নিউইয়র্ক ০৮:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

স্বাধীন বাংলায় কবর নিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:১৪:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৪
  • / ১১৭৭ বার পঠিত

যে দেশের স্বাধীনতার চরম বিরোধী ছিলেন, স্বাধীনতার পর যে দেশের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিতে ছিলেন সচেষ্ট, সে বাংলাদেশেই শেষ শয্যা নিতে হয়েছে গোলাম আযমকে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাভোগের মধ্যে মারা যাওয়া গোলাম আযমকে শনিবার জানাজার পর ঢাকার মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

বিকালে দাফনের আগে দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদে হয় জামায়াতের সাবেক আমিরের জানাজা। এতে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বাইরে রাজনৈতিক মিত্র বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর গুটিকয়েক নেতাকেই দেখা গেছে।

একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনাকারী হিসেবে গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই সাজার এক বছর গড়াতেই বন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয় ৯২ বছর বয়সী এই ব্যক্তির।

অপরাধ মৃত্যুদণ্ডসম উল্লেখ করেই বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে একাত্তরে জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে কারাদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।

তিনি দণ্ড ভোগ করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্রিজন সেলে। ২০১২ সালে গ্রেপ্তারের পর বিচারের পুরোটা সময়ই বাংলাদেশের সবচেয়ে আধুনিক এই হাসপাতালে ছিলেন তিনি, সেখানেই বৃহস্পতিবার তার মৃত্যু হয়।

মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুক্রবার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর মগবাজারে বাড়িতে ফ্রিজিং ভ্যানে রাখা লাশটি শনিবার দুপুরে জানাজার জন্য বের করা হয়।

প্রায় ৩৩ বছর আগে যেখানে একটি জানাজায় গিয়ে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন, সেই বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাজার জন্য আনা হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতা গোলাম আযমকে।

জোহরের নামাজের পর জানাজা হয়, তা পড়ান গোলাম আযমের চতুর্থ ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।

জানাজার আগে তিনি অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে বলেন, “আমার বাবা জীবদ্দশায় জ্ঞাত হয়ে কখনও কাউকে দুঃখ দেননি, কষ্ট দেননি। অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন।

“অথচ তাকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আপনারা দোয়া করবেন আমার বাবাকে যেন আল্লাহ শহীদের মর্যাদা দান করেন।”

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় গোলাম আযমকে। তার জন্য যে শাস্তি তাকে দেওয়া হয়, তা এক বছর তিন মাস খেটেই মারা গেলেন তিনি।

জীবদ্দশায় যিনি একাত্তরের বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য কখনও ক্ষমা কিংবা দুঃখ প্রকাশও করেননি, এমনকি গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন আগেও তার বক্তব্য ছিল, একাত্তরে তাদের কোনও ‘ভুল’ ছিল না।

আযমী বলেন, “বাবার আদর্শ ছিল দেশে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। তার মৃত্যু মানে ইসলাম আন্দোলনের বিদায় নয়। আমি বিশ্বাস করি, বাবা অধ্যাপক গোলাম আযমের মতো এরকম আরও লক্ষ লক্ষ গোলাম আযমের জন্ম হবে, তারাই একদিন ইসলামের বিজয় নিয়ে আসবে।”

আযমীর এই বক্তব্যের সময় উপস্থিত জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অনেককে আবেগ প্রবণ হয়ে উচ্চ স্বরে কাঁদতে দেখা গেছে।

আযমীর আগে জামায়াতের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমানও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “আমরা আজ শপথ করছি, দেশে যতক্ষণ ন্যায় প্রতিষ্ঠা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ইসলামী আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।”

একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন রুদ্ধ করতে ইসলামের নামে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণকে জায়েজ করতে চেয়েছিল জামায়াত। তাদের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই এখন এই সব অভিযোগে দণ্ডিত।

গোলাম আযমের জানাজায় জামায়াত নেতাদের মধ্যে ছিলেন এটিএম মাসুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, তাসনীম আলম, জসিমউদ্দিন সরকার, সেলিম উদ্দিনসহ জেলা আমিররা।

যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী, গোলাম আযমের ভগ্নিপতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন খানসহ পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন জানাজায়।

২০ দলীয় জোটের শরিক বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে দেখা গেছে জানাজায়। এদের মধ্যে ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, কামাল উদ্দিন জাফরী, মুসলিম লীগের নুরুল হুদা, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, হামদুল্লাহ আল মেহেদি, শামসুদ্দিন পারভেজ, মাসুদ খান, বিজেপির সালাহউদ্দিন মতিন প্রকাশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের এটিএম হেমায়েতউদ্দিন।

বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী উলামা দলের সভাপতি হাফেজ আবদুল মালেক ছাড়াও ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ। তবে তিনি ছিলেন সাংবাদিক নেতা হিসেবে।

শওকতের পাশপাশি সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন রুহুল আমিন গাজী, আবদুল হাই শিকদার, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান।

জানাজা শেষে বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটক দিয়ে বের করা হয় কফিন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা কফিন আনার সময় যেভাবে ঘিরে ছিল, নেওয়ার সময়ও সেভাবে ঘিরে রাখে। এরপর কফিন নিয়ে পল্টন হয়ে শোক মিছিল চলে মগবাজারের দিকে।
পুরানা পল্টন মোড়ে কয়েকটি ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা দুপুরের আগ থেকে গোলাম আযমবিরোধী প্রতিবাদ করছিল। কফিন বায়তুল মোকাররমে নেওয়ার সময় তাদের মধ্য থেকে কফিনকে লক্ষ্য করে জুতাও ছোড়া হয়। তবে ওই সময় পুলিশ ছিল বেশ তৎপর, ফলে তারা কফিনের কাছে ঘেঁষতে পারেনি।

লাশ নেওয়ার আগে বায়তুল মোকাররম এলাকায় পরপর কয়েকটি হাতবোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। কে বা কারা হাতবোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।

লাশ বায়তুল মোকাররমে নেওয়ার আগেই পুলিশ বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ তোপখানা সড়কে সব যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল, শোক মিছিল ওই এলাকা ছাড়ার পর সড়ক খুলে দেওয়া হয়।

এদিকে মিছিলসহ কফিন মগবাজারে পৌঁছার পর বিকাল পৌনে ৪টায় সেখানকার মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতার প্রতীক গোলাম আযমকে।

গোলাম আযমের আগে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল আব্দুল আলীমের। আর যারা দণ্ডিত রয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই গোলাম আযমের শিষ্য।

এদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম কামারুজ্জামান।

দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। দলটির বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলা রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত এই সবারই নেতা ছিলেন গোলাম আযম। ১৯৯৯ সালে রাজনীতি থেকে অবসরে গেলেও তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে জামায়াতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছিলেন তিনি।

১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানাবাড়িতে জন্ম নেওয়া গোলাম আযম জামায়াতে যোগ দেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর প্রভাবে।

ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল মওদুদীকে, আর তার শিষ্য গোলাম আযমও একই অপরাধ করেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং চার দশক পরে দণ্ডিতও হন।

১৯৬৯ সালে গোলাম আযম যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হন, বাংলার মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন তখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; তা-ও পাকিস্তানি পাসপোর্টে। স্বাধীনতার পর তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার।

বাংলাদেশে ফেরার পর ১৯৮১ সালে বায়তুল মোকাররমে একটি জানাজা পড়তে গিয়ে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের এই নেতা।

১৯৯১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার পর ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর জামায়াত গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন।

ওই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আবার সামনে আসে। এর মধ্যে আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আযম।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই বিচার শুরুর উদ্যোগ নিলে একে একে গ্রেপ্তার হন জামায়াতের শীর্ষনেতারা। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। পরের বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।

২০১২ সালে যে বন্দিত্ব শুরু হয়েছিল গোলাম আযমের, তার মধ্যেই অবসান ঘটে তার জীবনের। এরপর কবর হল সেই মাটিতে, যে মাটির স্বাধীনতা তিনি চাননি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

স্বাধীন বাংলায় কবর নিলেন স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতা

প্রকাশের সময় : ০১:১৪:৩৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৪

যে দেশের স্বাধীনতার চরম বিরোধী ছিলেন, স্বাধীনতার পর যে দেশের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিতে ছিলেন সচেষ্ট, সে বাংলাদেশেই শেষ শয্যা নিতে হয়েছে গোলাম আযমকে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারাভোগের মধ্যে মারা যাওয়া গোলাম আযমকে শনিবার জানাজার পর ঢাকার মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

বিকালে দাফনের আগে দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদে হয় জামায়াতের সাবেক আমিরের জানাজা। এতে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বাইরে রাজনৈতিক মিত্র বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর গুটিকয়েক নেতাকেই দেখা গেছে।

একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনাকারী হিসেবে গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই সাজার এক বছর গড়াতেই বন্দি অবস্থায় মৃত্যু হয় ৯২ বছর বয়সী এই ব্যক্তির।

অপরাধ মৃত্যুদণ্ডসম উল্লেখ করেই বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে একাত্তরে জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে কারাদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।

তিনি দণ্ড ভোগ করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্রিজন সেলে। ২০১২ সালে গ্রেপ্তারের পর বিচারের পুরোটা সময়ই বাংলাদেশের সবচেয়ে আধুনিক এই হাসপাতালে ছিলেন তিনি, সেখানেই বৃহস্পতিবার তার মৃত্যু হয়।

মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুক্রবার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর মগবাজারে বাড়িতে ফ্রিজিং ভ্যানে রাখা লাশটি শনিবার দুপুরে জানাজার জন্য বের করা হয়।

প্রায় ৩৩ বছর আগে যেখানে একটি জানাজায় গিয়ে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন, সেই বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাজার জন্য আনা হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতা গোলাম আযমকে।

জোহরের নামাজের পর জানাজা হয়, তা পড়ান গোলাম আযমের চতুর্থ ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।

জানাজার আগে তিনি অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে বলেন, “আমার বাবা জীবদ্দশায় জ্ঞাত হয়ে কখনও কাউকে দুঃখ দেননি, কষ্ট দেননি। অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করেছেন।

“অথচ তাকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছিল। আপনারা দোয়া করবেন আমার বাবাকে যেন আল্লাহ শহীদের মর্যাদা দান করেন।”

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় গোলাম আযমকে। তার জন্য যে শাস্তি তাকে দেওয়া হয়, তা এক বছর তিন মাস খেটেই মারা গেলেন তিনি।

জীবদ্দশায় যিনি একাত্তরের বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য কখনও ক্ষমা কিংবা দুঃখ প্রকাশও করেননি, এমনকি গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুদিন আগেও তার বক্তব্য ছিল, একাত্তরে তাদের কোনও ‘ভুল’ ছিল না।

আযমী বলেন, “বাবার আদর্শ ছিল দেশে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। তার মৃত্যু মানে ইসলাম আন্দোলনের বিদায় নয়। আমি বিশ্বাস করি, বাবা অধ্যাপক গোলাম আযমের মতো এরকম আরও লক্ষ লক্ষ গোলাম আযমের জন্ম হবে, তারাই একদিন ইসলামের বিজয় নিয়ে আসবে।”

আযমীর এই বক্তব্যের সময় উপস্থিত জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অনেককে আবেগ প্রবণ হয়ে উচ্চ স্বরে কাঁদতে দেখা গেছে।

আযমীর আগে জামায়াতের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমানও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “আমরা আজ শপথ করছি, দেশে যতক্ষণ ন্যায় প্রতিষ্ঠা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ইসলামী আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।”

একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন রুদ্ধ করতে ইসলামের নামে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণকে জায়েজ করতে চেয়েছিল জামায়াত। তাদের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই এখন এই সব অভিযোগে দণ্ডিত।

গোলাম আযমের জানাজায় জামায়াত নেতাদের মধ্যে ছিলেন এটিএম মাসুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, তাসনীম আলম, জসিমউদ্দিন সরকার, সেলিম উদ্দিনসহ জেলা আমিররা।

যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী, গোলাম আযমের ভগ্নিপতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন খানসহ পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন জানাজায়।

২০ দলীয় জোটের শরিক বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে দেখা গেছে জানাজায়। এদের মধ্যে ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, কামাল উদ্দিন জাফরী, মুসলিম লীগের নুরুল হুদা, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, হামদুল্লাহ আল মেহেদি, শামসুদ্দিন পারভেজ, মাসুদ খান, বিজেপির সালাহউদ্দিন মতিন প্রকাশ, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের এটিএম হেমায়েতউদ্দিন।

বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী উলামা দলের সভাপতি হাফেজ আবদুল মালেক ছাড়াও ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ। তবে তিনি ছিলেন সাংবাদিক নেতা হিসেবে।

শওকতের পাশপাশি সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন রুহুল আমিন গাজী, আবদুল হাই শিকদার, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান।

জানাজা শেষে বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটক দিয়ে বের করা হয় কফিন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা কফিন আনার সময় যেভাবে ঘিরে ছিল, নেওয়ার সময়ও সেভাবে ঘিরে রাখে। এরপর কফিন নিয়ে পল্টন হয়ে শোক মিছিল চলে মগবাজারের দিকে।
পুরানা পল্টন মোড়ে কয়েকটি ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা দুপুরের আগ থেকে গোলাম আযমবিরোধী প্রতিবাদ করছিল। কফিন বায়তুল মোকাররমে নেওয়ার সময় তাদের মধ্য থেকে কফিনকে লক্ষ্য করে জুতাও ছোড়া হয়। তবে ওই সময় পুলিশ ছিল বেশ তৎপর, ফলে তারা কফিনের কাছে ঘেঁষতে পারেনি।

লাশ নেওয়ার আগে বায়তুল মোকাররম এলাকায় পরপর কয়েকটি হাতবোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। কে বা কারা হাতবোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।

লাশ বায়তুল মোকাররমে নেওয়ার আগেই পুলিশ বায়তুল মোকাররম মসজিদসহ তোপখানা সড়কে সব যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল, শোক মিছিল ওই এলাকা ছাড়ার পর সড়ক খুলে দেওয়া হয়।

এদিকে মিছিলসহ কফিন মগবাজারে পৌঁছার পর বিকাল পৌনে ৪টায় সেখানকার মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতার প্রতীক গোলাম আযমকে।

গোলাম আযমের আগে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল আব্দুল আলীমের। আর যারা দণ্ডিত রয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই গোলাম আযমের শিষ্য।

এদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম কামারুজ্জামান।

দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। দলটির বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলা রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে।

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত এই সবারই নেতা ছিলেন গোলাম আযম। ১৯৯৯ সালে রাজনীতি থেকে অবসরে গেলেও তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে জামায়াতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছিলেন তিনি।

১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নানাবাড়িতে জন্ম নেওয়া গোলাম আযম জামায়াতে যোগ দেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর প্রভাবে।

ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল মওদুদীকে, আর তার শিষ্য গোলাম আযমও একই অপরাধ করেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং চার দশক পরে দণ্ডিতও হন।

১৯৬৯ সালে গোলাম আযম যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হন, বাংলার মানুষের স্বাধিকারের আন্দোলন তখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম। এসব আধা সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন চালায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান এই জামায়াত নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে যান গোলাম আযম। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ এ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে আবার বাংলাদেশে আসেন এই জামায়াত নেতা; তা-ও পাকিস্তানি পাসপোর্টে। স্বাধীনতার পর তার নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার।

বাংলাদেশে ফেরার পর ১৯৮১ সালে বায়তুল মোকাররমে একটি জানাজা পড়তে গিয়ে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের এই নেতা।

১৯৯১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার পর ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর জামায়াত গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন।

ওই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আবার সামনে আসে। এর মধ্যে আদালতের এক রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পান গোলাম আযম।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর এই বিচার শুরুর উদ্যোগ নিলে একে একে গ্রেপ্তার হন জামায়াতের শীর্ষনেতারা। ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে। পরের বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে বিচারকরা তাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।

২০১২ সালে যে বন্দিত্ব শুরু হয়েছিল গোলাম আযমের, তার মধ্যেই অবসান ঘটে তার জীবনের। এরপর কবর হল সেই মাটিতে, যে মাটির স্বাধীনতা তিনি চাননি।