নিউইয়র্ক ১০:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

অবশেষে কারাগারে লতিফ সিদ্দিকী

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৯:০৯:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০১৪
  • / ১২২৭ বার পঠিত

ঢাকা: নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে লতিফ সিদ্দিকীর ঠাঁই হল কারাগারেই। মন্ত্রিসভা ও ক্ষমতাসীন দল থেকে অপসারিত সাবেক এই মন্ত্রী ধর্মীয় উস্কানির মামলার পলাতক আসামি ছিলেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরার একদিন পর মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) দুপুরে তিনি ধানমন্ডি থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এরপর পুলিশ তাকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে হাজির করলে বিচারক আতিকুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। লতিফ সিদ্দিকী তার পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেননি। পাশাপাশি জামিনের জন্য কোনো আবেদনও করেননি। এদিকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের দাবিতে পূর্বঘোষিত হরতালের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট। তারা সরকারকে ধন্যবাদও জানিয়েছে।
লতিফ সিদ্দিকীকে আদালতে আনা হচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিএমএম আদালতের মূল ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন আইনজীবী ও সাধারণ মানুষ। লতিফ সিদ্দিকীকে বহনকারী প্রিজনভ্যান উপস্থিত হওয়া মাত্রই- ‘নাস্তিকের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘ফাঁসি ফাঁসি চাই, মুরতাদের ফাঁসি চাই’ … ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা আদালত প্রাঙ্গণ। ওই সময় অনেকের হাতে ছিল জুতা ও ঝাড়ু। আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার সময়েও একই ধরনের ক্ষুব্ধ ৎুপতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন সাধারণ জনগণ। তবে প্রিজনভ্যান থেকে এজলাসে আনা-নেয়ার পথে তিনি ছিলেন বেশ স্বাভাবিক। ভাবলেশহীনভাবে ওঠানামা করেছেন প্রিজনভ্যানে।
আদালত থেকে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে পৌঁছানোর পর নতুন নাটকের জন্ম দেন টাঙ্গাইলে বিতর্কিত এই সংসদ সদস্য। প্রিজনভ্যান থেকে নেমে পকেট গেট (ছোট ফটক) দিয়ে কারাগারে প্রবেশে অসম্মতি জানালে বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারা কর্তৃপক্ষকে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, তাকে ভেতরে নিতে হলে প্রধান ফটক খুলতে হবে। ওই সময় লতিফ সিদ্দিকী উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘আমি এখনও এমপি। গত ৩০ বছর আমি পকেট গেট দিয়ে ইন বা আউট হইনি। আজও হবো না।’ আইন-শৃংখলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী তার অবস্থানে অনড় থাকেন। প্রায় ১৭ মিনিট এ অবস্থা চলার সময় কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পরে কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধান গেটটি খুলে দিলে তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন।
যেভাবে আত্মসমর্পণ : ধানমন্ডি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক যুগান্তরকে জানান, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিজেই থানায় ফোন করেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ওই সময় ডিউটি অফিসার ছিলেন এসআই জাহাঙ্গীর আলম। লতিফ সিদ্দিকী ল্যান্ডফোনে ডিউটি অফিসারকে জানান, তিনি কিছু সময়ের মধ্যেই থানায় আসবেন। ডিউটি অফিসার তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি তাকে জানালে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ফোন করেন। খবর পেয়ে রমনা জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইব্রাহীম হোসেন থানায় আসেন। ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান, বেলা দেড়টার দিকে লতিফ সিদ্দিকী একটি প্রাইভেট কারে করে থানায় আসেন এবং সরাসরি তার কক্ষে ঢোকেন। এর আগেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপনের সব কাগজপত্র তৈরি করে রাখা হয়। তৈরি রাখা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশও। থানায় প্রবেশের ১৫ মিনিট পরই ওসি আবু বকর সিদ্দিক তার ব্যবহৃত সরকারি গাড়িতে করেই লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে আদালতের পথে রওনা হন। তখন এই গাড়ির আগে-পিছে ছিল সাদা ও পোশাকধারী পুলিশের তিনটি গাড়ি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, রোববার রাতে কলকাতা থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর থেকেই সাবেক এই মন্ত্রী তাদের নজরদারির মধ্যেই ছিলেন। তিনি যেখানে ছিলেন তার আশপাশে সার্বক্ষণিক সাদা পোশাকের পুলিশ ছিল। গ্রেফতারে আইনগত জটিলতা নিয়ে বিতর্ক থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘সবুজ সংকেতের’ অপেক্ষায় ছিল পুলিশ।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, জাতীয় সংসদের স্পিকারের বক্তব্য এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই সময় গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলেন। লতিফ সিদ্দিকী ওই কর্মকর্তাকে বলেন, ‘আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়ার প্রয়োজন নেই। আমি সকালে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করবো। আমি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি। আপনারা সকালে আসেন।’
এরপর গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে সরকারের ওপর মহল থেকে এ সংক্রান্ত একটি সবুজ সংকেত দেয়া হয়। এতে বলা হয়, লতিফ সিদ্দিকীকে রাতে গ্রেফতার না দেখিয়ে সকালে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া। এরপরই গ্রেফতার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে পুলিশ।
L. Siddiqi-2আদালতে লতিফ সিদ্দিকী: দুপুর ২টার দিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাজতখানায় নেয়া হয় সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে। ২টা ২৫ মিনিটে আদালতের এজলাসে তোলা হয় তাকে। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ওই সময় বিচারক তাকে বলেন, আপনার কোনো আইনজীবী আছে কিনা? জামিন চেয়েছেন কি? জবাবে লতিফ বলেন, ‘আমি কোনো আইনজীবী নিযুক্ত করিনি। নিজেই নিজের মামলার শুনানি করব। আর জামিন আবেদন করিনি।’
এ সময় মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবেদ রাজাকে কিছু বলার নির্দেশ দেন বিচারক। আবেদ রাজা আদালতকে বলেন, ‘মহানবী ও হজ সম্পর্কে কটূক্তি করে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন লতিফ সিদ্দিকী। বিশ্বের ২শ’ কোটি মুসলমানের পক্ষে আমি ঘৃণাভরে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তার বাবা (লতিফ সিদ্দিকী) আইনজীবী ছিলেন। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন। তাই তার শাস্তি দাবি করছি।’ তার এ বক্তব্যের পরই বিচারক আদেশ দেন। তিনি বলেন, ‘আসামি জামিনের কোনো আবেদন করেনি। তাই তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিচ্ছি। তাকে কারাগারে পাঠানো হোক।’
৭ মিনিটের শুনানি: এজলাসে লতিফ ছিলেন মাত্র সাত মিনিট। কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন। তিনি বলেন, এটা একটি জামিনযোগ্য মামলা।
হাজতখানায় ২০ মিনিট: কারাগারে নেয়ার আদেশের পর পুলিশ তাকে সিএমএম কোর্ট হাজতখানা চত্বরে নিয়ে যায়। ওই সময় চত্বরে রাখা এক উচ্চপদস্থ পুলিশের গাড়িতে তাকে রাখা হয়। তখন তিনি পুলিশের কাছে পানি পান করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে পানি দেয়া হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িতে হাসিমুখে বসেছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। এ হজের জন্য ২০ লাখ লোক সৌদি আরবে গেছেন। এদের কোনো কাজ নাই। কোনো প্রোডাকশন নাই, শুধু ডিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা বিদেশে দিয়ে আসছে।’
তার এসব মন্তব্য নিয়ে সারা দেশে শুরু হয় তোলপাড়। তার ফাঁসির দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যাহত থাকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের ১৮ জেলায় তার বিরুদ্ধে ২২টি মামলা হয়। প্রত্যেকটি আদালত তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা।
মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বাদ: ওই বক্তব্যের পর গত ১২ অক্টোবর আমেরিকায় থাকাকালেই লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্যপদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পরে তার দলের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। পরে তিনি আমেরিকা থেকে ভারতে আসেন। কলকাতায় কিছুদিন অবস্থানের পর নাটকীয়ভাবে রোববার (২৩ নভেম্বর) রাত ৮টা ২১ মিনিটে তিনি এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে ভিআইপি লাউঞ্জ দোলনচাঁপায় প্রায় এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন। এ সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করা হয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনো নির্দেশনা না থাকায় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাকে আটক না করে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। তবে তখন থেকেই লতিফ সিদ্দিকী গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেই ছিলেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল। এর মধ্যেই সোমবার লতিফ সিদ্দিকী আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে যান বলে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে কেউ তা স্বীকার করেনি।
কারা ফটকে ১৭ মিনিটের নাটক: ‘আমি রানিং এমপি, আমি কেন মাথা নিচু করে পকেট দিয়ে ঢুকব? আমি প্রধান ফটক দিয়ে যাব’। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে গিয়ে এ কথা বলেই বেঁকে বসেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এ সময় পুলিশের কর্মকর্তারা নিরাপত্তার অজুহাতে তাকে কারাগারে প্রবেশের জন্য পীড়াপীড়ি করলে তিনি ধমকের সুরে বলেন, আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না। আমাকে ভেতরে নিতে হলে প্রধান ফটক খুলতে হবে।
সিদ্ধান্তে অটল থাকায় ১৭ মিনিট কারা ফটকে লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে জেল সুপার এসে সমস্যার সমাধান করেন। কারাগারে সাবেক মন্ত্রীকে প্রথম শ্রেণীর বন্দির (ডিভিশন) মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী বলছেন, লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে ঢোকানোর ক্ষেত্রে কারাবিধি (জেলকোড) লংঘন করা হয়েছে।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.), পবিত্র হজ ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে কটূক্তির কারণে প্রায় দুই ডজন গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরার একদিন পর মঙ্গলবার দুপুরে ধানমন্ডি থানায় আতœসমর্পণ করেন লতিফ সিদ্দিকী। এরপর তাকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হলে বিচারক আতিকুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর একটি প্রিজন ভ্যানে
করে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। পুলিশি পাহারায় প্রিজন ভ্যানটি যখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে পৌঁছে তখন বেলা ৩টা ২৫ মিনিট। এর আগেই কারাগারের মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেয় বিপুলসংখ্যক পোশাকধারী পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থ’ার সদস্য। ঊর্ধ্বতন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও সেখানে হাজির হন। সাদা জুতা, কালো প্যান্ট ও সাদা চেক শার্ট পরিহিত লতিফ সিদ্দিকী প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকান। এ সময় পুলিশ তাকে ছোট ফটক দিয়ে কারাগারে প্রবেশের জন্য বলে। কারা ফটকের দিকে তাকিয়ে বেঁকে বসেন লতিফ সিদ্দিকী। তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে সাফ জানিয়ে দেন, তাকে ভেতরে নিতে হলে কারাগারের মূল ফটক খুলতে হবে। তিনি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘৩০ বছর আমি পকেট গেট দিয়ে ইন বা আউট হইনি। আজও হব না।’ পুলিশ সদস্য ও কারা কর্মকর্তারা লতিফ সিদ্দিকীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এত পরিমাণ সংবাদকর্মীর সামনে মূল ফটক খুলতে গেলে সামলানো কঠিন হবে। বরং তিনি দয়া করে পকেট ফটক দিয়ে ভেতরে গেলে সব ঝামেলাই এড়ানো সম্ভব। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী তার অবস্থানে অনড় থাকেন।
সংবাদকর্মীরা এ সময় লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে থাকেন। সাংবাদিকরা লতিফ সিদ্দিকীকে উদ্দেশ করে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়তে থাকেন। তিনি মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেন, তিনি কিছুই বলবেন না।
লালবাগ পুলিশের সহকারী কমিশনার ফয়েজ আহমেদ, কোতোয়ালির ওসি আবুল হাসান, চকবাজারের ওসি আজিজুল হকসহ উপ¯ি’ত পুলিশ কর্মকর্তারা এ সময় লতিফ সিদ্দিকীকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এরই একপর্যায়ে ৩টা ৪২ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার ফরমান আলী প্রধান ফটক খুলে বাইরে আসেন। তার সঙ্গে প্রধান ফটক দিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন গত দুই মাস ধরে আলোচনায় থাকা লতিফ সিদ্দিকী।
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মূল ফটকের গায়ে লাগোয়া ছোট আকারের ‘পকেট ফটক’ দিয়েই তারা আসামি ও কয়েদিদের আনা-নেয়া করা হয়। প্রিজন ভ্যান ও গাড়ি ঢোকানোর প্রয়োজন হলে অথবা বিশেষ প্রয়োজনে মূল ফটক খোলা হয়।
জেল সুপার ফরমান আলী টেলিফোনে জানান, কোন ফটক দিয়ে কে কারাগারে ঢুকবে বা বের হতে পারবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হয়ে থাকে। জেলার থেকে শুরু করে কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন গেটে আসেন, তখন বড় গেটটি খোলা হয়ে থাকে। ঘটনার সময়, জেলার নেসারুল আলম প্রধান গেটে আসলে নিয়ম অনুযায়ী কারারক্ষীরা প্রধান গেটটি খুলে দেন। এ সুযোগে পুলিশ লতিফ সিদ্দিকীকে জেলারের সঙ্গেই কারা অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়।
লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়নি দাবি করে জেল সুপার বলেন, ‘উনি আমার সঙ্গেই ঢুকেছেন। তাই এক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বড় গেট খুলে কোনো আসামিকে কারাগারে ঢোকানোর কোনো বিধান জেলকোডে নেই। লতিফ সিদ্দিকীর ঘটনায় স্পষ্টই আইন লংঘিত হয়েছে। সরকারের মদদ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না। তার এ আচরণই প্রমাণ করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেও তার মধ্যে অনুশোচনা বোধ নেই। কারাগারের একটি সূত্র বলেছে, কারাগারে লতিফ সিদ্দিকীকে প্রথম শ্রেণীর বন্দির সুবিধা (ডিভিশন) দেয়া হয়েছে। তাকে ডিভিশনের ২৬ নম্বর সেলে রাখা হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী কারাগারে প্রবেশের আগেই তার পরিবারের পক্ষ থেকে রাতের খাবার সরবরাহ করা হয়। ভাত, মুরগি. মুসুরির ডাল, সবজি ও মাছ নিয়ে আসেন লতিফ সিদ্দিকীর এক আত্মীয়। কারাগারে প্রবেশের পরপরই তিনি গোসল সেরে নেন। রাতে তিনি পরিবারের পক্ষ থেকে দেয়া খাবার খাবেন বলেই আগেই কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন। (দৈনিক যুগান্তর)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

অবশেষে কারাগারে লতিফ সিদ্দিকী

প্রকাশের সময় : ০৯:০৯:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০১৪

ঢাকা: নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে লতিফ সিদ্দিকীর ঠাঁই হল কারাগারেই। মন্ত্রিসভা ও ক্ষমতাসীন দল থেকে অপসারিত সাবেক এই মন্ত্রী ধর্মীয় উস্কানির মামলার পলাতক আসামি ছিলেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরার একদিন পর মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) দুপুরে তিনি ধানমন্ডি থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এরপর পুলিশ তাকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে হাজির করলে বিচারক আতিকুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। লতিফ সিদ্দিকী তার পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেননি। পাশাপাশি জামিনের জন্য কোনো আবেদনও করেননি। এদিকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের দাবিতে পূর্বঘোষিত হরতালের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট। তারা সরকারকে ধন্যবাদও জানিয়েছে।
লতিফ সিদ্দিকীকে আদালতে আনা হচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিএমএম আদালতের মূল ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন আইনজীবী ও সাধারণ মানুষ। লতিফ সিদ্দিকীকে বহনকারী প্রিজনভ্যান উপস্থিত হওয়া মাত্রই- ‘নাস্তিকের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘ফাঁসি ফাঁসি চাই, মুরতাদের ফাঁসি চাই’ … ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা আদালত প্রাঙ্গণ। ওই সময় অনেকের হাতে ছিল জুতা ও ঝাড়ু। আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার সময়েও একই ধরনের ক্ষুব্ধ ৎুপতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন সাধারণ জনগণ। তবে প্রিজনভ্যান থেকে এজলাসে আনা-নেয়ার পথে তিনি ছিলেন বেশ স্বাভাবিক। ভাবলেশহীনভাবে ওঠানামা করেছেন প্রিজনভ্যানে।
আদালত থেকে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে পৌঁছানোর পর নতুন নাটকের জন্ম দেন টাঙ্গাইলে বিতর্কিত এই সংসদ সদস্য। প্রিজনভ্যান থেকে নেমে পকেট গেট (ছোট ফটক) দিয়ে কারাগারে প্রবেশে অসম্মতি জানালে বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কারা কর্তৃপক্ষকে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, তাকে ভেতরে নিতে হলে প্রধান ফটক খুলতে হবে। ওই সময় লতিফ সিদ্দিকী উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘আমি এখনও এমপি। গত ৩০ বছর আমি পকেট গেট দিয়ে ইন বা আউট হইনি। আজও হবো না।’ আইন-শৃংখলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী তার অবস্থানে অনড় থাকেন। প্রায় ১৭ মিনিট এ অবস্থা চলার সময় কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পরে কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধান গেটটি খুলে দিলে তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন।
যেভাবে আত্মসমর্পণ : ধানমন্ডি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক যুগান্তরকে জানান, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিজেই থানায় ফোন করেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ওই সময় ডিউটি অফিসার ছিলেন এসআই জাহাঙ্গীর আলম। লতিফ সিদ্দিকী ল্যান্ডফোনে ডিউটি অফিসারকে জানান, তিনি কিছু সময়ের মধ্যেই থানায় আসবেন। ডিউটি অফিসার তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি তাকে জানালে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ফোন করেন। খবর পেয়ে রমনা জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইব্রাহীম হোসেন থানায় আসেন। ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান, বেলা দেড়টার দিকে লতিফ সিদ্দিকী একটি প্রাইভেট কারে করে থানায় আসেন এবং সরাসরি তার কক্ষে ঢোকেন। এর আগেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপনের সব কাগজপত্র তৈরি করে রাখা হয়। তৈরি রাখা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশও। থানায় প্রবেশের ১৫ মিনিট পরই ওসি আবু বকর সিদ্দিক তার ব্যবহৃত সরকারি গাড়িতে করেই লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে আদালতের পথে রওনা হন। তখন এই গাড়ির আগে-পিছে ছিল সাদা ও পোশাকধারী পুলিশের তিনটি গাড়ি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, রোববার রাতে কলকাতা থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর থেকেই সাবেক এই মন্ত্রী তাদের নজরদারির মধ্যেই ছিলেন। তিনি যেখানে ছিলেন তার আশপাশে সার্বক্ষণিক সাদা পোশাকের পুলিশ ছিল। গ্রেফতারে আইনগত জটিলতা নিয়ে বিতর্ক থাকায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘সবুজ সংকেতের’ অপেক্ষায় ছিল পুলিশ।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, জাতীয় সংসদের স্পিকারের বক্তব্য এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই সময় গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলেন। লতিফ সিদ্দিকী ওই কর্মকর্তাকে বলেন, ‘আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়ার প্রয়োজন নেই। আমি সকালে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করবো। আমি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি। আপনারা সকালে আসেন।’
এরপর গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে সরকারের ওপর মহল থেকে এ সংক্রান্ত একটি সবুজ সংকেত দেয়া হয়। এতে বলা হয়, লতিফ সিদ্দিকীকে রাতে গ্রেফতার না দেখিয়ে সকালে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া। এরপরই গ্রেফতার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে পুলিশ।
L. Siddiqi-2আদালতে লতিফ সিদ্দিকী: দুপুর ২টার দিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাজতখানায় নেয়া হয় সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে। ২টা ২৫ মিনিটে আদালতের এজলাসে তোলা হয় তাকে। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ওই সময় বিচারক তাকে বলেন, আপনার কোনো আইনজীবী আছে কিনা? জামিন চেয়েছেন কি? জবাবে লতিফ বলেন, ‘আমি কোনো আইনজীবী নিযুক্ত করিনি। নিজেই নিজের মামলার শুনানি করব। আর জামিন আবেদন করিনি।’
এ সময় মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবেদ রাজাকে কিছু বলার নির্দেশ দেন বিচারক। আবেদ রাজা আদালতকে বলেন, ‘মহানবী ও হজ সম্পর্কে কটূক্তি করে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন লতিফ সিদ্দিকী। বিশ্বের ২শ’ কোটি মুসলমানের পক্ষে আমি ঘৃণাভরে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তার বাবা (লতিফ সিদ্দিকী) আইনজীবী ছিলেন। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন। তাই তার শাস্তি দাবি করছি।’ তার এ বক্তব্যের পরই বিচারক আদেশ দেন। তিনি বলেন, ‘আসামি জামিনের কোনো আবেদন করেনি। তাই তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিচ্ছি। তাকে কারাগারে পাঠানো হোক।’
৭ মিনিটের শুনানি: এজলাসে লতিফ ছিলেন মাত্র সাত মিনিট। কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন। তিনি বলেন, এটা একটি জামিনযোগ্য মামলা।
হাজতখানায় ২০ মিনিট: কারাগারে নেয়ার আদেশের পর পুলিশ তাকে সিএমএম কোর্ট হাজতখানা চত্বরে নিয়ে যায়। ওই সময় চত্বরে রাখা এক উচ্চপদস্থ পুলিশের গাড়িতে তাকে রাখা হয়। তখন তিনি পুলিশের কাছে পানি পান করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাকে পানি দেয়া হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িতে হাসিমুখে বসেছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। এ হজের জন্য ২০ লাখ লোক সৌদি আরবে গেছেন। এদের কোনো কাজ নাই। কোনো প্রোডাকশন নাই, শুধু ডিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা বিদেশে দিয়ে আসছে।’
তার এসব মন্তব্য নিয়ে সারা দেশে শুরু হয় তোলপাড়। তার ফাঁসির দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন অব্যাহত থাকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের ১৮ জেলায় তার বিরুদ্ধে ২২টি মামলা হয়। প্রত্যেকটি আদালত তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তিনি নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা।
মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বাদ: ওই বক্তব্যের পর গত ১২ অক্টোবর আমেরিকায় থাকাকালেই লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্যপদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। পরে তার দলের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। পরে তিনি আমেরিকা থেকে ভারতে আসেন। কলকাতায় কিছুদিন অবস্থানের পর নাটকীয়ভাবে রোববার (২৩ নভেম্বর) রাত ৮টা ২১ মিনিটে তিনি এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে ভিআইপি লাউঞ্জ দোলনচাঁপায় প্রায় এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখেন। এ সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করা হয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনো নির্দেশনা না থাকায় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাকে আটক না করে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন। তবে তখন থেকেই লতিফ সিদ্দিকী গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেই ছিলেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল। এর মধ্যেই সোমবার লতিফ সিদ্দিকী আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে যান বলে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে কেউ তা স্বীকার করেনি।
কারা ফটকে ১৭ মিনিটের নাটক: ‘আমি রানিং এমপি, আমি কেন মাথা নিচু করে পকেট দিয়ে ঢুকব? আমি প্রধান ফটক দিয়ে যাব’। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে গিয়ে এ কথা বলেই বেঁকে বসেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এ সময় পুলিশের কর্মকর্তারা নিরাপত্তার অজুহাতে তাকে কারাগারে প্রবেশের জন্য পীড়াপীড়ি করলে তিনি ধমকের সুরে বলেন, আমাকে আইন শেখাতে আসবেন না। আমাকে ভেতরে নিতে হলে প্রধান ফটক খুলতে হবে।
সিদ্ধান্তে অটল থাকায় ১৭ মিনিট কারা ফটকে লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে জেল সুপার এসে সমস্যার সমাধান করেন। কারাগারে সাবেক মন্ত্রীকে প্রথম শ্রেণীর বন্দির (ডিভিশন) মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী বলছেন, লতিফ সিদ্দিকীকে কারাগারে ঢোকানোর ক্ষেত্রে কারাবিধি (জেলকোড) লংঘন করা হয়েছে।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.), পবিত্র হজ ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে কটূক্তির কারণে প্রায় দুই ডজন গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরার একদিন পর মঙ্গলবার দুপুরে ধানমন্ডি থানায় আতœসমর্পণ করেন লতিফ সিদ্দিকী। এরপর তাকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হলে বিচারক আতিকুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর একটি প্রিজন ভ্যানে
করে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। পুলিশি পাহারায় প্রিজন ভ্যানটি যখন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে পৌঁছে তখন বেলা ৩টা ২৫ মিনিট। এর আগেই কারাগারের মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেয় বিপুলসংখ্যক পোশাকধারী পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থ’ার সদস্য। ঊর্ধ্বতন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও সেখানে হাজির হন। সাদা জুতা, কালো প্যান্ট ও সাদা চেক শার্ট পরিহিত লতিফ সিদ্দিকী প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকান। এ সময় পুলিশ তাকে ছোট ফটক দিয়ে কারাগারে প্রবেশের জন্য বলে। কারা ফটকের দিকে তাকিয়ে বেঁকে বসেন লতিফ সিদ্দিকী। তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে সাফ জানিয়ে দেন, তাকে ভেতরে নিতে হলে কারাগারের মূল ফটক খুলতে হবে। তিনি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘৩০ বছর আমি পকেট গেট দিয়ে ইন বা আউট হইনি। আজও হব না।’ পুলিশ সদস্য ও কারা কর্মকর্তারা লতিফ সিদ্দিকীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, এত পরিমাণ সংবাদকর্মীর সামনে মূল ফটক খুলতে গেলে সামলানো কঠিন হবে। বরং তিনি দয়া করে পকেট ফটক দিয়ে ভেতরে গেলে সব ঝামেলাই এড়ানো সম্ভব। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী তার অবস্থানে অনড় থাকেন।
সংবাদকর্মীরা এ সময় লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতে থাকেন। সাংবাদিকরা লতিফ সিদ্দিকীকে উদ্দেশ করে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়তে থাকেন। তিনি মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেন, তিনি কিছুই বলবেন না।
লালবাগ পুলিশের সহকারী কমিশনার ফয়েজ আহমেদ, কোতোয়ালির ওসি আবুল হাসান, চকবাজারের ওসি আজিজুল হকসহ উপ¯ি’ত পুলিশ কর্মকর্তারা এ সময় লতিফ সিদ্দিকীকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এরই একপর্যায়ে ৩টা ৪২ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার ফরমান আলী প্রধান ফটক খুলে বাইরে আসেন। তার সঙ্গে প্রধান ফটক দিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন গত দুই মাস ধরে আলোচনায় থাকা লতিফ সিদ্দিকী।
কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মূল ফটকের গায়ে লাগোয়া ছোট আকারের ‘পকেট ফটক’ দিয়েই তারা আসামি ও কয়েদিদের আনা-নেয়া করা হয়। প্রিজন ভ্যান ও গাড়ি ঢোকানোর প্রয়োজন হলে অথবা বিশেষ প্রয়োজনে মূল ফটক খোলা হয়।
জেল সুপার ফরমান আলী টেলিফোনে জানান, কোন ফটক দিয়ে কে কারাগারে ঢুকবে বা বের হতে পারবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হয়ে থাকে। জেলার থেকে শুরু করে কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন গেটে আসেন, তখন বড় গেটটি খোলা হয়ে থাকে। ঘটনার সময়, জেলার নেসারুল আলম প্রধান গেটে আসলে নিয়ম অনুযায়ী কারারক্ষীরা প্রধান গেটটি খুলে দেন। এ সুযোগে পুলিশ লতিফ সিদ্দিকীকে জেলারের সঙ্গেই কারা অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেয়।
লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো হয়নি দাবি করে জেল সুপার বলেন, ‘উনি আমার সঙ্গেই ঢুকেছেন। তাই এক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বড় গেট খুলে কোনো আসামিকে কারাগারে ঢোকানোর কোনো বিধান জেলকোডে নেই। লতিফ সিদ্দিকীর ঘটনায় স্পষ্টই আইন লংঘিত হয়েছে। সরকারের মদদ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না। তার এ আচরণই প্রমাণ করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেও তার মধ্যে অনুশোচনা বোধ নেই। কারাগারের একটি সূত্র বলেছে, কারাগারে লতিফ সিদ্দিকীকে প্রথম শ্রেণীর বন্দির সুবিধা (ডিভিশন) দেয়া হয়েছে। তাকে ডিভিশনের ২৬ নম্বর সেলে রাখা হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী কারাগারে প্রবেশের আগেই তার পরিবারের পক্ষ থেকে রাতের খাবার সরবরাহ করা হয়। ভাত, মুরগি. মুসুরির ডাল, সবজি ও মাছ নিয়ে আসেন লতিফ সিদ্দিকীর এক আত্মীয়। কারাগারে প্রবেশের পরপরই তিনি গোসল সেরে নেন। রাতে তিনি পরিবারের পক্ষ থেকে দেয়া খাবার খাবেন বলেই আগেই কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন। (দৈনিক যুগান্তর)