নিউইয়র্ক ১২:০৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

মর্মান্তিক : সিলেটে পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে শিশু হত্যা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:১৬:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ জুলাই ২০১৫
  • / ৯৬৩ বার পঠিত

সিলেট: শেখ আজিজুর রহমান পেশায় মাইক্রোচালক। তবে রোজ পারিশ্রমিকে। কেউ বদলি দিলে গাড়ি চালাতে যান। কাজে গেলে বাজার হয়। খাবার জোটে। নতুবা পুরো পরিবার নিয়েই থাকতে হয় উপোস। সেই আজিজুর রহমানের দুই ছেলে রাজন ও সাজন। রাজনের বয়স ১৩ বছর। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালেই বই-খাতা ফেলে তুলে নিতে হয় সবজির ডালা। সবজি বেচে আর বাবাকে নানাভাবে সাহায্য করে পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল এটুকুন ছেলে। কিন্তু মধ্যযুগীয় নির্মমতা সবটুকু কেড়ে নিল তার। চোর অপবাদ দিয়ে বর্বর ঘাতকেরা খুঁটির সঙ্গে হাত পেছনে বেঁধে মাথা, নখ ও পিঠে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, হাত-পা দুমড়ে-মুচড়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে তাকে। মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় নাভিতে রড দিয়ে মুচড়িয়ে। মুত্যুর আগে করুণ আকুতি জানিয়ে একটু পানি খেতে চেয়েছিল সে। জবাবে বলা হয়েছিল- ‘ঘাম খা’। তার করুণ আর্তি, আর্তচিৎকার কিছুই মন গলাতে পারেনি ঘাতকদের। উল্টো চারপাশ ঘিরে উল্লাস করে গেছে তারা।
এমনকি এ পৈশাচিক নির্যাতনের সময় ঘাতকরা ধারণ করে ভিডিও চিত্রও। ছড়িয়ে দেয় ইন্টারনেটে। তা দেখে কেঁপে উঠে সিলেট। শুধু কি সিলেট, পুরো বাংলাদেশই স্তব্ধ রাজনের এমন মৃত্যুতে। আর তার পরিবার? সেখানে শুধুই শোকের মাতম। মা লুবনা আক্তার পাগলপ্রায়। আত্মীয়-স্বজনরা এসে কোনোমতে তাকে আগলে রেখেছেন। বাবা ছুটছেন থানায়, এর কাছে, ওর কাছে। ছেলে হত্যার বিচার চান তিনি।
রোববার (১২ জুলাই) বিকালে এ প্রতিবেদকের কথা হয় রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমানের। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, ‘আমার ছেলে চোর না। আমার পরিবার-বংশের কারও বিরুদ্ধে এমন অপবাদ নেই। মামলা দূরে থাক জীবনে কোনোদিন আমরার বিরুদ্ধে বিচারও বইসেনা। বাচ্চাটারে খুন করার পরে চোর বানাইছে। আমার ছেলে রাজন কেমন সারা এলাকা জানে। তারা খুব টাকাওয়ালা। আমার রাজনরে মারার পরে ছোট ছেলে সাজনরে নানা বাড়ি নিয়া রাখছি। তারা পাইলে মার লাইবো।’
রাজনের পিতা কথা বলতে পারলেও মা লুবনা কথা বলতে পারেন না। তার মুখে এখন একটাই ভাষা কান্না। রাজনের পিতার দাবি, ৮ জন মিলে রাজনকে খুন করেছে। এরমধ্যে গ্রেফতার থাকা মুহিতের রিমান্ডের শুনানি সোমবার হবে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু অপর ৭ ঘাতকদের ঘটনার ৪ দিনেও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। ঘাতকরা সবাই এতদিন এলাকায় ছিল। নির্যাতনের ভিডিও ফাঁসের পর তোলপাড় শুরু হয়। পালাতে শুরু করেছে ঘাতকরা।
তিনি বলেন, প্রবাসী কামরুল, মুহিত, আলী, শামীম, ইফসুফ, ময়না, দুলাল ও পাভেল আমার ছেলে রাজনকে খুন করেছে। তাদের নির্যাতনে সর্বশেষ রাজনের দেহ নিথর হয়ে আসে এবং মারা যায়। পরে গাড়িতে করে লাশ গুম করতে নিয়ে গেলে জনতার হাতে মুহিত আটক হয়। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়। এছাড়া আর কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি।
বুধবার (৮ জুলাই) নির্মম এ ঘটনা ঘটে সিলেট শহরতলির কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড এলাকায়। এ ঘটনাকে ঘিরে পুরো সিলেট শহরে তোলপাড় হচ্ছে। নির্যাতনের ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর রাজনের বাড়িতে মানুষের ঢল নামে। সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদে আলী গ্রামে রাজনের বাড়ি। প্রথমে এ নির্মম ঘটনাকে সাধারণ চোর পেটানোর ঘটনা বলে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। রোববার ভিডিও ফাঁস হলে মধ্যযুগীয় পৈশাচিকতা আর ধামাচাপা দেয়া যায়নি। শুরু হয় তোলপাড়। দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় মিডিয়াকর্মী ও প্রশাসনের।
রাজনের আত্মীয়-স্বজনরা জানান, বুধবার সবজি বিক্রি করতে বের হওয়া রাজন আর ফেরেনি। রাতে বাড়ি না ফেরায় রাজনের বাবা-মা জালালাবাদ থানায় জিডি করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাজনের লাশ দেখে মুষড়ে পড়েন তারা দু’জনই। এ ঘটনায় প্রথমে জালালাবাদ থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। পরে রাজনের পিতাও আরেকটি এজাহার দেন। মামলা নং-২৯৭/১৫।
জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন বলেন, দুটি এজাহারই আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। মামলাটি ওসি তদন্ত আলমগীর হোসেন তদন্ত করছেন বলে তিনি জানান। হত্যাকান্ডস্থলের পার্শ্ববর্তী নিউ উত্তরণ মটর্সের স্বত্বাধিকারী সুদীপ বাবুর বক্তব্য নেয়া হয়েছে বলে জানান ওসি। তিনি বলেন, গ্রেফতার থাকা মুহিতের ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। সোমবার রিমান্ডের শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
নির্যাতনের সময় মোবাইলে রেকর্ডকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, উল্লাসের সঙ্গে শিশু রাজনের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। প্রায় ২৮ মিনিটব্যাপী ভিডিওর ১৬ মিনিট খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করা হচ্ছে রাজনকে। এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। একদিকে রাজনের আর্তচিৎকার, অন্যদিকে নির্যাতনকারীদের অট্টহাসি। ভিডিওর শেষ প্রান্তে একজন বলে উঠে ‘কিতা করতাম?’ তখন আরেকজন বলে ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ রাজনকে নির্যাতনের ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, রাজনকে কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ডের পার্শ্ববর্তী খাঁন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়।
ভিডিও চিত্রে চারজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিওতে দু’জনের চেহারা দেখা গেছে। ‘এই ক (বল) তুই চোর, তোর নাম ক… লগে কারা আছিল…’ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়ে মারধর করা হয়। একনাগাড়ে প্রায় ১৬ মিনিট রাজনকে অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোল দিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে পানি খাওয়ার আকুতি জানায় রাজন। কিন্তু পানির বদলে ‘ঘাম খা’ বলে মাটিতে ফেলে রাখা হয় তাকে।
ভিডিও চিত্র ধারণ করার সময়ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিহ্নিত রয়েছে সময়। তখন সকাল সাড়ে ৭টা। মারধর করার সময় একদিকে রাজনের মুখে আর্তচিৎকার, আর অন্যদিকে নির্যাতনকারীদের মুখে অট্টহাসি দিয়ে নানা কটূক্তি করতেও শোনা গেছে। রাজনের নখে, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে আঘাত করে এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেয়া হয়। ‘হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো…’ বলে রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেক দফা পেটানো হয়। এ সময় রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ বেশ ফোলা দেখা গেছে।
যে ভিডিও ধারণ করার কাজটি করছিল, তাকে নির্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায়- ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কিনা। ওপাশ থেকে ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব…’ বলতে শোনা গেছে। শেষ দিকে নির্যাতনকারী একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চায়- ‘কিতা করতাম?’ বলে। অপর একজনকে তখন ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ বলতে শোনা যায়। জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন, নির্যাতন ভিডিও চিত্রে ধারণ করার বিষয়টি শুনেছি এবং এটি দেখেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথাও হয়েছে। ওসি জানান, ঘটনার সঙ্গে মামলার আসামি চারজনই সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভিডিও চিত্র ধারণসহ পুরো ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুহিতকে আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। রোববার আদালতে রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে। এদিকে, এ মামলার অন্যতম আসামি সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলামের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন।
বুধবার রাজনকে এমন নির্যাতন করে লাশ গুমের চেষ্টা করে ঘাতকরা। ওইদিন ঘাতকরা বেলা ১১টার দিকে একটি মাইক্রোবাসে তার লাশ পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামের মাঠে ফেলে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর সন্দেহ হলে মাইক্রোবাসসহ একজনকে আটক করে। খবর পেয়ে রাতে থানায় গিয়ে পরিবারের সদস্যরা রাজনের লাশ শনাক্ত করেন। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

মর্মান্তিক : সিলেটে পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে শিশু হত্যা

প্রকাশের সময় : ০৬:১৬:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ জুলাই ২০১৫

সিলেট: শেখ আজিজুর রহমান পেশায় মাইক্রোচালক। তবে রোজ পারিশ্রমিকে। কেউ বদলি দিলে গাড়ি চালাতে যান। কাজে গেলে বাজার হয়। খাবার জোটে। নতুবা পুরো পরিবার নিয়েই থাকতে হয় উপোস। সেই আজিজুর রহমানের দুই ছেলে রাজন ও সাজন। রাজনের বয়স ১৩ বছর। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালেই বই-খাতা ফেলে তুলে নিতে হয় সবজির ডালা। সবজি বেচে আর বাবাকে নানাভাবে সাহায্য করে পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল এটুকুন ছেলে। কিন্তু মধ্যযুগীয় নির্মমতা সবটুকু কেড়ে নিল তার। চোর অপবাদ দিয়ে বর্বর ঘাতকেরা খুঁটির সঙ্গে হাত পেছনে বেঁধে মাথা, নখ ও পিঠে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, হাত-পা দুমড়ে-মুচড়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে তাকে। মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় নাভিতে রড দিয়ে মুচড়িয়ে। মুত্যুর আগে করুণ আকুতি জানিয়ে একটু পানি খেতে চেয়েছিল সে। জবাবে বলা হয়েছিল- ‘ঘাম খা’। তার করুণ আর্তি, আর্তচিৎকার কিছুই মন গলাতে পারেনি ঘাতকদের। উল্টো চারপাশ ঘিরে উল্লাস করে গেছে তারা।
এমনকি এ পৈশাচিক নির্যাতনের সময় ঘাতকরা ধারণ করে ভিডিও চিত্রও। ছড়িয়ে দেয় ইন্টারনেটে। তা দেখে কেঁপে উঠে সিলেট। শুধু কি সিলেট, পুরো বাংলাদেশই স্তব্ধ রাজনের এমন মৃত্যুতে। আর তার পরিবার? সেখানে শুধুই শোকের মাতম। মা লুবনা আক্তার পাগলপ্রায়। আত্মীয়-স্বজনরা এসে কোনোমতে তাকে আগলে রেখেছেন। বাবা ছুটছেন থানায়, এর কাছে, ওর কাছে। ছেলে হত্যার বিচার চান তিনি।
রোববার (১২ জুলাই) বিকালে এ প্রতিবেদকের কথা হয় রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমানের। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, ‘আমার ছেলে চোর না। আমার পরিবার-বংশের কারও বিরুদ্ধে এমন অপবাদ নেই। মামলা দূরে থাক জীবনে কোনোদিন আমরার বিরুদ্ধে বিচারও বইসেনা। বাচ্চাটারে খুন করার পরে চোর বানাইছে। আমার ছেলে রাজন কেমন সারা এলাকা জানে। তারা খুব টাকাওয়ালা। আমার রাজনরে মারার পরে ছোট ছেলে সাজনরে নানা বাড়ি নিয়া রাখছি। তারা পাইলে মার লাইবো।’
রাজনের পিতা কথা বলতে পারলেও মা লুবনা কথা বলতে পারেন না। তার মুখে এখন একটাই ভাষা কান্না। রাজনের পিতার দাবি, ৮ জন মিলে রাজনকে খুন করেছে। এরমধ্যে গ্রেফতার থাকা মুহিতের রিমান্ডের শুনানি সোমবার হবে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু অপর ৭ ঘাতকদের ঘটনার ৪ দিনেও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। ঘাতকরা সবাই এতদিন এলাকায় ছিল। নির্যাতনের ভিডিও ফাঁসের পর তোলপাড় শুরু হয়। পালাতে শুরু করেছে ঘাতকরা।
তিনি বলেন, প্রবাসী কামরুল, মুহিত, আলী, শামীম, ইফসুফ, ময়না, দুলাল ও পাভেল আমার ছেলে রাজনকে খুন করেছে। তাদের নির্যাতনে সর্বশেষ রাজনের দেহ নিথর হয়ে আসে এবং মারা যায়। পরে গাড়িতে করে লাশ গুম করতে নিয়ে গেলে জনতার হাতে মুহিত আটক হয়। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়। এছাড়া আর কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি।
বুধবার (৮ জুলাই) নির্মম এ ঘটনা ঘটে সিলেট শহরতলির কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড এলাকায়। এ ঘটনাকে ঘিরে পুরো সিলেট শহরে তোলপাড় হচ্ছে। নির্যাতনের ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর রাজনের বাড়িতে মানুষের ঢল নামে। সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদে আলী গ্রামে রাজনের বাড়ি। প্রথমে এ নির্মম ঘটনাকে সাধারণ চোর পেটানোর ঘটনা বলে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। রোববার ভিডিও ফাঁস হলে মধ্যযুগীয় পৈশাচিকতা আর ধামাচাপা দেয়া যায়নি। শুরু হয় তোলপাড়। দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় মিডিয়াকর্মী ও প্রশাসনের।
রাজনের আত্মীয়-স্বজনরা জানান, বুধবার সবজি বিক্রি করতে বের হওয়া রাজন আর ফেরেনি। রাতে বাড়ি না ফেরায় রাজনের বাবা-মা জালালাবাদ থানায় জিডি করতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাজনের লাশ দেখে মুষড়ে পড়েন তারা দু’জনই। এ ঘটনায় প্রথমে জালালাবাদ থানার এসআই আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। পরে রাজনের পিতাও আরেকটি এজাহার দেন। মামলা নং-২৯৭/১৫।
জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন বলেন, দুটি এজাহারই আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। মামলাটি ওসি তদন্ত আলমগীর হোসেন তদন্ত করছেন বলে তিনি জানান। হত্যাকান্ডস্থলের পার্শ্ববর্তী নিউ উত্তরণ মটর্সের স্বত্বাধিকারী সুদীপ বাবুর বক্তব্য নেয়া হয়েছে বলে জানান ওসি। তিনি বলেন, গ্রেফতার থাকা মুহিতের ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। সোমবার রিমান্ডের শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
নির্যাতনের সময় মোবাইলে রেকর্ডকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, উল্লাসের সঙ্গে শিশু রাজনের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। প্রায় ২৮ মিনিটব্যাপী ভিডিওর ১৬ মিনিট খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করা হচ্ছে রাজনকে। এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। একদিকে রাজনের আর্তচিৎকার, অন্যদিকে নির্যাতনকারীদের অট্টহাসি। ভিডিওর শেষ প্রান্তে একজন বলে উঠে ‘কিতা করতাম?’ তখন আরেকজন বলে ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ রাজনকে নির্যাতনের ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, রাজনকে কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ডের পার্শ্ববর্তী খাঁন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়।
ভিডিও চিত্রে চারজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিওতে দু’জনের চেহারা দেখা গেছে। ‘এই ক (বল) তুই চোর, তোর নাম ক… লগে কারা আছিল…’ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়ে মারধর করা হয়। একনাগাড়ে প্রায় ১৬ মিনিট রাজনকে অনেকটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোল দিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে পানি খাওয়ার আকুতি জানায় রাজন। কিন্তু পানির বদলে ‘ঘাম খা’ বলে মাটিতে ফেলে রাখা হয় তাকে।
ভিডিও চিত্র ধারণ করার সময়ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিহ্নিত রয়েছে সময়। তখন সকাল সাড়ে ৭টা। মারধর করার সময় একদিকে রাজনের মুখে আর্তচিৎকার, আর অন্যদিকে নির্যাতনকারীদের মুখে অট্টহাসি দিয়ে নানা কটূক্তি করতেও শোনা গেছে। রাজনের নখে, মাথা ও পেটে রোল দিয়ে আঘাত করে এক সময় বাঁ হাত ও ডান পা ধরে মোচড়াতেও দেখা যায়। কয়েক মিনিটের জন্য রাজনকে হাতের বাঁধন খুলে রশি লাগিয়ে হাঁটতে দেয়া হয়। ‘হাড়গোড় তো দেখি সব ঠিক আছে, আরও মারো…’ বলে রাজনের বাঁ হাত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে আরেক দফা পেটানো হয়। এ সময় রাজনের শরীর ও চোখ-মুখ বেশ ফোলা দেখা গেছে।
যে ভিডিও ধারণ করার কাজটি করছিল, তাকে নির্দেশ করে নির্যাতনকারীরা জানতে চায়- ঠিকমতো ভিডিও ধারণ হচ্ছে কিনা। ওপাশ থেকে ‘ফেসবুকে ছাড়ি দিছি, অখন সারা দুনিয়ার মানুষ দেখব…’ বলতে শোনা গেছে। শেষ দিকে নির্যাতনকারী একজন সঙ্গীদের কাছে জানতে চায়- ‘কিতা করতাম?’ বলে। অপর একজনকে তখন ‘মামায় যে কইছন, ওই কাম করি ছাড়ি দে!’ বলতে শোনা যায়। জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন, নির্যাতন ভিডিও চিত্রে ধারণ করার বিষয়টি শুনেছি এবং এটি দেখেছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথাও হয়েছে। ওসি জানান, ঘটনার সঙ্গে মামলার আসামি চারজনই সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভিডিও চিত্র ধারণসহ পুরো ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুহিতকে আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। রোববার আদালতে রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে। এদিকে, এ মামলার অন্যতম আসামি সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলামের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন।
বুধবার রাজনকে এমন নির্যাতন করে লাশ গুমের চেষ্টা করে ঘাতকরা। ওইদিন ঘাতকরা বেলা ১১টার দিকে একটি মাইক্রোবাসে তার লাশ পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামের মাঠে ফেলে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর সন্দেহ হলে মাইক্রোবাসসহ একজনকে আটক করে। খবর পেয়ে রাতে থানায় গিয়ে পরিবারের সদস্যরা রাজনের লাশ শনাক্ত করেন। (দৈনিক যুগান্তর)