নিউইয়র্ক ১২:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৫ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

বছর শেষে অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:১৩:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯
  • / ২৫৫ বার পঠিত

এম এম মাসুদ: গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে গতি সঞ্চার হয়েছিল সেটা আর নেই। দিন যত যাচ্ছে অর্থনীতিতে সংকট ততই বাড়ছে। প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচক এখন নিম্নমুখী। রপ্তানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধিই নেই, আমদানিতেও একই অবস্থা। রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি। মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী। আয় কম থাকায় সরকারের ঋণ করার প্রবণতা বাড়ছে। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।
লেনদেনের ভারসাম্যও কমছে। কমছে বেসরকারি ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি। অব্যাহতভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তবে রেমিটেন্স প্রবাহের ধারা ইতিবাচক থাকায় রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার পরও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারও দীর্ঘদিন ধরেই পতনের ধারায় রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রতিবেদনে বলা হয়, এক সময় সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আমাদের শক্তির কারণ ছিলো সেই স্থিতিশীলতার মধ্যেই এখন চিড় ধরেছে। এর মূল অনুষঙ্গ হলো- কর আহরণে দুর্বলতা, ব্যাংকিং খাতে সমস্যা এবং বৈদেশিক লেনদেনের স্থিতিতে চাপ। এছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের সূচকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকলেও বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের দিক থেকে ততোটা ভালো অবস্থানে নেই। তাই এ বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকের অবস্থা এখন খারাপ। রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। রাজস্ব আদায় কমছে। মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী। চাপে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানিও কমছে। বিনিয়োগে খরা কাটছে না। ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড়। শেয়ারবাজারে মন্দা লেগেই আছে। সে কারণেই বলা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই এখন সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। আবার প্রবাসী আয় বাড়লেও পপ্রবাসীর সংখ্যা কমছে। ভবিষ্যতে প্রবাসী আয় আসারও প্রবণতাও কমে যাবে।
রেমিটেন্সে সুখবর: গত নভেম্বর শেষে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৭৭১ কোটি ৪১ লাখ ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ২২.৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশ। এছাড়া নভেম্বর মাসে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩১.৭৫ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয়কে উৎসাহ দিতে সরকার এখন ২% হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে।
রিজার্ভে টান: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাস শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৪৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। গত ১৪ নভেম্বর এটি কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৬৫ কোটি ডলারে। আর নভেম্বর মাসে মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ আকুর বিল পরিশোধ করে ৯৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এতেই কমে যায় রিজার্ভের পরিমাণ। পরে প্রবাসী আয় যোগ হওয়ায় কিছুটা বৃদ্ধি পায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১১ ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২১৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার, ৬ মাস আগে গত জুনে যা ছিল ৩ হাজার ২৭১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ৬ মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৫১ কোটি ৭৮ লাখ ডলার।
রাজস্ব আয়ে ঘাটতি: সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রায় ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এই চার মাসের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ এবার গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। প্রতিবারই বছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায় কিছুটা কম হয়। তবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
রপ্তানি আয় কমছে: দশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি খাত। টানা ৫ মাস ধরে রপ্তানি আয় কমছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ মাস অর্থাৎ নভেম্বর শেষে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ১২.৫৯ শতাংশ। এ সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার, অথচ আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ১০.৭০ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছর রপ্তানি কমেছে ৭.৫৯ শতাংশ।
আমদানি ব্যয় বেড়েছে: ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্য ঘাটতির ওপর। আগে যে পণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল ওই পণ্য শুধু টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে এখন ১০৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, জুলাই-অক্টোবর ৪ মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, এর বিপরীতে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩.১৭ শতাংশ।
ডলারের দাম বৃদ্ধি: ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা, চলতি মাসের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে আমদানি পর্যায়ে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে ৮৬ টাকা পর্যন্ত।
বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে: আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬২ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
মূল্যস্ফীতি বেড়েছে: নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশে। যা আগের মাসে ছিল ৫.৪৭ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬.৪১ শতাংশে এবং খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৪৭ শতাংশে।
শেয়ারবাজার নিম্নমুখী: পুঁজিবাজারের অবস্থা আরো করুণ। মূল্যসূচক কমছেই। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। উল্টো দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খরাপের দিকে যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে অব্যাহত দর পতনের প্রতিবাদে মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর সামনে বিক্ষোভ করে বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশের দাম অভিহিত মূল্যের (ফেস ভ্যালু, ১টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকার কম।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে: চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ ৩ ভাগের ১ ভাগ হয়ে গেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণেই বিক্রি কম বলে মনে করা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট তিরণ করা ঋণের ১১.৬৯ শতাংশ।
সরকারের ব্যাংক ঋণ: ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে যে ঋণ নেয়ার কথা ছিল তার প্রায় পুরোটা ৫ মাসেই নিয়ে ফেলেছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ৫ মাস ৯ দিনেই (১লা জুলাই থেকে ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে সরকার।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকেই মন্দার আভাস। রাজস্ব, রপ্তানি, ঋণ, এসব কোনোটির পরিস্থিতিই তেমন ভালো নয়। আগে একসঙ্গে এত সূচকের খারাপ অবস্থা দেখা যায়নি। (মানবজমিন)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

About Author Information

বছর শেষে অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী

প্রকাশের সময় : ০১:১৩:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

এম এম মাসুদ: গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে গতি সঞ্চার হয়েছিল সেটা আর নেই। দিন যত যাচ্ছে অর্থনীতিতে সংকট ততই বাড়ছে। প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচক এখন নিম্নমুখী। রপ্তানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধিই নেই, আমদানিতেও একই অবস্থা। রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি। মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী। আয় কম থাকায় সরকারের ঋণ করার প্রবণতা বাড়ছে। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।
লেনদেনের ভারসাম্যও কমছে। কমছে বেসরকারি ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি। অব্যাহতভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তবে রেমিটেন্স প্রবাহের ধারা ইতিবাচক থাকায় রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার পরও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারও দীর্ঘদিন ধরেই পতনের ধারায় রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রতিবেদনে বলা হয়, এক সময় সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আমাদের শক্তির কারণ ছিলো সেই স্থিতিশীলতার মধ্যেই এখন চিড় ধরেছে। এর মূল অনুষঙ্গ হলো- কর আহরণে দুর্বলতা, ব্যাংকিং খাতে সমস্যা এবং বৈদেশিক লেনদেনের স্থিতিতে চাপ। এছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের সূচকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকলেও বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের দিক থেকে ততোটা ভালো অবস্থানে নেই। তাই এ বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, একমাত্র রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকের অবস্থা এখন খারাপ। রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে। রাজস্ব আদায় কমছে। মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী। চাপে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানিও কমছে। বিনিয়োগে খরা কাটছে না। ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড়। শেয়ারবাজারে মন্দা লেগেই আছে। সে কারণেই বলা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই এখন সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। আবার প্রবাসী আয় বাড়লেও পপ্রবাসীর সংখ্যা কমছে। ভবিষ্যতে প্রবাসী আয় আসারও প্রবণতাও কমে যাবে।
রেমিটেন্সে সুখবর: গত নভেম্বর শেষে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৭৭১ কোটি ৪১ লাখ ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ২২.৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশ। এছাড়া নভেম্বর মাসে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩১.৭৫ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয়কে উৎসাহ দিতে সরকার এখন ২% হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে।
রিজার্ভে টান: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাস শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৪৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। গত ১৪ নভেম্বর এটি কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৬৫ কোটি ডলারে। আর নভেম্বর মাসে মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ আকুর বিল পরিশোধ করে ৯৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এতেই কমে যায় রিজার্ভের পরিমাণ। পরে প্রবাসী আয় যোগ হওয়ায় কিছুটা বৃদ্ধি পায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১১ ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২১৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার, ৬ মাস আগে গত জুনে যা ছিল ৩ হাজার ২৭১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ৬ মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৫১ কোটি ৭৮ লাখ ডলার।
রাজস্ব আয়ে ঘাটতি: সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রায় ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এই চার মাসের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ এবার গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। প্রতিবারই বছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায় কিছুটা কম হয়। তবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
রপ্তানি আয় কমছে: দশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রপ্তানি খাত। টানা ৫ মাস ধরে রপ্তানি আয় কমছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ মাস অর্থাৎ নভেম্বর শেষে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ১২.৫৯ শতাংশ। এ সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার, অথচ আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ১০.৭০ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছর রপ্তানি কমেছে ৭.৫৯ শতাংশ।
আমদানি ব্যয় বেড়েছে: ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্য ঘাটতির ওপর। আগে যে পণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল ওই পণ্য শুধু টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে এখন ১০৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, জুলাই-অক্টোবর ৪ মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, এর বিপরীতে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩.১৭ শতাংশ।
ডলারের দাম বৃদ্ধি: ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা, চলতি মাসের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে আমদানি পর্যায়ে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে ৮৬ টাকা পর্যন্ত।
বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে: আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬২ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
মূল্যস্ফীতি বেড়েছে: নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশে। যা আগের মাসে ছিল ৫.৪৭ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬.৪১ শতাংশে এবং খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৪৭ শতাংশে।
শেয়ারবাজার নিম্নমুখী: পুঁজিবাজারের অবস্থা আরো করুণ। মূল্যসূচক কমছেই। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। উল্টো দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খরাপের দিকে যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে অব্যাহত দর পতনের প্রতিবাদে মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর সামনে বিক্ষোভ করে বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশের দাম অভিহিত মূল্যের (ফেস ভ্যালু, ১টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকার কম।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে: চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ ৩ ভাগের ১ ভাগ হয়ে গেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণেই বিক্রি কম বলে মনে করা হচ্ছে।
খেলাপি ঋণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা মোট তিরণ করা ঋণের ১১.৬৯ শতাংশ।
সরকারের ব্যাংক ঋণ: ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে যে ঋণ নেয়ার কথা ছিল তার প্রায় পুরোটা ৫ মাসেই নিয়ে ফেলেছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ৫ মাস ৯ দিনেই (১লা জুলাই থেকে ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়ে ফেলেছে সরকার।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচকেই মন্দার আভাস। রাজস্ব, রপ্তানি, ঋণ, এসব কোনোটির পরিস্থিতিই তেমন ভালো নয়। আগে একসঙ্গে এত সূচকের খারাপ অবস্থা দেখা যায়নি। (মানবজমিন)