সিরাজগঞ্জে গুলিবিদ্ধ সাংবাদিকের মৃত্যু
- প্রকাশের সময় : ০৮:২৩:১৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৭
- / ৬৪২ বার পঠিত
ঢাকা: দুই সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আবার সংঘাত-হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছেন। গত তিন দিনে চার জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গত বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারী) আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ সমকাল-এর শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম (শিমুল) গত শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারী) মারা গেছেন। এ খবর শুনে তাঁর নানি রোকেয়া বেগমও মারা যান। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পাবনার ঈশ্বরদীতে যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুজন কর্মী গুলিবিদ্ধ এবং আরও দুজন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। এর আগে বুধবার (১ ফেব্রুয়ারী) রাতে খুন হন নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রভাষ রায়। তাঁর স্ত্রী টুটুল রানীর অভিযোগ, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধের জের ধরে তাঁর স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। ওই নির্বাচনের পরদিন প্রভাষ রায়ের বাড়িতে হামলা করেছিল স্বদলীয় প্রতিপক্ষ।
বৃহস্পতিবার রাতে শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান মডেল কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম হাসান খানকে (৫২) কুপিয়ে আহত করেছে স্বদলীয় প্রতিপক্ষ। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোহাম্মদ ফখরুল মজিদ বলেন, গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় সৃষ্ট দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে গোলাম হাসান খানের ওপর হামলা হয়েছে।
এর আগে ১৭ জানুয়ারী সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি জলমহালের দখলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৩ জন নিহত ও ২২ জন আহত হন। এর আগের দিন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বড়মাছুয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাইউম হোসেনকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষ। চলতি বছরের প্রথম দিনই সংবাদের শিরোনাম হয় খুলনা আওয়ামী লীগ। আগের দিন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জেড এ মাহমুদকে লক্ষ্য করে গুলি করে তাঁর প্রতিপক্ষ। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিহত হন পথচারী এক নারী।
আগে গত বছরের জুলাইয়ে খুলনা ও কুমিলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পৃথক তিনটি ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন নেতা-কর্মী খুন হন। এরপর সাড়ে তিন মাস তেমন হানাহানি ছিল না। গত নভেম্বরের শেষ দিকে আবার অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হতে থাকে ক্ষমতাসীন দলটি। ১৯ নভেম্বর স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। পরদিন নিজ বাসায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর স্বজনদের অভিযোগ, হত্যার পর তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনার পেছনেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখছেন নিহতের পরিবার ও আওয়ামী লীগের নেতারা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ ডিসেম্বর রাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
অভ্যন্তরীণ এসব সংঘাতের বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মত হচ্ছে, এসব সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কারণ খুবই কম। এলাকায় প্রভাব বিস্তার, জলমহাল, বালুমহাল, ঠিকাদারি ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ কিংবা জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দখল প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ সংঘর্ষ বা বিরোধ তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও কিছু কিছু জায়গায় বিরোধ তৈরি হয়েছে, যার জের এখনো রয়ে গেছে।
যে কারণে সিরাজগঞ্জে সংঘর্ষ: আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, নেতাদের দলীয় আধিপত্য বিস্তার আর ক্ষমতার প্রভাবের কারণে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে বৃহস্পতিবার সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়েছে। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে বর্তমান সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিবুর রহমান। অপর পক্ষে সাবেক সাংসদ চয়ন ইসলাম ও শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত পৌর মেয়র হালিমুল হক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শাহজাদপুরের পৌর মেয়র হালিমুল হকের ছোট ভাই পিন্টু পৌর শহরের কালীবাড়ি মোড়ে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি কান্দাপাড়া মহল্লার বাসিন্দা বিজয় মাহমুদকে (১৮) বেদম মারধর করেন। বিজয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমানের অনুসারী। বিজয়কে মারধরের খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর সমর্থনে মহল্লার লোকজন ও আওয়ামী লীগের একাংশ এবং কলেজের ছাত্ররা এক জোট হয়ে বেলা তিনটার দিকে মেয়রের বাড়িতে হামলা চালায়। এতে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় গুলি ও বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়। সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থলে যাওয়া সাংবাদিক আবদুল হাকিম মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। শুক্রবার ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
নিহত সাংবাদিক আবদুল হাকিম, পৌর মেয়র হালিমুল হক শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে সাংবাদিক আবদুল হাকিমের মরদেহ প্রথমে শাহজাদপুর প্রেসক্লাব চত্বরে, পরে শাহজাদপুর থানায় নেওয়া হয়। তখন তাঁর স্বজন ও সর্বস্তরের মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। অ্যাম্বুলেন্সের পাশে থাকা আবদুল হাকিমের ভাই আজাদ বলেন, ‘এখন পুলিশ আসছে। তখন পুলিশ থাকা সত্ত্বেও আমার ভাই গুলি খেয়েছে। তখন তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন তারা পাহারা দিচ্ছে।’
এ সময় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ কাজল অভিযোগ করেন, ‘পৌর মেয়রের শটগানের গুলিতেই সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। আমরা অবিলম্বে আসামিদের গ্রেপ্তারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’ সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে আবদুল হাকিমের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। সিভিল সার্জন শেখ মনজুর রহমান বলেন, হাকিমের খুলিতে একটি গুলি পাওয়া গেছে।
এদিকে সাংবাদিক হত্যার প্রতিবাদে শাহজাদপুর উপজেলায় শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারী) সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে উপজেলা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ। এই হরতালে সমর্থন জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেন সাংবাদিকেরা।
সাংবাদিক আবদুল হাকিমের মৃত্যুর খবর শোনার পর তাঁর নানি উপজেলার মাদলা গ্রামের রোকেয়া বেগম (৯০) রাত আটটার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। দ্রুত শাহজাদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। শনিবার নানি ও নাতি দুজনের লাশ জানাজা শেষে মাদলা গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হবে।
নিহত সাংবাদিক হাকিমের পরিবারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কামরুল ইসলাম এ কথা জানিয়েছেন।
মেয়রকে আসামি করে মামলা: নিহত সাংবাদিকের স্ত্রী নুরুন নাহার বেগম শুক্রবার শাহজাদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। এতে মেয়র হালিমুল হক, তাঁর দুই ভাইসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের পর পুলিশ পৌর মেয়রের লাইসেন্স করা শটগান জব্দ করে এবং তাঁর ভাইকে আটক করে।
সিরাজগঞ্জে সাংবাদিক হত্যার বিষয়ে শুক্রবার নারায়ণগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনায় যে-ই জড়িত থাক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রভাব বিস্তার ও দল ভারী করার চেষ্টা করছে। দল ভারী করার জন্য অনুপ্রবেশকারী পরগাছাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিষয়টি আমরা সিরিয়াসলি দেখছি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে।’ বিষয়টি তদন্ত করতে আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ঈশ্বরদীতে যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ: পাবনার ঈশ্বরদীতে একটি ক্লাবের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আমবাগান এলাকায় যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে চারজন আহত হন। এর মধ্যে দুজন গুলিবিদ্ধ, বাকি দুজন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ঘটনার সময় ৩০-৩৫টি গুলির শব্দ শুনতে পান তাঁরা। গুলিবিদ্ধ দুজন হলেন যুবলীগের কর্মী শামীম হোসেন (৩৬) ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে সুমন (৩৫)। তাঁদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহত অপর দুজন হলেন স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ হোসেন (৩৫) ও নয়ন শেখ (৩৬)। তাঁদের ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, আমবাগান পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে অবস্থিত ‘টাইগার ক্লাবের’ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজীব সরকারের সমর্থকদের সঙ্গে ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম ও পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুনের সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এই বিরোধের জেরেই সংঘর্ষ হয়।
আমবাগান পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মতিয়ার রহমান বলেন, সংঘর্ষ ও গোলাগুলির খবর পেয়ে রাতেই ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জহুরুল হক ও ঈশ্বরদী থানার ওসি আবদুল হাই তালুকদারের নেতৃত্বে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।(প্রথম আলো)