নিউইয়র্ক ০৮:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

নতুন মানচিত্রে বাংলাদেশ

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:২৪:৩৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ অগাস্ট ২০১৫
  • / ১২৯৬ বার পঠিত

ঢাকা: ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ। ছিটমহল বিনিময়ে ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করল বিশ্ব। ৬৮ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটল। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। তারা সমস্বরে গাইলেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। উড়ল বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। ছিটমহলের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠল ৬৮টি মোমের বাতি। রাজনীতির পাশা খেলায় যবনিকাপাত ঘটল। জয় হল মানুষের। মুছে গেল রাষ্ট্রহীনতার কষ্ট। রাষ্ট্রহীন মানুষগুলো এখন পাবে আইডি কার্ড, জন্মনিবন্ধন সনদ। আনন্দের মধ্যেও বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত ছিটমহল থেকে যারা ভারত চলে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। মন খারাপ তাদের স্বজনদেরও। ছিটমহল বিনিময় উপলক্ষে ওইসব প্রত্যন্ত জনপদে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার ছাড়াও স্থানীয় জনগণ কমিটি গঠন করে নিরাপত্তার আয়োজন করেছেন।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ে নতুন করে আঁকা হল সীমানা রেখা। বাংলাদেশ পেল লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টিসহ মোট ১১১টি ছিটমহল। অপদখলীয় ভূমি বিনিময় এবং সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানার মধ্যে চিহ্নিত হল সাড়ে চার কিলোমিটার স্থলসীমানা। এখন মুহুরীর চরে শুধু দুই কিলোমিটার সীমানাই অচিহ্নিত রয়ে গেল। ছিটমহল এখন শুধুই ইতিহাস। ওই সব ভূখণ্ডে নিজের জন্মভূমিতে পরবাসী থাকা প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ পেলেন অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির স্বাদ। বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য এক নজির সৃষ্টি হল শান্তিপূর্ণভাবে ভূখণ্ড বিনিময় এবং নিজেদের নাগরিকত্ব বেছে নেয়ার মাধ্যমে। এমন দিনে তারা আবেগে-উচ্ছাসে প্রকাশ করেন মুক্তির আনন্দ। অবরুদ্ধ জীবনে তাদের অন্তহীন অভিশাপ মুক্তির এই ক্ষণে ঘরে ঘরে বইছে আনন্দের বন্যা। সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশ প্রজ্ঞাপন জারি করে নতুন ভূখণ্ড চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি সই হয় ১৯৭৪ সালে যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। ওই সময়ে বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তখন তা করেনি। তারপর ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তির সঙ্গে সই হয় প্রটোকল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে ভারতের সংবিধান সংশোধন জরুরি হয় পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বর্তমান সরকার দেশটির পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে সংবিধান সংশোধনে সমর্থ হন। এরপরই প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত হয়।
মোদির ঢাকা সফরকালে সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর করে দুই দেশ। তার আলোকে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ৩১ জুলাই মধ্যরাতেই সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়ে যায়। সেখানে ওড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা। সেখানে ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর ভূখণ্ড এখন বাংলাদেশের সীমানা। এসব ভূখণ্ডের অবস্থান বাংলাদেশের লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায়। সর্বশেষ গত ৬ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ছিটমহলে দু’দেশের যৌথ জনগণনা মতে, এসব ভূখণ্ডে বাসিন্দার সংখ্যা ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। তাদের মধ্যে ৯৭৯ জন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রেখে ভারত ফিরে যেতে চেয়েছেন। এই ৯৭৯ জন আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ভারত ফিরে যাবেন।
ছিটমহল বিনিময়ের অংশ হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মালিকানা পেয়েছে ভারত। সেখানে সাত হাজার সাতশ’ ১০ দশমিক শূন্য দুই একর ভূখণ্ড বাংলাদেশকে ছাড়তে হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহার জেলায় এসব ছিটমহল অবস্থিত। সেখানে বাসিন্দার সংখ্যা ১৪ হাজার ২১৫ জন। তাদের কেউই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল রাখতে রাজি হননি। ফলে তারা এখন ভারতের নাগরিক।
স্যার সিরিল রেডক্লিফ ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকেছিলেন। যেসব এলাকা নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান চিহ্নিত করেছিলেন তাই এখন বাংলাদেশের ভূখণ্ড। রেডক্লিফ সীমানা রেখা আঁকার সময়ে বাস্তব সমস্যা উপলব্ধি করেননি। ফলে বাস্তবে রেডক্লিফের সীমানা অনেক স্থানে হেরফের হয়। অনেক স্থানে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতের দখলে এবং ভারতের ভূখণ্ড বাংলাদেশের দখলে থাকে। সেই দখলের স্থানগুলোকেই বলা হয় অপদখলীয় ভূমি। সীমান্ত চুক্তির আলোকে দু’দেশের যৌথ জরিপ দল যার দখলে যে জায়গা রয়েছে সেটাকে ঠিক রেখে সীমানা রেখা খানিকটা ঘুরিয়ে দেন। ফলে সীমানার স্থানেও মানচিত্র পাল্টায়। এভাবে দেখা যাচ্ছে রেডক্লিফের মানচিত্রের আলোকে ছয়টি স্থানে দুই হাজার দু’শ ৬৭ দশমিক ৬৮২ একর ভারতীয় ভূমি বাংলাদেশ অপদখলীয় অবস্থায় ছিল। এখন সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ায় সেই ভূখণ্ডও বাংলাদেশের হয়ে গেল। তার বিপরীতে সীমান্তের ১২টি স্থানে দুই হাজার ৭৭৭ দশমিক শূন্য ৩৪ একর ভূখণ্ড ভারত অপদখলীয় রেখেছিল। এসব ভূখণ্ড এখন ভারতের মূল ভূখণ্ডে মিশে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থলসীমান্ত রয়েছে। তার মধ্যে সাড়ে ছয় কিলোমিটার স্থলসীমান্ত অচিহ্নিত ছিল। দু’দেশের যৌথ জরিপ দলের সদস্যরা উত্তরাঞ্চলে দইখাদা এবং পূর্বাঞ্চলীয় লাঠিটিলায় সাড়ে চার কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করেছেন। ফলে এ দুটি স্থানে মানচিত্র নিশ্চিত হল। তবে ফেনী জেলার মুহুরীর চরে সীমানা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। মুহুরী নদীর মধ্যস্রোতকে দুই দেশের সীমান্ত রেখা ধরা হয়। কিন্তু মধ্যস্রোতই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ফলে সীমান্ত চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের পথে এই সামান্য বাধাটুকু রয়ে গেল।
ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হওয়া নিয়ে ওইসব জনপদে চলছে বাঁধভাঙা উচ্ছাস। স্থানীয় প্রশাসন উত্তরাঞ্চলীয় চার জেলা লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছিটমহলগুলোতে ১ আগষ্ট শনিবার সকালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। তবে তার আগেই স্থানীয় জনগণ পতাকা উড়িয়েছেন। সেখানের মানুষের হাতে হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টি এই মোট ১১১টি ছিটমহল পেয়েছে বাংলাদেশ। সেসব স্থানে এখন নানা আয়োজনে উৎসব চলছে বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন। এসব আয়োজনের মধ্যে রয়েছে বাড়ি বাড়ি ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্বলন, মসজিদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা, লাঠিখেলা ও নৌকাবাইচ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা ইত্যাদি।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতে বিগত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কংগ্রেস আমলেই ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু ওই সময়ে বিজেপি সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করা সম্ভব হয়নি। তবে বিলটি পার্লামেন্টে থেকে যায়। ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা এবং নিুকক্ষ লোকসভা উভয় কক্ষেই বিল পাস করতে হয়। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিজেপি ইউটার্ন নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। এ সময় বিজেপির আসাম শাখা তার বিরোধিতা করে। ফলে বিজেপি সরকার একবার আসামকে বাদ রেখেই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। আসাম রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে স্থানীয় রাজনীতির স্বার্থ হাসিলে এই উদ্যোগ নেয়ায় কংগ্রেস তার বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনী বিলটি পূর্ণাঙ্গরূপেই পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে পাস হয়।
এদিকে মানচিত্র পরিবর্তন করে নতুন মানচিত্র প্রণয়নে দু’দেশের যৌথ জরিপ কর্মকর্তারা এগারশ’র চেয়ে বেশি স্ট্রিপ ম্যাপ প্রস্তুত করেন। সেগুলোতে সই করার জন্য ‘সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’ (প্ল্যানিপটিমিয়ারি) ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ সই করেন। এই স্বাক্ষরের মাধ্যমেই নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ ও ভারত। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

নতুন মানচিত্রে বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ১০:২৪:৩৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ অগাস্ট ২০১৫

ঢাকা: ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ। ছিটমহল বিনিময়ে ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করল বিশ্ব। ৬৮ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটল। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। তারা সমস্বরে গাইলেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। উড়ল বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। ছিটমহলের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠল ৬৮টি মোমের বাতি। রাজনীতির পাশা খেলায় যবনিকাপাত ঘটল। জয় হল মানুষের। মুছে গেল রাষ্ট্রহীনতার কষ্ট। রাষ্ট্রহীন মানুষগুলো এখন পাবে আইডি কার্ড, জন্মনিবন্ধন সনদ। আনন্দের মধ্যেও বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত ছিটমহল থেকে যারা ভারত চলে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। মন খারাপ তাদের স্বজনদেরও। ছিটমহল বিনিময় উপলক্ষে ওইসব প্রত্যন্ত জনপদে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার ছাড়াও স্থানীয় জনগণ কমিটি গঠন করে নিরাপত্তার আয়োজন করেছেন।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ে নতুন করে আঁকা হল সীমানা রেখা। বাংলাদেশ পেল লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টিসহ মোট ১১১টি ছিটমহল। অপদখলীয় ভূমি বিনিময় এবং সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানার মধ্যে চিহ্নিত হল সাড়ে চার কিলোমিটার স্থলসীমানা। এখন মুহুরীর চরে শুধু দুই কিলোমিটার সীমানাই অচিহ্নিত রয়ে গেল। ছিটমহল এখন শুধুই ইতিহাস। ওই সব ভূখণ্ডে নিজের জন্মভূমিতে পরবাসী থাকা প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ পেলেন অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির স্বাদ। বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য এক নজির সৃষ্টি হল শান্তিপূর্ণভাবে ভূখণ্ড বিনিময় এবং নিজেদের নাগরিকত্ব বেছে নেয়ার মাধ্যমে। এমন দিনে তারা আবেগে-উচ্ছাসে প্রকাশ করেন মুক্তির আনন্দ। অবরুদ্ধ জীবনে তাদের অন্তহীন অভিশাপ মুক্তির এই ক্ষণে ঘরে ঘরে বইছে আনন্দের বন্যা। সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশ প্রজ্ঞাপন জারি করে নতুন ভূখণ্ড চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি সই হয় ১৯৭৪ সালে যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। ওই সময়ে বাংলাদেশ চুক্তিটি অনুসমর্থন করলেও ভারত তখন তা করেনি। তারপর ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তির সঙ্গে সই হয় প্রটোকল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করতে ভারতের সংবিধান সংশোধন জরুরি হয় পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বর্তমান সরকার দেশটির পার্লামেন্টে সর্বসম্মতভাবে সংবিধান সংশোধনে সমর্থ হন। এরপরই প্রটোকলসহ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ উন্মুক্ত হয়।
মোদির ঢাকা সফরকালে সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর করে দুই দেশ। তার আলোকে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ৩১ জুলাই মধ্যরাতেই সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের অংশ হয়ে যায়। সেখানে ওড়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা। সেখানে ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর ভূখণ্ড এখন বাংলাদেশের সীমানা। এসব ভূখণ্ডের অবস্থান বাংলাদেশের লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায়। সর্বশেষ গত ৬ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ছিটমহলে দু’দেশের যৌথ জনগণনা মতে, এসব ভূখণ্ডে বাসিন্দার সংখ্যা ৪১ হাজার ৪৪৯ জন। তাদের মধ্যে ৯৭৯ জন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রেখে ভারত ফিরে যেতে চেয়েছেন। এই ৯৭৯ জন আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ভারত ফিরে যাবেন।
ছিটমহল বিনিময়ের অংশ হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মালিকানা পেয়েছে ভারত। সেখানে সাত হাজার সাতশ’ ১০ দশমিক শূন্য দুই একর ভূখণ্ড বাংলাদেশকে ছাড়তে হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কুচবিহার জেলায় এসব ছিটমহল অবস্থিত। সেখানে বাসিন্দার সংখ্যা ১৪ হাজার ২১৫ জন। তাদের কেউই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল রাখতে রাজি হননি। ফলে তারা এখন ভারতের নাগরিক।
স্যার সিরিল রেডক্লিফ ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকেছিলেন। যেসব এলাকা নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান চিহ্নিত করেছিলেন তাই এখন বাংলাদেশের ভূখণ্ড। রেডক্লিফ সীমানা রেখা আঁকার সময়ে বাস্তব সমস্যা উপলব্ধি করেননি। ফলে বাস্তবে রেডক্লিফের সীমানা অনেক স্থানে হেরফের হয়। অনেক স্থানে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতের দখলে এবং ভারতের ভূখণ্ড বাংলাদেশের দখলে থাকে। সেই দখলের স্থানগুলোকেই বলা হয় অপদখলীয় ভূমি। সীমান্ত চুক্তির আলোকে দু’দেশের যৌথ জরিপ দল যার দখলে যে জায়গা রয়েছে সেটাকে ঠিক রেখে সীমানা রেখা খানিকটা ঘুরিয়ে দেন। ফলে সীমানার স্থানেও মানচিত্র পাল্টায়। এভাবে দেখা যাচ্ছে রেডক্লিফের মানচিত্রের আলোকে ছয়টি স্থানে দুই হাজার দু’শ ৬৭ দশমিক ৬৮২ একর ভারতীয় ভূমি বাংলাদেশ অপদখলীয় অবস্থায় ছিল। এখন সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ায় সেই ভূখণ্ডও বাংলাদেশের হয়ে গেল। তার বিপরীতে সীমান্তের ১২টি স্থানে দুই হাজার ৭৭৭ দশমিক শূন্য ৩৪ একর ভূখণ্ড ভারত অপদখলীয় রেখেছিল। এসব ভূখণ্ড এখন ভারতের মূল ভূখণ্ডে মিশে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থলসীমান্ত রয়েছে। তার মধ্যে সাড়ে ছয় কিলোমিটার স্থলসীমান্ত অচিহ্নিত ছিল। দু’দেশের যৌথ জরিপ দলের সদস্যরা উত্তরাঞ্চলে দইখাদা এবং পূর্বাঞ্চলীয় লাঠিটিলায় সাড়ে চার কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করেছেন। ফলে এ দুটি স্থানে মানচিত্র নিশ্চিত হল। তবে ফেনী জেলার মুহুরীর চরে সীমানা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। মুহুরী নদীর মধ্যস্রোতকে দুই দেশের সীমান্ত রেখা ধরা হয়। কিন্তু মধ্যস্রোতই চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ফলে সীমান্ত চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নের পথে এই সামান্য বাধাটুকু রয়ে গেল।
ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হওয়া নিয়ে ওইসব জনপদে চলছে বাঁধভাঙা উচ্ছাস। স্থানীয় প্রশাসন উত্তরাঞ্চলীয় চার জেলা লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছিটমহলগুলোতে ১ আগষ্ট শনিবার সকালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। তবে তার আগেই স্থানীয় জনগণ পতাকা উড়িয়েছেন। সেখানের মানুষের হাতে হাতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টি এই মোট ১১১টি ছিটমহল পেয়েছে বাংলাদেশ। সেসব স্থানে এখন নানা আয়োজনে উৎসব চলছে বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন। এসব আয়োজনের মধ্যে রয়েছে বাড়ি বাড়ি ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্বলন, মসজিদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা, লাঠিখেলা ও নৌকাবাইচ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা ইত্যাদি।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতে বিগত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কংগ্রেস আমলেই ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু ওই সময়ে বিজেপি সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করে। ফলে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করা সম্ভব হয়নি। তবে বিলটি পার্লামেন্টে থেকে যায়। ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা এবং নিুকক্ষ লোকসভা উভয় কক্ষেই বিল পাস করতে হয়। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিজেপি ইউটার্ন নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। এ সময় বিজেপির আসাম শাখা তার বিরোধিতা করে। ফলে বিজেপি সরকার একবার আসামকে বাদ রেখেই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। আসাম রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনে স্থানীয় রাজনীতির স্বার্থ হাসিলে এই উদ্যোগ নেয়ায় কংগ্রেস তার বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনী বিলটি পূর্ণাঙ্গরূপেই পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে পাস হয়।
এদিকে মানচিত্র পরিবর্তন করে নতুন মানচিত্র প্রণয়নে দু’দেশের যৌথ জরিপ কর্মকর্তারা এগারশ’র চেয়ে বেশি স্ট্রিপ ম্যাপ প্রস্তুত করেন। সেগুলোতে সই করার জন্য ‘সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী’ (প্ল্যানিপটিমিয়ারি) ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ সই করেন। এই স্বাক্ষরের মাধ্যমেই নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ ও ভারত। (দৈনিক যুগান্তর)