জাতীয় সংসদে ভারতের জনগণ, নরেন্দ্র মোদি ও সোনিয়া গান্ধীসহ সব রাজনৈতিক দলকে ধন্যবাদ : বাংলাদেশের দুঃসময়ের বন্ধু ভারত : প্রধানমন্ত্রী
- প্রকাশের সময় : ০৮:৪৪:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ জুন ২০১৫
- / ১৪৫৪ বার পঠিত
ঢাকা: ভারতের লোকসভায় স্থলসীমান্ত বিল পাস হওয়ায় দেশটির জনগণ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিরোধীদলীয় নেত্রী সোনিয়া গান্ধীসহ সব রাজনৈতিক দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২ মে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি ধন্যবাদ জানান। ভারতের লোকসভায় স্থলসীমান্ত বিল পাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ভারতীয় জনগণকে ধন্যবাদ জানাতে জাতীয় সংসদে ধন্যবাদ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন চিফ হুইপ আসম ফিরোজ।
কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭-এর আওতায় তিনি প্রস্তাবটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করলে সরকারি দল, বিরোধী দল এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা এর ওপর আলোচনায় অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন- বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, দলের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী মিয়া, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের মাঈনউদ্দীন খান বাদল, সাবেক পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম সুজন ও মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন এবং স্বতন্ত্র সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
শেখ হাসিনা ভারতকে দুঃসময়ের বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারা সহযোগিতা করেছিল বলেই ৯ মাসে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। ভারত সব সময় বাংলাদেশের পাশে ছিল এবং সব সময় আছে। তিনি বলেন, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আমেরিকায় আমার কথা হয়েছিল। সেখানে তিনি আমাকে বলেছিলেন, এ বিলটি অনুমোদন করিয়ে দেবেন। তিনি কথা রেখেছেন। এজন্যই বিলটি পাস হওয়ার পর ওইদিনই আমি কোনো প্রটোকলের দিকে না তাকিয়ে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৈ, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারসহ সব দলের সদস্যকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু যেমন স্বাধীনতা দিয়েছেন তেমনি বাঙালীর প্রতিটি সফলতার ক্ষেত্র তিনিই তৈরি করে গিয়েছিলেন। স্থলসীমানা চুক্তি, সমুদ্রসীমা আইন সবই তিনি করে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তারা এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিল বলেই আমরা সরকার গঠন করে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি বলেন, আমি একটি বিষয় বিশ্বাস করি, দুই দেশের মধ্যে কোনো সমস্যা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শুধু চুক্তিই করে যাননি, সংবিধানে আইনটিও করে যান। বঙ্গবন্ধু আইন করে গিয়েছিলেন বলেই আমাদের ভিতটা এত শক্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক আগেই এ চুক্তি বাস্তবায়ন হয়ে যেত।
সংসদ নেতা বলেন, আমি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ভারত সফরে যাই তখন চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে কথা বলি। এরপর ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফরে এসে তিনি কথা দিয়েছিলেন সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন বিলটি লোকসভায় তুলবেন। সে অনুযায়ী বিলটি লোকসভায় উত্থাপন করা হয়, এরপর রাজ্যসভায় পাঠানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। দক্ষিণ এশিয়ার বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে দেখা হলে আমি বলি আমাদের শত্রু একটা, সেটা হচ্ছে দারিদ্র্য। এই অঞ্চলের মানুষ যারা দরিদ্র তাদের দরিদ্রতার হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। এটা করতে গেলে আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে হবে। সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষগুলোকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনে নতুন সমাজ দিতে পারব।
সীমান্ত চুক্তি শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের ফসল: ভারতের সংসদে স্থলসীমান্ত বিল পাস হওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই এ চুক্তিটি হয়েছে বলে উল্লেখ করে এজন্য প্রধানমন্ত্রীকেও ধন্যবাদ জানান সংসদ সদস্যরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে লোকসভায় স্থলসীমান্ত বিল পাস হওয়াকে বিরল ঘটনা আখ্যায়িত করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, অন্যদের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের সংবিধান সংশোধন এটা বিরল দৃষ্টান্ত। ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভা সেই বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিজের শাসন আমলের কথা উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, এই চুক্তি বাস্তবায়নে আমি নিজেও রাষ্ট্রপতি থাকার সময় চেষ্টা করেছি। আমিও পারিনি। ৪১ বছর ধরে এ চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। এবার তা হয়েছে। এজন্য তিনি শেখ হাসিনাকে লেখা তার অভিনন্দনপত্রের কিছু অংশ সংসদে উল্লেখ করে বলেন, ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে এতদিন যারা গোলামি চুক্তি বলেছেন- এ চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তাদের মুখে ছাই পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিস্তার পানি চুক্তি বাস্তবায়ন হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।’
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার বাবা নেই, তার কাজগুলো আপনাকে করতে হবে। আপনি তা করেও যাচ্ছেন। আপনাকে একের পর এক কাজ করতে হবে। ভালো কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে বাধা বেশি। সেই বাধা ভেঙে এগিয়ে যেতে হবে। সোনার বাংলা আপনাকে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও রয়েছে। বরং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বেশি। সেই প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার আলোকেই তিস্তা চুক্তিও বাস্তবায়িত হবে বলে আমি আশা করি। সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান সব সমস্যার সমাধান হবে।
আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে সম্পন্ন করছেন। শেখ হাসিনা আছেন বলেই এই চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। সীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্কের বিরাট অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে অন্য সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। বিএনপি ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল কিন্তু কিছুই দিতে পারেনি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু নেই। তার দুটি গুণ তার কন্যা ড়ুহণ করেছেন। তিনি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করেন। যে কারণে চার দশক পর এই বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, যতই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হোক না কেন, তা সফল হবে না। আমাদের সঙ্গে জনগণ আছে। আমরা সফল হবোই।
মোহাম্মদ নাসিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যের কারণেই ভারতের পার্লামেন্টে দীর্ঘ ৬২ বছর পর সীমান্ত বিল পাস হয়েছে। তিনি বলেন, এ খবরে দেশবাসী খুশি হলেও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া খুশি হতে পারেননি। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানালেও নিজের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাননি। তিনি রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি।
ডেপুটি স্পিকার মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, শেখ হাসিনা আছেন বলেই এই চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। সীমান্ত বিল অনুমোদনের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্কের বিরাট অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে অন্য সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।
সংসদে উত্থাপিত নোটিশের ৫টি ভুল: ভারতের পার্লামেন্টে সীমান্ত বিল পাস হওয়ায় নরেন্দ্র মোদির সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে সংসদে চিফ হুইপ আসম ফিরোজের উত্থাপিত নোটিশে পাঁচটি ‘ভুল’ পেয়েছেন বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। প্রস্তাবে বলা ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শী কূটনৈতিক সাফল্যে সম্প্রতি ভারতের সংসদে স্থলসীমান্ত চুক্তি পাস হওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিশেষ আলোচনার মাধ্যমে ভারতের জনগণ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হোক।’
ওই নোটিশের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, “বক্তব্য দেয়ার আগে নোটিশের কিছু ভুল সংশোধন করা দরকার। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শী…’, এখানে হবে শেখ হাসিনা সরকারের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতায়…।” তিনি আরও বলেন, “মাননীয় স্পিকার এখানে বলা হয়েছে, ‘ভারতের সংসদ’। ভারতে কোনো সংসদ নেই। এখানে হবে রাজ্যসভা ও লোকসভা। ‘স্থলসীমান্ত চুক্তি পাস’ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। চুক্তি অনেক আগেই পাস হয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছে। আর ‘জাতীয় সংসদে বিশেষ আলোচনার মাধ্যমে’ শব্দগুলো ডিলিট হবে। ভারতের জনগণ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের ধন্যবাদ জানানো হোক।”(দৈনিক যুগান্তর)