নিউইয়র্ক ১১:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ঢাকায় এবার প্রকাশক দীপনকে কুপিয়ে হত্যা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৬:১৩:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ নভেম্বর ২০১৫
  • / ৮৭২ বার পঠিত

ঢাকা: রাজধানীতে দুটি পৃথক ঘটনায় প্রায় একই সময়ে চার ব্লগারের ওপর হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অভিজিতের বইয়ের আরেক প্রকাশক ‘শুদ্ধস্বর’র স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ তিন ব্লগারকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। এ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশংকাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, শনিবার (৩১ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে শাহবাগের জনাকীর্ণ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। ঘাতকরা তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে বাইরে থেকে অফিসটি বন্ধ করে পালিয়ে যায়। পরে কর্মচারী, মার্কেটের লোকজন ও তার বাবা দীপনকে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে এ ঘটনার পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আজিজ সুপার মার্কেটের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত বেশ কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি টিভি) ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
এর আগে বিকাল পৌনে ৩টার দিকে দুর্বৃত্তরা ৮/১৩ লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক ও ব্লগার আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় দুর্বৃত্তরা দুই রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। পরে দুর্বৃত্তরা বাইরে থেকে অফিসটি তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায়। আশংকাজনক অবস্থায় তাদের তিনজনকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহমেদুর রশিদ টুটুলের সহকর্মীরা বলেছেন, এর আগেও কয়েক দফায় দুর্বৃত্তরা হত্যার হুমকি দেয় টুটুলকে। এ কারণে তিনি মোহাম্মদপুর থানায় বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরিও করেন। বিশেষ করে অভিজিৎ রায় হত্যাকান্ডের পর সাধারণ ডায়েরি করলে কিছুদিন তার নিরাপত্তায় পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থাও করা হয়। তবে কয়েক দিন পর ওই পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহারও করে নেয়া হয়। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ওই ভবনের কেয়ারটেকার মোহাম্মদ ফারুক হাসানকে আটক করেছে। শনিবার পৃথক যে দুটি প্রকাশনী সংস্থার অফিসে হামলার ঘটনা ঘটেছে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানই মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করত।
তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, দুটি ঘটনারই যোগসূত্র রয়েছে। দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তারা মনে করছেন। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা জানতে পুলিশ অনুসন্ধান শুরু করেছে। এদিকে এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জাগরণী মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন। শনিবার ওই ঘটনার পর হাসপাতালে ছুটে যান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র (একাংশ) ইমরান এইচ সরকার ছাড়াও তাদের স্বজনরা। হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে ইমরান এইচ সরকার এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সরকারের নীর্লিপ্ততার কারণে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ শাহবাগসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এদিকে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বসানো হয়েছে ‘আর্চওয়ে।’
বই কেনার কথা বলে অফিসে ঢোকে হামলাকারীরা: শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্মচারী রাসেল বলেন, বেলা আড়াইটা থেকে ৩টার দিকে ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী তিনজন তাদের অফিসে আসে। এ সময় তারা দরজায় নক করলে তিনি নিজেই দরজা খুলে আগন্তকের পরিচয় জানতে চান। এ সময় তারা বই কেনার জন্য সিলেট থেকে এসেছেন জানালে তাদেরকে অফিসে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়। রাসেল জানান, ওই তিন যুবকের পেছন পেছন আরও দু’জন অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। রাসেলের ভাষায়, অফিসে ঢোকার পরপরই তারা দরজা বন্ধ করে পিস্তলের মুখে টুটুলসহ সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এরপর তারা আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এ সময় তারেক রহিম দৌড়ে রুম থেকে বেরোতে গেলে তাকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তদের একজন গুলি ছোড়ে। তার কোমরের বাম দিকে গুলি লাগলে মেঝেতে পড়ে যান। রাসেল জানান, ঘটনার সময় তিনি ভয়ে বাথরুমে পালিয়ে থাকেন। এরপর দুর্বৃত্তরা হামলা শেষে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে চলে যায়।
তিন মিনিটের মিশনে ৫ জন: লালমাটিয়া সি-ব্লকে ৮/১৩, বাড়ির চার তলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলার সময় মোট ৫ দুর্বৃত্ত উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে তিনজন সরাসরি হামলায় অংশ নেয়। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে অপারেশন শেষ করে দুর্বৃত্তরা ওই ভবনের নিচে থাকা দুটি মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, বই কেনার নাম করে ওই অফিসে তিনজন প্রবেশ করেছিল। এরপর তাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে।’ এর পেছনে উগ্রপন্থীরা ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনও বলার মতো সময় আসেনি। আমরা সব বিষয় তদšন্ত করে দেখছি।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাসেল জানান, প্রকাশক টুটুলসহ কয়েকজন ছিলেন শুদ্ধস্বরের অফিসে। বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে প্রবেশ করে অস্ত্রধারী তিন যুবক। তাদের একজনের কাছে কালো ব্যাগ ছিল। তারা এসে দরজা নক করে। এ সময় তারা বলে, বই কেনার জন্য এসেছে এবং সেখানে তাদের এক ‘ভাই’ আছে। দরজা খুলে দেয়ার পর একজন ঢুকেই বলে আমরা কিছু বই কিনব। তিনজনের মধ্যে একজন স্বাস্থ্যবান। অপর একজনের মুখে হালকা দাড়ি ছিল। একজনের হাতে পিস্তল ছিল। যার হাতে পিস্তল ছিল, তার বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর হবে।
প্রথমে যে ঢুকেছিল তার কাছে কালো একটি ব্যাগ ছিল। ওই ব্যাগ থকে তারা চাপাতি বের করে। অন্য একটি ঘরে নিয়ে আটকে রাখে রাসেলকে। তিনজনকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর তারা চলে যায়। এ সময় সঙ্গে নিয়ে আসা তালা বাসার দরজায় লাগিয়ে দেয়। রাসেল আরও বলে, যাওয়ার সময় তারেক স্যারকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করে।
শুদ্ধস্বর কার্যালয় ভবনের সামনের একটি টেইলার্সের সোহেল বলেন, চিৎকার শুনে আমরা ওইদিকে খেয়াল করে দেখি দুটি মোটরসাইকেলে করে পাঁচজন দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে।
রাসেল ফোন করেছিল সাংবাদিককে: হামলার পর সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফিকে ফোন করেছিল ওই অফিসের পিয়ন রাসেল। এ বিষয়ে রাসেল জানায়, শফি স্যার টুটুল স্যারের বন্ধু। শফি স্যারের কয়েকটি বই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এজন্য শফি স্যার প্রায়শই শুদ্ধস্বরের অফিসে যেতেন। ফোন পেয়ে মুস্তাফিজ শফি নিজেই সেখানে ছুটে যান। তিনি আহতদের উদ্ধারের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেন।
সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তাফিজ শফি ঘটনাস্থলে বলেন, ‘আড়াইটার পরপরই প্রকাশক টুটুলের নম্বর থেকে তার মোবাইলে একটি ফোন আসে। রাসেল নামে এক যুবক নিজেকে শুদ্ধস্বরের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে বলেন, কয়েকজন লোক এসে তিনজনকে কুপিয়ে ও গুলি করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চলে গেছে। ওই সময় টেলিফোনে তাদের রক্ষা করার আকুতি জানায় রাসেল। মুস্তাফিজ বলেন, খবর পেয়ে তিনি তাৎক্ষণিক তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের মোবাইলে বিষয়টি জানান।
টুটুল এসএমএস করে পুলিশকে: হামলার শিকার হয়ে রক্তাক্ত যখম অবস্থায় তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে এসএমএস করেন। ওই এসএমএসে আক্রান্ত হওয়ার কথা ও পুলিশের সহযোগিতা চান। উপ-কমিশনার বিপ্লব সরকার যুগান্তরকে জানান, এসএমএস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে পুলিশ পাঠান। পরে পুলিশ গিয়ে তালা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
বিপ্লব কুমার সরকার জানান, ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে তিনজন হামলাকারী ভেতরে প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা গুলি ও গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মীর জামাল উদ্দিন জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলে আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠায়। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে খবর দেয়া হয় ক্রাইম সিন সংগ্রহের জন্য। তারা সেখান থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। এছাড়া ঘটনাস্থলে সাধারণ লোকজনের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
ফেসবুকে হুমকির পর একাধিক জিডি: অভিজিৎ নিহত হওয়ার পর তার বইয়ের প্রকাশক হিসেবে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল টুটুলকে। সেজন্য টুটুল মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছিলেন। ফেব্রুয়ারীতে ওই জিডির পর তাদের নিরপত্তায় কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে- জানতে চাইলে ডিসি তেজগাঁও বলেন, ‘জিডি করেছিল কিনা, ঠিক এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। তবে যারা যখনই নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশের সাহায্য চেয়েছে পুলিশ পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিয়েছে। অফিসের স্টাফ রাসেল জানায়, ডিজির পর এক সপ্তাহ পুলিশ টুটুলকে প্রটেকশন দেয়। অফিসেও কয়েকবার আসে। কিন্তু কিছু দিন পর অজ্ঞাত কারণে পুলিশ সরিয়ে নেয়া হয়।
ঘটনাস্থলের বর্ণনা: শনিবার বিকালে লালমাটিয়া-সি ব্লকে ৮/১৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওই পাঁচতলা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, চারতলায় প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কার্যালয়। কার্যালয়ে ঢুকতেই সোফা ও আশপাশে ছোপ ছোপ রক্তে ভেসে গেছে। চার কক্ষের ওই অফিস রুমটি তছনছ অবস্থায় রয়েছে। দেয়ালসহ চারদিকে শুধু রক্তের দাগ। সেখানে কাজ করছেন সিআইডি, ডিবি, থানা পুলিশ ও পিবিআইসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। পাঁচতলা ওই বাড়িটির সামনে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও বিপুলসংখ্যক উৎসুক জনতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বাড়িটির মালিক দুই সহোদর রফিকুল হোসেন ও আজাহার হোসেন। এর মধ্যে আজাহার হোসেনের কেয়ারটেকার ফারুক হাসানকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। ঘটনার সময় তিনি দুপুরের খাবারের জন্য বাড়ির ভেতর ছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। অন্যদিকে রফিকুল হোসেনের কেয়ারটেকার আলামিন ছিলেন চতুর্থতলার সামনে পাশের ভাড়াটিয়া ম্যাপলিপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক সৈয়দ গোলাম মোর্শেদের বাসায়।
Diponদীপনের ওপর হামলা চালানো হয় যেভাবে: সন্ধ্যায় জনাকীর্ণ আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। ঘাতকরা কিলিং মিশন শেষে বাইরে থেকে অফিসটি বন্ধ করে রেখে যায়। পরে কর্মচারী ও মার্কেটের লোকজন দীপনকে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে এ ঘটনার পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আজিজ সুপার মার্কেটের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত বেশ কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
জাগৃতি প্রকাশনীর মানেজার মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘তৃতীয় তলার অফিসে স্যার বসেন। আর আমরা বসি নিচতলায় শোরুমে। লালমাটিয়ার খবর শুনে স্যারের সঙ্গে কথা বলি। কিছু সময় পর আবার তাকে ফোন করি। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ধারণা করেছিলাম হয়তো ব্যস্ত। কিন্তু বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্যার ফোন না ধরায় অস্থির হয়ে পড়ি। উপরে অফিসে গিয়ে দেখি অটোলকের দরজা ভেতর থেকে লক করা। এর মধ্যে মার্কেটের লোকজনকে খবর দেই। তারা ছুটে আসেন। শোরুম থেকে বিকল্প চাবি এনে দরজা খুলে দেখি স্যার রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। পুরো কক্ষে জমাটবাঁধা রক্ত। মার্কেটের লোকজন পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।’ ম্যানেজার আলাউদ্দিন আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে তাকে ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারা হয়েছে।
ঢামেকে হৃদয়বিদারক দৃশ্য: গুরুতর আহত তিনজন ও নিহত একজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে উপস্থিত স্বজন ও বন্দুদের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আহতদের বাকরুদ্ধ স্বজনরা নিজেদের প্রিয়জনকে বাঁচানোর আকুতি জানান জনে জনে।
শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার তারেক রহীম ও রণদীপম বসুকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় বেলা পৌনে ৪টার দিকে। হাসপাতালে নেয়ার পরই তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। সেখানে ধুয়ে পরিষ্কার করে সেলাই করে ব্যান্ডেজ দেয়া হয়। টুটুল ও তারেক রহিমের শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। প্রয়োজন হয় রক্তের। তাদের বন্ধুরা ছুটে আসেন রক্ত দিতে। ছুটে যান ব্লগাররাও। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, তারেক রহীম গুরুতরও যখম হয়েছেন। তার শরীরে গুলি লেগেছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া টুটলের অবস্থাও আশংকাজনক।
টুটলের বন্ধু মারূফ জানান, ব্লগাররা অফিসে, ঘরে কোথাও এখন আর নিরাপদ নন। নিলয়কে ঘরের ভেতর এবং দীপনকে অফিসে খুন করা হয়েছে। তাহলে তারা যাবে কোথায়?
এদিকে দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ছেলের লাশ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। তার দাবি, যারা হামলা করেছে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে। একারণেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্লগারদের ভর্তি করার পর হাসপাতালে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মোজাম্মেল হক জানান, হাসপাতাল এলাকায় দুই প্লাটুন পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে। দুই দফায় ব্লগারদের ওপর হামলা ও খুনের পর ঢাকা শহরে টহল ও তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে।
অভিজিতের বই প্রকাশ করত শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি: বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করত শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি। ‘এক ব্যাগ অভিজিৎ’ নামে এই লেখকের সব বইয়ের সংস্করণ প্রকাশ করেছিল তারা। অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করার কারণে হুমকি পাওয়ায় এ প্রকাশনা সংস্থার প্রধান মোহাম্মদপুর থানায় কয়েকটি জিডি করেছিলেন।
শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর ‘এক ব্যাগ অভিজিৎ’-এর বইগুলো হচ্ছে: ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’, ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ : ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’, ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’,‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ এবং ‘সমকামিতা।’ সমকামিতা, বিশ্বাসের ভাইরাস বই দুটি নিয়ে কারও কারও মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা ছিল।
প্রসঙ্গত, ড. অভিজিতের বই ও ব্লগ নিয়ে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারী একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর শাহবাগ মোড়ে ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আহত হয়েছিলেন তার স্ত্রী রাফিদা আহম্মেদ বন্যা। স্বামীকে হারিয়ে কিছুদিন পর রাফিদা আহমেদ বন্যা আমেরিকায় পাড়ি জমান। তখন থেকেই তিনি সে দেশেই বসবাস করছেন। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

ঢাকায় এবার প্রকাশক দীপনকে কুপিয়ে হত্যা

প্রকাশের সময় : ০৬:১৩:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ নভেম্বর ২০১৫

ঢাকা: রাজধানীতে দুটি পৃথক ঘটনায় প্রায় একই সময়ে চার ব্লগারের ওপর হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অভিজিতের বইয়ের আরেক প্রকাশক ‘শুদ্ধস্বর’র স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ তিন ব্লগারকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। এ তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশংকাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, শনিবার (৩১ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে শাহবাগের জনাকীর্ণ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। ঘাতকরা তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে বাইরে থেকে অফিসটি বন্ধ করে পালিয়ে যায়। পরে কর্মচারী, মার্কেটের লোকজন ও তার বাবা দীপনকে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে এ ঘটনার পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আজিজ সুপার মার্কেটের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত বেশ কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি টিভি) ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
এর আগে বিকাল পৌনে ৩টার দিকে দুর্বৃত্তরা ৮/১৩ লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক ও ব্লগার আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় দুর্বৃত্তরা দুই রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। পরে দুর্বৃত্তরা বাইরে থেকে অফিসটি তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায়। আশংকাজনক অবস্থায় তাদের তিনজনকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহমেদুর রশিদ টুটুলের সহকর্মীরা বলেছেন, এর আগেও কয়েক দফায় দুর্বৃত্তরা হত্যার হুমকি দেয় টুটুলকে। এ কারণে তিনি মোহাম্মদপুর থানায় বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরিও করেন। বিশেষ করে অভিজিৎ রায় হত্যাকান্ডের পর সাধারণ ডায়েরি করলে কিছুদিন তার নিরাপত্তায় পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থাও করা হয়। তবে কয়েক দিন পর ওই পুলিশি নিরাপত্তা প্রত্যাহারও করে নেয়া হয়। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ওই ভবনের কেয়ারটেকার মোহাম্মদ ফারুক হাসানকে আটক করেছে। শনিবার পৃথক যে দুটি প্রকাশনী সংস্থার অফিসে হামলার ঘটনা ঘটেছে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানই মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করত।
তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, দুটি ঘটনারই যোগসূত্র রয়েছে। দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তারা মনে করছেন। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তা জানতে পুলিশ অনুসন্ধান শুরু করেছে। এদিকে এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জাগরণী মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন। শনিবার ওই ঘটনার পর হাসপাতালে ছুটে যান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র (একাংশ) ইমরান এইচ সরকার ছাড়াও তাদের স্বজনরা। হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে ইমরান এইচ সরকার এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সরকারের নীর্লিপ্ততার কারণে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ শাহবাগসহ সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এদিকে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বসানো হয়েছে ‘আর্চওয়ে।’
বই কেনার কথা বলে অফিসে ঢোকে হামলাকারীরা: শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্মচারী রাসেল বলেন, বেলা আড়াইটা থেকে ৩টার দিকে ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী তিনজন তাদের অফিসে আসে। এ সময় তারা দরজায় নক করলে তিনি নিজেই দরজা খুলে আগন্তকের পরিচয় জানতে চান। এ সময় তারা বই কেনার জন্য সিলেট থেকে এসেছেন জানালে তাদেরকে অফিসে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়। রাসেল জানান, ওই তিন যুবকের পেছন পেছন আরও দু’জন অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। রাসেলের ভাষায়, অফিসে ঢোকার পরপরই তারা দরজা বন্ধ করে পিস্তলের মুখে টুটুলসহ সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এরপর তারা আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এ সময় তারেক রহিম দৌড়ে রুম থেকে বেরোতে গেলে তাকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তদের একজন গুলি ছোড়ে। তার কোমরের বাম দিকে গুলি লাগলে মেঝেতে পড়ে যান। রাসেল জানান, ঘটনার সময় তিনি ভয়ে বাথরুমে পালিয়ে থাকেন। এরপর দুর্বৃত্তরা হামলা শেষে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে চলে যায়।
তিন মিনিটের মিশনে ৫ জন: লালমাটিয়া সি-ব্লকে ৮/১৩, বাড়ির চার তলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলার সময় মোট ৫ দুর্বৃত্ত উপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে তিনজন সরাসরি হামলায় অংশ নেয়। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে অপারেশন শেষ করে দুর্বৃত্তরা ওই ভবনের নিচে থাকা দুটি মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসান বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, বই কেনার নাম করে ওই অফিসে তিনজন প্রবেশ করেছিল। এরপর তাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে।’ এর পেছনে উগ্রপন্থীরা ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনও বলার মতো সময় আসেনি। আমরা সব বিষয় তদšন্ত করে দেখছি।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাসেল জানান, প্রকাশক টুটুলসহ কয়েকজন ছিলেন শুদ্ধস্বরের অফিসে। বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে প্রবেশ করে অস্ত্রধারী তিন যুবক। তাদের একজনের কাছে কালো ব্যাগ ছিল। তারা এসে দরজা নক করে। এ সময় তারা বলে, বই কেনার জন্য এসেছে এবং সেখানে তাদের এক ‘ভাই’ আছে। দরজা খুলে দেয়ার পর একজন ঢুকেই বলে আমরা কিছু বই কিনব। তিনজনের মধ্যে একজন স্বাস্থ্যবান। অপর একজনের মুখে হালকা দাড়ি ছিল। একজনের হাতে পিস্তল ছিল। যার হাতে পিস্তল ছিল, তার বয়স ১৬ থেকে ১৭ বছর হবে।
প্রথমে যে ঢুকেছিল তার কাছে কালো একটি ব্যাগ ছিল। ওই ব্যাগ থকে তারা চাপাতি বের করে। অন্য একটি ঘরে নিয়ে আটকে রাখে রাসেলকে। তিনজনকে চাপাতি দিয়ে কোপানোর পর তারা চলে যায়। এ সময় সঙ্গে নিয়ে আসা তালা বাসার দরজায় লাগিয়ে দেয়। রাসেল আরও বলে, যাওয়ার সময় তারেক স্যারকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করে।
শুদ্ধস্বর কার্যালয় ভবনের সামনের একটি টেইলার্সের সোহেল বলেন, চিৎকার শুনে আমরা ওইদিকে খেয়াল করে দেখি দুটি মোটরসাইকেলে করে পাঁচজন দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে।
রাসেল ফোন করেছিল সাংবাদিককে: হামলার পর সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফিকে ফোন করেছিল ওই অফিসের পিয়ন রাসেল। এ বিষয়ে রাসেল জানায়, শফি স্যার টুটুল স্যারের বন্ধু। শফি স্যারের কয়েকটি বই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এজন্য শফি স্যার প্রায়শই শুদ্ধস্বরের অফিসে যেতেন। ফোন পেয়ে মুস্তাফিজ শফি নিজেই সেখানে ছুটে যান। তিনি আহতদের উদ্ধারের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেন।
সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তাফিজ শফি ঘটনাস্থলে বলেন, ‘আড়াইটার পরপরই প্রকাশক টুটুলের নম্বর থেকে তার মোবাইলে একটি ফোন আসে। রাসেল নামে এক যুবক নিজেকে শুদ্ধস্বরের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে বলেন, কয়েকজন লোক এসে তিনজনকে কুপিয়ে ও গুলি করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে চলে গেছে। ওই সময় টেলিফোনে তাদের রক্ষা করার আকুতি জানায় রাসেল। মুস্তাফিজ বলেন, খবর পেয়ে তিনি তাৎক্ষণিক তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের মোবাইলে বিষয়টি জানান।
টুটুল এসএমএস করে পুলিশকে: হামলার শিকার হয়ে রক্তাক্ত যখম অবস্থায় তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে এসএমএস করেন। ওই এসএমএসে আক্রান্ত হওয়ার কথা ও পুলিশের সহযোগিতা চান। উপ-কমিশনার বিপ্লব সরকার যুগান্তরকে জানান, এসএমএস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে পুলিশ পাঠান। পরে পুলিশ গিয়ে তালা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
বিপ্লব কুমার সরকার জানান, ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে তিনজন হামলাকারী ভেতরে প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি তাজা গুলি ও গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মীর জামাল উদ্দিন জানান, পুলিশ ঘটনাস্থলে আহতদের দ্রুত হাসপাতালে পাঠায়। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটকে খবর দেয়া হয় ক্রাইম সিন সংগ্রহের জন্য। তারা সেখান থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। এছাড়া ঘটনাস্থলে সাধারণ লোকজনের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
ফেসবুকে হুমকির পর একাধিক জিডি: অভিজিৎ নিহত হওয়ার পর তার বইয়ের প্রকাশক হিসেবে ফেসবুকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল টুটুলকে। সেজন্য টুটুল মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছিলেন। ফেব্রুয়ারীতে ওই জিডির পর তাদের নিরপত্তায় কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে- জানতে চাইলে ডিসি তেজগাঁও বলেন, ‘জিডি করেছিল কিনা, ঠিক এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। তবে যারা যখনই নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশের সাহায্য চেয়েছে পুলিশ পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিয়েছে। অফিসের স্টাফ রাসেল জানায়, ডিজির পর এক সপ্তাহ পুলিশ টুটুলকে প্রটেকশন দেয়। অফিসেও কয়েকবার আসে। কিন্তু কিছু দিন পর অজ্ঞাত কারণে পুলিশ সরিয়ে নেয়া হয়।
ঘটনাস্থলের বর্ণনা: শনিবার বিকালে লালমাটিয়া-সি ব্লকে ৮/১৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওই পাঁচতলা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, চারতলায় প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বরের কার্যালয়। কার্যালয়ে ঢুকতেই সোফা ও আশপাশে ছোপ ছোপ রক্তে ভেসে গেছে। চার কক্ষের ওই অফিস রুমটি তছনছ অবস্থায় রয়েছে। দেয়ালসহ চারদিকে শুধু রক্তের দাগ। সেখানে কাজ করছেন সিআইডি, ডিবি, থানা পুলিশ ও পিবিআইসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। পাঁচতলা ওই বাড়িটির সামনে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও বিপুলসংখ্যক উৎসুক জনতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বাড়িটির মালিক দুই সহোদর রফিকুল হোসেন ও আজাহার হোসেন। এর মধ্যে আজাহার হোসেনের কেয়ারটেকার ফারুক হাসানকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। ঘটনার সময় তিনি দুপুরের খাবারের জন্য বাড়ির ভেতর ছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। অন্যদিকে রফিকুল হোসেনের কেয়ারটেকার আলামিন ছিলেন চতুর্থতলার সামনে পাশের ভাড়াটিয়া ম্যাপলিপ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক সৈয়দ গোলাম মোর্শেদের বাসায়।
Diponদীপনের ওপর হামলা চালানো হয় যেভাবে: সন্ধ্যায় জনাকীর্ণ আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ঢুকে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। ঘাতকরা কিলিং মিশন শেষে বাইরে থেকে অফিসটি বন্ধ করে রেখে যায়। পরে কর্মচারী ও মার্কেটের লোকজন দীপনকে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে এ ঘটনার পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আজিজ সুপার মার্কেটের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত বেশ কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
জাগৃতি প্রকাশনীর মানেজার মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘তৃতীয় তলার অফিসে স্যার বসেন। আর আমরা বসি নিচতলায় শোরুমে। লালমাটিয়ার খবর শুনে স্যারের সঙ্গে কথা বলি। কিছু সময় পর আবার তাকে ফোন করি। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ধারণা করেছিলাম হয়তো ব্যস্ত। কিন্তু বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্যার ফোন না ধরায় অস্থির হয়ে পড়ি। উপরে অফিসে গিয়ে দেখি অটোলকের দরজা ভেতর থেকে লক করা। এর মধ্যে মার্কেটের লোকজনকে খবর দেই। তারা ছুটে আসেন। শোরুম থেকে বিকল্প চাবি এনে দরজা খুলে দেখি স্যার রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। পুরো কক্ষে জমাটবাঁধা রক্ত। মার্কেটের লোকজন পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ এসে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।’ ম্যানেজার আলাউদ্দিন আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে তাকে ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারা হয়েছে।
ঢামেকে হৃদয়বিদারক দৃশ্য: গুরুতর আহত তিনজন ও নিহত একজনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে উপস্থিত স্বজন ও বন্দুদের আহাজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আহতদের বাকরুদ্ধ স্বজনরা নিজেদের প্রিয়জনকে বাঁচানোর আকুতি জানান জনে জনে।
শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার তারেক রহীম ও রণদীপম বসুকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় বেলা পৌনে ৪টার দিকে। হাসপাতালে নেয়ার পরই তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। সেখানে ধুয়ে পরিষ্কার করে সেলাই করে ব্যান্ডেজ দেয়া হয়। টুটুল ও তারেক রহিমের শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। প্রয়োজন হয় রক্তের। তাদের বন্ধুরা ছুটে আসেন রক্ত দিতে। ছুটে যান ব্লগাররাও। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, তারেক রহীম গুরুতরও যখম হয়েছেন। তার শরীরে গুলি লেগেছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া টুটলের অবস্থাও আশংকাজনক।
টুটলের বন্ধু মারূফ জানান, ব্লগাররা অফিসে, ঘরে কোথাও এখন আর নিরাপদ নন। নিলয়কে ঘরের ভেতর এবং দীপনকে অফিসে খুন করা হয়েছে। তাহলে তারা যাবে কোথায়?
এদিকে দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ছেলের লাশ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। তার দাবি, যারা হামলা করেছে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে। একারণেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্লগারদের ভর্তি করার পর হাসপাতালে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মোজাম্মেল হক জানান, হাসপাতাল এলাকায় দুই প্লাটুন পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে। দুই দফায় ব্লগারদের ওপর হামলা ও খুনের পর ঢাকা শহরে টহল ও তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে।
অভিজিতের বই প্রকাশ করত শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি: বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করত শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি। ‘এক ব্যাগ অভিজিৎ’ নামে এই লেখকের সব বইয়ের সংস্করণ প্রকাশ করেছিল তারা। অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করার কারণে হুমকি পাওয়ায় এ প্রকাশনা সংস্থার প্রধান মোহাম্মদপুর থানায় কয়েকটি জিডি করেছিলেন।
শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর ‘এক ব্যাগ অভিজিৎ’-এর বইগুলো হচ্ছে: ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’, ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ : ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’, ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’,‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ এবং ‘সমকামিতা।’ সমকামিতা, বিশ্বাসের ভাইরাস বই দুটি নিয়ে কারও কারও মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা ছিল।
প্রসঙ্গত, ড. অভিজিতের বই ও ব্লগ নিয়ে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারী একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর শাহবাগ মোড়ে ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আহত হয়েছিলেন তার স্ত্রী রাফিদা আহম্মেদ বন্যা। স্বামীকে হারিয়ে কিছুদিন পর রাফিদা আহমেদ বন্যা আমেরিকায় পাড়ি জমান। তখন থেকেই তিনি সে দেশেই বসবাস করছেন। (দৈনিক যুগান্তর)