নিউইয়র্ক ১২:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

৪৫তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২৫ মার্চ : বাঙালী জাতির গৌরবের দিন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:৩১:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০১৬
  • / ৬৯২ বার পঠিত

ঢাকা: ‘স্বাধীনতাহীনতায়
কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃংখল বল
কে পরাবে পায় হে কে পরাবে পায়।’
বাঙালী জাতির গৌরবের দিন, আনন্দের দিন ২৬ মার্চ। পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে মাথাউঁচু করে দাঁড়ানোর দিন ২৬ মার্চ। দিনটি ৪৫তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ব্রিটিশ-ভারতে পরাধীনতার শৃংখলমুক্তি ও স্বাধীনতার আকাংক্ষা নিয়ে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম দুর্দান্ত সাহস নিয়ে এ পংক্তিমালা উচ্চারণ করেছিলেন। এ সাহসী উচ্চারণের পথ ধরেই একাত্তরের অগ্নিগর্ভা দিনে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- ‘পৃথিবীর এক প্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে/দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’
নিত্যদিনের মতো আজও ভোরের সূর্যালোকের বর্ণচ্ছটায় রাঙাবে কৃষ্ণচূড়া, গ্রামীণ পথের শেষে নদীর তীরে অশ্বত্থ শাখা থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান, শ্যামল প্রান্তরের দূর-দূরান্ত থেকে বাজবে রাখালিয়ার মনকাড়া বাঁশির সুর, নীল আকাশের বুকে ডানা মেলবে উড়ন্ত বলাকার ঝাঁক, কলকাকলিতে মুখরিত হবে জনপদ। তবুও অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে আজকের দিনটি সম্পূর্ণ আলাদা। মৃত্যুপণ লড়াই ও রক্তসমুদ্র পাড়ি দিয়ে বীর বাঙালী জাতি ছিনিয়ে এনেছে জাতীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন- স্বাধীনতা।
স্বাধিকার আদায়ের দৃঢ় মনোবল নিয়ে পশুশক্তিকে পরাজিত করে ঘোর অন্ধকার-অমানিশা কাটিয়ে বাংলার চিরসবুজ জমিনে রক্তে রাঙানো লাল- সবুজ পতাকার ভ্রুণ জন্ম নেয় আজকের ঐতিহাসিক দিনটিতেই। সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দু’শ বছরের ব্রিটিশ-বেনিয়া শাসনের অবসানের পর ২৪ বছর ধরে বিজাতীয় ভাষা, গোষ্ঠীর শাসন ও শোষণ। এ পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে আজকের দিনে মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশেই বাংলার মানুষের স্বপ্ন-সাধ ও কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সূচনা ঘটে। একদিনের ঘোষণায় বা কারও বাঁশির শব্দ শুনে গোটা জাতি জীবনবাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। ’৪৭-এ অদ্ভুত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভক্তির পর থেকেই উর্দু শাসকদের নানা কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বাঙালীর রক্ত সংগ্রামের চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। মাতৃভাষার দাবিতে সেই ’৪৮ সাল থেকে শুরু করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তদান সংগ্রাম-আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জাতির রায়, ’৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তিসনদ ঘোষণা, ’৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় এবং ’৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায়ই এসেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং স্বপ্নের স্বাধীনতা।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ জগদ্বিখ্যাত ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। খুঁজে পায় গেরিলা যুদ্ধের গোপন কৌশল ও করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। তারপরও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুর ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর জাতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সমগ্র জাতি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান বুকে ধারণ করে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালির রক্তের বন্যায় ভেসে যায় পাকিস্তানের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দু’লক্ষাধিক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’। প্রায় এক কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান, রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহ ও কূটনৈতিক সমর্থন, সমগ্র মুক্তিকামী বিশ্ব ও জনতার আকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই পৃথিবীর মানচিত্রে আরও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্ম- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত দিনটিতে সমগ্র জাতি আজ বাঁধভাঙা প্রাণের উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হবে। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব স্মৃতির মিনার। হৃদয়পটে সৃষ্ট গভীর ক্ষত থেকে ভেসে উঠবে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’- এ পক্তিমালার মর্মার্থ।
যেভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা: রাত ১২টায় খবর আসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে হামলা করেছে। রাত পৌনে ১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে তার বাসভবনেই অবস্থান করতে থাকেন। পাক সামরিক সরকারের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তার ব্যারিকেড সরিয়ে কর্নেল জহিরের নেতৃত্বে একটি কমান্ডো প্লাটুন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন হুমায়ুন বঙ্গবন্ধু ভবনের দেয়ালের চারদিকে অবস্থান নেয়। মেজর বিলাল বঙ্গবন্ধু ভবনের দোতলার একটি বন্ধ ঘরের দরজা ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তারা বঙ্গবন্ধুকে ট্যাংক-কামানসহ কড়া পাহারায় শেরেবাংলা নগরের সামরিক সদর দফতরে নিয়ে যায়। পরে তাকে নেয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে। টিক্কা খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখান থেকেই পরদিন নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রামে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজের সেটেও ধরা পড়ে। শুনতে পান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখার প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিকও। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণার খবরটি পাকিস্তান সরকার ও ইস্টার্ন জোনের সামরিক কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। ওয়্যারলেস বার্তাটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জহুর আহম্মেদ চৌধুরী পেয়ে রাতেই তা সাইক্লোস্টাইল করে বিলির ব্যবস্থা করেন। পরদিন এ বার্তাটিই কালুরঘাট বেতার থেকে সর্বপ্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান। তারপর বারবার ঘোষণাটি পড়ে শোনান অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি পাঠ করানোর জন্য মেজর জিয়াকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন চট্টগ্রামের বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। মেজর জিয়া প্রথমে নিজেকে সুপ্রিম কমান্ডার ঘোষণা করে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র হামলা, শত শত ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা, বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারসহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকাসহ গোটা দেশেই শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
কর্মসূচি: মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রক্তদান কর্মসূচি, র‌্যালি প্রভৃতি।
আওয়ামী লীগ: সূর্যোদয়ের ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। এছাড়া টুঙ্গীপাড়ায় পৃথক কর্মসূচি রয়েছে। পরের দিন রোববার বিকাল সাড়ে তিনটায় কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনায় অংশ নেবেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা।
বিএনপি: সকাল সাড়ে ৭টায় শেরে বাংলা নগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ও সকাল সাড়ে ৮টায় শেরে বাংলা নগরে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং বিকাল তিনটায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা কর্মসূচি রয়েছে। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

৪৫তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২৫ মার্চ : বাঙালী জাতির গৌরবের দিন

প্রকাশের সময় : ১০:৩১:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০১৬

ঢাকা: ‘স্বাধীনতাহীনতায়
কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃংখল বল
কে পরাবে পায় হে কে পরাবে পায়।’
বাঙালী জাতির গৌরবের দিন, আনন্দের দিন ২৬ মার্চ। পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে মাথাউঁচু করে দাঁড়ানোর দিন ২৬ মার্চ। দিনটি ৪৫তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ব্রিটিশ-ভারতে পরাধীনতার শৃংখলমুক্তি ও স্বাধীনতার আকাংক্ষা নিয়ে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম দুর্দান্ত সাহস নিয়ে এ পংক্তিমালা উচ্চারণ করেছিলেন। এ সাহসী উচ্চারণের পথ ধরেই একাত্তরের অগ্নিগর্ভা দিনে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- ‘পৃথিবীর এক প্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে/দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’
নিত্যদিনের মতো আজও ভোরের সূর্যালোকের বর্ণচ্ছটায় রাঙাবে কৃষ্ণচূড়া, গ্রামীণ পথের শেষে নদীর তীরে অশ্বত্থ শাখা থেকে ভেসে আসবে কোকিলের কুহুতান, শ্যামল প্রান্তরের দূর-দূরান্ত থেকে বাজবে রাখালিয়ার মনকাড়া বাঁশির সুর, নীল আকাশের বুকে ডানা মেলবে উড়ন্ত বলাকার ঝাঁক, কলকাকলিতে মুখরিত হবে জনপদ। তবুও অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে আজকের দিনটি সম্পূর্ণ আলাদা। মৃত্যুপণ লড়াই ও রক্তসমুদ্র পাড়ি দিয়ে বীর বাঙালী জাতি ছিনিয়ে এনেছে জাতীয় ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন- স্বাধীনতা।
স্বাধিকার আদায়ের দৃঢ় মনোবল নিয়ে পশুশক্তিকে পরাজিত করে ঘোর অন্ধকার-অমানিশা কাটিয়ে বাংলার চিরসবুজ জমিনে রক্তে রাঙানো লাল- সবুজ পতাকার ভ্রুণ জন্ম নেয় আজকের ঐতিহাসিক দিনটিতেই। সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দু’শ বছরের ব্রিটিশ-বেনিয়া শাসনের অবসানের পর ২৪ বছর ধরে বিজাতীয় ভাষা, গোষ্ঠীর শাসন ও শোষণ। এ পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে আজকের দিনে মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশেই বাংলার মানুষের স্বপ্ন-সাধ ও কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সূচনা ঘটে। একদিনের ঘোষণায় বা কারও বাঁশির শব্দ শুনে গোটা জাতি জীবনবাজি রেখে মরণপণ লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। ’৪৭-এ অদ্ভুত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভক্তির পর থেকেই উর্দু শাসকদের নানা কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বাঙালীর রক্ত সংগ্রামের চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। মাতৃভাষার দাবিতে সেই ’৪৮ সাল থেকে শুরু করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তদান সংগ্রাম-আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জাতির রায়, ’৫৬-তে এসে সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফার মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তিসনদ ঘোষণা, ’৬৯-এর ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় এবং ’৭০-এ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ বিজয়ের ধারাবাহিকতায়ই এসেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং স্বপ্নের স্বাধীনতা।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ জগদ্বিখ্যাত ঘোষণার মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যায়। খুঁজে পায় গেরিলা যুদ্ধের গোপন কৌশল ও করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা। তারপরও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুর ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর জাতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সমগ্র জাতি দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান বুকে ধারণ করে আত্মশক্তিতে বিশ্বাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিপাগল বাঙালির রক্তের বন্যায় ভেসে যায় পাকিস্তানের দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দু’লক্ষাধিক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, জ্বালাও-পোড়াও অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’। প্রায় এক কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান, রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহ ও কূটনৈতিক সমর্থন, সমগ্র মুক্তিকামী বিশ্ব ও জনতার আকুণ্ঠ সমর্থন এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই পৃথিবীর মানচিত্রে আরও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্ম- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত দিনটিতে সমগ্র জাতি আজ বাঁধভাঙা প্রাণের উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হবে। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব স্মৃতির মিনার। হৃদয়পটে সৃষ্ট গভীর ক্ষত থেকে ভেসে উঠবে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’- এ পক্তিমালার মর্মার্থ।
যেভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা: রাত ১২টায় খবর আসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে হামলা করেছে। রাত পৌনে ১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে তার বাসভবনেই অবস্থান করতে থাকেন। পাক সামরিক সরকারের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তার ব্যারিকেড সরিয়ে কর্নেল জহিরের নেতৃত্বে একটি কমান্ডো প্লাটুন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন হুমায়ুন বঙ্গবন্ধু ভবনের দেয়ালের চারদিকে অবস্থান নেয়। মেজর বিলাল বঙ্গবন্ধু ভবনের দোতলার একটি বন্ধ ঘরের দরজা ভেঙে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তারা বঙ্গবন্ধুকে ট্যাংক-কামানসহ কড়া পাহারায় শেরেবাংলা নগরের সামরিক সদর দফতরে নিয়ে যায়। পরে তাকে নেয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনীর অফিসার্স মেসে। টিক্কা খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখান থেকেই পরদিন নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রামে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজের সেটেও ধরা পড়ে। শুনতে পান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখার প্রধান মেজর সিদ্দিক সালিকও। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণার খবরটি পাকিস্তান সরকার ও ইস্টার্ন জোনের সামরিক কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। ওয়্যারলেস বার্তাটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জহুর আহম্মেদ চৌধুরী পেয়ে রাতেই তা সাইক্লোস্টাইল করে বিলির ব্যবস্থা করেন। পরদিন এ বার্তাটিই কালুরঘাট বেতার থেকে সর্বপ্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান। তারপর বারবার ঘোষণাটি পড়ে শোনান অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি পাঠ করানোর জন্য মেজর জিয়াকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন চট্টগ্রামের বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহম্মেদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। মেজর জিয়া প্রথমে নিজেকে সুপ্রিম কমান্ডার ঘোষণা করে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র হামলা, শত শত ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা, বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারসহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকাসহ গোটা দেশেই শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
কর্মসূচি: মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রক্তদান কর্মসূচি, র‌্যালি প্রভৃতি।
আওয়ামী লীগ: সূর্যোদয়ের ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। এছাড়া টুঙ্গীপাড়ায় পৃথক কর্মসূচি রয়েছে। পরের দিন রোববার বিকাল সাড়ে তিনটায় কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনায় অংশ নেবেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা।
বিএনপি: সকাল সাড়ে ৭টায় শেরে বাংলা নগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ও সকাল সাড়ে ৮টায় শেরে বাংলা নগরে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং বিকাল তিনটায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা কর্মসূচি রয়েছে। (দৈনিক যুগান্তর)