নিউইয়র্ক ১১:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সীমান্ত চুক্তির বিল অনুমোদন : অবসান হচ্ছে ৬৩ বছরের প্রতীক্ষার : বাংলাদেশের ৫১টি, ভারতের ১১১টি ছিটমহল বিনিময়ের সম্ভাবনা : উভয় সীমান্তে আনন্দের বন্যা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৪:৩৫:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ মে ২০১৫
  • / ২০২৬ বার পঠিত

ঢাকা: আসামকে অন্তর্ভুক্ত রেখেই ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা মঙ্গলবার (৫ মে) সীমান্ত চুক্তির বিল অনুমোদন দিয়েছে। ফলে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিল মোদির সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। এরমধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। ফলে দুই দেশের ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর ৬৩ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্তের রেখাও টানা হবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দু’দেশের মানচিত্রেও কিছুটা পরিবর্তন আসবে।
বিল অনুমোদন কেন্দ্র করে বিজেপি সরকার ও কংগ্রেসের মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। বিজিপে সরকার আসামকে বাদ রেখে বিল পাসের উদ্যোগ নিলে তীব্র আপত্তি জানায় কংগ্রেস। তারা এই চুক্তি পাসের বিরোধিতা করবে বলেও জানিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৪ মে) রাতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর বাসভবনে এক সমঝোতা বৈঠকে কংগ্রেসের দাবি মেনে নেয় বিজেপি। এখন কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই বিল পাসে সমর্থন দেবে। সীমান্ত চুক্তি পাসের উদ্যোগের খবরে বাংলাদেশ ও ভারতে ছিটমহলবাসীর মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে বলে জানা গেছে।
BD-India Border Aggrimentসীমান্ত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। চুক্তির বাস্তবায়ন হলে ১৭ হাজার একরের কিছু বেশি জমি বাংলাদেশ পাবে। ভারত পাবে সাত হাজার একরের সামান্য বেশি জমি। তবে বা¯স্তব এই জমির কোনো বিনিময় হবে না। এটা হবে কাগজপত্রে এবং ধারণাগত বিনিময়। বর্তমানে এই জমি উভয় দেশের দখলে রয়েছে। এছাড়াও, চুক্তির আওতায় অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর হবে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির একটি অতিরিক্ত প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। সেখানে ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর এবং অচিহ্নিত স্থলসীমানা চিহ্নিত করার মাধ্যমে একটি প্যাকেজ সমাধান করা হয়। এই সমাধানের লক্ষ্যে দুই দেশের জরিপ কর্মকর্তারা বিরোধপূর্ণ এলাকায় গিয়ে গুচ্ছ মানচিত্র প্রস্তুত করেন। এই গুচ্ছ মানচিত্র দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষর ও হস্তান্তর হয়েছে। ফলে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বলে পরিচিত সীমান্ত চুক্তিতে ২০১১ সালের নতুন প্রটোকল এমন ভাবে যুক্ত করা হয়েছে যে, সীমান্তেও কোনো বাসিন্দাকেই সরানো হবে না। বর্তমানে যারা যেভাবে সীমানা দখলে রেখেছেন তা স্থির রেখে নতুন সীমান্ত রেখা টানা হয়েছে। ফলে দুই দেশের মানচিত্রে কাগজপত্রে খানিকটা বদল হয়েছে বটে।
বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলেই সীমান্ত চুক্তি পাস করতে রাজ্যসভায় বিল উত্থাপন করেছিল। কিন্তু তখন বিজেপি এই চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে বিল পাস হয়নি বটে তবে রাজ্যসভায় কোনো বিল উত্থাপন হলে তা থেকে যায়। ফলে বিলটি রাজ্যসভায় এখনও আছে। এখন তা পাসের জন্য আজকের কার্যসূচিতে নেয়া হচ্ছে। এক সময় চুক্তির বিরোধিতাকারী বিজেপি এখন যুক্তি দেখাচ্ছে, এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ বন্ধ হবে। ফলে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন সম্ভব হবে। তবে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য হল নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের আগে ভারত তার প্রতিশ্রুতির একটি বাস্তবায়ন। এতে করে মোদির সরকার বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেক্ষেত্রেও অগ্রগতির আশা করছে দিল্লি। এমন হলে মোদির সফরে আরও অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হতে পারে। যদিও মোদির সফরের আগে আরেক প্রতিশ্রুতি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ৮ মে লোকসভার চলতি অধিবেশন শেষে চীন, মঙ্গোলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। এরপর জুন বা জুলাইয়ে বাংলাদেশে আসতে চান তিনি। তবে ভারতীয় কূটনীতিকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘খালি হাতে’ ঢাকা সফরে যাওয়া মোদির ‘ঠিক হবে না’। এ কারণে লোকসভার চলতি অধিবেশনেই বিলটি পাস করিয়ে আনতে মোদির এই তাড়াহুড়ো। ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি’ নামে পরিচিত ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরে এসে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ঢাকায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘ভারত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত। ১৯৭৪ সালে ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ এবং ২০১১ সালে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে এ সংক্রান্ত যে প্রটোকল সই করেছেন, তা এখনও বৈধ। চুক্তির আলোকে সেটা বাস্তবায়নকে স্বাগত জানাই’। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে আশা করছি। তবে তার সফরের দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি’।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর সংবিধান সংশোধন করতে ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে তা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাস হতে হবে। ৬ মে বুধবার ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় এই বিল পাসের লক্ষ্যে তা উত্থাপন করা হবে। রাজ্যসভায় পাস হলে বৃহস্পতিবার বিলটি উত্থাপন করা হতে পারে পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ লোকসভায়। এদিকে, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়াকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ছিটমহলের বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের অবসান হবে। এতে করে মানবিক সমস্যার সমাধান হবে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা অনেক সহজ হবে। ফলে সন্ত্রাস দমনসহ যে কোনো ধরনের জঙ্গিদের চলাচল রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও সহজ হবে।
আসাম বিজেপির পক্ষ থেকে স্থল সীমান্ত চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করা হয়। ফলে চুক্তি থেকে আসামের ছিটমহলগুলো বাদ দেয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিবেচনা করেছিলেন। এরপর স্থল সীমান্ত চুক্তি থেকে আসামকে বাদ না দিতে মোদিকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। আসামকে বাদ দিলে রাজ্যসভায় এ বিল পাসে সমর্থন দেয়া হবে না বলে ইঙ্গিত দেয় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। শেষ পর্যন্ত সোমবার রাতে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর বাসভবনে এক বৈঠকে আসামকে রেখেই প্রস্তাবটি পাসের জন্য তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আসাম বিজেপির সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যসহ দলের সংসদ সদস্যরাও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ছিটমহল বিনিময়ের পর ভারতের ছিটমহলে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের সব দায়-দায়িত্ব ভারত সরকার বহন করবে। পুনর্বাসনের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্যের নয়। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিটমহল বসবাসকারীদের কেউ যদি ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন তবে তার পুনর্বাসনের সব দায় কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নাগরিকত্ব দেয়াসহ সব দায়িত্ব পালন করবে ভারতের সরকার। ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব দেয়াসহ পুনর্বাসনে রাজ্য সরকারের কোনো সুপারিশ থাকলে কেন্দ্র তাও বিবেচনা করবে। এসব বিষয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ফিরে দেখা: ছিটমহল হচ্ছে কোনো দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য একটি দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান ভূখন্ড বা জনপদ। ছিটমহল থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ওখানে যেতে হলে অন্য দেশটির জমির ওপর দিয়ে যেতে হয়। এসব ছিটমহল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় এবং সীমানার ওপারে ভারতের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। কোচরাজারা এবং রংপুরের মহারাজারা মূলত ছিল সীমান্ত। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও মহলের বিনিময় হতো। মোগল আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা ও মহারাজারা মিলিত হতো তিস্তা পাড়ে দাবা ও তাস খেলার উদ্দেশে। খেলায় বাজি ধরা হতো বিভিন্ন মহল নিয়ে, যা কাগজের টুকরা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। খেলায় হার-জিতের মধ্য দিয়ে এই কাগজের টুকরা বা ছিট বিনিময় হতো। সঙ্গে সঙ্গে বদলাত সংশ্লিষ্ট মহলের মালিকানা। এভাবে সেই আমলে তৈরি হয়েছিল এক রাজ্যের ভেতরে অন্যের ছিটমহল। অপরদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অনেক স্থানে দুই দেশের বাসিন্দারা সীমান্তরেখা ছাড়িয়ে গিয়ে ভূমি দখল করে রেখেছে বছরের পর বছর। যাদের দখলে আছে তারা এসব বিরোধপূর্ণ স্থানে কৃষি কাজও করছে। এখন এসব ভূমি বহু বছর ধরে যে দেশ দখল করে রাখছে তাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর হবে চুক্তি বাস্তবায়ন হলে। এক্ষেত্রে রেডক্লিফের সীমান্ত রেখারও পরিবর্তন হচ্ছে- যার ফলে নতুন গুচ্ছ মানচিত্র তৈরি করেছেন দুই দেশের জরিপ কর্মকর্তারা। অপদখলীয় ভূমিগুলোও বিনিময় করা হবে, যার ফলে ভারত প্রায় দুই হাজার আটশ’ একর জমি পাবে। আর বাংলাদেশকে দিতে হবে দুই হাজার দুইশ’ ষাট একরের মতো জমি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থল সীমান্ত রয়েছে। এই দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে তিনটি স্থানে সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা এখনও অচিহ্নিত রয়েছে। এই স্থানগুলোতে বিরোধপূর্ণ এলাকা দিয়ে প্রায়ই সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখন সীমানায় যে স্থান যার দখলে রয়েছে সেখানেই সীমান্ত রেখা টেনে গুচ্ছ মানচিত্র করা হয়েছে।(দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সীমান্ত চুক্তির বিল অনুমোদন : অবসান হচ্ছে ৬৩ বছরের প্রতীক্ষার : বাংলাদেশের ৫১টি, ভারতের ১১১টি ছিটমহল বিনিময়ের সম্ভাবনা : উভয় সীমান্তে আনন্দের বন্যা

প্রকাশের সময় : ০৪:৩৫:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ মে ২০১৫

ঢাকা: আসামকে অন্তর্ভুক্ত রেখেই ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা মঙ্গলবার (৫ মে) সীমান্ত চুক্তির বিল অনুমোদন দিয়েছে। ফলে কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিল মোদির সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। এরমধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। ফলে দুই দেশের ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর ৬৩ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্তের রেখাও টানা হবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দু’দেশের মানচিত্রেও কিছুটা পরিবর্তন আসবে।
বিল অনুমোদন কেন্দ্র করে বিজেপি সরকার ও কংগ্রেসের মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল। বিজিপে সরকার আসামকে বাদ রেখে বিল পাসের উদ্যোগ নিলে তীব্র আপত্তি জানায় কংগ্রেস। তারা এই চুক্তি পাসের বিরোধিতা করবে বলেও জানিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (৪ মে) রাতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর বাসভবনে এক সমঝোতা বৈঠকে কংগ্রেসের দাবি মেনে নেয় বিজেপি। এখন কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেস উভয়েই বিল পাসে সমর্থন দেবে। সীমান্ত চুক্তি পাসের উদ্যোগের খবরে বাংলাদেশ ও ভারতে ছিটমহলবাসীর মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে বলে জানা গেছে।
BD-India Border Aggrimentসীমান্ত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। চুক্তির বাস্তবায়ন হলে ১৭ হাজার একরের কিছু বেশি জমি বাংলাদেশ পাবে। ভারত পাবে সাত হাজার একরের সামান্য বেশি জমি। তবে বা¯স্তব এই জমির কোনো বিনিময় হবে না। এটা হবে কাগজপত্রে এবং ধারণাগত বিনিময়। বর্তমানে এই জমি উভয় দেশের দখলে রয়েছে। এছাড়াও, চুক্তির আওতায় অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর হবে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির একটি অতিরিক্ত প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। সেখানে ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর এবং অচিহ্নিত স্থলসীমানা চিহ্নিত করার মাধ্যমে একটি প্যাকেজ সমাধান করা হয়। এই সমাধানের লক্ষ্যে দুই দেশের জরিপ কর্মকর্তারা বিরোধপূর্ণ এলাকায় গিয়ে গুচ্ছ মানচিত্র প্রস্তুত করেন। এই গুচ্ছ মানচিত্র দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষর ও হস্তান্তর হয়েছে। ফলে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বলে পরিচিত সীমান্ত চুক্তিতে ২০১১ সালের নতুন প্রটোকল এমন ভাবে যুক্ত করা হয়েছে যে, সীমান্তেও কোনো বাসিন্দাকেই সরানো হবে না। বর্তমানে যারা যেভাবে সীমানা দখলে রেখেছেন তা স্থির রেখে নতুন সীমান্ত রেখা টানা হয়েছে। ফলে দুই দেশের মানচিত্রে কাগজপত্রে খানিকটা বদল হয়েছে বটে।
বিগত কংগ্রেস সরকারের আমলেই সীমান্ত চুক্তি পাস করতে রাজ্যসভায় বিল উত্থাপন করেছিল। কিন্তু তখন বিজেপি এই চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে বিল পাস হয়নি বটে তবে রাজ্যসভায় কোনো বিল উত্থাপন হলে তা থেকে যায়। ফলে বিলটি রাজ্যসভায় এখনও আছে। এখন তা পাসের জন্য আজকের কার্যসূচিতে নেয়া হচ্ছে। এক সময় চুক্তির বিরোধিতাকারী বিজেপি এখন যুক্তি দেখাচ্ছে, এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ বন্ধ হবে। ফলে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন সম্ভব হবে। তবে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য হল নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের আগে ভারত তার প্রতিশ্রুতির একটি বাস্তবায়ন। এতে করে মোদির সরকার বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেক্ষেত্রেও অগ্রগতির আশা করছে দিল্লি। এমন হলে মোদির সফরে আরও অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি হতে পারে। যদিও মোদির সফরের আগে আরেক প্রতিশ্রুতি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ৮ মে লোকসভার চলতি অধিবেশন শেষে চীন, মঙ্গোলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। এরপর জুন বা জুলাইয়ে বাংলাদেশে আসতে চান তিনি। তবে ভারতীয় কূটনীতিকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ‘খালি হাতে’ ঢাকা সফরে যাওয়া মোদির ‘ঠিক হবে না’। এ কারণে লোকসভার চলতি অধিবেশনেই বিলটি পাস করিয়ে আনতে মোদির এই তাড়াহুড়ো। ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি’ নামে পরিচিত ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফরে এসে প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ঢাকায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘ভারত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত। ১৯৭৪ সালে ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ এবং ২০১১ সালে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে এ সংক্রান্ত যে প্রটোকল সই করেছেন, তা এখনও বৈধ। চুক্তির আলোকে সেটা বাস্তবায়নকে স্বাগত জানাই’। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে আশা করছি। তবে তার সফরের দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি’।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর সংবিধান সংশোধন করতে ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে তা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাস হতে হবে। ৬ মে বুধবার ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় এই বিল পাসের লক্ষ্যে তা উত্থাপন করা হবে। রাজ্যসভায় পাস হলে বৃহস্পতিবার বিলটি উত্থাপন করা হতে পারে পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ লোকসভায়। এদিকে, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়াকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ছিটমহলের বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের অবসান হবে। এতে করে মানবিক সমস্যার সমাধান হবে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা অনেক সহজ হবে। ফলে সন্ত্রাস দমনসহ যে কোনো ধরনের জঙ্গিদের চলাচল রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও সহজ হবে।
আসাম বিজেপির পক্ষ থেকে স্থল সীমান্ত চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করা হয়। ফলে চুক্তি থেকে আসামের ছিটমহলগুলো বাদ দেয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিবেচনা করেছিলেন। এরপর স্থল সীমান্ত চুক্তি থেকে আসামকে বাদ না দিতে মোদিকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। আসামকে বাদ দিলে রাজ্যসভায় এ বিল পাসে সমর্থন দেয়া হবে না বলে ইঙ্গিত দেয় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। শেষ পর্যন্ত সোমবার রাতে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর বাসভবনে এক বৈঠকে আসামকে রেখেই প্রস্তাবটি পাসের জন্য তোলার সিদ্ধান্ত হয়। আসাম বিজেপির সভাপতি সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্যসহ দলের সংসদ সদস্যরাও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ছিটমহল বিনিময়ের পর ভারতের ছিটমহলে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের সব দায়-দায়িত্ব ভারত সরকার বহন করবে। পুনর্বাসনের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্যের নয়। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিটমহল বসবাসকারীদের কেউ যদি ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন তবে তার পুনর্বাসনের সব দায় কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নাগরিকত্ব দেয়াসহ সব দায়িত্ব পালন করবে ভারতের সরকার। ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব দেয়াসহ পুনর্বাসনে রাজ্য সরকারের কোনো সুপারিশ থাকলে কেন্দ্র তাও বিবেচনা করবে। এসব বিষয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ফিরে দেখা: ছিটমহল হচ্ছে কোনো দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য একটি দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান ভূখন্ড বা জনপদ। ছিটমহল থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ওখানে যেতে হলে অন্য দেশটির জমির ওপর দিয়ে যেতে হয়। এসব ছিটমহল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় এবং সীমানার ওপারে ভারতের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। কোচরাজারা এবং রংপুরের মহারাজারা মূলত ছিল সীমান্ত। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও মহলের বিনিময় হতো। মোগল আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা ও মহারাজারা মিলিত হতো তিস্তা পাড়ে দাবা ও তাস খেলার উদ্দেশে। খেলায় বাজি ধরা হতো বিভিন্ন মহল নিয়ে, যা কাগজের টুকরা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। খেলায় হার-জিতের মধ্য দিয়ে এই কাগজের টুকরা বা ছিট বিনিময় হতো। সঙ্গে সঙ্গে বদলাত সংশ্লিষ্ট মহলের মালিকানা। এভাবে সেই আমলে তৈরি হয়েছিল এক রাজ্যের ভেতরে অন্যের ছিটমহল। অপরদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অনেক স্থানে দুই দেশের বাসিন্দারা সীমান্তরেখা ছাড়িয়ে গিয়ে ভূমি দখল করে রেখেছে বছরের পর বছর। যাদের দখলে আছে তারা এসব বিরোধপূর্ণ স্থানে কৃষি কাজও করছে। এখন এসব ভূমি বহু বছর ধরে যে দেশ দখল করে রাখছে তাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর হবে চুক্তি বাস্তবায়ন হলে। এক্ষেত্রে রেডক্লিফের সীমান্ত রেখারও পরিবর্তন হচ্ছে- যার ফলে নতুন গুচ্ছ মানচিত্র তৈরি করেছেন দুই দেশের জরিপ কর্মকর্তারা। অপদখলীয় ভূমিগুলোও বিনিময় করা হবে, যার ফলে ভারত প্রায় দুই হাজার আটশ’ একর জমি পাবে। আর বাংলাদেশকে দিতে হবে দুই হাজার দুইশ’ ষাট একরের মতো জমি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থল সীমান্ত রয়েছে। এই দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে তিনটি স্থানে সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা এখনও অচিহ্নিত রয়েছে। এই স্থানগুলোতে বিরোধপূর্ণ এলাকা দিয়ে প্রায়ই সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখন সীমানায় যে স্থান যার দখলে রয়েছে সেখানেই সীমান্ত রেখা টেনে গুচ্ছ মানচিত্র করা হয়েছে।(দৈনিক যুগান্তর)