নিউইয়র্ক ০১:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

১৯৭১ : নথি গায়েব যুদ্ধশিশুর

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৩৫:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ মার্চ ২০১৬
  • / ৮৯৭ বার পঠিত

ঢাকা: একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কাছে দত্তক হিসেবে পাঠানো হতো তখনকার সমাজকল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে। দত্তকায়ন হতো এ বিভাগের ‘ভবঘুরে’ শাখার মাধ্যমে। ওই সময়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ এখন সমাজসেবা অধিদপ্তর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভবঘুরে শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, একটি সাধারণ খোলা শেলফের নিচের দিকে দত্তক দেওয়ার কিছু নথি পড়ে আছে। ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে আড়াই হাজার শিশু বিদেশে দত্তক পাঠানোর তথ্য জানা গেলেও সেখানে নথি পাওয়া গেছে প্রায় ৭০০। বাকি ১৮০০ নথিই হারিয়ে গেছে বা গায়েব করা হয়েছে। ওই সময় সবাইকে ‘পরিত্যক্ত শিশু’ নামেই বিদেশে পাঠানো হয়। সরকারি নথিপত্রে ‘যুদ্ধশিশু’ বলে কোনো শব্দ উল্লেখ ছিল না। পরে আধুনিকমনস্ক ব্যক্তিরা একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারদের দ্বারা এ দেশের নির্যাতিত নারীদের গর্ভে যে শিশুদের জন্ম হয়, তাদেরকে নাম দেন ‘যুদ্ধশিশু’।
সংশ্লিষ্টরা অনুমান করছেন, বিদেশে দত্তক দেওয়া ওই আড়াই হাজার শিশুর মধ্যে বেশির ভাগই যুদ্ধশিশু। অন্যরা বিভিন্নভাবে পরিত্যক্ত।
১৯৭৬ সালের মে থেকে ১৯৮০ সালের মে মাস পর্যন্ত সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন মীজানুর রহমান শেলী। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে যুদ্ধশিশুদের পাঠানো হয়েছিল। পরে তার সঙ্গে অভিভাবকহীন ও পরিত্যক্ত শিশুদের বিদেশে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। যুদ্ধশিশুদের পাঠানো শুরু হয় ১৯৭২ সালে। আমার ধারণা, দেড় হাজারের বেশি পরিত্যক্ত শিশুকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল। শিশুদের দত্তক হিসেবে পাঠানোর পর আমি নেদারল্যান্ডস ও কানাডা সফর করে তাদের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম। নেদারল্যান্ডসে ১৪-১৫টি পরিবারে গিয়েছিলাম। বিদেশি ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশীরা মানবিক কারণে শিশুদের দত্তক নিয়েছিলেন। তবে সব নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। আমরা সারা দেশে মাত্র পাঁচ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে কাজ করেছি।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরে দত্তক শিশুদের সব নথিপত্র নেই বলে স্বীকার করেন সংস্থার পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) জুলফিকার হায়দার। তিনি বলেন, ‘আমাদের অফিসের স্থান তিন দফা পরিবর্তন করা হয়েছে। বহু ফাইল মিসিং হয়েছে। সেটা বুঝতেই পারছেন। বিদেশে যাওয়া সেই শিশুরা এখন যুবক-যুবতী হয়ে ঢাকায় আমাদের অফিসে এসে তথ্য জানতে চায়। আমরা তা দিতে পারছি না।’
একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালী নিধনযজ্ঞের পাশাপাশি এ দেশের নারীদের নির্যাতন করেছে নির্বিচারে। এতে করে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ করতে হয়েছিল অনেক নারীকে। প্রথম দিকে ধর্ষিত নারীর সংখ্যা দুই লাখ বলা হলেও পরবর্তী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ওই সংখ্যা সাড়ে চার লাখের বেশি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ব গির্জা পরিষদের এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর শেষে জেনেভায় গিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধের ৯ মাসে হানাদার বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশের যে দুই লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছেন তাঁরা এখন মুসলিম সমাজে একঘরে হয়ে পড়েছেন। কার্যত তাঁদের যাওয়ার কোনো ঠাঁই নেই। বাস্তব কারণেই গোপনে গর্ভপাত করাতে বাধ্য হয়েছেন বেশির ভাগ ধর্ষিত নারী। সন্তানকে আলোর মুখ দেখিয়ে বহু মা ‘কলঙ্ক’ থেকে রেহাই পেতে আত্মাহুতি দেন। পরিবারের সম্মান বাঁচাতে অনেক অনাহৃত সন্তানকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল রাস্তায় কিংবা হাসপাতালের বেডে। রেখে যাওয়া সন্তানকে কেউ আশ্রয় দেবে এমন আশা ছিল তাঁদের।
যুদ্ধ শেষে এসব শিশুর লালন-পালন, আশ্রয় ও পরবর্তী সময়ে বেড়ে ওঠা নিয়ে তৎকালীন সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। মানবতাবাদী কর্মী ও বিদেশি সংস্থার কর্মকর্তারা যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে এগিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রপতির এক বিশেষ আদেশের আওতায় সরকার ১৯৭২ সালে আন্তর্দেশীয় শিশু দত্তকায়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এর আওতায় পরিত্যক্ত শিশু ঘোষণা করে যুদ্ধশিশুসহ অন্য পরিত্যক্ত শিশুদের পাঠানো হয় বিদেশে।
ওই সময় দত্তকায়নে জড়িত ছিল এমন সংস্থাগুলোর একাধিক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কমপক্ষে আড়াই হাজার শিশু বিদেশে পাঠানো হয়েছিল দত্তক হিসেবে। এ-সংক্রান্ত এক তালিকা থেকে দেখা যায়, নেদারল্যান্ডসে পাঠানো হয়েছিল ২৩৪ শিশু। নরওয়েতে ২০০ এবং ফ্রান্সে অন্তত ৬০ শিশুকে পাঠানো হয়েছিল। শুরুর দিকে একদিনেই কানাডায় পাঠানো হয়েছিল ১৫ শিশুকে।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ মিশনারি জন হোস্টিংস একাত্তরের জুনে নিউজউইক সাময়িকীকে বলেছিলেন, ‘সেনারা মেয়েদের পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। তারপর বেয়নেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছে তাদের।’ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে সীমান্তের ওপারে পেট্রাপোল ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া এক তরুণী টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, ‘দরজা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে কয়েকজন সৈন্য। …আমার চোখের সামনে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলে মা আর বাবাকে। মেঝের ওপর ফেলে তিন সেনা মিলে ধর্ষণ করে আমাকে।’ ১৯৭১ সালের ২১ জুন টাইম ম্যাগাজিনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। ত্রিপুরার এক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া আরেক বাঙালী তরুণী টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, পালিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ১৩ জন পাকিস্তানী সেনা পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
এভাবে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার স্মারক যুদ্ধশিশুরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র, হাসপাতাল ও বেবি হোম থেকে তখন ‘অনাকাঙ্খিত’ শিশুদের বড় একটি অংশের ঠিকানা হয়েছিল ঢাকার ২৬ ইসলামপুরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির শিশু সদনে। মাদার তেরেসাও এসেছিলেন ঢাকায়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও দত্তকায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, শিশুদের পাঠানো হয়েছিল কানাডা, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ফ্রান্স, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে। এসব দেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে পরিত্যক্ত শিশুদের দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ দেশেও এসব সংস্থার শাখা ছিল। কানাডায় ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন, নেদারল্যান্ডসে ইউনিকো, ফ্রান্সে ট্রি দ্য হোমস, নরওয়েতে নওরেজিয়ান অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু দত্তকায়ন প্রকল্পে যুক্ত ছিল। সংশ্লিষ্ট থানা, মিশনারিজ অব চ্যারিটি বা অন্য কোনো বেবি হোমের প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ও যে দেশে দত্তক পাঠানো হবে সে দেশের সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে উপযুক্ত পরিবারে শিশুদের দত্তক দেওয়া হয়েছিল।
মিশনারিজ অব চ্যারিটি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২১ জানুয়ারী মাদার তেরেসা ঢাকার ২৬ ইসলামপুরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির ঢাকা শাখা স্থাপন করেন। যুদ্ধে যেসব শিশু পরিবার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের একটি অংশও সেখানে আশ্রয় পেয়েছিল। বহু নির্যাতিত নারীও সেখানে সন্তান প্রসব করেন। বেশির ভাগ শিশু সেখান থেকে বিদেশি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দত্তক মা-বাবা পান।
যুদ্ধশিশু গবেষকদের কাছ থেকে জানা গেছে, মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে বিভিন্ন জেলায় ভূমিষ্ঠ যুদ্ধশিশুদেরও পাঠানো হতো। কমপক্ষে ২০ হাজার শিশুকে সেখানে রাখা হয়েছিল। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালেও তখন যুদ্ধশিশুরা আশ্রয় পেয়েছিল।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিত্যক্ত শিশুদের অনেকেরই সঠিক নাম জানা যেত না। পাসপোর্টের জন্য বা সরকারি সার্টিফিকেটের জন্য তাদের নতুন নাম রাখা হতো। বেশির ভাগের ঠিকানায় লেখা হতো সরকারি বেবি হোমের ঠিকানা। দাদা-দাদি অথবা পিতৃ-মাতৃহীন আত্মীয়দের মধ্যে কেউ শিশুদের বেবি হোমে দিয়ে যেতেন। বাবা-মা ভরণ-পোষণে অক্ষম হওয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এফিডেভিট করে তাঁদের দাবি ত্যাগ করেও শিশুকে দত্তক দিতেন। সমাজকল্যাণ বিভাগ কখনো কখনো তাদের কাছে আসা শিশুদের বয়স ও প্রাপ্তিস্থান উল্লেখ করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিত।
পাওয়া যায় না নথি: ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে দুই মাসের যুদ্ধশিশু আরিফ চৌধুরী লনিকে পাঠানো হয়েছিল সুইডেনের স্যান্ডবার্গে। কস্তা হগো সানবিল ও খ্রিস্টিনা এলিজাবেথ সানডেলের পরিবারে ছেলে হিসেবে লনিকে গ্রহণ করা হয়। বড় হয়ে জন্মভূমির নাম জানতে পেরে উদগগ্রীব লনি ২০১৩ সাল থেকে একের পর এক চিঠি লিখে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ জানতে। সুইডেন দূতাবাস থেকেও লনির আদি ঠিকানা বের করে দিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরে চিঠি আসছে প্রতিবছর। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট সুইডেন দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারি ইমা এরিকসন তাঁর লেখা চিঠিতে লনির মূল ঠিকানা জরুরি ভিত্তিতে বের করে দেওয়ার আবেদন করেন। সেই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় লনিকে দত্তক দেওয়ার সময় তার পালক মা-বাবার কাছে দেওয়া আদেশপত্রটি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভবঘুরে শাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লনিকে দত্তক পাঠানো-সংক্রান্ত নথি খোঁজাখুঁজি করেও পাননি। লনির পাসপোর্টে তার ঠিকানা হিসেবে ‘ঢাকা’ লেখা ছিল।
সুলতানার নাম নেই তালিকায়: নেদারল্যান্ডসে থিয়া ও ক্রিস দম্পতির কাছে দত্তক দেওয়া হয়েছিল সুলতানাকে। সে দেশে তাঁর নাম হয়ে যায় সুলতানা ভ্যান ডি লিস্ট। চট্টগ্রামের চান্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীর কোনো গ্রামে জন্ম হয়েছিল—তা জানতে পেরে গত ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় আসেন সুলতানা। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন স্বামী ইউরি জেকবস ও ১০ বছরের ছেলে নোয়া আবেদ নাবিলা জেকবসকে। ঢাকা থেকে দোহাজারী গিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেও সুলতানা কোনো হদিস পাননি নিজ গ্রামের। ফিরে গেছেন ১২ ফেব্রুয়ারী। গত ১১ ফেব্রুয়ারী রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় আলাপকালে সুলতানা বলেন, ‘নাড়ির টানে এসে কাউকে খুঁজে পাইনি। একাধিক পরিবার থেকে দাবি করা হচ্ছে তারা আমার স্বজন। ডিএনএ পরীক্ষা না করলে তা বোঝা যাবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নেদারল্যান্ডসে পাঠানো ২৩৪ জনের তালিকায় সুলতানার নাম নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরেও এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য মেলেনি। নেদারল্যান্ডসে দত্তক দেওয়া বাংলাদেশীদের তথ্য সংগ্রহ করছেন সে দেশের সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা মো. ইসমাইল শরীফ। তিনি বলেন, ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ওই সংস্থার হয়ে বাংলাদেশে কাজ করেছেন। তাঁর জানা মতে, কমপক্ষে ২০ জন শিশু নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে এসেছেন শিকড়ের খোঁজে। এসেছিলেন চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া ফিলোমিন, নোয়াখালীতে জন্ম নেওয়া আলম ভেন্ডার কই, ময়মনসিংহে জন্ম নেওয়া কমলা। মোতালিব নামের একজন অবশ্য নিজ গ্রামের খোঁজ পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে দত্তক যাওয়া শিশুরা নিজ দেশের স্মৃতির খোঁজ নিতে ২০০৪ সালে শাপলা নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল। পরে সেটির কর্মকান্ডও বন্ধ হয়ে যায়।
কানাডার রায়ান গুড বাদল গ্রামের বাড়ির খোঁজে বাংলাদেশে এসেছেন বারবার। প্রথম আসেন ১৯ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে। গ্রাম কিংবা মা-বাবার খোঁজ পাননি তিনিও। কলকাতার মিশনারিজ অব চ্যারিটি থেকে তাঁর সব নথি সংগ্রহ করে সেই ঠিকানা অনুসরণ করে বরিশালের ওই গ্রামে গিয়ে সত্যতা পাননি। বাদল পরে এ দেশে বছরখানেক একটি এনজিওতে চাকরি করেন। আশা ছিল চাকরির ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের খোঁজ নেবেন। কিন্তু প্রকৃত ঠিকানা আর পাননি। ওই সময় একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবিরের পরামর্শে ‘বাংলাদেশ কোথায়?’ নামে একটি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বাদল। শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘সে বাংলাদেশ বলতে তার মাকে বোঝে। বাদলের কাছেই ১৫০ জন যুদ্ধশিশুর নাম আছে। তাদের বসবাস লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।’
ছবি ক্যাপশন: নরওয়েতে দত্তক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল একাত্তরের তিন যুদ্ধশিশু (ওপরে বাঁ থেকে) ফালগুন, জাহানারা ও নীলিমা। (নিচে বাঁ থেকে) যুদ্ধশিশু কোহিনুর নোর্ডবার্গ, তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন নরওয়ের এক দম্পতি এবং মনোয়ারা ক্লার্ককে দত্তক পাঠানো হয়েছিল কানাডায়। (দৈনিক কালের কন্ঠ)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

১৯৭১ : নথি গায়েব যুদ্ধশিশুর

প্রকাশের সময় : ০৭:৩৫:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ মার্চ ২০১৬

ঢাকা: একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কাছে দত্তক হিসেবে পাঠানো হতো তখনকার সমাজকল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে। দত্তকায়ন হতো এ বিভাগের ‘ভবঘুরে’ শাখার মাধ্যমে। ওই সময়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ এখন সমাজসেবা অধিদপ্তর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভবঘুরে শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, একটি সাধারণ খোলা শেলফের নিচের দিকে দত্তক দেওয়ার কিছু নথি পড়ে আছে। ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে আড়াই হাজার শিশু বিদেশে দত্তক পাঠানোর তথ্য জানা গেলেও সেখানে নথি পাওয়া গেছে প্রায় ৭০০। বাকি ১৮০০ নথিই হারিয়ে গেছে বা গায়েব করা হয়েছে। ওই সময় সবাইকে ‘পরিত্যক্ত শিশু’ নামেই বিদেশে পাঠানো হয়। সরকারি নথিপত্রে ‘যুদ্ধশিশু’ বলে কোনো শব্দ উল্লেখ ছিল না। পরে আধুনিকমনস্ক ব্যক্তিরা একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারদের দ্বারা এ দেশের নির্যাতিত নারীদের গর্ভে যে শিশুদের জন্ম হয়, তাদেরকে নাম দেন ‘যুদ্ধশিশু’।
সংশ্লিষ্টরা অনুমান করছেন, বিদেশে দত্তক দেওয়া ওই আড়াই হাজার শিশুর মধ্যে বেশির ভাগই যুদ্ধশিশু। অন্যরা বিভিন্নভাবে পরিত্যক্ত।
১৯৭৬ সালের মে থেকে ১৯৮০ সালের মে মাস পর্যন্ত সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন মীজানুর রহমান শেলী। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে যুদ্ধশিশুদের পাঠানো হয়েছিল। পরে তার সঙ্গে অভিভাবকহীন ও পরিত্যক্ত শিশুদের বিদেশে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। যুদ্ধশিশুদের পাঠানো শুরু হয় ১৯৭২ সালে। আমার ধারণা, দেড় হাজারের বেশি পরিত্যক্ত শিশুকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল। শিশুদের দত্তক হিসেবে পাঠানোর পর আমি নেদারল্যান্ডস ও কানাডা সফর করে তাদের অবস্থা দেখতে গিয়েছিলাম। নেদারল্যান্ডসে ১৪-১৫টি পরিবারে গিয়েছিলাম। বিদেশি ছাড়াও প্রবাসী বাংলাদেশীরা মানবিক কারণে শিশুদের দত্তক নিয়েছিলেন। তবে সব নথিপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে কি না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। আমরা সারা দেশে মাত্র পাঁচ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে কাজ করেছি।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরে দত্তক শিশুদের সব নথিপত্র নেই বলে স্বীকার করেন সংস্থার পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) জুলফিকার হায়দার। তিনি বলেন, ‘আমাদের অফিসের স্থান তিন দফা পরিবর্তন করা হয়েছে। বহু ফাইল মিসিং হয়েছে। সেটা বুঝতেই পারছেন। বিদেশে যাওয়া সেই শিশুরা এখন যুবক-যুবতী হয়ে ঢাকায় আমাদের অফিসে এসে তথ্য জানতে চায়। আমরা তা দিতে পারছি না।’
একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালী নিধনযজ্ঞের পাশাপাশি এ দেশের নারীদের নির্যাতন করেছে নির্বিচারে। এতে করে অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ করতে হয়েছিল অনেক নারীকে। প্রথম দিকে ধর্ষিত নারীর সংখ্যা দুই লাখ বলা হলেও পরবর্তী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ওই সংখ্যা সাড়ে চার লাখের বেশি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বিশ্ব গির্জা পরিষদের এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর শেষে জেনেভায় গিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধের ৯ মাসে হানাদার বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশের যে দুই লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছেন তাঁরা এখন মুসলিম সমাজে একঘরে হয়ে পড়েছেন। কার্যত তাঁদের যাওয়ার কোনো ঠাঁই নেই। বাস্তব কারণেই গোপনে গর্ভপাত করাতে বাধ্য হয়েছেন বেশির ভাগ ধর্ষিত নারী। সন্তানকে আলোর মুখ দেখিয়ে বহু মা ‘কলঙ্ক’ থেকে রেহাই পেতে আত্মাহুতি দেন। পরিবারের সম্মান বাঁচাতে অনেক অনাহৃত সন্তানকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল রাস্তায় কিংবা হাসপাতালের বেডে। রেখে যাওয়া সন্তানকে কেউ আশ্রয় দেবে এমন আশা ছিল তাঁদের।
যুদ্ধ শেষে এসব শিশুর লালন-পালন, আশ্রয় ও পরবর্তী সময়ে বেড়ে ওঠা নিয়ে তৎকালীন সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। মানবতাবাদী কর্মী ও বিদেশি সংস্থার কর্মকর্তারা যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে এগিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রপতির এক বিশেষ আদেশের আওতায় সরকার ১৯৭২ সালে আন্তর্দেশীয় শিশু দত্তকায়ন প্রকল্প হাতে নেয়। এর আওতায় পরিত্যক্ত শিশু ঘোষণা করে যুদ্ধশিশুসহ অন্য পরিত্যক্ত শিশুদের পাঠানো হয় বিদেশে।
ওই সময় দত্তকায়নে জড়িত ছিল এমন সংস্থাগুলোর একাধিক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭২ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কমপক্ষে আড়াই হাজার শিশু বিদেশে পাঠানো হয়েছিল দত্তক হিসেবে। এ-সংক্রান্ত এক তালিকা থেকে দেখা যায়, নেদারল্যান্ডসে পাঠানো হয়েছিল ২৩৪ শিশু। নরওয়েতে ২০০ এবং ফ্রান্সে অন্তত ৬০ শিশুকে পাঠানো হয়েছিল। শুরুর দিকে একদিনেই কানাডায় পাঠানো হয়েছিল ১৫ শিশুকে।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে বসবাসরত ব্রিটিশ মিশনারি জন হোস্টিংস একাত্তরের জুনে নিউজউইক সাময়িকীকে বলেছিলেন, ‘সেনারা মেয়েদের পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। তারপর বেয়নেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছে তাদের।’ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে সীমান্তের ওপারে পেট্রাপোল ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া এক তরুণী টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, ‘দরজা ভেঙে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে কয়েকজন সৈন্য। …আমার চোখের সামনে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলে মা আর বাবাকে। মেঝের ওপর ফেলে তিন সেনা মিলে ধর্ষণ করে আমাকে।’ ১৯৭১ সালের ২১ জুন টাইম ম্যাগাজিনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। ত্রিপুরার এক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া আরেক বাঙালী তরুণী টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, পালিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ১৩ জন পাকিস্তানী সেনা পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
এভাবে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার স্মারক যুদ্ধশিশুরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র, হাসপাতাল ও বেবি হোম থেকে তখন ‘অনাকাঙ্খিত’ শিশুদের বড় একটি অংশের ঠিকানা হয়েছিল ঢাকার ২৬ ইসলামপুরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির শিশু সদনে। মাদার তেরেসাও এসেছিলেন ঢাকায়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও দত্তকায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, শিশুদের পাঠানো হয়েছিল কানাডা, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ফ্রান্স, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে। এসব দেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে পরিত্যক্ত শিশুদের দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ দেশেও এসব সংস্থার শাখা ছিল। কানাডায় ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন, নেদারল্যান্ডসে ইউনিকো, ফ্রান্সে ট্রি দ্য হোমস, নরওয়েতে নওরেজিয়ান অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু দত্তকায়ন প্রকল্পে যুক্ত ছিল। সংশ্লিষ্ট থানা, মিশনারিজ অব চ্যারিটি বা অন্য কোনো বেবি হোমের প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ও যে দেশে দত্তক পাঠানো হবে সে দেশের সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে উপযুক্ত পরিবারে শিশুদের দত্তক দেওয়া হয়েছিল।
মিশনারিজ অব চ্যারিটি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২১ জানুয়ারী মাদার তেরেসা ঢাকার ২৬ ইসলামপুরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির ঢাকা শাখা স্থাপন করেন। যুদ্ধে যেসব শিশু পরিবার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তাদের একটি অংশও সেখানে আশ্রয় পেয়েছিল। বহু নির্যাতিত নারীও সেখানে সন্তান প্রসব করেন। বেশির ভাগ শিশু সেখান থেকে বিদেশি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দত্তক মা-বাবা পান।
যুদ্ধশিশু গবেষকদের কাছ থেকে জানা গেছে, মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে বিভিন্ন জেলায় ভূমিষ্ঠ যুদ্ধশিশুদেরও পাঠানো হতো। কমপক্ষে ২০ হাজার শিশুকে সেখানে রাখা হয়েছিল। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালেও তখন যুদ্ধশিশুরা আশ্রয় পেয়েছিল।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিত্যক্ত শিশুদের অনেকেরই সঠিক নাম জানা যেত না। পাসপোর্টের জন্য বা সরকারি সার্টিফিকেটের জন্য তাদের নতুন নাম রাখা হতো। বেশির ভাগের ঠিকানায় লেখা হতো সরকারি বেবি হোমের ঠিকানা। দাদা-দাদি অথবা পিতৃ-মাতৃহীন আত্মীয়দের মধ্যে কেউ শিশুদের বেবি হোমে দিয়ে যেতেন। বাবা-মা ভরণ-পোষণে অক্ষম হওয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এফিডেভিট করে তাঁদের দাবি ত্যাগ করেও শিশুকে দত্তক দিতেন। সমাজকল্যাণ বিভাগ কখনো কখনো তাদের কাছে আসা শিশুদের বয়স ও প্রাপ্তিস্থান উল্লেখ করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিত।
পাওয়া যায় না নথি: ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে দুই মাসের যুদ্ধশিশু আরিফ চৌধুরী লনিকে পাঠানো হয়েছিল সুইডেনের স্যান্ডবার্গে। কস্তা হগো সানবিল ও খ্রিস্টিনা এলিজাবেথ সানডেলের পরিবারে ছেলে হিসেবে লনিকে গ্রহণ করা হয়। বড় হয়ে জন্মভূমির নাম জানতে পেরে উদগগ্রীব লনি ২০১৩ সাল থেকে একের পর এক চিঠি লিখে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ জানতে। সুইডেন দূতাবাস থেকেও লনির আদি ঠিকানা বের করে দিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরে চিঠি আসছে প্রতিবছর। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট সুইডেন দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারি ইমা এরিকসন তাঁর লেখা চিঠিতে লনির মূল ঠিকানা জরুরি ভিত্তিতে বের করে দেওয়ার আবেদন করেন। সেই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় লনিকে দত্তক দেওয়ার সময় তার পালক মা-বাবার কাছে দেওয়া আদেশপত্রটি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভবঘুরে শাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লনিকে দত্তক পাঠানো-সংক্রান্ত নথি খোঁজাখুঁজি করেও পাননি। লনির পাসপোর্টে তার ঠিকানা হিসেবে ‘ঢাকা’ লেখা ছিল।
সুলতানার নাম নেই তালিকায়: নেদারল্যান্ডসে থিয়া ও ক্রিস দম্পতির কাছে দত্তক দেওয়া হয়েছিল সুলতানাকে। সে দেশে তাঁর নাম হয়ে যায় সুলতানা ভ্যান ডি লিস্ট। চট্টগ্রামের চান্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীর কোনো গ্রামে জন্ম হয়েছিল—তা জানতে পেরে গত ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় আসেন সুলতানা। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন স্বামী ইউরি জেকবস ও ১০ বছরের ছেলে নোয়া আবেদ নাবিলা জেকবসকে। ঢাকা থেকে দোহাজারী গিয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেও সুলতানা কোনো হদিস পাননি নিজ গ্রামের। ফিরে গেছেন ১২ ফেব্রুয়ারী। গত ১১ ফেব্রুয়ারী রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় আলাপকালে সুলতানা বলেন, ‘নাড়ির টানে এসে কাউকে খুঁজে পাইনি। একাধিক পরিবার থেকে দাবি করা হচ্ছে তারা আমার স্বজন। ডিএনএ পরীক্ষা না করলে তা বোঝা যাবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নেদারল্যান্ডসে পাঠানো ২৩৪ জনের তালিকায় সুলতানার নাম নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরেও এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য মেলেনি। নেদারল্যান্ডসে দত্তক দেওয়া বাংলাদেশীদের তথ্য সংগ্রহ করছেন সে দেশের সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা মো. ইসমাইল শরীফ। তিনি বলেন, ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ওই সংস্থার হয়ে বাংলাদেশে কাজ করেছেন। তাঁর জানা মতে, কমপক্ষে ২০ জন শিশু নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে এসেছেন শিকড়ের খোঁজে। এসেছিলেন চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া ফিলোমিন, নোয়াখালীতে জন্ম নেওয়া আলম ভেন্ডার কই, ময়মনসিংহে জন্ম নেওয়া কমলা। মোতালিব নামের একজন অবশ্য নিজ গ্রামের খোঁজ পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে দত্তক যাওয়া শিশুরা নিজ দেশের স্মৃতির খোঁজ নিতে ২০০৪ সালে শাপলা নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিল। পরে সেটির কর্মকান্ডও বন্ধ হয়ে যায়।
কানাডার রায়ান গুড বাদল গ্রামের বাড়ির খোঁজে বাংলাদেশে এসেছেন বারবার। প্রথম আসেন ১৯ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে। গ্রাম কিংবা মা-বাবার খোঁজ পাননি তিনিও। কলকাতার মিশনারিজ অব চ্যারিটি থেকে তাঁর সব নথি সংগ্রহ করে সেই ঠিকানা অনুসরণ করে বরিশালের ওই গ্রামে গিয়ে সত্যতা পাননি। বাদল পরে এ দেশে বছরখানেক একটি এনজিওতে চাকরি করেন। আশা ছিল চাকরির ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের খোঁজ নেবেন। কিন্তু প্রকৃত ঠিকানা আর পাননি। ওই সময় একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবিরের পরামর্শে ‘বাংলাদেশ কোথায়?’ নামে একটি চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বাদল। শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘সে বাংলাদেশ বলতে তার মাকে বোঝে। বাদলের কাছেই ১৫০ জন যুদ্ধশিশুর নাম আছে। তাদের বসবাস লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।’
ছবি ক্যাপশন: নরওয়েতে দত্তক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল একাত্তরের তিন যুদ্ধশিশু (ওপরে বাঁ থেকে) ফালগুন, জাহানারা ও নীলিমা। (নিচে বাঁ থেকে) যুদ্ধশিশু কোহিনুর নোর্ডবার্গ, তাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন নরওয়ের এক দম্পতি এবং মনোয়ারা ক্লার্ককে দত্তক পাঠানো হয়েছিল কানাডায়। (দৈনিক কালের কন্ঠ)