নিউইয়র্ক ০৩:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:৪২:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৪
  • / ১১১৯ বার পঠিত

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। গত ২৯ অক্টোবর বুধবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে (বাংলাদেশ সময়) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন। তবে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আনিত ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ থেকেই তাঁকে খালাস দেয়া হয়েছে। বাকি অভিযোগগুলোর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ এবং ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
এদিকে রায় ঘোষণার পরে মাওলানা নিজামীর আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম প্রতিক্রিয়াতে বলেছেন, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। এ রায় ভুল ও ভিত্তিহীন। এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাজুল ইসলাম আরো বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। আপিলে নিজামীর মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে বলেও আশা কাশ করেন এই আইনজীবী।
রায় ঘোষণার দিন বেলা ১১টা ৮ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ২০৪ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু হয়। শুরুতেই ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কবে রায় দিতে পারবো। এ জন্য অনেকে অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু আমরা এসব কথা আমলে নিতে পারি না, কোন জবাবও দিতে পারি না। কেননা  আমরা টক-শো কিংবা রাস্তায় আদালতের বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারি না। কথা বলা বা জবাব দেয়া আমাদের জন্য সমিচীনও নয়। আমরা আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, আইন আর সংবিধান দিয়ে বিচার করি। আমরা কারো নির্দেশ বা নির্দেশনাতে বিচার করি না। আমরা আইন সংবিধান আর ঘটনার বিবেচনায় বিচার করি।
এরপর মাওলানা নিজামীর মামলার সংক্ষিপ্ত রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। পরবর্তী অংশ পড়েন বিচাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। পরে রায়ের মূল অংশটি পড়েন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটি ট্রাইব্যুনালের দশম রায় এবং ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে এটিই প্রথম রায়। এর আগে মঙ্গলবার মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার জন্য ট্রাইব্যুনাল এই দিন ধার্য করেন। তার আগে গত ২৪ জুন এই মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর অসুস্থতার কারণে সেদিন রায় ঘোষণা করা হয়নি।
২০১৩ সালের ১৩ নবেম্বর প্রথমবারের মতো এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই অবসরে চলে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল অধিকতর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে দ্বিতীয় দফায় গত ২৪ মার্চ মামলার রায় অপেক্ষমান রাখেন।
২০১২ সালের ২৮মে এই ট্রাইব্যুনাল মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। অভিযোগের মধ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা।
অভিযোগ গঠনের ৩ মাস পর ২৬ আগস্ট তার বিরুদ্ধে মামলায় বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর জবানবন্দীর মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন মুক্তিযোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খানসহ আরো ২৫ জন।
আসামীপক্ষের সাক্ষী (সাফাই সাক্ষী) হিসেবে প্রথমে ১০ হাজার ১১ জন সাক্ষীর তালিকা দিয়েছিল আসামীপক্ষ। পরে তারা ২৩ জন সাক্ষীর একটি সংশোধিত তালিকা জমা দেন। এর মধ্যে ৪ জনকে সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে দেন ট্রাইব্যুনাল। সাফাই সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মুমেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন একটি মামলায় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
চার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আনিত ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ থেকেই তাঁকে খালাস দেয়া হয়েছে। বাকি অভিযোগগুলোর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ এবং ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
২নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন মাওলানা নিজামী। সভার পরিকল্পনা অনুসারে ১৪ মে দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪৫০ জনকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করে। এছাড়া প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
৪নং অভিযোগ, পাবনার করমজা গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের ঘটনায় নিজামীর সম্পৃক্ততা।
৬নং অভিযোগ হলো, একাত্তরের ২৭ নবেম্বর ধুলাউড়া গ্রামে ৩০ জনকে হত্যায় নেতৃত্ব ও সম্পৃক্ততার।
১৬ নম্বর অভিযোগ বুদ্ধিজীবী নিধনের। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর চাপনো হয়েছে রায়ে।
চার অভিযোগে যাবজ্জীবন
মাওলানা নিজামীকে ১, ৩, ৭ ও ৮ নং অভিযোগে যাবজ্জীব কারাদন্ড দেয়া হয়।
১নং অভিযোগে বলা হয়েছে, পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানী সেনারা অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে আরো কয়েকজনের সঙ্গে হত্যা করা হয়।
৩নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নিজামী ঐ ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
৭নং অভিযোগ, একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর সোহরাব আলী নামক এক ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হত্যার।
৮নং অভিযোগে বলা হয়েছে, ঐ সালের ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানী সেনাদের প্ররোচনা দেন।
আট অভিযোগ থেকে খালাস
নিম্মোক্ত ৮ অভিযোগ থেকে মাওলানা নিজামীকে খালাস
৫নং অভিযোগ হলো, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ২১ জন নিরস্ত্র মানুষ মারা যায়।
৯ নং অভিযোগ, ৩ ডিসেম্বর হিন্দু অধ্যুষিত বিশালিখা গ্রামে ৭০ জনকে গণহত্যার।
১০ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিলচন্দ্র কুন্ডুর বাড়িতে আগুন দেয়।
১১ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।
১২ নং অভিযোগ হলো, ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন নিজামী।
১৩ নং অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় বক্তব্য দেন তিনি।
১৪ নং অভিযোগ হলো, ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য।
১৫ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী ও রাজাকার সামাদ মিয়ার ষড়যন্ত্রে সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। (দৈনিক সংগ্রাম)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ

প্রকাশের সময় : ০৮:৪২:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০১৪

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। গত ২৯ অক্টোবর বুধবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে (বাংলাদেশ সময়) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন। তবে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে আনিত ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ থেকেই তাঁকে খালাস দেয়া হয়েছে। বাকি অভিযোগগুলোর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ এবং ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
এদিকে রায় ঘোষণার পরে মাওলানা নিজামীর আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম প্রতিক্রিয়াতে বলেছেন, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। এ রায় ভুল ও ভিত্তিহীন। এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাজুল ইসলাম আরো বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। আপিলে নিজামীর মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে বলেও আশা কাশ করেন এই আইনজীবী।
রায় ঘোষণার দিন বেলা ১১টা ৮ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ২০৪ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু হয়। শুরুতেই ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কবে রায় দিতে পারবো। এ জন্য অনেকে অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু আমরা এসব কথা আমলে নিতে পারি না, কোন জবাবও দিতে পারি না। কেননা  আমরা টক-শো কিংবা রাস্তায় আদালতের বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারি না। কথা বলা বা জবাব দেয়া আমাদের জন্য সমিচীনও নয়। আমরা আমাদের বিবেক, বুদ্ধি, আইন আর সংবিধান দিয়ে বিচার করি। আমরা কারো নির্দেশ বা নির্দেশনাতে বিচার করি না। আমরা আইন সংবিধান আর ঘটনার বিবেচনায় বিচার করি।
এরপর মাওলানা নিজামীর মামলার সংক্ষিপ্ত রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। পরবর্তী অংশ পড়েন বিচাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। পরে রায়ের মূল অংশটি পড়েন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটি ট্রাইব্যুনালের দশম রায় এবং ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে এটিই প্রথম রায়। এর আগে মঙ্গলবার মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার জন্য ট্রাইব্যুনাল এই দিন ধার্য করেন। তার আগে গত ২৪ জুন এই মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর অসুস্থতার কারণে সেদিন রায় ঘোষণা করা হয়নি।
২০১৩ সালের ১৩ নবেম্বর প্রথমবারের মতো এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই অবসরে চলে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল অধিকতর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে দ্বিতীয় দফায় গত ২৪ মার্চ মামলার রায় অপেক্ষমান রাখেন।
২০১২ সালের ২৮মে এই ট্রাইব্যুনাল মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। অভিযোগের মধ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা।
অভিযোগ গঠনের ৩ মাস পর ২৬ আগস্ট তার বিরুদ্ধে মামলায় বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর জবানবন্দীর মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন মুক্তিযোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আজহারুল হকের স্ত্রী সৈয়দা সালমা হক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক খানসহ আরো ২৫ জন।
আসামীপক্ষের সাক্ষী (সাফাই সাক্ষী) হিসেবে প্রথমে ১০ হাজার ১১ জন সাক্ষীর তালিকা দিয়েছিল আসামীপক্ষ। পরে তারা ২৩ জন সাক্ষীর একটি সংশোধিত তালিকা জমা দেন। এর মধ্যে ৪ জনকে সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে দেন ট্রাইব্যুনাল। সাফাই সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন জামায়াত নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মুমেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন একটি মামলায় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
চার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আনিত ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ থেকেই তাঁকে খালাস দেয়া হয়েছে। বাকি অভিযোগগুলোর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ এবং ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
২নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন মাওলানা নিজামী। সভার পরিকল্পনা অনুসারে ১৪ মে দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪৫০ জনকে পাকিস্তানী সেনারা হত্যা করে। এছাড়া প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
৪নং অভিযোগ, পাবনার করমজা গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের ঘটনায় নিজামীর সম্পৃক্ততা।
৬নং অভিযোগ হলো, একাত্তরের ২৭ নবেম্বর ধুলাউড়া গ্রামে ৩০ জনকে হত্যায় নেতৃত্ব ও সম্পৃক্ততার।
১৬ নম্বর অভিযোগ বুদ্ধিজীবী নিধনের। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর চাপনো হয়েছে রায়ে।
চার অভিযোগে যাবজ্জীবন
মাওলানা নিজামীকে ১, ৩, ৭ ও ৮ নং অভিযোগে যাবজ্জীব কারাদন্ড দেয়া হয়।
১নং অভিযোগে বলা হয়েছে, পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানী সেনারা অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে আরো কয়েকজনের সঙ্গে হত্যা করা হয়।
৩নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নিজামী ঐ ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
৭নং অভিযোগ, একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর সোহরাব আলী নামক এক ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হত্যার।
৮নং অভিযোগে বলা হয়েছে, ঐ সালের ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানী সেনাদের প্ররোচনা দেন।
আট অভিযোগ থেকে খালাস
নিম্মোক্ত ৮ অভিযোগ থেকে মাওলানা নিজামীকে খালাস
৫নং অভিযোগ হলো, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ২১ জন নিরস্ত্র মানুষ মারা যায়।
৯ নং অভিযোগ, ৩ ডিসেম্বর হিন্দু অধ্যুষিত বিশালিখা গ্রামে ৭০ জনকে গণহত্যার।
১০ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিলচন্দ্র কুন্ডুর বাড়িতে আগুন দেয়।
১১ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।
১২ নং অভিযোগ হলো, ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন নিজামী।
১৩ নং অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় বক্তব্য দেন তিনি।
১৪ নং অভিযোগ হলো, ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য।
১৫ নং অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী ও রাজাকার সামাদ মিয়ার ষড়যন্ত্রে সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। (দৈনিক সংগ্রাম)