ব্যবসা বিক্রি চুক্তির বিনাশ্রমের অর্থ মানুষকে-অমানুষে রূপান্তরিত করেছে।
** বর্তমান সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন উপযোগী নহে।
** এ সংবিধানের উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন গণমুখী রাষ্ট্রের অন্তরায়।
** স্বাশাষিত স্থানীয় সরকার হচ্ছে-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কর্মসূচী।
আজকের এই গুমোট-নিস্তব্দ-নির্বাক অবস্থা থেকে মুক্তির পথ অবশ্যই আছে, তবে সেটা দলীয় ভিত্তিতে নয়; জাতীয় ঐক্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, একবিংশ শতাব্দীর ভিশন-এর ভিত্তিতে এগুতে হবে।
যেমন:
ক). দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট (১মাথা ২ ভোট। স্থানীয় ও পেশাভিত্তিক)।
খ). ফেডারেল পদ্ধতির সরকার (দ্বি-কক্ষ মিলে সংসদ)।
গ). বাংলাদেশে ৮-৯টি প্রদেশ, প্রাদেশিক সরকার ও সংসদ।
ঘ). ১০-২০ বছরের জন্য জাতীয় ঐকমত্যে (ন্যাশনাল কনসার্ন- সাব-গভ.) আনতে হবে।
ঙ). ন্যাশনাল ইকোনোমিক কাউন্সিল।
চ). বিক্রয়লব্ধ শিক্ষা চালু করা/ আউট সোর্সিং ইনকামের বিস্তৃতি ঘটাতে হবে।
ছ). উচ্চকক্ষ থেকে নির্বাচনের পূর্বে ও অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।
জ). স্বাধীন-নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
ঝ) উপ আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক জোট গঠন করতে হবে।
ঞ). উচ্চকক্ষে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে ১০ জন প্রতিনিধি নিতে হবে।
ট). প্রবাসীদের বাংলাদেশে বিমান থেকে অবতরণকালীন বিশেষ মর্যাদা (ভিআইপি-সিআইপি), বিমানবন্দর থেকে তাদের বাড়ী পর্য্যন্ত-নিরাপত্তার ওয়াচ, অবজার্ভ এবং পুনরায় ফেরা পর্য্যন্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঠ). কৃষকদের জাতীয় চাহিদা ও রফতানীর জন্য উৎপাদনকৃত জমির পরিমাণ নির্দিষ্টকরণ এবং উৎপাদিত পণ্য ১০-২০% উচ্চমূল্যে রাষ্ট্রকে কিনে নিতে হবে।
ঢ). শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
ড). বিচার বিভাগীয় কাউন্সিল ও সাংবিধানিক আদালত গঠন করতে হবে। সকল মানুষের সম-অধিকার দিতে হবে।
ন). ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিতে হবে।
তাহলে দেশ মাথা উচুঁ করে শুধু মধ্য আয়ের নয়- উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে।
আসুন দেশে-বিদেশে আমরা যারাই আছি-সকলে মিলে বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ -সাম্যের দেশ হিসেবে গড়ে তুলি।
লিখিত বক্তব্যের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আসম আব্দুর রব বলেন, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, বিচার-বিভাগের স্বাধীনতা আর আইনের শাসনই মহান মুক্তিযুদ্ধের মুল চেতনা। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে আসম রব বিনয়ের সাথে বলেন, ইসলামকে যেখানে-সেখানে ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন না।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইতিহাস বলে রক্তপাত ছাড়া সামারিক শাসকরা ব্যারাকে ফিরে যায়নি। সামরিক সরকার এরশাদকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতেই আমি বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আর সেই সময়ে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আমার ভ‚মিকা ইতিহাসে লিখা রয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আসম রব বলেন, দেশের সমস্যা সমাধানে আমরা ব্যর্থ হওয়ার পরও কর্মসূচী ও প্রস্তাব রেখেছি। এরবাইরেও যদি কারো নতুন কোন প্রস্তাব বা পরামর্শ থাকে তাহলে তা আমাদের সামনে নিয়ে আসুন। সবাই মিলেই দেশটা গড়তে হবে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে রব বলেন, বাংলাদেশে আর কোন দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু, রব-তোফায়েল, শাজাহান সিরাজ বা মাখনের জন্ম হবে না। তাই কারো সাথে কারো তুলনা করা ঠিক হবে না।