কেমন কাটালেন খালেদা জিয়া গুলশান অফিসে ৯২ দিন
- প্রকাশের সময় : ০৮:২৭:৩৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৮ এপ্রিল ২০১৫
- / ৫২৯ বার পঠিত
ঢাকা: ৫ জানুয়ারী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দুদিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারী রাতে রাজধানীর গুলশানের নিজ কার্যালয়ে কার্যত ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর ৫ জানুয়ারী বিকেলেও বের হবার চেষ্টা করে বাধা পান তিনি। সেইদিন থেকে দেখতে দেখতে কেটে গেল ৯২ দিন।
কখনো ‘অবরুদ্ধ’ আবার কখনো ‘স্বেচ্ছায়’ কার্যালয়ের দোতলার ছোট পরিসরে ৯২ দিন ধরে অবস্থান করেন তিনি। কার্যালয় থেকে বের হতে এখন আর কোনো বাধা না থাকলে নড়ছেন না। দলের সিনিয়র নেতাদের দাবি, আন্দোলনে স্বার্থেই এখানে অবস্থান করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে দলের অন্য একটি সূত্র বলছে, কার্যালয় থেকে বের হলে তাকে আর এখানে ফিরতে দেয়া হবে না। এজন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পরও কার্যালয় থেকে বের হননি তিনি।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে গত ১৭ ফেবব্রুয়ারী থেকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করেন দলটির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এবিষয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের স্বার্থেই এখানে অবস্থান করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন’।
এদিকে কার্যালয়ে অবস্থানের এ দীর্ঘ সময়ে নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। এমনকি প্রিয় সন্তানের মৃত্যু সংবাদও শোনতে হয়েছে। একদিকে আন্দোলন অন্যদিকে প্রিয় সন্তানের মৃত্যু। তারপরও কার্যালয় ত্যাগ করেননি তিনি। আন্দোলনের স্বার্থে কার্যালয়ে অবস্থান করায় প্রথমবারের মতো বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত, ২১ ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যেতে পারেন নি খালেদা জিয়া।
এছাড়া প্রথম থেকেই গুলশান কার্যালয়কে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা ঘটে।
কার্যালয়ে খালেদার অবস্থানের প্রথম দিন অর্থাৎ গত ৩ জানুয়ারী রাত থেকেই কার্যত ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়েন। এর পরদিন রাতই নিরাপত্তার নামে ১৩টি ইট, মাটি, বালু ভর্তি ট্রাক দিয়ে কার্যালয়ের দুই পাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। সীমিত করা হয় ওই এলাকায় জনসাধারণের উপস্থিতি ও যান চলাচল। সড়কের দুই মাথায় বসানো হয় দুটি তল্লাশি চৌকি। প্রস্তুত রাখা হয় পুলিশের ভ্যান, জলকামান ও সাঁজোয়া যান।
এর দুদিন পর অর্থাৎ ৫ জানুয়ারী বিকেলে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে কালো পতাকা নিয়ে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু কার্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে পুলিশের অবস্থানের কারণে বের হতে পারেননি তিনি। সেসময় তার সঙ্গে থাকা মহিলা দলের নেতা-কর্মীরা প্রধান ফটক খুলে দেয়ার দাবিতে যখন ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে এক পর্যায়ে সেখানে পিপার স্প্রে ছুড়ে পুলিশ। পিপার স্প্রের ঝাঁজে খালেদা জিয়া, তিন সাংবাদিকসহ প্রায় ১০ নেতা-কর্মী আহত হন। এ অবস্থায়ই গাড়ি থেকে বের হয়ে উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে বক্তব্য দেন বিএনপি প্রধান। সেদিনই অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দিয়ে কার্যালয়ে ফিরে যান তিনি।
এর আটদিন পর অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারী খালেদা জিয়া তার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমানের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলা এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ওই রাতেই ৪৮ ঘণ্টার হরতাল আহ্বান করে বিএনপি। ১৯ জানুয়ারী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৭৯তম জন্মবার্ষিকীতেও কার্যালয়েই ছিলেন খালেদা জিয়া। তার পক্ষে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দেন বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল।
খালেদা জিয়া কার্যালয়ে থাকা অবস্থায় তার জন্য সবচেয়ে বড় আঘাতটি ছিল ২৪ জানুয়ারী নিজের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদটি। সংবাদ শোনে শোকাহত হয়ে পড়েন তিনি। এদিন শোক জানাতে গুলশান কার্যালয়ের ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সেখানে ঢুকতে পারেননি তিনি। বাইরে কয়েক মিনিট অপেক্ষার পরও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
খালেদার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা না করতে পারার বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস সেদিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপারসনকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তবে দুই নেত্রীর সাক্ষাৎ না হওয়ার ঘটনায় দেশের বিশিষ্টজনরা বিএনপির সমালোচনা করেন।
এদিকে ২৭ জানুয়ারী মালয়েশিয়া থেকে আরাফাত রহমান কোকোর মৃতদেহ কার্যালয়ে এলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ছেলের মরদেহের সামনে এসেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। সন্তানের লাশ দেখে শুধু তাকিয়ে থেকেছেন আর অঝোরে কেঁদেছেন। কিন্তু প্রিয় সন্তানকে শেষ বিদায় জানিয়ে গুলশান কার্যালয়েই থেকে যান তিনি। এরপর ২৯ জানুয়ারী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
এর দুইদিন পর অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারী দিবাগত রাত ২টা ৪২ মিনিটে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। পরের দিন সকালে বিচ্ছিন্ন করা হয় ডিস, ইন্টারনেট ও টেলিফোন সংযোগ। মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্কও বন্ধ করা হয় তার কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায়। প্রায় ২০ ঘণ্টা পর কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলেও অন্য সেবাগুলো বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।
এদিকে ১ ফেব্রুয়ারী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পথে তার উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকে আটক করে পুলিশ। এর দুদিন পর ৩ ফেব্রুয়ারী হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার না করায় খালেদাকে গুলি করতে অস্ত্র হাতে তার কার্যালয়ের সামনে যান মুফিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। যিনি নিজেকে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের’ একজন কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। এ দিন কার্যালয়ের সামনে এসে হঠাৎ করেই তার কোমড় থেকে একটি অস্ত্র বের করেন এবং বলতে থাকেন, ‘সে (খালেদা জিয়া) কোথায়। হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করে নাই কেন? তাকে গুলি করে মারব!’
এদিকে নিজস্ব ব্যবস্থায় খালেদার নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে ৮ ফেব্রুয়ারী কার্যালয়টির নিরাপত্তা বাড়াতে এর চারপাশের দেয়ালের ওপরে লাগানো হয় কাঁটাতারের বেড়া।
১১ ফেব্রুয়ারী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার কার্যালয়ে অবস্থান করা অন্যদের জন্য আনা খাবার ফিরিয়ে দেয় পুলিশ। যদিও এর আগে খাবার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। এদিন বিকেলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত রবার্ট গিবসন বৈঠক করেন। দীর্ঘ ৩৯ দিন পর সেদিন কার্যালয়ের প্রান ফটক খোলা হয়েছিল।
১৭ ফেব্রুয়ারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। সেদিনই কার্যালয়ে আসেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এরপর থেকে তিনিও কার্যালয়েই অবস্থান করছেন। এদিকে কার্যালয়ে অবস্থান করার মধ্যেই দুই মামলায় ধার্যকৃত তারিখে হাজির না হওয়ায় ২৫ ফেব্রুয়ারী খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরে ১ মার্চ তার কার্যালয়ে তল্লাশি চালাতে আদালতের অনুমতি নিয়েছে পুলিশ। যদিও তল্লাশি চালানো হয়নি।
সর্বশেষ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাননি খালেদা জিয়া।
আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে নিজের পরামর্শকদের সঙ্গে নিজের কার্যালয়ে থেকেই কথা বলছেন এবং নেতা-কর্মীদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
গুলশানের ওই কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুম, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আলম ডিউ, নিরাপত্তা সমন্বয়কারী কর্নেল (অব.) আব্দুল মজিদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, শায়রুল কবির খান অবস্থান করছেন।
গত ৩ জানুয়ারী থেকে গুলশান কার্যালয়ে থাকা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা বলেন, ‘একটি বাড়ির ভেতরে অবরুদ্ধ অবস্থায় কেমন থাকা যায় তা আপনারাই ভালো জানেন। আমরা তাও নিচ তলায় নেমে, ছাদে উঠে হাঁটাচলা করি, কিন্তু চেয়ারপারসনের চলাফেরা দোতলাতেই সীমাবদ্ধ।’তিনি বলেন, ‘নামাজ পড়ে, পেপার পড়ে, নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে চেয়ারপারসনের সময় কাটে।’ সপ্তাহে একবার লন্ডনে অবস্থানরত বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়া কথা হয় বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় জামিন পেয়ে বেগম খালেদা জিয়া ৫ এপ্রিল রোববার আদালত থেকে সরাসরি নিজ বাসায় উঠেন।