নিউইয়র্ক ০৮:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল ট্রাইব্যুনাল জাতীয় ট্রাইব্যুনালও নয়-ষড়যন্ত্র

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ১১:৫০:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪
  • / ১৩৬৮ বার পঠিত

নিউইয়র্ক: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার আইনজীবী ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ সুন্দর দেশ। কিন্তু দেশটির সব কিছুর মধ্যেই রাজনীতি। যে কারণে দেশটি এগুতে পারছে না, বরং যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। তবে সে বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানের বিচার। কিন্তু বাংলাদেশে যে ‘আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে তা বিতর্কিত। এখানে ন্যায়বিচার ও যথাযথ আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনের প্রক্রিয়া অনুসরণের কোনো স্থান নেই। সরকার যতই দাবী কারুক না কেন,  ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট বিধিতে যে ত্রুটি রয়েছে তা সংশোধন না করার কারণে এটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তো নয়ই, জাতীয় ট্রাইব্যুনালও নয়। বাংলাদেশে বিচারের নামে অবিচার হচ্ছে। কোন দায়বদ্ধতা নেই। ট্রাইব্যুনালের সবকিছুই ওয়ান সাইটেড। এই টাইব্যুনাল একটি ষড়যন্ত্র। এব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকার কোনো উপায় নেই।
HRDB Seminar (6)সিটির জ্যামাইকাস্থ ইর্য়ক কলেজ মিলনায়তনে গত ৬ ডিসেম্বর শনিবার অপরাহ্নে ‘বাংলাদেশে বিচার বিভাগীয় ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড’ শীর্ষক এক সেমিনার মূখ্য আলোচক হিসেবে বক্তৃতাকালে ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান উপরোক্ত কথা বলেন। হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফর বাংলাদেশ (এইচআরডিবি’র) এই সেমিনারের আয়োজন করে। বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা ও এইচআরডিবি’র সভাপতি মাহতাবউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অতিথি আলোচক ছিলেন কানাডা ডউসন কলেজের অধ্যাপক ড.আবিদ বাহার, মুলধারার নেতা ড.আব্দুল হাফিজ জামিল, নিউইর্য়ক মজলিশে শুরা’র লিডার শাইখ আহমেদ ও ইউনিভাসির্টি অফ নর্থ ক্যারোলিনার অধ্যাপক ড. নকিবুর রহমান।
সেমিনারের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন মোহাম্মদ তারেক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন এইচআরডিবি’র সহ সভাপতি মীর মাসুম আলী। আরো বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নিজামউদ্দীন, কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট ডা. জুন্নুন চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু, এর্টনী আব্দুল আজিজ, মুলধারার নেত্রী শাহানা মাসুম, নতুন প্রজন্মের তালহা শাহাজ ও উমামা মাসুম। সেমিনারটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন অধ্যাপক জাহিদ বিন জামির ও লিমা।
HRDB Seminar (37)সেমিনারে বক্তৃতাকালে ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া এবং চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ২০১০ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো ঢাকায় গেলে আমি লাল গালিচা সংবর্ধনা পাই। সম্মান ছিলো খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। আমাকে বাংলাদেশ সরকারের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়।
ব্রিটিশ আইনজীবি টবি বলেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল-এর বিচারকের স্কাইপী সংলাপ প্রকাশের ঘটনাই প্রমাণ করে এই ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন ছিল না। এটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তো নয়ই, জাতীয় ট্রাইব্যুনালও নয়। ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন ও সাক্ষ্য আইনকে গ্রহণ করা হয়নি এবং আন্তর্জাতিক আইনের ধারে কাছেও যায়নি। ফলে ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার যে দাবী সরকার করে আসছে তা রাখা তো দূরের কথা, জাতীয় মানও বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে তার আট বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, বসনিয়ার ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ছিল না, সেটি তাদের ন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ছিল। কিন্তু বসনিয়া সরকার বিচার পরিচালনায় আন্তর্জাতিক আইনের সহযোগিতা নিয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক বিচারক, আন্তর্জাতিক প্রসিকিউটর ও আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা ছিল বলে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ‘সমগ্র বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত’ সৃষ্টি করতে সকল আন্তর্জাতিক আইন অগ্রাহ্য করেছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকেও কেয়ার করছে না, সরকারের ‘ডোন্ট কেয়ায়’-এর উত্তর আমার কাছে নেই।
টবি ক্যাডম্যান বলেন, যেকোন সরকারের সমালোচনাই গণতন্ত্র। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বলেছেন, আন্তর্জাতিক আপরাধ টাইব্যুনালের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে গঠিত ট্রাইব্যুনালে আর্ন্তাতিক নিয়ম-নীতি মানা হচ্ছে না।
সেমিনারে অধ্যাপক ড.আবিদ বাহার ‘শেখ হাসিনার সরকারকে একটি অবৈধ সরকার‘ আখ্যায়িত করে বলেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধ পরবর্তী তালিকায় যারা যুদ্ধপরাধী ছিলেন তাদের নাম শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেই। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবই বড় রাজাকার’। ৭১-এর তিনি ও তার পরিবারকে নিরাপদে রাখতে ভুট্টোর সহযোগিতা চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন কারা কারা রাজাকার, তাই শেখ মুজিব স্বাধীনতার পর রাজাকারদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
তিনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শেখ মুজিব ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাড়া করা মাস্তান। কলকাতার ইসলামিক কলেজের মাস্তানদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবকে ব্যবহার করা হয়। সেই মুজিবের আদর্শই বহন করছে আজকের ছাত্রলীগ। তিনি বলেন, আমরা সবাই আল্লাহকে বিশ্বাস করি আর আওয়ামী লীগ মুজিব ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করে না।
ড. আবিদ বাহার বলেন, শেখ মুজিব বিরোধীদল চাননি বলেই বাকশাল কায়েম করেছিলেন। হাসিনা সরকার শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, বিএনপিসহ বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছে। এই সরকার ‘দ্বিতীয় বাকশাল সরকার’ হিসেবে দেশ পরিচালনা করছে। রাজাকারদের বিচার করতে হলে আগে শেখ হাসিনার মন্ত্রী বেয়াইকে ধরতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সততার রাজনীতি নেই। তিনি বলেন, সরকার প্রধানের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন রক্ষা করা। অথচ শেখ হাসিনা সরকার মানুষ হত্যা করে জাতির কাছে ‘ফ্যাসিস্ট আর কিলার সরকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। মন্ত্রীরা ইসলামী ধর্ম-কর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করছেন। এই সরকারের পিছনে রয়েছে ভারত। আর ভারত হাসিনা সরকারকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে কলোনী বানাতে চায়। এসবে বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের নিজেদেরকেই রক্ষা করতে হবে’।
ড. আব্দুল হাফিজ জামিল, আমাদের সমস্যা ও ইস্যুগুলোর পাশাপাশি সমাধানও জানতে হবে। যেকোন সমস্যার সমাধান আমাদের হাতেই। আমি নিজে ফ্রিডম চাইলে, অন্যকেও ফ্রিডম দিতে হবে। তিনি বাংলাদেশ ও মিশরের সমস্যাকে একই সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
ড. শেখ আহমদ বলেন, আমরা কোন ক্রিমিনালকে সমর্থন করতে এই সেমিনারে আসিনি। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ‘মাইনরিটি আর কোয়ালিটি’ সম্পন্ন রাজনৈতিক দল আর ইসলামের সঠিক পথে চলছে বলেই আওয়ামী লীগ সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তাই এই সরকারের কাছে সুবিচার পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আপনারা একা নন, আমরা সবাই আপনাদের সাথে রয়েছি।
অধ্যাপক ড. নকিবুর রহমান বলেন, আমার বাবা মতিউর রহমান নিজামী কাউকে হত্যা করেননি। কাশিম উদ্দিনের হত্যার জন্য বাবা নয় পাকিস্তানীরাই দায়ী। কাশিম উদ্দিনের পরিবারের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা রয়েছে, তার ছেলে শিবলীর সাথে আমার কথা হয়েছে। শিবলী বলেছেন, ২০০১ সালের আগে আমি বা আমার পরিবার কোন দিন মওলানা নিজামীর নাম শুনিনি, তিনি (নিজামী) মন্ত্রী হওয়ার পর আমরা চিনেছি। শিবলীরা ১৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং বর্তমানে ডালাসে বসবাস করছেন। বাবার বিরুদ্ধে দিত্বীয় স্বাক্ষী নান্নুকেও মিথ্যা স্বাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে যাদেরকে স্বাক্ষী হিসেবে আনা হচ্ছে তাদের সাথে মামলায় অভিযুক্তদের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামের প্রতি আমাদের দরদ নেই, বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের দাবী।
HRDB Seminar (17)অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ফেরাউন আর মীর জাফরের প্রেতাত্বা ভর করেছে। শেখ হাসিনা সরকার ভারতের গোলামে পরিণত হয়েছে। যার জন্য সরকার ৪০ বছরের মিমাংসিত ইস্যু নতুন করে সামনে এসে জাতিকে বিভক্ত করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে হঠানো যাবে না, লগি-বৈঠা দিয়ে ইসলামিক আন্দোলনও হঠানো যাবে না।
ড. নিজামউদ্দীন বলেন, নূন্যতম মানবাধিকার পাওয়া অধিকার সকল নাগরিকেরই রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অধিকার না দিয়ে জুডিশিয়াল কিলিং চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী আব্দুল কাদের মোল্লার মতো কৃতিছাত্রকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান।
ডা. জুন্নুন চৌধুরী বলেন, একাত্তুরের পর বাংলাদেশে কোন স্বাধীনতা বিরোধী ছিলো না। জামায়াতও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কথা বলেনি। পৃথিবী চলছে এক দিকে আর বাংলাদেশ চলছে উল্টো পথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বাংলাদেশে নাটক চলছে। শাহবাগ মঞ্চ আরেকটা নাটক ছিলো। ৭১-এর ১৯ বছর বয়সী কাদের মোল্লার পক্ষে মানুষ খুন, নারী ধর্ষন সম্ভব নয়। আর কামরুজ্জামানকে ফাঁসি দেয়া হলে পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।
HRDB Seminar (19)জিল্লুর রহমান জিল্লু বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে সুবিচার কামনা বৃথা। তাই কার ঈশারায় তারা এসব করছে, এই সরকারের পিছনে কে রয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। তিনি রাজপথে প্রতিবাদী হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জবাব দেয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
এর্টনী আব্দুল আজিজ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে যা করছে তা সবই নাটক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার জাতিকে বিভক্ত করছে। বিচার হতে হলে নিরপক্ষে হতে হবে, নিরপেক্ষ বিচার, নিরপেক্ষ আদালত লাগবে। দলীয় বিচারক আর দলীয় স্বাক্ষী দিয়ে নিরপেক্ষ বিচার হয় না।
শাহানা মাসুম বলেন, শুধু বাংলাদেশের মানবাধিকার নয় আজ আমাদের বিশ্ব মানবাধিকার বিষয়েও সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশে যাকে তাকে রাজাকার বলা ‘বিভ্রান্তিকর’। আমরা নিরপেক্ষ বিচার চাই।
প্রতিকূল পবিবেশের মধ্যে কয়েক শত প্রবাসী নর-নারী ও নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা এই সেমিনারে যোগ দেন।

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল ট্রাইব্যুনাল জাতীয় ট্রাইব্যুনালও নয়-ষড়যন্ত্র

প্রকাশের সময় : ১১:৫০:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪

নিউইয়র্ক: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার আইনজীবী ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ সুন্দর দেশ। কিন্তু দেশটির সব কিছুর মধ্যেই রাজনীতি। যে কারণে দেশটি এগুতে পারছে না, বরং যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। তবে সে বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানের বিচার। কিন্তু বাংলাদেশে যে ‘আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে তা বিতর্কিত। এখানে ন্যায়বিচার ও যথাযথ আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনের প্রক্রিয়া অনুসরণের কোনো স্থান নেই। সরকার যতই দাবী কারুক না কেন,  ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট বিধিতে যে ত্রুটি রয়েছে তা সংশোধন না করার কারণে এটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তো নয়ই, জাতীয় ট্রাইব্যুনালও নয়। বাংলাদেশে বিচারের নামে অবিচার হচ্ছে। কোন দায়বদ্ধতা নেই। ট্রাইব্যুনালের সবকিছুই ওয়ান সাইটেড। এই টাইব্যুনাল একটি ষড়যন্ত্র। এব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকার কোনো উপায় নেই।
HRDB Seminar (6)সিটির জ্যামাইকাস্থ ইর্য়ক কলেজ মিলনায়তনে গত ৬ ডিসেম্বর শনিবার অপরাহ্নে ‘বাংলাদেশে বিচার বিভাগীয় ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড’ শীর্ষক এক সেমিনার মূখ্য আলোচক হিসেবে বক্তৃতাকালে ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান উপরোক্ত কথা বলেন। হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফর বাংলাদেশ (এইচআরডিবি’র) এই সেমিনারের আয়োজন করে। বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা ও এইচআরডিবি’র সভাপতি মাহতাবউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অতিথি আলোচক ছিলেন কানাডা ডউসন কলেজের অধ্যাপক ড.আবিদ বাহার, মুলধারার নেতা ড.আব্দুল হাফিজ জামিল, নিউইর্য়ক মজলিশে শুরা’র লিডার শাইখ আহমেদ ও ইউনিভাসির্টি অফ নর্থ ক্যারোলিনার অধ্যাপক ড. নকিবুর রহমান।
সেমিনারের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন মোহাম্মদ তারেক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন এইচআরডিবি’র সহ সভাপতি মীর মাসুম আলী। আরো বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, সিটি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নিজামউদ্দীন, কমিউনিটি এক্টিভিষ্ট ডা. জুন্নুন চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান জিল্লু, এর্টনী আব্দুল আজিজ, মুলধারার নেত্রী শাহানা মাসুম, নতুন প্রজন্মের তালহা শাহাজ ও উমামা মাসুম। সেমিনারটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন অধ্যাপক জাহিদ বিন জামির ও লিমা।
HRDB Seminar (37)সেমিনারে বক্তৃতাকালে ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া এবং চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ২০১০ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো ঢাকায় গেলে আমি লাল গালিচা সংবর্ধনা পাই। সম্মান ছিলো খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। আমাকে বাংলাদেশ সরকারের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়।
ব্রিটিশ আইনজীবি টবি বলেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল-এর বিচারকের স্কাইপী সংলাপ প্রকাশের ঘটনাই প্রমাণ করে এই ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন ছিল না। এটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তো নয়ই, জাতীয় ট্রাইব্যুনালও নয়। ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন ও সাক্ষ্য আইনকে গ্রহণ করা হয়নি এবং আন্তর্জাতিক আইনের ধারে কাছেও যায়নি। ফলে ট্রাইব্যুনালের বিচারে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার যে দাবী সরকার করে আসছে তা রাখা তো দূরের কথা, জাতীয় মানও বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ব্যারিষ্টার টবি ক্যাডম্যান বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে তার আট বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, বসনিয়ার ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল ছিল না, সেটি তাদের ন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ছিল। কিন্তু বসনিয়া সরকার বিচার পরিচালনায় আন্তর্জাতিক আইনের সহযোগিতা নিয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক বিচারক, আন্তর্জাতিক প্রসিকিউটর ও আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা ছিল বলে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ‘সমগ্র বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত’ সৃষ্টি করতে সকল আন্তর্জাতিক আইন অগ্রাহ্য করেছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকেও কেয়ার করছে না, সরকারের ‘ডোন্ট কেয়ায়’-এর উত্তর আমার কাছে নেই।
টবি ক্যাডম্যান বলেন, যেকোন সরকারের সমালোচনাই গণতন্ত্র। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বলেছেন, আন্তর্জাতিক আপরাধ টাইব্যুনালের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে গঠিত ট্রাইব্যুনালে আর্ন্তাতিক নিয়ম-নীতি মানা হচ্ছে না।
সেমিনারে অধ্যাপক ড.আবিদ বাহার ‘শেখ হাসিনার সরকারকে একটি অবৈধ সরকার‘ আখ্যায়িত করে বলেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধ পরবর্তী তালিকায় যারা যুদ্ধপরাধী ছিলেন তাদের নাম শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেই। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবই বড় রাজাকার’। ৭১-এর তিনি ও তার পরিবারকে নিরাপদে রাখতে ভুট্টোর সহযোগিতা চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন কারা কারা রাজাকার, তাই শেখ মুজিব স্বাধীনতার পর রাজাকারদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
তিনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শেখ মুজিব ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাড়া করা মাস্তান। কলকাতার ইসলামিক কলেজের মাস্তানদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবকে ব্যবহার করা হয়। সেই মুজিবের আদর্শই বহন করছে আজকের ছাত্রলীগ। তিনি বলেন, আমরা সবাই আল্লাহকে বিশ্বাস করি আর আওয়ামী লীগ মুজিব ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করে না।
ড. আবিদ বাহার বলেন, শেখ মুজিব বিরোধীদল চাননি বলেই বাকশাল কায়েম করেছিলেন। হাসিনা সরকার শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, বিএনপিসহ বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছে। এই সরকার ‘দ্বিতীয় বাকশাল সরকার’ হিসেবে দেশ পরিচালনা করছে। রাজাকারদের বিচার করতে হলে আগে শেখ হাসিনার মন্ত্রী বেয়াইকে ধরতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সততার রাজনীতি নেই। তিনি বলেন, সরকার প্রধানের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন রক্ষা করা। অথচ শেখ হাসিনা সরকার মানুষ হত্যা করে জাতির কাছে ‘ফ্যাসিস্ট আর কিলার সরকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। মন্ত্রীরা ইসলামী ধর্ম-কর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করছেন। এই সরকারের পিছনে রয়েছে ভারত। আর ভারত হাসিনা সরকারকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে কলোনী বানাতে চায়। এসবে বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের নিজেদেরকেই রক্ষা করতে হবে’।
ড. আব্দুল হাফিজ জামিল, আমাদের সমস্যা ও ইস্যুগুলোর পাশাপাশি সমাধানও জানতে হবে। যেকোন সমস্যার সমাধান আমাদের হাতেই। আমি নিজে ফ্রিডম চাইলে, অন্যকেও ফ্রিডম দিতে হবে। তিনি বাংলাদেশ ও মিশরের সমস্যাকে একই সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
ড. শেখ আহমদ বলেন, আমরা কোন ক্রিমিনালকে সমর্থন করতে এই সেমিনারে আসিনি। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ‘মাইনরিটি আর কোয়ালিটি’ সম্পন্ন রাজনৈতিক দল আর ইসলামের সঠিক পথে চলছে বলেই আওয়ামী লীগ সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তাই এই সরকারের কাছে সুবিচার পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আপনারা একা নন, আমরা সবাই আপনাদের সাথে রয়েছি।
অধ্যাপক ড. নকিবুর রহমান বলেন, আমার বাবা মতিউর রহমান নিজামী কাউকে হত্যা করেননি। কাশিম উদ্দিনের হত্যার জন্য বাবা নয় পাকিস্তানীরাই দায়ী। কাশিম উদ্দিনের পরিবারের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা রয়েছে, তার ছেলে শিবলীর সাথে আমার কথা হয়েছে। শিবলী বলেছেন, ২০০১ সালের আগে আমি বা আমার পরিবার কোন দিন মওলানা নিজামীর নাম শুনিনি, তিনি (নিজামী) মন্ত্রী হওয়ার পর আমরা চিনেছি। শিবলীরা ১৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং বর্তমানে ডালাসে বসবাস করছেন। বাবার বিরুদ্ধে দিত্বীয় স্বাক্ষী নান্নুকেও মিথ্যা স্বাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে যাদেরকে স্বাক্ষী হিসেবে আনা হচ্ছে তাদের সাথে মামলায় অভিযুক্তদের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামের প্রতি আমাদের দরদ নেই, বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই আমাদের দাবী।
HRDB Seminar (17)অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ফেরাউন আর মীর জাফরের প্রেতাত্বা ভর করেছে। শেখ হাসিনা সরকার ভারতের গোলামে পরিণত হয়েছে। যার জন্য সরকার ৪০ বছরের মিমাংসিত ইস্যু নতুন করে সামনে এসে জাতিকে বিভক্ত করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে হঠানো যাবে না, লগি-বৈঠা দিয়ে ইসলামিক আন্দোলনও হঠানো যাবে না।
ড. নিজামউদ্দীন বলেন, নূন্যতম মানবাধিকার পাওয়া অধিকার সকল নাগরিকেরই রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অধিকার না দিয়ে জুডিশিয়াল কিলিং চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী আব্দুল কাদের মোল্লার মতো কৃতিছাত্রকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান।
ডা. জুন্নুন চৌধুরী বলেন, একাত্তুরের পর বাংলাদেশে কোন স্বাধীনতা বিরোধী ছিলো না। জামায়াতও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কথা বলেনি। পৃথিবী চলছে এক দিকে আর বাংলাদেশ চলছে উল্টো পথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বাংলাদেশে নাটক চলছে। শাহবাগ মঞ্চ আরেকটা নাটক ছিলো। ৭১-এর ১৯ বছর বয়সী কাদের মোল্লার পক্ষে মানুষ খুন, নারী ধর্ষন সম্ভব নয়। আর কামরুজ্জামানকে ফাঁসি দেয়া হলে পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন।
HRDB Seminar (19)জিল্লুর রহমান জিল্লু বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে সুবিচার কামনা বৃথা। তাই কার ঈশারায় তারা এসব করছে, এই সরকারের পিছনে কে রয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। তিনি রাজপথে প্রতিবাদী হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জবাব দেয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
এর্টনী আব্দুল আজিজ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে যা করছে তা সবই নাটক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার জাতিকে বিভক্ত করছে। বিচার হতে হলে নিরপক্ষে হতে হবে, নিরপেক্ষ বিচার, নিরপেক্ষ আদালত লাগবে। দলীয় বিচারক আর দলীয় স্বাক্ষী দিয়ে নিরপেক্ষ বিচার হয় না।
শাহানা মাসুম বলেন, শুধু বাংলাদেশের মানবাধিকার নয় আজ আমাদের বিশ্ব মানবাধিকার বিষয়েও সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশে যাকে তাকে রাজাকার বলা ‘বিভ্রান্তিকর’। আমরা নিরপেক্ষ বিচার চাই।
প্রতিকূল পবিবেশের মধ্যে কয়েক শত প্রবাসী নর-নারী ও নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা এই সেমিনারে যোগ দেন।