নিউইয়র্ক ০৮:৫০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা ঢাকার: দ্য গার্ডিয়ান

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:১৮:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ মে ২০১৬
  • / ৬৯১ বার পঠিত

ঢাকা: এক ধরনের ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে ঢাকার রাজপথে। শিক্ষাবিদ, ব্লগার, কিছু বিশেষ মতাদর্শী লোকদের কাছে ঢাকা এখন কোন যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও ভয়ানক লাগছে। বৃটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের রোববারের (১ মে) সংখ্যা দ্য অবজার্ভারে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। গত তিন বছরে একে একে ১৬ জন মুক্তমনা ছাত্র, শিক্ষক, নিরাপত্তাকর্মী, কূটনৈতিক মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা এবং ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছয় জন ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক, এক ইতালিয়ান ধর্মযাজক, দুই বিদেশী নাগরিক ও এক সমকামী রয়েছেন।
৩০ এপ্রিল শনিবার টাঙ্গাইলে নিখিল জোয়ার্দার নামে এক হিন্দুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ মনে করছে, ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নবী মোহাম্মদ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন। ওই অভিযোগের সঙ্গে তাকে হত্যার সম্পর্ক থাকতে পারে। অন্যান্য টার্গেটের মধ্যে রয়েছে খুব উঁচু স্তরের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব। আছে কিছু সাধারণ নাগরিকও। এদের হয়তো খুন করা হয়েছে স্রেফ তাদের জীবনধারা নিয়ে আইএসের আপত্তির কারণে। হতাহতদের মধ্যে বৈচিত্র রয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞের প্রতি কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া ছিল শ্লথ। ফলে নিহতদের সঙ্গে মিলে যায় এমন ভাবধারার মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে আতঙ্ক।
এসব খুনের দরুণ অনেক তরুণ নিজেদের দৈনন্দিন রুটিন পালটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। ‘জুলহাস ও তনয়ের মৃত্যুর খবর প্রকাশ হওয়ার পর, অনেক তরুণ-তরুণী সমকামীর যৌন-পরিচয়ের খবর পরিবারের কাছে প্রকাশ হয়। অথচ এখনই নিজেদের পরিবারকে জানাতে তারা প্রস্তুত ছিলেন না।’ এ কথাটি বলেছেন মান্নানের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি আমেরিকায় বসবাস করেন। নিজের নামটি তিনি জানাতে চাননি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমন মানুষকে জানি যারা প্রায় ৭ দিন ধরে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন না।’
এ হত্যাযজ্ঞের শকওয়েভ সমকামী বা অ্যাক্টিভিস্ট সম্প্রদায়কে ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে কূটনীতিক ও উন্নয়নকর্মীদের ভেতরও। মান্নান ছিলেন আমেরিকান দূতাবাসের সাবেক কর্মী। মৃত্যুর আগে তিনি মার্কিন সরকারের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি’তে কাজ করতেন।
‘তারা (জঙ্গিরা) এমন মানুষকে মেরে মনোযোগ কাড়তে চায়, যাদের মৃত্যুর ফলে ব্যাপক প্রচারণা পাওয়া যাবে’ বললেন আরেক আমেরিকা প্রবাসী। মান্নান ও তনয়কে হত্যার দুই দিন আগে, মোটরসাইকেলে করে দুই ব্যক্তি রাজশাহীর একটি বাসস্টপে নামে। এরপর তারা কুপিয়ে হত্যা করে রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) দাবি করেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘নাস্তিক্যবাদীতার দিকে আহ্বান করা’র জন্য।
রেজাউল করিম সিদ্দিকী ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। তিনি ছিলেন একজন গায়ক। ধর্মপ্রাণ মুসলমানও ছিলেন তিনি। ছিল না কোন রাজনৈতিক সংস্পর্শ। সেঁতার বিশেষ প্রিয় ছিল তার। নিজের গ্রামের বাড়ির মসজিদে তিনি নিয়মিত দান করতেন। স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাহায্য করেছিলেন। এ কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সস্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ শহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘যে কেউ টার্গেট হয়ে যেতে পারতো।’
আতঙ্কিত অনেকে মনে করছেন যে, ঠিক এটাই ছিল খুনীদের উদ্দেশ্য। এক মাসে পাঁচটি নৃশংস হত্যাকান্ড গোটা বাংলাদেশী সমাজেই শীতল প্রভাব ফেলেছে। সেক্যুলার অ্যাক্টিভিস্টিদের গ্রুপ গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ইমরান এইচ. সরকার বলেন, ‘নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আমার উপস্থিতি কমিয়ে ফেলতে হয়েছে। এমনকি ক’দিন আগেও পরিস্থিতি এতটা ভীতিজনক ছিল না।’
সবগুলো হামলার দায় হয় আইএস স্বীকার করেছে, নয়তো আল কায়দা ইন দ্য সাব কন্টিনেন্টের শাখা আনসার আল ইসলাম। কিন্তু বাংলাদেশে আন্তঃদেশীয় জিহাদি গ্রুপগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ঘরোয়া জঙ্গিরাই এসব হামলা চালাচ্ছে। এ জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসূত্র আছে প্রধান বিরোধী দলের, যারা কিনা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়।
যে-ই এ হত্যাযজ্ঞের পেছনে থাকুক না কেন, দেশে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার উদ্বেগজনক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অথচ, ১৬ কোটি জনসংখ্যার এ দেশটি চরমপন্থা প্রতিরোধে এতদিন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে সফল ছিল।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমরা উদারপন্থী মুল্যবোধ ধারণ করে আসছে। বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী। তার মতে, ওই ঐতিহ্য এখন হুমকির মুখে। তার ভাষায়, ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। ইসলামী জঙ্গিবাদ গত ১০-১৫ বছর ধরে কেবল বেড়েছে।’
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বয়কট করা ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতারোহন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই সরকার সহিংসতা উস্কে দেয়ার অভিযোগে জ্যেষ্ঠ বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে।
আফসান চৌধুরী বলেন, ‘সরকার বিরোধী দলকে এই মাত্রার শাস্তি দিয়েছে যে, তারা এখন আর রাজনৈতিক শক্তি নয়।’ শক্ত বিরোধী দল না থাকায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পুরো পরিবেশ আঁচ করার অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ধারাবাহিক হত্যাকান্ড শুরু হয়। অ্যাক্টিভিস্টরা দাবি জানিয়েছিল যে, ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগীতার দায়ে দোষী সবাইকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে।
যাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, তাদের অনেকেই বিরোধী দল ও তাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখছে না, এমন অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ব্যাপক সমালোচনা করে। একটি ইসলামী গোষ্ঠী ‘হেফাজতে ইসলাম’ তখন ৮৪ জন নাস্তিক ব্লগারের তালিকা প্রকাশ করে। গোষ্ঠিটি দাবি জানায় যে, অনলাইনে ধর্মের প্রতি অবমাননাকর কর্মকান্ডের জন্য এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারের।
ভুক্তভোগীদের পরিবার ও ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের শঙ্কা, পুলিশের তদন্ত খুবই শ্লথ ও অকার্যকর। এখন পর্যন্ত ৪৬ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র দুই জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারকে খুনে জড়িত থাকার দায়ে তাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে।
ইমরান এইচ. সরকার বলেন, ‘একটি গ্রেপ্তার মানেই ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নয়।’ অনেকের মধ্যে হতাশা রয়েছে যে, নিহত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান ব্লগার অভিজিৎ রায়ের কিছু হত্যাকারী দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছে। জুলহাস মান্নানের হত্যাকান্ডের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অধ্যাপক শহিদুজ্জামান বলেন, ‘মান্নান হত্যাকান্ডে সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের ধরতে চেষ্টা করবে সরকার। কিন্তু তারা আদৌ আসল দোষীদের ধরতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ অনেক।’
যারা হামলা থেকে বেঁচে গেছেন, তারা মনে করেন তাদের কথা সবাই ভুলে গেছে। আশা মনির স্বামী ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কে তার সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অথচ, পুলিশ তার সঙ্গে গত পাঁচ মাসে একবারও যোগাযোগ করেনি বলে জানান তিনি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এ মামলায় ৫ সন্দেহভাজনকে আটক করেছে।
অনেকের উদ্বেগ এখানে যে, কর্তৃপক্ষের উচিৎ খুনীদের ধরা, ভিকটিমদের দোষারোপ করা নয়। বাংলাদেশ পুলিশ প্রধানের এক বিবৃতির দিকে তারা নির্দেশ করেন। মান্নান হত্যার পর পুলিশ প্রধান বলেছিলেন, যে নাগরিকদের উচিৎ তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক হওয়া। বিভিন্ন সময় কর্মকর্তারা ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করায় ব্লগারদের দায়ী করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মান্নানের ওই বন্ধু বলেন, ‘যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি দুঃখ দেয়, তা হলো, সরকার এ হত্যাকান্ডের অন্যান্য মোটিভ বের করতে অতিরিক্ত কসরত করছে।’
এমনকি কর্তৃপক্ষ যদি খুনীদের খুঁজে বের করে বিচার করতে প্রচেষ্টা বাড়ায়ও, ভয় কমবে না। ঢাকার কূটনীতিক পাড়ায় বসবাস করেন, এমন এক সমকামী বিদেশী বলেন, ‘আমি প্রতিদিন সকালে পার্কে হাটি। আজকে এক ব্যক্তি ছুরিসহ আমার দিকে আসছিল। যখন সে আমাকে ছাড়িয়ে চলে যায়, তখন আমি পেছনে ফিরে নিশ্চিত হই যে, আসলেই সে চলে গেছে কিনা।’ এই ব্যক্তি নিজের ভয়কে দূর করতে পারেননি। এমনকি পরে যখন তিনি বুঝতে পারলেন ছুরিসহ ওই লোকটি আসলে পাশের মাঠে ঘাস কাটতে গেছে, তখনও ভয় পিছু ছাড়েনি তার।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা ঢাকার: দ্য গার্ডিয়ান

প্রকাশের সময় : ০৭:১৮:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ মে ২০১৬

ঢাকা: এক ধরনের ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে ঢাকার রাজপথে। শিক্ষাবিদ, ব্লগার, কিছু বিশেষ মতাদর্শী লোকদের কাছে ঢাকা এখন কোন যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও ভয়ানক লাগছে। বৃটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের রোববারের (১ মে) সংখ্যা দ্য অবজার্ভারে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। গত তিন বছরে একে একে ১৬ জন মুক্তমনা ছাত্র, শিক্ষক, নিরাপত্তাকর্মী, কূটনৈতিক মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা এবং ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছয় জন ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক, এক ইতালিয়ান ধর্মযাজক, দুই বিদেশী নাগরিক ও এক সমকামী রয়েছেন।
৩০ এপ্রিল শনিবার টাঙ্গাইলে নিখিল জোয়ার্দার নামে এক হিন্দুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ মনে করছে, ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি নবী মোহাম্মদ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন। ওই অভিযোগের সঙ্গে তাকে হত্যার সম্পর্ক থাকতে পারে। অন্যান্য টার্গেটের মধ্যে রয়েছে খুব উঁচু স্তরের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব। আছে কিছু সাধারণ নাগরিকও। এদের হয়তো খুন করা হয়েছে স্রেফ তাদের জীবনধারা নিয়ে আইএসের আপত্তির কারণে। হতাহতদের মধ্যে বৈচিত্র রয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞের প্রতি কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া ছিল শ্লথ। ফলে নিহতদের সঙ্গে মিলে যায় এমন ভাবধারার মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে আতঙ্ক।
এসব খুনের দরুণ অনেক তরুণ নিজেদের দৈনন্দিন রুটিন পালটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। ‘জুলহাস ও তনয়ের মৃত্যুর খবর প্রকাশ হওয়ার পর, অনেক তরুণ-তরুণী সমকামীর যৌন-পরিচয়ের খবর পরিবারের কাছে প্রকাশ হয়। অথচ এখনই নিজেদের পরিবারকে জানাতে তারা প্রস্তুত ছিলেন না।’ এ কথাটি বলেছেন মান্নানের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি আমেরিকায় বসবাস করেন। নিজের নামটি তিনি জানাতে চাননি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমন মানুষকে জানি যারা প্রায় ৭ দিন ধরে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন না।’
এ হত্যাযজ্ঞের শকওয়েভ সমকামী বা অ্যাক্টিভিস্ট সম্প্রদায়কে ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে কূটনীতিক ও উন্নয়নকর্মীদের ভেতরও। মান্নান ছিলেন আমেরিকান দূতাবাসের সাবেক কর্মী। মৃত্যুর আগে তিনি মার্কিন সরকারের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি’তে কাজ করতেন।
‘তারা (জঙ্গিরা) এমন মানুষকে মেরে মনোযোগ কাড়তে চায়, যাদের মৃত্যুর ফলে ব্যাপক প্রচারণা পাওয়া যাবে’ বললেন আরেক আমেরিকা প্রবাসী। মান্নান ও তনয়কে হত্যার দুই দিন আগে, মোটরসাইকেলে করে দুই ব্যক্তি রাজশাহীর একটি বাসস্টপে নামে। এরপর তারা কুপিয়ে হত্যা করে রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। ইসলামিক স্টেট (আইএস) দাবি করেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘নাস্তিক্যবাদীতার দিকে আহ্বান করা’র জন্য।
রেজাউল করিম সিদ্দিকী ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। তিনি ছিলেন একজন গায়ক। ধর্মপ্রাণ মুসলমানও ছিলেন তিনি। ছিল না কোন রাজনৈতিক সংস্পর্শ। সেঁতার বিশেষ প্রিয় ছিল তার। নিজের গ্রামের বাড়ির মসজিদে তিনি নিয়মিত দান করতেন। স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাহায্য করেছিলেন। এ কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সস্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ শহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘যে কেউ টার্গেট হয়ে যেতে পারতো।’
আতঙ্কিত অনেকে মনে করছেন যে, ঠিক এটাই ছিল খুনীদের উদ্দেশ্য। এক মাসে পাঁচটি নৃশংস হত্যাকান্ড গোটা বাংলাদেশী সমাজেই শীতল প্রভাব ফেলেছে। সেক্যুলার অ্যাক্টিভিস্টিদের গ্রুপ গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ইমরান এইচ. সরকার বলেন, ‘নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আমার উপস্থিতি কমিয়ে ফেলতে হয়েছে। এমনকি ক’দিন আগেও পরিস্থিতি এতটা ভীতিজনক ছিল না।’
সবগুলো হামলার দায় হয় আইএস স্বীকার করেছে, নয়তো আল কায়দা ইন দ্য সাব কন্টিনেন্টের শাখা আনসার আল ইসলাম। কিন্তু বাংলাদেশে আন্তঃদেশীয় জিহাদি গ্রুপগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ঘরোয়া জঙ্গিরাই এসব হামলা চালাচ্ছে। এ জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসূত্র আছে প্রধান বিরোধী দলের, যারা কিনা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়।
যে-ই এ হত্যাযজ্ঞের পেছনে থাকুক না কেন, দেশে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার উদ্বেগজনক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অথচ, ১৬ কোটি জনসংখ্যার এ দেশটি চরমপন্থা প্রতিরোধে এতদিন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে সফল ছিল।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমরা উদারপন্থী মুল্যবোধ ধারণ করে আসছে। বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরী। তার মতে, ওই ঐতিহ্য এখন হুমকির মুখে। তার ভাষায়, ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। ইসলামী জঙ্গিবাদ গত ১০-১৫ বছর ধরে কেবল বেড়েছে।’
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বয়কট করা ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতারোহন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই সরকার সহিংসতা উস্কে দেয়ার অভিযোগে জ্যেষ্ঠ বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে।
আফসান চৌধুরী বলেন, ‘সরকার বিরোধী দলকে এই মাত্রার শাস্তি দিয়েছে যে, তারা এখন আর রাজনৈতিক শক্তি নয়।’ শক্ত বিরোধী দল না থাকায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পুরো পরিবেশ আঁচ করার অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ধারাবাহিক হত্যাকান্ড শুরু হয়। অ্যাক্টিভিস্টরা দাবি জানিয়েছিল যে, ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগীতার দায়ে দোষী সবাইকে মৃত্যুদন্ড দিতে হবে।
যাদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, তাদের অনেকেই বিরোধী দল ও তাদের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখছে না, এমন অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ব্যাপক সমালোচনা করে। একটি ইসলামী গোষ্ঠী ‘হেফাজতে ইসলাম’ তখন ৮৪ জন নাস্তিক ব্লগারের তালিকা প্রকাশ করে। গোষ্ঠিটি দাবি জানায় যে, অনলাইনে ধর্মের প্রতি অবমাননাকর কর্মকান্ডের জন্য এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারের।
ভুক্তভোগীদের পরিবার ও ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের শঙ্কা, পুলিশের তদন্ত খুবই শ্লথ ও অকার্যকর। এখন পর্যন্ত ৪৬ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র দুই জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারকে খুনে জড়িত থাকার দায়ে তাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে।
ইমরান এইচ. সরকার বলেন, ‘একটি গ্রেপ্তার মানেই ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নয়।’ অনেকের মধ্যে হতাশা রয়েছে যে, নিহত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান ব্লগার অভিজিৎ রায়ের কিছু হত্যাকারী দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছে। জুলহাস মান্নানের হত্যাকান্ডের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অধ্যাপক শহিদুজ্জামান বলেন, ‘মান্নান হত্যাকান্ডে সম্ভাব্য সন্দেহভাজনদের ধরতে চেষ্টা করবে সরকার। কিন্তু তারা আদৌ আসল দোষীদের ধরতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ অনেক।’
যারা হামলা থেকে বেঁচে গেছেন, তারা মনে করেন তাদের কথা সবাই ভুলে গেছে। আশা মনির স্বামী ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কে তার সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অথচ, পুলিশ তার সঙ্গে গত পাঁচ মাসে একবারও যোগাযোগ করেনি বলে জানান তিনি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এ মামলায় ৫ সন্দেহভাজনকে আটক করেছে।
অনেকের উদ্বেগ এখানে যে, কর্তৃপক্ষের উচিৎ খুনীদের ধরা, ভিকটিমদের দোষারোপ করা নয়। বাংলাদেশ পুলিশ প্রধানের এক বিবৃতির দিকে তারা নির্দেশ করেন। মান্নান হত্যার পর পুলিশ প্রধান বলেছিলেন, যে নাগরিকদের উচিৎ তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক হওয়া। বিভিন্ন সময় কর্মকর্তারা ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করায় ব্লগারদের দায়ী করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মান্নানের ওই বন্ধু বলেন, ‘যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি দুঃখ দেয়, তা হলো, সরকার এ হত্যাকান্ডের অন্যান্য মোটিভ বের করতে অতিরিক্ত কসরত করছে।’
এমনকি কর্তৃপক্ষ যদি খুনীদের খুঁজে বের করে বিচার করতে প্রচেষ্টা বাড়ায়ও, ভয় কমবে না। ঢাকার কূটনীতিক পাড়ায় বসবাস করেন, এমন এক সমকামী বিদেশী বলেন, ‘আমি প্রতিদিন সকালে পার্কে হাটি। আজকে এক ব্যক্তি ছুরিসহ আমার দিকে আসছিল। যখন সে আমাকে ছাড়িয়ে চলে যায়, তখন আমি পেছনে ফিরে নিশ্চিত হই যে, আসলেই সে চলে গেছে কিনা।’ এই ব্যক্তি নিজের ভয়কে দূর করতে পারেননি। এমনকি পরে যখন তিনি বুঝতে পারলেন ছুরিসহ ওই লোকটি আসলে পাশের মাঠে ঘাস কাটতে গেছে, তখনও ভয় পিছু ছাড়েনি তার।