মোশতাক-চাষী নজরদারিতেই ছিলেন
- প্রকাশের সময় : ০৮:৫৪:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০১৬
- / ১৪৩৮ বার পঠিত
ঢাকা: বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তিতে প্রথম আলো কথা বলেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা সচিব হোসেন তৌফিক ইমাম ওরফে এইচ টি ইমামের সঙ্গে। তিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ গ্রন্থের লেখকও তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
* ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার তাঁর একটি বইয়ে লিখেছেন, মুজিবনগর সরকারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ভারতীয় সরকার বিদেশি সাংবাদিকদের এই ধারণা দিয়েছেন যে এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত।
এইচ টি ইমাম: এটা অর্ধ সত্য। মুজিবনগর বলে কোনো সরকার ছিল না। প্রবাসী সরকার কথাটিও ঠিক নয়। সরকার ছিল গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ২৬ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। ভারতের শিলিগুড়ির কাছাকাছি একটি এলাকায় নতুন গণপরিষদ ও সরকারের যাত্রা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত ও পাঠ করা হয় ১০ এপ্রিল ১৯৭১। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় নতুন সরকার শপথ নিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সমার্থক। যুদ্ধকালীন সরকারের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম মূল উদ্বেগ ছিল বঙ্গবন্ধুর মুক্তি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভাতেই অশ্রুসিক্ত হতেন।
* ১৯৬৯-৭১-এর মার্চ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে আপনি ডিসি ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাহাড়ি নেতাদের ভূমিকা কী ছিল?
এইচ টি ইমাম: এম এন লারমা ছিলেন চীনপন্থী মার্ক্সবাদী। এম এন লারমার সঙ্গে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের মিল ছিল না। ত্রিদিব রায় শতভাগ পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। তার দুটো কারণ। তাঁর যদিও ভারতের পক্ষে থাকার কথা। ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায় নামকরা অভিনেত্রী সাধনা মুখার্জির বোন। খুবই সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবার। ত্রিদিব রায়ের বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী কর্নেল হিউমের। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার হয়ে এসেছিলেন। তিনি ডিসি থাকতেই তাঁর বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। আমরা যখন অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ নিয়ে রামগড়ে আশ্রয় নিই, তখন পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে এসেছিলেন কর্নেল হিউম। তখন থেকেই পাকিস্তানীদের কাছে ত্রিদিব রায় নয়নের মণি হয়ে ওঠেন।
* ত্রিদিব রায় কি কোনো অপরাধ করেছিলেন?
এইচ টি ইমাম: না। হতে পারে পাকিস্তানী রাজনীতিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল। এম এন লারমা পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে পাহাড়িদের স্বাধীনতার জন্য পাহাড়িদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ২৫ মার্চের পরে রাজনৈতিক নেতারা আমাকে চট্টগ্রাম-নোয়াখালীর প্রশাসক নিয়োগ দেন। আমরা কিন্তু চট্টগ্রাম-নোয়াখালী শুভপুর ব্রিজের যুদ্ধ হওয়া (২ মে) পর্যন্ত স্বাধীন রেখেছিলাম। ওই সময়ে প্রশাসন পরিচালনা ও জনযুদ্ধ সমার্থক হয়ে উঠেছিল। মে মাসের মধ্যেই মন্ত্রণালয় এবং সচিব নিয়োগ সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ একদিকে যেমন জনযুদ্ধ আবার তা পরিচালিত হয়েছে গণতান্ত্রিক উপায়ে একটি রাজনৈতিক নেতৃত্বে। সংক্ষেপে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি সফল ও সার্থক জনযুদ্ধ। আবার সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনায় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী ও তাঁর সামরিক প্রশাসন। সামরিক অধিনায়কেরা অপারেশন পরিচালনায় স্বাধীন থাকতেন।
* মুক্তিযুদ্ধকালে জনপ্রশাসন নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ থেকে নাকি কলকাতা থেকে হতো?
এইচ টি ইমাম: সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহায়তা দিয়েছে আঞ্চলিক বেসামরিক দপ্তর। পরে সেটাই জোনাল কাউন্সিল হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায়। কালুরঘাট থেকে আগরতলায় ১০ মেগাওয়াটের ট্রান্সফরমার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা দিয়ে ভালো শোনা যেত না। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে এপ্রিলের শেষে আমরা আগরতলার গভর্নরের বাড়িতে কথা বলি। মুক্তিপাগল ছাত্র-যুবক শুধু ভারতে আশ্রয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। তারা চেয়েছিল অস্ত্র। পূর্ব পাকিস্তানের জিওলজিক্যাল সার্ভে প্রধান হাবিবুর রহমানের পরিকল্পনায় যুব সংগঠন গড়ে তোলা হলো। যে কাজ যে ভালো পারবে, তাকে সেটাই দেওয়ার জন্য একটা সুন্দর জনপ্রশাসন গড়ে উঠেছিল। এই ধারণা আমরা মিসেস গান্ধীকে দিতেই তিনি তা লুফে নিলেন। মিসেস গান্ধীকে আরও বললাম, আমরা যাতে স্বাধীনভাবে বেতার কেন্দ্র চালাতে পারি, সে জন্য একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার দিন। কলকাতায় একটি বাড়ি দিন। তিনি রাজি হলেন। পরে কলকাতার বালিগঞ্জে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কার্যক্রম চলেছে।
* মুক্তিযুদ্ধে নির্বাচিত নেতাদের অধীনে জনপ্রশাসন চললেও এখন আমরা মূলত জেলা প্রশাসকনির্ভর একটি প্রশাসন গড়ে তুলেছি। ডেপুটি কমিশনার অর্থ কি জেলা প্রশাসক?
এইচ টি ইমাম: ডেপুটি কমিশনারের কার্যক্রম আলাদা। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার বিষয়টি এসে যায়। ডেপুটি কমিশনার কোনো নির্দিষ্ট পদ নয়। তার প্রথম পরিচয় ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। পরে হয়েছে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এ দুটোই তাঁর মূল কাজ। পরে আমরা ডেপুটি কমিশনার করেছি। কারণ তাঁর একজন সমন্বয়কারী দরকার। এখন আমরা উপজেলা পরিষদের মতো জেলা পরিষদ করতে যাচ্ছি। যিনি চেয়ারম্যান হবেন, তিনি প্রশাসক হবেন না। প্রশাসক হবেন জেলা প্রশাসক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কিন্তু মূল বিষয় ছিল না। বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রশ্নও ছিল না। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করেছিলেন, তাঁদেরই ডিসি-এসপি পদে বসানো হয়েছিল।
* একটা সমালোচনা হলো আপনারা স্বাধীনতার পরে স্ক্রিনিং কমিটি করলেও সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করেননি, পাকিস্তানী প্রশাসনকেই সুরক্ষা দিয়েছিলেন।
* এটা ঠিক যে, অধিকাংশকেই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আনুগত্যের নীতি (স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ) বিবেচনা করেই নিয়োগ ও বদলি করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান আসার আগ পর্যন্ত সেই ধারাই বজায় ছিল।
* দু-একটি স্মরণীয় ঘটনা?
এইচ টি ইমাম: জিয়াউর রহমান কালুরঘাটে বলেছিলেন, সপ্তম নৌবহর আসতে পারে, তাই তিনি কক্সবাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। কিন্তু তা না করে তিনি কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা, মহালছড়ি হয়ে রামগড়ে এলেন। রামগড়েই তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, জিয়াউর রহমান সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।
* বলেন কি? এপ্রিলের দিকে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের কথা জিয়া বলেছিলেন, তার প্রমাণ কি?
এইচ টি ইমাম: মুক্তিযুদ্ধের আগাগোড়াই জিয়াকে যুদ্ধে অংশ নিতে দেখা যায়নি। আর সপ্তম নৌবহরের কথা রামগড়ে তিনি আমাকেও বলেছিলেন। তখন সেখানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁর মধ্যে দুজন এখন বর্তমানে সংসদ সদস্য। তাঁরা হলেন মেজর রফিক ও মেজর জেনারেল ভূঁইয়া।
* বঙ্গবন্ধু তাহলে তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিলেন কেন?
এইচ টি ইমাম: কর্নেল ওসমানী মূলত ঢালাওভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেক্টর কমান্ডারদের প্রায় সবাইকেই এই খেতাব দেওয়া হয়। আর তিনি আমার জানামতে কোনো সম্মুখসমরে অংশ নেননি। যেমনটা নিয়েছেন খালেদ মোশাররফ, কে এম সফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী, সি আর দত্ত ও জেনারেল মঞ্জুর।
* মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনার খরচ কীভাবে মেটানো হয়েছে?
এইচ টি ইমাম: আমাদের সরকার ছিল ছোট, কিন্তু অত্যন্ত সুগঠিত ও দক্ষ। জ্যেষ্ঠ ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সংখ্যা হয়তো ১০০-র বেশি ছিল না। আমরা কিন্তু সরকার ও জনপ্রশাসন চালাতে ভারত সরকার থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য নিইনি। ট্রেজারির অর্থ ছাড়াও ভারতীয় ট্রেডিং করপোরেশনের মাধ্যমে বিদেশে চা ও পাট রপ্তানি করেছি। আমাদের কোনো মুদ্রা ছিল না। পাকিস্তানী মুদ্রা যা নেওয়া হয়েছিল, সেটা ভারতীয় মুদ্রায় রূপান্তর করা হয়েছিল। আমরা ভারতীয় মুদ্রায় বেতন-ভাতা পেতাম। ডিসি হিসেবে মাসে আড়াই হাজার টাকা পেতাম। মন্ত্রিসভা সচিব হিসেবে নিতাম ৫০০ টাকা।
* খোন্দকার মোশতাককে নিয়ে কলকাতায় কী ঘটেছিল?
এইচ টি ইমাম: ভারতের কংগ্রেস নেতা ড. ত্রিগুণা সেন, যাকে মিসেস গান্ধী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশ বিরোধী ছিলেন। আমেরিকাপন্থী হিসেবে ড. সেন ও তাঁর গ্রুপের একটা পরিচিতি ছিল। আর সেই গ্রুপের সঙ্গে খোন্দকার মোশতাকের দহরম-মহরম ছিল। তাদের মাধ্যমেই খোন্দকার মোশতাক, মাহবুব উল আলম চাষী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখের কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খোন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে যাওয়ার প্রস্তুতি কিন্তু মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তক্রমেই হয়েছিল। তাঁর স্যুট পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন জানা গেল, পাকিস্তান থেকে সেখানে যাবেন শাহ আজিজুর রহমান, আর সেখানে গিয়ে তাঁরা কনফেডারেশনের ঘোষণা দেবেন। তখন ভিন্ন একটি কারণ দেখিয়ে মোশতাকের যাত্রা শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়েছিল। সেই শাহ আজিজ কিন্তু নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন, কিন্তু জিয়া তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন।
* মোশতাক-চাষী দুজনের ওপরই বিশেষ নজরদারি ছিল?
এইচ টি ইমাম: মোশতাক ও চাষী বসতেন হাইকমিশন অফিস, মানে ইস্পাহানি ভবনে। আমরা থিয়েটার রোডে। চাষী ও ঠাকুর কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতেন। সে কারণে আমারই উদ্যোগে জুলাই থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সচিবদের নিয়ে সাপ্তাহিক সভা আরম্ভ করেন। এতে প্রত্যেক সচিবকে তাঁর মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে হতো। এর মাধ্যমে চাষিকে সরাসরি সরকারি কর্তৃত্বে নিয়ে আসা হয়েছিল।
* আপনাকে ধন্যবাদ।
এইচ টি ইমাম: আপনাকেও ধন্যবাদ। (প্রথম আলো)