নিউইয়র্ক ০৭:৪১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ইসলামিক ফাউন্ডেশন’র ফতোয়া ‘চেয়ারে বসে নামাজ’ নিয়ে তোলপাড় : ইফা’র ইউটার্ন

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১০:০৩:০৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুন ২০১৫
  • / ৯৩৫ বার পঠিত

ঢাকা: ‘চেয়ারে বসে নামাজ আদায় জায়েজ নয়’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা)-এর এমন এক ফতোয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে। গঠন করা হয়েছে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি ইফার গবেষণা বিভাগ থেকে পাঠানো সংস্থার প্যাড, সিল-স্বাক্ষরযুক্ত এই ফতোয়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। দেশের আলেম-ওলামাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে এর পরই ইউটার্ন নেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ২ জুন মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই ফতোয়া অস্বীকার করে এ সংস্থাটি। এতে মুসল্লিদের মাঝে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন দাবি করে ওই ফতোয়া তাদের নয়। এটি মুফতি আবদুল্লাহর ব্যক্তিগত মত।
ইফা’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জাতীয় পত্রিকায় মসজিদে চেয়ারে বসে নামাজ পড়া বা না পড়ার বিষয়ে যে ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে তা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বক্তব্য নয়। এটা হয়তো তার ব্যক্তিগত (মুফতি আবদুল্লাহ) মতামত। এ বিষয় ব্যাপক পর্যালোচনা ও সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য দেশের প্রখ্যাত ও বিজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণকে নিয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস-এর সভায় অনুমোদিত হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর অতি শিগগির তা জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীকে অবহিত করা হবে। কিন্তু ফতোয়া দিয়ে তা অস্বীকার করায় দেশের আলেম সমাজ এবং মুসল্লিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেন, এতে দেশের রাষ্ট্রায়াত্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্য এবং মর্যাদা ক্ষ্ন্নু হয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্যাড, সিল এবং গবেষণা বিভাগের মুফতি আবদুল্লাহর স্বাক্ষর থাকার পরও কি করে এটা অস্বীকার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করা হয়েছে। এর আগে হালাল খাবারের সনদ নিয়েও ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুরূপ এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। এছাড়া সংস্থার মহাপরিচালকের নানা দুর্নীতি-অনিয়মের খবর প্রায় সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমানের পদোন্নতিকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহলের আশীর্বাদের কারণে কোন প্রতিকার হচ্ছে না এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এদিকে সাম্প্রতিক দেয়া ফতোয়ার বিষয়ে বেশির ভাগ আলেম-ওলামা এবং মুসল্লিরা বলেন, কোরআন-হাদিস না পড়ে না বুঝে এ ধরনের ফতোয়া দেয়া ঠিক না।
ফাউন্ডেশনের ফতোয়ায় বলা হয়, নামাজের সবগুলো ফরজ রোকনের মধ্যে সিজদা করা তথা মাটিতে নাক, কপাল-মাথা স্পর্শ করে সর্বোচ্চ বিনয় ও দীনতা-হীনতার স্বাক্ষর রাখা, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। যে কারণে, একজন অসুস্থ রোগী যিনি দাঁড়িয়ে হোক বা বসে হোক উভয় অবস্থায় ইশারা ব্যতীত নামাজ আদায়ে সক্ষম নন। তার বেলায় বলা হয়েছে, বসে নামাজ আদায়ই তার পক্ষে উত্তম। অথচ বসে আদায়ের ক্ষেত্রে ১৩টি ফরযের অন্যতম কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরযটি বাদ পড়ে যাচ্ছে! তবুও সেটি উত্তম কেন? উত্তম হচ্ছে, যে সিজদা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আদায় করতে হয়, বসা অবস্থায় সেই মাটির অধিক কাছাকাছি অবস্থান হয়ে থাকে, সে জন্য। চেয়ারে বসা অবস্থায় কি মাথা ঠেকিয়ে আদায় করতে হয়, বসা অবস্থায় সেই মাটির অধিক কাছাকাছি অবস্থান হয়ে থাকে, সে জন্য। চেয়ারে বসা অবস্থায় কি মাথা-কপাল মাটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না?
চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ে এবাদতের প্রাণরূপ সর্বোচ্চ দীনতা-হীনতা প্রকাশের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হয় না। তাই চেয়ারে বসে নামাজ আদায় সঠিক নয়। মসজিদে চেয়ার ঢুকিয়ে তাতে আসন গ্রহণ করা, রাজাধিরাজ, শাহানশাহ আহকামুল-হাকেমীন এর শাহী দরবারের আদব পরিপন্থি বিধায় তা বৈধ নয় এবং তাতে বসে নামাজ আদায়ও বৈধ নয়। চেয়ারদ্বারা মসজিদে জামাতের কাতারের বিঘœ ঘটে। তাই মসজিদে চেয়ার ঢুকানো ঠিক নয়। জামাত-কাতার ব্যতীতও তাতে মসজিদের স্বাভাবিক ও মৌলিক সৌন্দর্য, সকলের সমান বিনয়ী অবস্থানের বিঘ্ন ঘটে। তাই মসজিদে চেয়ার ঢুকানো ঠিক নয়।
ফিক্হ-ফাতাওয়ার আকর গ্রন্থাদিতে একজন রোগীর ক্ষেত্রে চেয়ারে বসে নামাজ পড়ার কোন প্রসঙ্গ নেই। তবে আধুনিক সময়ে তথা বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ছাপানো কোন কোন উর্দু/আইব ফাতওয়া গ্রন্থে প্রসঙ্গটি স্থান পেলেও তাতে- প্রথমত: সমস্যারটির সমাধান সুস্পষ্টভাবে আসেনি। দ্বিতীয়ত: সংশ্লিষ্টরা, সমস্যার গভীরে যাননি এবং ব্যতিক্রম হিসেবে বা বিশেষ বা কারও ক্ষেত্রে আইনগত বৈধতা দানের সুযোগে, তার ভবিষ্যৎ মন্দ ফলাফল কি দাঁড়াবে (যা বর্তমানে মসজিদগুলোতে চেয়ারে সারি দেখে, বোঝা যাচ্ছে) তা তারা অনুমান করতে পারেননি। একান্ত গবেষণা-বিতর্কের খাতিরে যদি কারও বেলায় এমনটি বলা হয় যে, তিনি দাঁড়িয়েও নামাজ পড়তে পারেন না এবং চেয়ার ব্যতীত যে কোন প্রক্রিয়ায় বসেও পারেন না। তেমন কারও জন্য বৈধতার অনুমতির কথা মেনে নিলেও তা প্রযোজ্য হতে পারে বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত তথা মসজিদের বাইরের ক্ষেত্রে, মসজিদে নয়। কারণ, তার প্রয়োজনে মসজিদের পরিবেশ ব্যাহত করা যাবে না এবং তিনি রোগী তার পক্ষে জামাতে অংশগ্রহণও জরুরি নয়। তবে দেশের বেশির ভাগ আলেম-ওলামা বলেন এ ধরনের ফতোয়া দেয়ার এখতিয়ার ফাউন্ডেশনের নেই। তাছাড়া হঠাৎ এই ধরনের ফতোয়া জারির বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী, এই প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ শিক্ষক হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ দেশের অনেক শীর্ষ ওলামায়ে ক্বেরাম চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন। বাবুনগরীর খাদেম রাকিব আল হাসান এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, যারা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, অথবা কোমর বা পায়ে ব্যথার কারণে দাঁড়াতে পারেন না মসজিদের ফ্লোরে বসার মতো শক্তি যাদের নেই, তারাই চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন। সুতরাং কোরআন-হাদিস সম্পর্কে যাদের সীমিত জ্ঞান তারাই এ ধরেনর ফতোয়া দিতে পারেন। রাকিব হাসান বলেন, আমার দেখা এবং জানা মতে, দেশের অনেক বড় বড় মুফতিরা চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন। এটা নাজায়েজ হলে নিশ্চয় তারা সেটা করতেন না।
এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় ফতোয়া বোর্ডের মুফতিরা এক বিবৃতিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় সংক্রান্ত মনগড়া ভুল ফতোয়ার তীব্র নিন্দা জানান। তারা বলেন- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফতোয়া মূলত: ঈমানদারদের আল্লাহ্র মসজিদ ও ইবাদত থেকে ফিরিয়ে রাখারই সুগভীর চক্রান্তের অংশ। ইহা মূলত উলামাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিরই অংশ কিনা তাও সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে। ইফার ফতোয়ায় যে সমস্ত দলিল কোড করা হয়েছে তার কোনটিতেই চেয়ারে নামাজ পড়ার নিষেধাজ্ঞা নেই। অথচ কাদের খুশি করার জন্য ইফার মুফতি এহেন মনগড়া ফতোয়া দিতে সাহস করলেন। তা আমাদের বুঝে আসে না। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি শাইখ আবদুল মোমিন, সম্মিলিত উলামা-মাশায়েখ পরিষদের সভাপতি মাওলানা মুহীউদ্দীন খান, খেলাফত আন্দোলনের আমীর হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হজুর, মাওলানা মোহাম্মাদ ইসহাক, মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী প্রমুখ।(দৈনিক মানবজমিন)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

ইসলামিক ফাউন্ডেশন’র ফতোয়া ‘চেয়ারে বসে নামাজ’ নিয়ে তোলপাড় : ইফা’র ইউটার্ন

প্রকাশের সময় : ১০:০৩:০৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ জুন ২০১৫

ঢাকা: ‘চেয়ারে বসে নামাজ আদায় জায়েজ নয়’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা)-এর এমন এক ফতোয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে। গঠন করা হয়েছে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি। সম্প্রতি ইফার গবেষণা বিভাগ থেকে পাঠানো সংস্থার প্যাড, সিল-স্বাক্ষরযুক্ত এই ফতোয়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। দেশের আলেম-ওলামাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে এর পরই ইউটার্ন নেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ২ জুন মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই ফতোয়া অস্বীকার করে এ সংস্থাটি। এতে মুসল্লিদের মাঝে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন দাবি করে ওই ফতোয়া তাদের নয়। এটি মুফতি আবদুল্লাহর ব্যক্তিগত মত।
ইফা’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জাতীয় পত্রিকায় মসজিদে চেয়ারে বসে নামাজ পড়া বা না পড়ার বিষয়ে যে ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে তা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বক্তব্য নয়। এটা হয়তো তার ব্যক্তিগত (মুফতি আবদুল্লাহ) মতামত। এ বিষয় ব্যাপক পর্যালোচনা ও সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য দেশের প্রখ্যাত ও বিজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুফাসসির ও মুহাদ্দিসগণকে নিয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস-এর সভায় অনুমোদিত হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর অতি শিগগির তা জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে দেশবাসীকে অবহিত করা হবে। কিন্তু ফতোয়া দিয়ে তা অস্বীকার করায় দেশের আলেম সমাজ এবং মুসল্লিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেন, এতে দেশের রাষ্ট্রায়াত্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্য এবং মর্যাদা ক্ষ্ন্নু হয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্যাড, সিল এবং গবেষণা বিভাগের মুফতি আবদুল্লাহর স্বাক্ষর থাকার পরও কি করে এটা অস্বীকার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করা হয়েছে। এর আগে হালাল খাবারের সনদ নিয়েও ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুরূপ এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। এছাড়া সংস্থার মহাপরিচালকের নানা দুর্নীতি-অনিয়মের খবর প্রায় সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমানের পদোন্নতিকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহলের আশীর্বাদের কারণে কোন প্রতিকার হচ্ছে না এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এদিকে সাম্প্রতিক দেয়া ফতোয়ার বিষয়ে বেশির ভাগ আলেম-ওলামা এবং মুসল্লিরা বলেন, কোরআন-হাদিস না পড়ে না বুঝে এ ধরনের ফতোয়া দেয়া ঠিক না।
ফাউন্ডেশনের ফতোয়ায় বলা হয়, নামাজের সবগুলো ফরজ রোকনের মধ্যে সিজদা করা তথা মাটিতে নাক, কপাল-মাথা স্পর্শ করে সর্বোচ্চ বিনয় ও দীনতা-হীনতার স্বাক্ষর রাখা, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। যে কারণে, একজন অসুস্থ রোগী যিনি দাঁড়িয়ে হোক বা বসে হোক উভয় অবস্থায় ইশারা ব্যতীত নামাজ আদায়ে সক্ষম নন। তার বেলায় বলা হয়েছে, বসে নামাজ আদায়ই তার পক্ষে উত্তম। অথচ বসে আদায়ের ক্ষেত্রে ১৩টি ফরযের অন্যতম কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরযটি বাদ পড়ে যাচ্ছে! তবুও সেটি উত্তম কেন? উত্তম হচ্ছে, যে সিজদা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আদায় করতে হয়, বসা অবস্থায় সেই মাটির অধিক কাছাকাছি অবস্থান হয়ে থাকে, সে জন্য। চেয়ারে বসা অবস্থায় কি মাথা ঠেকিয়ে আদায় করতে হয়, বসা অবস্থায় সেই মাটির অধিক কাছাকাছি অবস্থান হয়ে থাকে, সে জন্য। চেয়ারে বসা অবস্থায় কি মাথা-কপাল মাটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না?
চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ে এবাদতের প্রাণরূপ সর্বোচ্চ দীনতা-হীনতা প্রকাশের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হয় না। তাই চেয়ারে বসে নামাজ আদায় সঠিক নয়। মসজিদে চেয়ার ঢুকিয়ে তাতে আসন গ্রহণ করা, রাজাধিরাজ, শাহানশাহ আহকামুল-হাকেমীন এর শাহী দরবারের আদব পরিপন্থি বিধায় তা বৈধ নয় এবং তাতে বসে নামাজ আদায়ও বৈধ নয়। চেয়ারদ্বারা মসজিদে জামাতের কাতারের বিঘœ ঘটে। তাই মসজিদে চেয়ার ঢুকানো ঠিক নয়। জামাত-কাতার ব্যতীতও তাতে মসজিদের স্বাভাবিক ও মৌলিক সৌন্দর্য, সকলের সমান বিনয়ী অবস্থানের বিঘ্ন ঘটে। তাই মসজিদে চেয়ার ঢুকানো ঠিক নয়।
ফিক্হ-ফাতাওয়ার আকর গ্রন্থাদিতে একজন রোগীর ক্ষেত্রে চেয়ারে বসে নামাজ পড়ার কোন প্রসঙ্গ নেই। তবে আধুনিক সময়ে তথা বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ছাপানো কোন কোন উর্দু/আইব ফাতওয়া গ্রন্থে প্রসঙ্গটি স্থান পেলেও তাতে- প্রথমত: সমস্যারটির সমাধান সুস্পষ্টভাবে আসেনি। দ্বিতীয়ত: সংশ্লিষ্টরা, সমস্যার গভীরে যাননি এবং ব্যতিক্রম হিসেবে বা বিশেষ বা কারও ক্ষেত্রে আইনগত বৈধতা দানের সুযোগে, তার ভবিষ্যৎ মন্দ ফলাফল কি দাঁড়াবে (যা বর্তমানে মসজিদগুলোতে চেয়ারে সারি দেখে, বোঝা যাচ্ছে) তা তারা অনুমান করতে পারেননি। একান্ত গবেষণা-বিতর্কের খাতিরে যদি কারও বেলায় এমনটি বলা হয় যে, তিনি দাঁড়িয়েও নামাজ পড়তে পারেন না এবং চেয়ার ব্যতীত যে কোন প্রক্রিয়ায় বসেও পারেন না। তেমন কারও জন্য বৈধতার অনুমতির কথা মেনে নিলেও তা প্রযোজ্য হতে পারে বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত তথা মসজিদের বাইরের ক্ষেত্রে, মসজিদে নয়। কারণ, তার প্রয়োজনে মসজিদের পরিবেশ ব্যাহত করা যাবে না এবং তিনি রোগী তার পক্ষে জামাতে অংশগ্রহণও জরুরি নয়। তবে দেশের বেশির ভাগ আলেম-ওলামা বলেন এ ধরনের ফতোয়া দেয়ার এখতিয়ার ফাউন্ডেশনের নেই। তাছাড়া হঠাৎ এই ধরনের ফতোয়া জারির বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফী, এই প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ শিক্ষক হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ দেশের অনেক শীর্ষ ওলামায়ে ক্বেরাম চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন। বাবুনগরীর খাদেম রাকিব আল হাসান এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, যারা বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, অথবা কোমর বা পায়ে ব্যথার কারণে দাঁড়াতে পারেন না মসজিদের ফ্লোরে বসার মতো শক্তি যাদের নেই, তারাই চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন। সুতরাং কোরআন-হাদিস সম্পর্কে যাদের সীমিত জ্ঞান তারাই এ ধরেনর ফতোয়া দিতে পারেন। রাকিব হাসান বলেন, আমার দেখা এবং জানা মতে, দেশের অনেক বড় বড় মুফতিরা চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন। এটা নাজায়েজ হলে নিশ্চয় তারা সেটা করতেন না।
এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় ফতোয়া বোর্ডের মুফতিরা এক বিবৃতিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে চেয়ারে বসে নামাজ আদায় সংক্রান্ত মনগড়া ভুল ফতোয়ার তীব্র নিন্দা জানান। তারা বলেন- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফতোয়া মূলত: ঈমানদারদের আল্লাহ্র মসজিদ ও ইবাদত থেকে ফিরিয়ে রাখারই সুগভীর চক্রান্তের অংশ। ইহা মূলত উলামাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিরই অংশ কিনা তাও সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে। ইফার ফতোয়ায় যে সমস্ত দলিল কোড করা হয়েছে তার কোনটিতেই চেয়ারে নামাজ পড়ার নিষেধাজ্ঞা নেই। অথচ কাদের খুশি করার জন্য ইফার মুফতি এহেন মনগড়া ফতোয়া দিতে সাহস করলেন। তা আমাদের বুঝে আসে না। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি শাইখ আবদুল মোমিন, সম্মিলিত উলামা-মাশায়েখ পরিষদের সভাপতি মাওলানা মুহীউদ্দীন খান, খেলাফত আন্দোলনের আমীর হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হজুর, মাওলানা মোহাম্মাদ ইসহাক, মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী প্রমুখ।(দৈনিক মানবজমিন)