নিউইয়র্ক ১২:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

পদ্মা এখন মরা গাঙ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৫:৪৭:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৫
  • / ১০১৮ বার পঠিত

ঢাকা: পদ্মা এখন মরা গাঙ। শুষ্ক মৌসুমের এক মাস না যেতেই ভয়াবহ নাব্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এই সময়ে নদীর ক্ষীণ ¯্রােতধারা বহাল থাকলেও এবার পরিস্থিতি আরো শোচনীয়। ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গাচুক্তি মোতাবেক পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এতে করে নদীর বুকে এখন নৌকার পরিবর্তে চলছে ট্রাক। বালুর ব্যবসা চলছে দেদারছে। পানির এই দৈন্যদশা আর কিছু দিন চললে নৌকার পরিবর্তে গরুর গাড়ি কিংবা সাইকেলে নদী পার হওয়া যাবে এমন ধারণা পোষন করছেন এলাকাবাসী।
ভারত গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ১৯৭৫ সাল থেকেই শুষ্ক মৌসুমে এই নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে এই নদীর অবস্থা এতটাই করুণ যে, ধু-ধু বালুকা রাশি পারি দিয়ে যে পদ্মার দেখা মিলছে তাকে খাল না বলে বড় জোড় ছোট একটি শাখা নদীর সাথেই তুলনা করা যায়। পাল তোলা নৌকা আর জাহাজের দেখা মেলাটা এখন ভাগ্যের ব্যাপার। পদ্মার এই করুণ পরিণতির জন্য দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ফারাক্কা বাঁধ পয়েন্টে জমা পানি সমভাবে ভাগ করে নেয়া। তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার শুক্কুর আলী বলেন, ফারাক্কা বাঁধের মারপ্যাঁচ কি তা বুঝেন না। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই হওয়া এই বয়ঃবৃদ্ধের ভাষায়, বছর দু’ আগেও পদ্মায় যে পরিমাণ পানি ছিল এখন তাও পাওয়া যায় না। কেন পানি পাওয়া যায় না তা তিনি বলতে পারেন না। শুধু জানালেন, আল্লাহ পানি না দিলে বান্দার কি করার আছে।
এমন বিশ্বাস যাদের তারা কখনই জানতে পারবে না বর্তমান সরকার গত ছয় বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে। গঙ্গার পানি চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, তিস্তর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি, বাংলাদেশের বিপদ ডেকে আনে টিপাইমুখে এরকম কোনো স্থাপন নির্মাণ থেকে ভারতকে বিরত রাখা এবং অভিন্ন সকল নদীর পানি সমভাবে ভাগ করে নেয়ার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। কিন্ত কাক্সিক্ষত সুফল আসেনি। অথচ বাংলাদেশকে পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হবে না, তিস্তা নিয়ে সহসাই চুক্তি হবে, গঙ্গা চুক্তি যথাযথভাবে মেনে চলব-এমন আশ্বাস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন খোদ ভারতের বিগত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্ত এসবই যে কথামালার ফুলঝুরি তা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে দাঁড়ালেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে এখন পানি নেই বললেই চলে। এই ব্রিজের ১৬টি স্প্যানের মাত্র ৪টি স্প্যানে (ব্রিজের খাম্বা) পানি আছে। বাকি ১২টি স্প্যান বালুর উপরে অবস্থান করছে। কুষ্টিয়ায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশপাশে পদ্মার বুকে চলছে গাছ লাগানো, সবজি চাষ, আর জেঁকে বসেছে বালুর ব্যবসা। পানি শূন্যতার কারণে জেলে ও মাঝিদের নৌকাগুলো বালুরচরে পড়ে আছে। শুকিয়ে কাঠ হওয়া এসব নৌকা জ্বালানির কাজে ছাড়া আর কোনো কাজেই ব্যবহার করা সম্ভব নয়-দীর্ঘদিনের জমানো কষ্ট বুকে চেপে জানালেন পৈতৃক পেশা ত্যাগকারী বয়ঃবৃদ্ধ এক জেলে। নাম তার ছলিমুদ্দিন।
হিমালয়ের গাঙ্গেত্রী হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে আড়াই হাজার কিলোমিটার বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রবেশ করা ওপারের গঙ্গা এপারের পদ্মা নদীর উপর ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা নামক ব্যারেজ পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পর থেকে শুরু হয় প্রমত্তা পদ্মাখ্যাত পদ্মার মরণদশা। এই বাঁধের কারণে দেশের নদী ব্যবস্থাপনায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। অসংখ্য নদী তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। শাখা নদী মরে গেছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে অনেক নিচে। আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে মারাত্মক রকমের। শুষ্ক মওসুমে তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠছে আবার শীতকালে নেমে আসছে চার এর নিচে। মরুময়তা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে গোটা পদ্মা অববাহিকার অধিবাসীদের।
অনেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে প্রচারণা চালালেও আসলে পদ্মা অববাহিকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণ ফারাক্কা বাঁধের অভিশাপ। পদ্মা নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে শাখা নদী বড়াল, মরাবড়াল, নারোদ, মুছাখান, ইছামতি, চিকনাই, নাগর, ধলাই,গড়াই, মাথাভাঙ্গা, হিসলা, কাজলা, চিত্রা, সাগোরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ মরে যাচ্ছে। আর কালিগঙ্গা, বেলাবত এসব নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে কিছুদিনের জন্য এসব নদীতে পানি থাকলেও প্রায় সারাবছর থাকে পানিশূন্য। তাছাড়া এসব নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে এসব নদীর দু’পার অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে। এখন এসব নদীর নাম স্থান পেয়েছে বইয়ের পাতায় কিংবা মানচিত্রে।
পদ্মায় অথৈ জলরাশি আর জলোচ্ছ্বল ঢেউয়ের জায়গাজুড়ে এখন শুধু বালু আর বালু। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ (পদ্মার উৎসমুখ) থেকে পাবনার ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দুশো কিলোমিটারজুড়ে এই বালুর চর। যেন মিনি মরুভূমি। এ বালুচরে যেখানে পলি জমেছে সেখানে কৃষক ঘাম ঝরিয়ে আবাদ করছে। তাই অনেক স্থানকে মনে হয় মরুদ্যান। এ বালুচরে তরুণ যুবকরা ফুটবল নিয়ে ছুটে বেড়ায়। হামলে পড়ে বালুদস্যুরা। চরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন খুবলে খুবলে তুলে নিয়ে যায় শত শত ট্রাক বালু। হয় কোটি কোটি টাকার লেনদেন। এ বিশাল বালুচরের পাশদিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণ ধারায় পদ্মা। এ নদীতে জাল আর নৌকা নিয়ে খুঁজে ফেরে রূপালী ইলিশসহ নানা ধরনের দেশীয় প্রজাতির মাছ। অনেক জেলে বাপ-দাদার পেশা বদলে হয়েছে কৃষক কিংবা চোরাচালানি। কেউ চরে ফসল ফলায় আবার কেউ এপার ওপার মালামাল আনা-নেয়া করে। বিএসএফের গুলিতে এদের কারো বুক ঝাঁঝরা হয়। নির্যাতনে পংগু হয়।
চলতি শুষ্ক মৌসুমে চুক্তি মোতাবেক গঙ্গার পানি পাওয়া যাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন জানান, ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী সবসময় পানি ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিক যে, ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানি আসছে তা উভয় দেশ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি বেশি আসলে আমরা আরো বেশি পেতাম। তিনি ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বাড়াতে নেপালে জলাধার নির্মাণের উপরও গুরুত্বারোপ করেন। সেইসাথে বলেন, গত ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারী ভারতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের কারিগরি কমিটির বৈঠকে গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। ঘুরে দেখেছি ফারাক্কা পয়েন্ট। আমরা বলেছি, চুক্তি মোতাবেক যাতে পানি দেয়া হয়। এছাড়াও ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক দ্রুত করার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের পর উভয় দেশের মধ্যে আর কোনো বৈঠক বসেনি। এ নিয়ে দিনক্ষণ তারিখ ঠিক করা হলেও দিল্লির আপত্তির কারণে তা স্থগিত করা হয়। জেআরসি’র বৈঠক না হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত নদী নিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফারাক্কা পয়েন্টে পানি বেশি আসছে না কেন জানতে চাইলে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান, গঙ্গার পানি ভারত বিভিন্ন পয়েন্টে সংযোগ খাল কাটার মাধ্যমে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে করে ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানি আসার কথা তা আসছে না। তিনি বলেন, গঙ্গার পানি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করাটা চুক্তির ২ এর ২ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তার মতে, দেশের নদী-নদীগুলোর যে বেহাল অবস্থা হয়েছে তাতে করে সরকারকে দ্রুত একটি মাস্টার প্ল্যান নিতে হবে। যাতে করে নদ-নদীগুলোর নাব্য ধরে রাখা যায়।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ভারত শুধু গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করেই পানি কূটনীতির ইতি টানেনি। গঙ্গার উপরে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে। বিশেষ করে উৎসমুখ গঙ্গার অন্যতম প্রদায়ক নদী ভাগীরথির উপর ভারত যে তেহরী বাঁধ নির্মাণ করেছে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে গঙ্গা তথা পদ্মা নদীর উপর। এ কারণে ভাটিতে এসে পদ্মার পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। এর ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে এসে পানি কমে গিয়ে বাংলাদেশকে তার মাসুল দিতে হচ্ছে। (দৈনিক ইনকিলাব)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

পদ্মা এখন মরা গাঙ

প্রকাশের সময় : ০৫:৪৭:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৫

ঢাকা: পদ্মা এখন মরা গাঙ। শুষ্ক মৌসুমের এক মাস না যেতেই ভয়াবহ নাব্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এই সময়ে নদীর ক্ষীণ ¯্রােতধারা বহাল থাকলেও এবার পরিস্থিতি আরো শোচনীয়। ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গাচুক্তি মোতাবেক পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এতে করে নদীর বুকে এখন নৌকার পরিবর্তে চলছে ট্রাক। বালুর ব্যবসা চলছে দেদারছে। পানির এই দৈন্যদশা আর কিছু দিন চললে নৌকার পরিবর্তে গরুর গাড়ি কিংবা সাইকেলে নদী পার হওয়া যাবে এমন ধারণা পোষন করছেন এলাকাবাসী।
ভারত গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ১৯৭৫ সাল থেকেই শুষ্ক মৌসুমে এই নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। চলতি শুষ্ক মৌসুমে এই নদীর অবস্থা এতটাই করুণ যে, ধু-ধু বালুকা রাশি পারি দিয়ে যে পদ্মার দেখা মিলছে তাকে খাল না বলে বড় জোড় ছোট একটি শাখা নদীর সাথেই তুলনা করা যায়। পাল তোলা নৌকা আর জাহাজের দেখা মেলাটা এখন ভাগ্যের ব্যাপার। পদ্মার এই করুণ পরিণতির জন্য দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ফারাক্কা বাঁধ পয়েন্টে জমা পানি সমভাবে ভাগ করে নেয়া। তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী এলাকার শুক্কুর আলী বলেন, ফারাক্কা বাঁধের মারপ্যাঁচ কি তা বুঝেন না। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই হওয়া এই বয়ঃবৃদ্ধের ভাষায়, বছর দু’ আগেও পদ্মায় যে পরিমাণ পানি ছিল এখন তাও পাওয়া যায় না। কেন পানি পাওয়া যায় না তা তিনি বলতে পারেন না। শুধু জানালেন, আল্লাহ পানি না দিলে বান্দার কি করার আছে।
এমন বিশ্বাস যাদের তারা কখনই জানতে পারবে না বর্তমান সরকার গত ছয় বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে। গঙ্গার পানি চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, তিস্তর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি, বাংলাদেশের বিপদ ডেকে আনে টিপাইমুখে এরকম কোনো স্থাপন নির্মাণ থেকে ভারতকে বিরত রাখা এবং অভিন্ন সকল নদীর পানি সমভাবে ভাগ করে নেয়ার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। কিন্ত কাক্সিক্ষত সুফল আসেনি। অথচ বাংলাদেশকে পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত করা হবে না, তিস্তা নিয়ে সহসাই চুক্তি হবে, গঙ্গা চুক্তি যথাযথভাবে মেনে চলব-এমন আশ্বাস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন খোদ ভারতের বিগত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্ত এসবই যে কথামালার ফুলঝুরি তা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে দাঁড়ালেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে এখন পানি নেই বললেই চলে। এই ব্রিজের ১৬টি স্প্যানের মাত্র ৪টি স্প্যানে (ব্রিজের খাম্বা) পানি আছে। বাকি ১২টি স্প্যান বালুর উপরে অবস্থান করছে। কুষ্টিয়ায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশপাশে পদ্মার বুকে চলছে গাছ লাগানো, সবজি চাষ, আর জেঁকে বসেছে বালুর ব্যবসা। পানি শূন্যতার কারণে জেলে ও মাঝিদের নৌকাগুলো বালুরচরে পড়ে আছে। শুকিয়ে কাঠ হওয়া এসব নৌকা জ্বালানির কাজে ছাড়া আর কোনো কাজেই ব্যবহার করা সম্ভব নয়-দীর্ঘদিনের জমানো কষ্ট বুকে চেপে জানালেন পৈতৃক পেশা ত্যাগকারী বয়ঃবৃদ্ধ এক জেলে। নাম তার ছলিমুদ্দিন।
হিমালয়ের গাঙ্গেত্রী হিমবাহ থেকে জন্ম নিয়ে আড়াই হাজার কিলোমিটার বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রবেশ করা ওপারের গঙ্গা এপারের পদ্মা নদীর উপর ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা নামক ব্যারেজ পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পর থেকে শুরু হয় প্রমত্তা পদ্মাখ্যাত পদ্মার মরণদশা। এই বাঁধের কারণে দেশের নদী ব্যবস্থাপনায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। অসংখ্য নদী তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। শাখা নদী মরে গেছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমেছে অনেক নিচে। আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে মারাত্মক রকমের। শুষ্ক মওসুমে তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠছে আবার শীতকালে নেমে আসছে চার এর নিচে। মরুময়তা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে গোটা পদ্মা অববাহিকার অধিবাসীদের।
অনেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে প্রচারণা চালালেও আসলে পদ্মা অববাহিকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণ ফারাক্কা বাঁধের অভিশাপ। পদ্মা নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে শাখা নদী বড়াল, মরাবড়াল, নারোদ, মুছাখান, ইছামতি, চিকনাই, নাগর, ধলাই,গড়াই, মাথাভাঙ্গা, হিসলা, কাজলা, চিত্রা, সাগোরখালি, চন্দনা, কপোতাক্ষ মরে যাচ্ছে। আর কালিগঙ্গা, বেলাবত এসব নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে কিছুদিনের জন্য এসব নদীতে পানি থাকলেও প্রায় সারাবছর থাকে পানিশূন্য। তাছাড়া এসব নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে এসব নদীর দু’পার অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে। এখন এসব নদীর নাম স্থান পেয়েছে বইয়ের পাতায় কিংবা মানচিত্রে।
পদ্মায় অথৈ জলরাশি আর জলোচ্ছ্বল ঢেউয়ের জায়গাজুড়ে এখন শুধু বালু আর বালু। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ (পদ্মার উৎসমুখ) থেকে পাবনার ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দুশো কিলোমিটারজুড়ে এই বালুর চর। যেন মিনি মরুভূমি। এ বালুচরে যেখানে পলি জমেছে সেখানে কৃষক ঘাম ঝরিয়ে আবাদ করছে। তাই অনেক স্থানকে মনে হয় মরুদ্যান। এ বালুচরে তরুণ যুবকরা ফুটবল নিয়ে ছুটে বেড়ায়। হামলে পড়ে বালুদস্যুরা। চরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন খুবলে খুবলে তুলে নিয়ে যায় শত শত ট্রাক বালু। হয় কোটি কোটি টাকার লেনদেন। এ বিশাল বালুচরের পাশদিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণ ধারায় পদ্মা। এ নদীতে জাল আর নৌকা নিয়ে খুঁজে ফেরে রূপালী ইলিশসহ নানা ধরনের দেশীয় প্রজাতির মাছ। অনেক জেলে বাপ-দাদার পেশা বদলে হয়েছে কৃষক কিংবা চোরাচালানি। কেউ চরে ফসল ফলায় আবার কেউ এপার ওপার মালামাল আনা-নেয়া করে। বিএসএফের গুলিতে এদের কারো বুক ঝাঁঝরা হয়। নির্যাতনে পংগু হয়।
চলতি শুষ্ক মৌসুমে চুক্তি মোতাবেক গঙ্গার পানি পাওয়া যাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন জানান, ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী সবসময় পানি ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিক যে, ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানি আসছে তা উভয় দেশ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি বেশি আসলে আমরা আরো বেশি পেতাম। তিনি ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বাড়াতে নেপালে জলাধার নির্মাণের উপরও গুরুত্বারোপ করেন। সেইসাথে বলেন, গত ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারী ভারতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের কারিগরি কমিটির বৈঠকে গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। ঘুরে দেখেছি ফারাক্কা পয়েন্ট। আমরা বলেছি, চুক্তি মোতাবেক যাতে পানি দেয়া হয়। এছাড়াও ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক দ্রুত করার ব্যাপারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকের পর উভয় দেশের মধ্যে আর কোনো বৈঠক বসেনি। এ নিয়ে দিনক্ষণ তারিখ ঠিক করা হলেও দিল্লির আপত্তির কারণে তা স্থগিত করা হয়। জেআরসি’র বৈঠক না হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত নদী নিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফারাক্কা পয়েন্টে পানি বেশি আসছে না কেন জানতে চাইলে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান, গঙ্গার পানি ভারত বিভিন্ন পয়েন্টে সংযোগ খাল কাটার মাধ্যমে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে করে ফারাক্কা পয়েন্টে যে পরিমাণ পানি আসার কথা তা আসছে না। তিনি বলেন, গঙ্গার পানি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করাটা চুক্তির ২ এর ২ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তার মতে, দেশের নদী-নদীগুলোর যে বেহাল অবস্থা হয়েছে তাতে করে সরকারকে দ্রুত একটি মাস্টার প্ল্যান নিতে হবে। যাতে করে নদ-নদীগুলোর নাব্য ধরে রাখা যায়।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ভারত শুধু গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করেই পানি কূটনীতির ইতি টানেনি। গঙ্গার উপরে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে। বিশেষ করে উৎসমুখ গঙ্গার অন্যতম প্রদায়ক নদী ভাগীরথির উপর ভারত যে তেহরী বাঁধ নির্মাণ করেছে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে গঙ্গা তথা পদ্মা নদীর উপর। এ কারণে ভাটিতে এসে পদ্মার পানিপ্রবাহ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। এর ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে এসে পানি কমে গিয়ে বাংলাদেশকে তার মাসুল দিতে হচ্ছে। (দৈনিক ইনকিলাব)