নিউইয়র্ক ১২:৪২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ভ্রমণ: তিন দিনের কক্সবাজার

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:২৫:৩১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ মার্চ ২০১৬
  • / ৩২৫৮ বার পঠিত

রুবা আক্তার: ২২ জানুয়ারী’২০১৬ শুক্রবার। কথা ছিলো সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়বে সাভার থেকে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি চলছে কক্সবাজার যাবো বলে কথা। যটপট ৭:৩০ মিনিটের আগেই রেডি হয়ে গেলাম। হঠাৎ স্বপ্না আপা ফোন দিয়ে বলল- শাহিন ভাই (আমাদের টিম লিডার) তার বড় আপাকে উত্তরা থেকে আনতে গিয়ে জ্যামে আটকে গিয়েছেন, তাই গাড়ি রাত ৮:৩০ মিনিটে ছাড়বে। যথারীতি তৈরী হয়ে অপেক্ষা করা কি যে যন্ত্রনাময় তা আর বলব কি? অবশেষে অপেক্ষার পর ব্যাগ নিয়ে নামতে গিয়ে দেখি ব্যাগতো নয়, যেন একটা বস্তা হয়ে গেছে। ব্যাগের এতো ওজন বাবারে! যাক চার তলা থেকে নেমে গেইট এর কাছে যেতেই একটু স্বস্তি হলো, যে স্বপ্না আপার ব্যাগতো দেখছি আমার ব্যাগের ডাবল সাইজ। উনার দুই বোন বাস পর্যন্ত ব্যাগ ধরে এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
বাস ছাড়তে ছাড়তে বাজলো রাত ৯:০০ টা। গাড়ি চলছে জনপ্রিয় অমর শিল্পী মান্না দে’র গান (যদি কাগজে লিখো নাম) গান বাজিয়ে। আমি আর স্বপ্না আপা পাশাপাশি বসে যাচ্ছি। জানালার পাশের সিটে আমি। মনে হচ্ছিল যেন আকাশ পথে পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি আমাদের অতি কাঙ্খিত গন্তব্যস্থলে। গাড়ি এখন ঢাকার কল্যাণপুর, আমাদের আরেক বড় আপা (জোৎ¯œা বেগম) ও তার স্বামী (মোহাম্মদ মতিন চৌধুরী) গাড়িতে উঠলেন। ভালো লাগার মুহুর্ত যেন টেস্টিং সল্ট দিয়ে আর একটু টেস্টি হয়ে গেল। আমি, স্বপ্না আপা আর জোৎ¯œা আপা বয়সের তারতম্য থাকলেও মন যেন একই বয়সের। গাড়ি কাচপুর ব্রীজের কাছে যেতেই ড্রাইভার সাহেব এমন সব গান বাজাতে শুরু করল মনে হচ্ছিল আমরা পাগলা বাবার মাজারে যাচ্ছি। জোৎ¯œা আপাতো বলেই বসল ‘ড্রাইভার সাহেব এসব কি গান প্লে করছেন? সুন্দর সুন্দর গান দেন’। স্বপ্না আপার কথায় একপর্যায় ভারতীয় বাংলা গান প্লে করল। যাক ভালোই লাগছিল। যখন আমরা মেঘনা পাড়ে, তখন প্রচন্ড শীত লাগছিল। মতিন ভাই বলছিলেন- গত রাতে নাকি খবরে বলেছে কাল থেকে শৈত প্রবাহ শুরু। ও মাই গড! একে তো প্রচন্ড শীত, তার উপর কুয়াশা। কক্সবাজারে এমন শীত আর কুয়াশা পড়লে কিভাবে উপভোগ করব ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাচ্ছি….যাচ্ছি…. সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারছিনা। প্রচন্ড শীত। গায়ে স্যুয়েটার পরা, স্বপ্না আপা আর আমি দুজনে এক চাদরে ঢেকে বসেছি। শীতকে কোনভাবেই হার মানাতে পারছি না। ফজরের আযান হচ্ছে- আমরা তখন চট্টগ্রাম পাড় হয়ে কক্সবাজার সীমানায় চলে আসছি। শীত আমাদেরকে ভালোভাবেই ভালবেসে জড়িয়ে আছে।
Ruba-1২৩ জানুয়ারী শনিবার। ভোর হয়েছে, সূর্য দেখা যাচ্ছে। গাড়ি এক পর্যায়ে কক্সবাজার সী বিচের কাছাকাছি হোটেল (সী আলিফ) এর কাছে চলে এলো, আমরা নামলাম।
আমি তো অবাক! কি ব্যাপার কি হলো……..
সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছি, হিম হিম শীত, এখানকার আবহাওয়াতো মনোরোম লাগছে। ওহ…… মনটাই ভালো হয়ে গেল। আমি আর স্বপ্না আপা হোটেল সী আলিফ-এর ৫০৫ নং কক্ষে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পরলাম সমুদ্র দেখার উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে এক অসাধারণ অনুভূতি…………যা বলে বোঝাতে পারবো না। সমুদ্র যে এতো ভাললাগার, ছবি দেখে পরিপূর্ণ অনুভব কখনোই করা সম্ভব নয়। গোসলের কোন প্রস্তুতি ছিলনা কোন কিছু না ভেবেই নেমে পরলাম বীচে আমি আর জোৎ¯œা আপা। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বিশাল জলরাশি………সে এক বিশাল অনুভূতি। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৪ কিলোমিটার। শুনেছি এখানকার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য দেখার জন্য বছরে ১০ লাখেরও বেশী পর্যটক ভীড় জমায়।
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরে লাঞ্চ করতে রেস্টুরেন্টে গেলাম। সমুদ্রের পাড়ে লাঞ্চ বলে কথা………..সামুদ্রিক মাছতো খেতেই হবে। লাঞ্চ শেষে বের হয়ে পরলাম হিমছড়ির উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে ইনানী বীচ। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার পথটা বীচের পাড় দিয়ে যেন সমুদ্র আমাদের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে।
Ruba-3চলে এলাম হিমছড়ি পাহাড়ের কাছে। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দুরে রয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেষে সমুদ্র সৈকত হিমছড়ি। সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, আকাশ ছোঁয়া পাহাড় সব মিলিয়ে এক চোখ ধাধানো প্রকৃতি। পাহাড়ে উঠছি, খাড়া পাহাড়, সিড়ি আছে বটে, তবুও মনে হচ্ছিল হিমালয় পাড়ি দিচ্ছি। এরই মাঝে আমাদের আরেক মজার মানুষ (উজ্জ্বল দা) বলছিলেন ‘এখনই বোঝা যাবে আমাদের মাঝে কারো হার্টের সমস্যা আছে কিনা’।
অনেক কষ্ট করে একসময় হিমছড়ি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। মনে হলো- যেন এভারেষ্ট জয় করে এলাম। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পাশে দাড়িয়ে থাকা শান্ত পাহারগুলো যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আরেক পাশে সমুদ্রের ঢেউ যেন দখিনার হাওয়া দিয়ে দেহটাকে সতেজ করে দিল। কি আশ্চর্য শিহরন; বিশাল পাহাড় আর সীমাহীন সমুদ্রের নিরব ভালবাসা পেয়ে আমি যেন পরিপূর্ণ। মনে হলো- ‘পৃথিবীর কাছে যেনো আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।’
Ruba-5সন্ধ্যা হতে আর বেশি বাকি নেই এরই মাঝে আমাদেরকে যেয়ে আসতে হবে ইনানী বীচ থেকে। তাই হিমছড়িকে আর সময় না দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে রওনা হলাম ইনানী বীচের উদ্দেশ্যে। হিমছড়ি ছাড়িয়ে প্রায় ৮ কিলোমিটার এগিয়ে আরেক আকর্ষনীয় সৈকত ইনানী। ইনানী বীচ যেন কানায় কানায় পরিপূর্ণ যৌবনবতী এক নারী। যা শুধুই ভাল লাগার। তাই মন যে কখন গেয়ে উঠল, ‘হৃদয় আমার নাচেরে’।
এরপর হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে রেস্টুরেন্টে। তারপর রাতে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটাকে বিছানায় ফেলতেই গভীর ঘুম। ঘুম ভাঙল ভোর ৪:৩০ মিনিটে এলার্মের শব্দে। ৫:৩০ মিনিটে বের হতে হবে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে।
Ruba-4২৪ জানুয়ারী রোববার। সকাল ৫:৩০ মিনিটে আমরা সবাই গাড়িতে করে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে টেকনাফ যাচ্ছিলাম। গাড়িতে বাজছিল মাধুরীর সব মনোমুগ্ধকর গান। মনটা এতো ফুরফুরে লাগছিল যেন কাশফুলের নরম ছোয়া। তখন জীবনের সব ভাল লাগা মুহুর্তের কথা বার বার মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বিশাল সমুদ্রের গভীরতা মাপা গেলেও মানুষের মনের গভীরতা মাপা কারো সাধ্য নেই……….। যাক মানুষের সাধ্যের বাইরে কিছুই নেই।
আমরা এক পর্যায় টেকনাফ চলে এলাম। টেকনাফে সকালের নাস্তা করে ‘কিয়ারী সিন্দবাদ’ নামে জাহাজে করে আমরা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে নাফ নদীতে যাত্রা শুরু করলাম। যেকোন যানবাহনেই বরাবরই আমি জানালার পাশে বসার চেষ্টা করি। এখানেও তাই করলাম। কিন্তু আমাদের সাথে একজন ৭০ এর উর্দ্ধ বয়সী (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার) আমাদের ভ্রমনের সবচেয়ে প্রবীণ ভ্রমন পিপাসুকে কেউ আংকেল, কেউবা নানা বলে সম্বোধন করছিলেন। যে সারিতে আমার সিট ছিল, সেই সারির জানালার পাশের সিটটিতে উনি বসেছেন। বয়স্ক মানুষ, তাই যথেষ্ঠ শ্রদ্ধার সাথে মিষ্টি করে বললাম আঙ্কেল আপনি একটু এই দিকটাতে বসবেন, আমি ওখানটাতে বসতাম! আংকেল তো ২৫ বছরের তাগরা যুবকের মেজাজ আর বল নিয়ে বললেন, ‘না আমি এখানেই বসব, আপনি অন্য দিকে বসেন’। কি আর করার বৃদ্ধ যুবককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সারির মাঝামাঝিতে বসলাম। কিছুক্ষন পর দেখলাম সমুদ্রের সৌন্দর্য্য সবাই জাহাজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে। মনে হলো- বুড়ো চাচারও খুব ইচ্ছে করছে বারান্দায় গিয়ে সমুদ্রের সুধা পান করতে। কিন্তু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন আর পরক্ষনেই ভাবছেন সিটটা যদি অন্য কেউ দখল করে নেয়! এই কথা আমি আমার পাশে বসা জোৎ¯œা আপার সাথে শেয়ার করলাম আর বললাম ‘বুড়া চাচা তো মাইনকার চিপায় পরছে’। আর হাসির রানী জোৎ¯œা আপা হাসতে হাসতে হেলেদুলে একাকার। একপর্যায়ে আমিও জাহাজের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম সমুদ্রের সুধা পান করতে। সমুদ্রের তীব্র বাতাসে আমার দেহখানি যেন শীতল হয়ে গেলো। উঞ্চ হৃদয়কে শীতল করতে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস নিলাম। চোখ খুলে দেখি বুড়ো চাচা আমার সামনের দিকে জাহাজের গ্রীল ধরে সমুদ্রের ঢেউয়ের খেলা দেখছেন। সমুদ্রে ডলফিন লাফিয়ে তার যৌবনভরা দেহটাকে বার বার ভ্রমণ পিপাসুদের যেন নাচ দেখাচ্ছে। মৃদু হেসে ভাবছিলাম যে- দেহ আর মনের কত তফাৎ! দেহের বয়স হলেও মনের বয়সকে স্থির রাখা যায় যদি সে নিজে চায়।
কবুতরের মতো রিষ্ট-পুষ্ট অতিথি পাখিগুলো যেন আমাদের সঙ্গী হয়ে সেন্ট মার্টিন পাড়ি জমাচ্ছে। যদিও ওরা ওদের মৌলিক প্রয়োজনে আমাদের সাথে যাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা তাদের পাখনা ওড়াতে ওড়াতে জীবনযুদ্ধে পাড়ি দিচ্ছিল রনক্ষেত্র। জাহাজ থেকে অনেকেই বিভিন্ন ধরণের চিপস খেতে দিচ্ছিল পাখিগুলোকে। আর পাখিরা একটি আরেকটিকে অতিক্রম করে ছিনিয়ে নিচ্ছিল তাদের কাঙ্খিত খাবারটি। এখানেই মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। কারণ মানুষকে যে সৃষ্টিকর্তা ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ হিসেবে বিবেক দিয়ে পাঠিয়েছেন এই ধরণীতে। আমরা কি সেটা মনে রাখি? দেহটা যখন প্রচন্ড বাতাসে শীতল হয়ে এলো, তখন দেহটাকে একটু আরাম দিতে জাহাজের ভেতরে এসে একটা সিটে বসে মাথার টুপিটা সামনের দিকে হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে খানিক্ষন ঘুমিয়ে নিলাম। এরই মাঝে শুনতে পেলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপ নাকি দেখা যাচ্ছে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, কোথায় কোথায়…..সেন্ট মার্টিন দ্বীপ? ভীড়ের মাঝে জাহাজের ভেতর থেকে বাইরের দিকে আসতে আসতে জাহাজ ততক্ষনে সেন্টমার্টিন দ্বীপে এসে পৌছে গেছে। টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ছোট্ট একটি দ্বীপ ‘সেন্টমার্টিন’। আয়তনে ৮ বর্গকিলোমিটার।
জাহাজ থেকে নেমে যখন দ্বীপের মাটিতে, মাটিতো নয় বালিতে পা রাখলাম তখন মনে হচ্ছিল যেন চন্দ্র পৃষ্ঠে পা রাখলাম।
যেহেতু দ্বীপে আসতেই দুপুর ১২:৩০ বেজে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো লাঞ্চ করে আমরা যা দেখার দেখব। লাঞ্চ-এর উদ্দেশ্যে দ্বীপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। স্বপ্না আপার পরিচিত এক হোটেল মালিক আছে তার হোটেলে লাঞ্চ করব আমরা। দ্বীপের মাঝখান দিয়ে রাস্তা ধরে হাটছি। হাটছি তো হাটছিই। প্রায় ৩০ মিনিট হাটার পর পেলাম হোটেল সী প্রবাল যার মালিক স্বপ্না আপার পরিচিত। সবাই বলাবলি করছিল জাহাজের কাছাকাছি কোথাও তো লাঞ্চ করা যেতো। এতো দুরে আসার কোন মানে হয়? যাক আমরা হোটেল সী প্রবালের গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। সী প্রবালের আঙ্গিনা দেখে সবাই তো অবাক। একি সেন্টমার্টিনের বীচতো দেখছি সী প্রবালের আঙ্গিনা। হোটেলটা দেখতে বেশ সুন্দর। খোলা জায়গায় ছনের চাল, তিন পাশে গাছ আর একপাশ সমুদ্র সৈকত। জাস্ট ভাবাই যায়না প্রকৃতি এতো সুন্দর হতে পারে। লাঞ্চ করবে কি সবাই দৌড়ে সী প্রবালের আঙ্গিনা অর্থাৎ সমুদ্র সৈকতে নিজেদেরকে পেরাসুটের মতো উড়িয়ে দিচ্ছিল। বলা ঠিক না তবুও বলি আমি ভাল ছবি তুলতে পারি এবং ছবি উঠাতেও পছন্দ করি। অনেকের ছবি তুলে দিলাম ক্যামেরায়। দুঃখের বিষয় নিজের ছবি তোলার মতো ভাল কোন ফটোগ্রাফার পেলাম না। যাক আমাদের সকলের দুলাভাই মতিন ভাই আমার সকল ছবি তুলে দিয়েছেন। আসলে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্র্য্য পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে হলে কমপক্ষে তিন দিন, তিন রাত সেখানে স্টে করতে হবে তা না হলে সম্ভব নয়। আমাদের ভাগ্যে ছিল মাত্র একদিন, তাও আবার কয়েক ঘন্টা। এই অল্প সময়ে মনের ক্ষুধা কিছুটা মিটিয়ে চলে এলাম জাহাজে।
Ruba-6জাহাজ সেন্ট মার্টিন থেকে ছাড়ল বিকেল ৩:৩০মিনিটে। সেই বুড়ো চাচা জাহাজের ভিতর আমাকে খুজছে। একে ওকে জিজ্ঞেস করছে, ঐ মেয়েটা কোথায়?…………. তো আমাকে পেয়ে বলল ‘আপনি তো জানালার পাশে বসতে চেয়েছিলেন এখন বসেন। সে কি আমার ভাল লাগার জন্য বলেছেন, নাকি জাহাজের বারান্দার সৌন্দর্য্য বুঝতে পেরে আমাকে জানালার পাশে বসতে দিচ্ছেন তা আমার বোধগম্য নয়। যাইহোক আমি বললাম, থ্যাঙ্কস আঙ্কেল। আমি বসবোনা, আপনি বসেন। আপনার ভাল লাগবে- বলে আগের সিটে বসে কিছুক্ষন পর জাহাজের বারান্দায় গেলাম সমুদ্রের ঢেউয়ের নাচ দেখতে।
আমরা সন্ধ্যা সন্ধ্যা সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফ চলে এলাম। টেকনাফ থেকে গাড়িতে করে যখন কক্সবাজার আসছিলাম তখন আকাশে পূর্ণ চাঁদ। আমরা গাইতে শুরু করলাম ‘চাদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে’।
Ruba-15আবার চলে এলাম কক্সবাজার হোটেল সী আলিফ-এ। একটু ফ্রেশ হয়ে নেমে গেলাম ডিনার করতে আর একটু বার্মিজ মার্কেটে ঢু মারতে। প্রথমে বার্মিজ মার্কেট ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে ডিনার করতে চলে এলাম রেস্টুরেন্টে। প্রতিদিন একই রেস্টুরেন্টে খেয়ে রেস্টুরেন্টের বয়গুলোও যেন আপন হয়ে গিয়েছিল। ঢুকতেই বয়গুলো মিষ্টি নির্ভেজাল হাসি দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাতো। কিন্তু সেদিন রাতে ডিনার করতে যেতে যেতে রাত ১১টা বেজে গেল। তখন রেস্টুরেন্টের বয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ১৫-১৬ বছর বয়সের সেই ছেলেটিকে আমার চোখ দুটো খুজছিল। কিন্তু ঐ ছেলেটিকে আর দেখতে পাইনি। ছেলেটা দেখতে কিউট ছিল, মানুষ হিসেবেও মনে হয়েছে ভাল। তাই ইচ্ছে ছিল ওকে কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলব। তবে এর আগেও বেশ কয়েকটা শপিংমলে আমি অল্পবয়স্ক ছেলেদেরকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি এবং কয়েকজনকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। ওরা কয়েকজন এখন স্কুলে পড়ে।
coxs-bazar-beach-10২৫ জানুয়ারী সোমবার। সকালে কক্সবাজার থেকে বিদায় নিতে হবে। জানিনা আবার কবে আসব এ জীবনে। আদৌ আর আসা হবে কিনা কক্সবাজারের প্রিয় সমুদ্র সৈকতে!
সকালে কক্সবাজার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম বান্দনবন যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বান্দরবন যাচ্ছি আকা বাকা পাহাড়ী পথ আর উচু-নিচু পাহাড়ের কথা ভেবে ভালই লাগছে। কিন্তু পরক্ষনেই এ ভেবে খারাপ লাগছে যে কক্সবাজার থেকে বিদায় নিচ্ছি। যেতে তো হবেই এখানে থাকার যে কোন অবকাশ নেই। প্রত্যেকেরই তার নির্দিষ্ট স্থানে যেতে হবেই শত চেষ্টা করেও এটা খন্ডানো যাবেনা।
উচু-নিচু শ্বাসরুদ্ধকর পাহাড়ী রাস্তা, চারপাশে সারিবদ্ধ পাহাড়, মেঘের সাথে ছোয়াছুঁয়ি, ঝর্ণার ধারা, বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অকৃত্রিম সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া; ভ্রমনের জন্য এর চেয়ে ভালো স্থান আর কিইবা হতে পারে! হ্যাঁ আমি প্রকৃতির এক অসাধারণ উপহার বান্দরবনের কথাই বলছি। দেশের সবচেয়ে কম জনবসতিপূর্ণ জেলা বান্দরবন। সকাল ৭টায় আমরা বান্দনবন যাওয়ার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ত্যাগ করলাম। বান্দরবনের দুই পাশে ঘন জঙ্গল আর বিশাল বিশাল পাহাড়। রাস্তাগুলো এমন আকাবাকা আর উচু নিচু মনে হচ্ছিল ফ্যান্টাসী কিংডম এর রোলার কোস্টারে রাইড করছি। গাড়ি আকা বাঁকা পথে চলতে চলতে একপর্যায় বান্দরবন স্ট্যান্ডে চলে এলো। আমাদের গাড়ি এই পর্যন্তই স্টপ আর ভিতরে যেতে পারবেনা। সেখান থেকে পাহাড়ী পথে নীলগিড়ি যাওয়ার জন্য ছোট ছোট ‘চাঁন্দের গাড়ি’ নামে এক ধরণের যানবাহন পাওয়া যায়। আমরা সেসব চাঁন্দের গাড়িতে করে রওনা হলাম নীলগিড়ির উদ্দেশ্যে।
ওরে বাবারে- চান্দের গাড়িগুলো এমন হেলেদুলে চলছিল পাহাড়ী পথে। যেন জীবনের শেষ নি:শ্বাস বুঝি এখানেই নিতে হবে। এখানকার রাস্তাগুলো এমনভাবে তৈরী যেন এক রাস্তা থেকে কিছু পথ সামনের রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় পাহাড়ের উচুতে খাড়া ভাবে উঠছে। খাড়া পথে চলতে কিছুটা ভয় পেলেও খুব অ্যাডভেঞ্চারিং টোর লাগছিল। চান্দের গাড়িগুলো যখন কোন মোর ঘুরে তখন যেন আমরাও চরকির মতো ঘুরতে থাকি। চান্দের গাড়িতে করে পুরোটা পথ আমরা হা হা হু হু করে হাসতে হাসতে যাচ্ছিলাম মুখ আর বন্ধ রাখতেই পারছিলাম না। সবাই গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলাম ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’, ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বান্দরবন থেকে নীলগিড়ি যেতে পথে চিম্বুক পাহাড় পার হয়ে যেতে হয়। ২৩০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট বাংলাদেশের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত চিম্বুক। চিম্বুক পাহাড় দেখতে ভারী সুন্দর। এই পাহাড়ের মূল অংশ থেকে সুর্যোদয় দেখতে অনেক মনোরম। তাই এই জায়গাটাকে বলা হয় চিম্বুকে সূর্যোদয়। চিম্বুক পাহাড় থেকে পাহাড়ী তেতুল কিনে নিলাম আদিবাসীদের কাছ থেকে। ভেবেছিলাম মিষ্টি হবে কিন্তু খুবই টক, যাইহোক পাহাড়ী তেতুল এটাও একটা পাহাড়ী ঐতিহ্য। এখানে কিছুক্ষন থেকে আবার নীলগিড়ির উদ্দেশ্যে পথ চলা। এরই মাঝে স্বপ্না আপার সুন্দন টুপিটা ভুল করে চিম্বুক পাহাড়ে রেখে গেছে। কি আর করার টুপির আশা ছেড়ে দিয়ে নীলগিড়ির নীলাকে দেখার উদ্দেশ্যে পাহাড়ী পথ ধরে চললাম সামনের দিকে। যদিও মনে হচ্ছিল রাস্তা ফুরোচ্ছেনা তবুও ভালই লাগছিল আকাবাকা পথে দুলতে দুলতে যেতে। যাচ্ছি আর দেখছি পাহাড় গুলো দেখতে কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন লাগছে। ভেবেছিলাম কুয়াশা পরেছে তাই এমন দেখাচ্ছে কিন্তু এক আদিবাসীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে পাহাড়গুলো অনেক দুরে তাই এমন কুয়াশাচ্ছন্ন দেখায় সব সময়।
coxs-bazar-beach-9পাহাড়গুলো যেন আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দারিয়ে আছে। দেখতে মেঘের মতো লাগছে। এভাবে হেলতে দুলতে চলে এলাম নীলগিড়িতে। নীলগিড়ি দেখতে আশ্চর্য রকম সুন্দর। এ যেন মেঘের উপর দাড়িয়ে আছে। বান্দরবন শহর থেকে ৪৮কিলোমিটার দুরে অবস্থিত এই মেঘের বাড়ি নীলগিড়ি। নীলগিড়ি পাহাড়ের চারপাশ থেকে যেন পুরো বান্দরবন দেখা যায়। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিটাকে তার নিপুন হাতে কত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন তা বুঝতে হলে প্রত্যেকেরই জীবনে একবার হলেও এখানে আশা উচিত। আকাশ যেমন নীল পাহাড়গুলোও যেন নীলাভা ধারণ করেছে। সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন এক পার্ক। বসার আসনগুলো এতো সুন্দর কারুকার্য করা মনে হয় যেন কোন জমিদার বাড়ি এসেছি। এমন মনোরম পরিবেশে ছবি না তুলে পারা যায়! তাই বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। পাহাড়ের চূড়ায় ক্যান্টিনের ব্যবস্থাও আছে। কিছুক্ষণ বেড়িয়ে সেখান থেকে লান্চ করে আবার যাত্রা শুরু করলাম বান্দরবন ফেরার উদ্দেশ্যে।
পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতেই মাঝপথে হঠাৎ চান্দের গাড়ি থামাল। এখানে নাকি পাহাড়ী আদিবাসীদের কিছু স্টল আছে তা দেখার এবং কিছু কেনাকাটার জন্য সবাই নামল কিন্তু আমি আর জোৎ¯œা আপা নামিনি। একটু পর স্বপ্না আপা আমায় ডাকতে লাগলেন। কি আশ্চর্য নামতে চাচ্ছিলাম না তবুও নেমে গেলাম কাছে। একি এ তো দেখছি ঝরনা। পাথরের পাহাড়ে ঝরনা। এটাই হচ্ছে শৈলপ্রপাত। বান্দরবানের রুমা সড়কের পাশে শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত প্রাকৃতিক ঝর্ণা হচ্ছে শৈলপ্রপাত। যদিও শীতের সময় ক্ষীনধারায় পানি নামছে তবে বর্ষায় প্রচুর পানি প্রবাহিত হয়। ঝর্ণার শীতল পানির ধারায় দেহ মন জুরিয়ে যায়। পাহাড়ের উপর থেকে বয়ে যাচ্ছে ঝরণার জলধারা। এই জলধারা কোথা থেকে আসছে আর কোথাইবা যাবে কে জানে!
কিছুটা সময় শৈলপ্রপাতে কাটিয়ে চলে এলাম বান্দরবন। সেখান থেকে আমাদের বাসে করে সোজা ঢাকায়। এভাবে রমণীয় কক্সবাজার থেকে রোমাঞ্চকর পরিবেশে তিন দিন কাটিয়ে চলে এলাম ব্যস্ত শহর ঢাকায় (সাভার), আমার ব্যস্ত জীবনে।
সাভার, ঢাকা।
২৬ জানুয়ারী.২০১৬

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

ভ্রমণ: তিন দিনের কক্সবাজার

প্রকাশের সময় : ০১:২৫:৩১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ মার্চ ২০১৬

রুবা আক্তার: ২২ জানুয়ারী’২০১৬ শুক্রবার। কথা ছিলো সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়বে সাভার থেকে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি চলছে কক্সবাজার যাবো বলে কথা। যটপট ৭:৩০ মিনিটের আগেই রেডি হয়ে গেলাম। হঠাৎ স্বপ্না আপা ফোন দিয়ে বলল- শাহিন ভাই (আমাদের টিম লিডার) তার বড় আপাকে উত্তরা থেকে আনতে গিয়ে জ্যামে আটকে গিয়েছেন, তাই গাড়ি রাত ৮:৩০ মিনিটে ছাড়বে। যথারীতি তৈরী হয়ে অপেক্ষা করা কি যে যন্ত্রনাময় তা আর বলব কি? অবশেষে অপেক্ষার পর ব্যাগ নিয়ে নামতে গিয়ে দেখি ব্যাগতো নয়, যেন একটা বস্তা হয়ে গেছে। ব্যাগের এতো ওজন বাবারে! যাক চার তলা থেকে নেমে গেইট এর কাছে যেতেই একটু স্বস্তি হলো, যে স্বপ্না আপার ব্যাগতো দেখছি আমার ব্যাগের ডাবল সাইজ। উনার দুই বোন বাস পর্যন্ত ব্যাগ ধরে এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
বাস ছাড়তে ছাড়তে বাজলো রাত ৯:০০ টা। গাড়ি চলছে জনপ্রিয় অমর শিল্পী মান্না দে’র গান (যদি কাগজে লিখো নাম) গান বাজিয়ে। আমি আর স্বপ্না আপা পাশাপাশি বসে যাচ্ছি। জানালার পাশের সিটে আমি। মনে হচ্ছিল যেন আকাশ পথে পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি আমাদের অতি কাঙ্খিত গন্তব্যস্থলে। গাড়ি এখন ঢাকার কল্যাণপুর, আমাদের আরেক বড় আপা (জোৎ¯œা বেগম) ও তার স্বামী (মোহাম্মদ মতিন চৌধুরী) গাড়িতে উঠলেন। ভালো লাগার মুহুর্ত যেন টেস্টিং সল্ট দিয়ে আর একটু টেস্টি হয়ে গেল। আমি, স্বপ্না আপা আর জোৎ¯œা আপা বয়সের তারতম্য থাকলেও মন যেন একই বয়সের। গাড়ি কাচপুর ব্রীজের কাছে যেতেই ড্রাইভার সাহেব এমন সব গান বাজাতে শুরু করল মনে হচ্ছিল আমরা পাগলা বাবার মাজারে যাচ্ছি। জোৎ¯œা আপাতো বলেই বসল ‘ড্রাইভার সাহেব এসব কি গান প্লে করছেন? সুন্দর সুন্দর গান দেন’। স্বপ্না আপার কথায় একপর্যায় ভারতীয় বাংলা গান প্লে করল। যাক ভালোই লাগছিল। যখন আমরা মেঘনা পাড়ে, তখন প্রচন্ড শীত লাগছিল। মতিন ভাই বলছিলেন- গত রাতে নাকি খবরে বলেছে কাল থেকে শৈত প্রবাহ শুরু। ও মাই গড! একে তো প্রচন্ড শীত, তার উপর কুয়াশা। কক্সবাজারে এমন শীত আর কুয়াশা পড়লে কিভাবে উপভোগ করব ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাচ্ছি….যাচ্ছি…. সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারছিনা। প্রচন্ড শীত। গায়ে স্যুয়েটার পরা, স্বপ্না আপা আর আমি দুজনে এক চাদরে ঢেকে বসেছি। শীতকে কোনভাবেই হার মানাতে পারছি না। ফজরের আযান হচ্ছে- আমরা তখন চট্টগ্রাম পাড় হয়ে কক্সবাজার সীমানায় চলে আসছি। শীত আমাদেরকে ভালোভাবেই ভালবেসে জড়িয়ে আছে।
Ruba-1২৩ জানুয়ারী শনিবার। ভোর হয়েছে, সূর্য দেখা যাচ্ছে। গাড়ি এক পর্যায়ে কক্সবাজার সী বিচের কাছাকাছি হোটেল (সী আলিফ) এর কাছে চলে এলো, আমরা নামলাম।
আমি তো অবাক! কি ব্যাপার কি হলো……..
সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছি, হিম হিম শীত, এখানকার আবহাওয়াতো মনোরোম লাগছে। ওহ…… মনটাই ভালো হয়ে গেল। আমি আর স্বপ্না আপা হোটেল সী আলিফ-এর ৫০৫ নং কক্ষে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পরলাম সমুদ্র দেখার উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে এক অসাধারণ অনুভূতি…………যা বলে বোঝাতে পারবো না। সমুদ্র যে এতো ভাললাগার, ছবি দেখে পরিপূর্ণ অনুভব কখনোই করা সম্ভব নয়। গোসলের কোন প্রস্তুতি ছিলনা কোন কিছু না ভেবেই নেমে পরলাম বীচে আমি আর জোৎ¯œা আপা। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বিশাল জলরাশি………সে এক বিশাল অনুভূতি। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩৪ কিলোমিটার। শুনেছি এখানকার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য দেখার জন্য বছরে ১০ লাখেরও বেশী পর্যটক ভীড় জমায়।
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দুপুরে লাঞ্চ করতে রেস্টুরেন্টে গেলাম। সমুদ্রের পাড়ে লাঞ্চ বলে কথা………..সামুদ্রিক মাছতো খেতেই হবে। লাঞ্চ শেষে বের হয়ে পরলাম হিমছড়ির উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে ইনানী বীচ। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার পথটা বীচের পাড় দিয়ে যেন সমুদ্র আমাদের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে।
Ruba-3চলে এলাম হিমছড়ি পাহাড়ের কাছে। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দুরে রয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেষে সমুদ্র সৈকত হিমছড়ি। সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, আকাশ ছোঁয়া পাহাড় সব মিলিয়ে এক চোখ ধাধানো প্রকৃতি। পাহাড়ে উঠছি, খাড়া পাহাড়, সিড়ি আছে বটে, তবুও মনে হচ্ছিল হিমালয় পাড়ি দিচ্ছি। এরই মাঝে আমাদের আরেক মজার মানুষ (উজ্জ্বল দা) বলছিলেন ‘এখনই বোঝা যাবে আমাদের মাঝে কারো হার্টের সমস্যা আছে কিনা’।
অনেক কষ্ট করে একসময় হিমছড়ি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। মনে হলো- যেন এভারেষ্ট জয় করে এলাম। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পাশে দাড়িয়ে থাকা শান্ত পাহারগুলো যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আরেক পাশে সমুদ্রের ঢেউ যেন দখিনার হাওয়া দিয়ে দেহটাকে সতেজ করে দিল। কি আশ্চর্য শিহরন; বিশাল পাহাড় আর সীমাহীন সমুদ্রের নিরব ভালবাসা পেয়ে আমি যেন পরিপূর্ণ। মনে হলো- ‘পৃথিবীর কাছে যেনো আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।’
Ruba-5সন্ধ্যা হতে আর বেশি বাকি নেই এরই মাঝে আমাদেরকে যেয়ে আসতে হবে ইনানী বীচ থেকে। তাই হিমছড়িকে আর সময় না দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে রওনা হলাম ইনানী বীচের উদ্দেশ্যে। হিমছড়ি ছাড়িয়ে প্রায় ৮ কিলোমিটার এগিয়ে আরেক আকর্ষনীয় সৈকত ইনানী। ইনানী বীচ যেন কানায় কানায় পরিপূর্ণ যৌবনবতী এক নারী। যা শুধুই ভাল লাগার। তাই মন যে কখন গেয়ে উঠল, ‘হৃদয় আমার নাচেরে’।
এরপর হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে রেস্টুরেন্টে। তারপর রাতে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটাকে বিছানায় ফেলতেই গভীর ঘুম। ঘুম ভাঙল ভোর ৪:৩০ মিনিটে এলার্মের শব্দে। ৫:৩০ মিনিটে বের হতে হবে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে।
Ruba-4২৪ জানুয়ারী রোববার। সকাল ৫:৩০ মিনিটে আমরা সবাই গাড়িতে করে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে টেকনাফ যাচ্ছিলাম। গাড়িতে বাজছিল মাধুরীর সব মনোমুগ্ধকর গান। মনটা এতো ফুরফুরে লাগছিল যেন কাশফুলের নরম ছোয়া। তখন জীবনের সব ভাল লাগা মুহুর্তের কথা বার বার মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বিশাল সমুদ্রের গভীরতা মাপা গেলেও মানুষের মনের গভীরতা মাপা কারো সাধ্য নেই……….। যাক মানুষের সাধ্যের বাইরে কিছুই নেই।
আমরা এক পর্যায় টেকনাফ চলে এলাম। টেকনাফে সকালের নাস্তা করে ‘কিয়ারী সিন্দবাদ’ নামে জাহাজে করে আমরা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে নাফ নদীতে যাত্রা শুরু করলাম। যেকোন যানবাহনেই বরাবরই আমি জানালার পাশে বসার চেষ্টা করি। এখানেও তাই করলাম। কিন্তু আমাদের সাথে একজন ৭০ এর উর্দ্ধ বয়সী (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার) আমাদের ভ্রমনের সবচেয়ে প্রবীণ ভ্রমন পিপাসুকে কেউ আংকেল, কেউবা নানা বলে সম্বোধন করছিলেন। যে সারিতে আমার সিট ছিল, সেই সারির জানালার পাশের সিটটিতে উনি বসেছেন। বয়স্ক মানুষ, তাই যথেষ্ঠ শ্রদ্ধার সাথে মিষ্টি করে বললাম আঙ্কেল আপনি একটু এই দিকটাতে বসবেন, আমি ওখানটাতে বসতাম! আংকেল তো ২৫ বছরের তাগরা যুবকের মেজাজ আর বল নিয়ে বললেন, ‘না আমি এখানেই বসব, আপনি অন্য দিকে বসেন’। কি আর করার বৃদ্ধ যুবককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সারির মাঝামাঝিতে বসলাম। কিছুক্ষন পর দেখলাম সমুদ্রের সৌন্দর্য্য সবাই জাহাজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে। মনে হলো- বুড়ো চাচারও খুব ইচ্ছে করছে বারান্দায় গিয়ে সমুদ্রের সুধা পান করতে। কিন্তু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন আর পরক্ষনেই ভাবছেন সিটটা যদি অন্য কেউ দখল করে নেয়! এই কথা আমি আমার পাশে বসা জোৎ¯œা আপার সাথে শেয়ার করলাম আর বললাম ‘বুড়া চাচা তো মাইনকার চিপায় পরছে’। আর হাসির রানী জোৎ¯œা আপা হাসতে হাসতে হেলেদুলে একাকার। একপর্যায়ে আমিও জাহাজের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম সমুদ্রের সুধা পান করতে। সমুদ্রের তীব্র বাতাসে আমার দেহখানি যেন শীতল হয়ে গেলো। উঞ্চ হৃদয়কে শীতল করতে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস নিলাম। চোখ খুলে দেখি বুড়ো চাচা আমার সামনের দিকে জাহাজের গ্রীল ধরে সমুদ্রের ঢেউয়ের খেলা দেখছেন। সমুদ্রে ডলফিন লাফিয়ে তার যৌবনভরা দেহটাকে বার বার ভ্রমণ পিপাসুদের যেন নাচ দেখাচ্ছে। মৃদু হেসে ভাবছিলাম যে- দেহ আর মনের কত তফাৎ! দেহের বয়স হলেও মনের বয়সকে স্থির রাখা যায় যদি সে নিজে চায়।
কবুতরের মতো রিষ্ট-পুষ্ট অতিথি পাখিগুলো যেন আমাদের সঙ্গী হয়ে সেন্ট মার্টিন পাড়ি জমাচ্ছে। যদিও ওরা ওদের মৌলিক প্রয়োজনে আমাদের সাথে যাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা তাদের পাখনা ওড়াতে ওড়াতে জীবনযুদ্ধে পাড়ি দিচ্ছিল রনক্ষেত্র। জাহাজ থেকে অনেকেই বিভিন্ন ধরণের চিপস খেতে দিচ্ছিল পাখিগুলোকে। আর পাখিরা একটি আরেকটিকে অতিক্রম করে ছিনিয়ে নিচ্ছিল তাদের কাঙ্খিত খাবারটি। এখানেই মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। কারণ মানুষকে যে সৃষ্টিকর্তা ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ হিসেবে বিবেক দিয়ে পাঠিয়েছেন এই ধরণীতে। আমরা কি সেটা মনে রাখি? দেহটা যখন প্রচন্ড বাতাসে শীতল হয়ে এলো, তখন দেহটাকে একটু আরাম দিতে জাহাজের ভেতরে এসে একটা সিটে বসে মাথার টুপিটা সামনের দিকে হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে খানিক্ষন ঘুমিয়ে নিলাম। এরই মাঝে শুনতে পেলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপ নাকি দেখা যাচ্ছে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, কোথায় কোথায়…..সেন্ট মার্টিন দ্বীপ? ভীড়ের মাঝে জাহাজের ভেতর থেকে বাইরের দিকে আসতে আসতে জাহাজ ততক্ষনে সেন্টমার্টিন দ্বীপে এসে পৌছে গেছে। টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ছোট্ট একটি দ্বীপ ‘সেন্টমার্টিন’। আয়তনে ৮ বর্গকিলোমিটার।
জাহাজ থেকে নেমে যখন দ্বীপের মাটিতে, মাটিতো নয় বালিতে পা রাখলাম তখন মনে হচ্ছিল যেন চন্দ্র পৃষ্ঠে পা রাখলাম।
যেহেতু দ্বীপে আসতেই দুপুর ১২:৩০ বেজে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত হলো লাঞ্চ করে আমরা যা দেখার দেখব। লাঞ্চ-এর উদ্দেশ্যে দ্বীপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। স্বপ্না আপার পরিচিত এক হোটেল মালিক আছে তার হোটেলে লাঞ্চ করব আমরা। দ্বীপের মাঝখান দিয়ে রাস্তা ধরে হাটছি। হাটছি তো হাটছিই। প্রায় ৩০ মিনিট হাটার পর পেলাম হোটেল সী প্রবাল যার মালিক স্বপ্না আপার পরিচিত। সবাই বলাবলি করছিল জাহাজের কাছাকাছি কোথাও তো লাঞ্চ করা যেতো। এতো দুরে আসার কোন মানে হয়? যাক আমরা হোটেল সী প্রবালের গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। সী প্রবালের আঙ্গিনা দেখে সবাই তো অবাক। একি সেন্টমার্টিনের বীচতো দেখছি সী প্রবালের আঙ্গিনা। হোটেলটা দেখতে বেশ সুন্দর। খোলা জায়গায় ছনের চাল, তিন পাশে গাছ আর একপাশ সমুদ্র সৈকত। জাস্ট ভাবাই যায়না প্রকৃতি এতো সুন্দর হতে পারে। লাঞ্চ করবে কি সবাই দৌড়ে সী প্রবালের আঙ্গিনা অর্থাৎ সমুদ্র সৈকতে নিজেদেরকে পেরাসুটের মতো উড়িয়ে দিচ্ছিল। বলা ঠিক না তবুও বলি আমি ভাল ছবি তুলতে পারি এবং ছবি উঠাতেও পছন্দ করি। অনেকের ছবি তুলে দিলাম ক্যামেরায়। দুঃখের বিষয় নিজের ছবি তোলার মতো ভাল কোন ফটোগ্রাফার পেলাম না। যাক আমাদের সকলের দুলাভাই মতিন ভাই আমার সকল ছবি তুলে দিয়েছেন। আসলে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্র্য্য পুরোপুরিভাবে উপভোগ করতে হলে কমপক্ষে তিন দিন, তিন রাত সেখানে স্টে করতে হবে তা না হলে সম্ভব নয়। আমাদের ভাগ্যে ছিল মাত্র একদিন, তাও আবার কয়েক ঘন্টা। এই অল্প সময়ে মনের ক্ষুধা কিছুটা মিটিয়ে চলে এলাম জাহাজে।
Ruba-6জাহাজ সেন্ট মার্টিন থেকে ছাড়ল বিকেল ৩:৩০মিনিটে। সেই বুড়ো চাচা জাহাজের ভিতর আমাকে খুজছে। একে ওকে জিজ্ঞেস করছে, ঐ মেয়েটা কোথায়?…………. তো আমাকে পেয়ে বলল ‘আপনি তো জানালার পাশে বসতে চেয়েছিলেন এখন বসেন। সে কি আমার ভাল লাগার জন্য বলেছেন, নাকি জাহাজের বারান্দার সৌন্দর্য্য বুঝতে পেরে আমাকে জানালার পাশে বসতে দিচ্ছেন তা আমার বোধগম্য নয়। যাইহোক আমি বললাম, থ্যাঙ্কস আঙ্কেল। আমি বসবোনা, আপনি বসেন। আপনার ভাল লাগবে- বলে আগের সিটে বসে কিছুক্ষন পর জাহাজের বারান্দায় গেলাম সমুদ্রের ঢেউয়ের নাচ দেখতে।
আমরা সন্ধ্যা সন্ধ্যা সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফ চলে এলাম। টেকনাফ থেকে গাড়িতে করে যখন কক্সবাজার আসছিলাম তখন আকাশে পূর্ণ চাঁদ। আমরা গাইতে শুরু করলাম ‘চাদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে’।
Ruba-15আবার চলে এলাম কক্সবাজার হোটেল সী আলিফ-এ। একটু ফ্রেশ হয়ে নেমে গেলাম ডিনার করতে আর একটু বার্মিজ মার্কেটে ঢু মারতে। প্রথমে বার্মিজ মার্কেট ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে ডিনার করতে চলে এলাম রেস্টুরেন্টে। প্রতিদিন একই রেস্টুরেন্টে খেয়ে রেস্টুরেন্টের বয়গুলোও যেন আপন হয়ে গিয়েছিল। ঢুকতেই বয়গুলো মিষ্টি নির্ভেজাল হাসি দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাতো। কিন্তু সেদিন রাতে ডিনার করতে যেতে যেতে রাত ১১টা বেজে গেল। তখন রেস্টুরেন্টের বয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ১৫-১৬ বছর বয়সের সেই ছেলেটিকে আমার চোখ দুটো খুজছিল। কিন্তু ঐ ছেলেটিকে আর দেখতে পাইনি। ছেলেটা দেখতে কিউট ছিল, মানুষ হিসেবেও মনে হয়েছে ভাল। তাই ইচ্ছে ছিল ওকে কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলব। তবে এর আগেও বেশ কয়েকটা শপিংমলে আমি অল্পবয়স্ক ছেলেদেরকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি এবং কয়েকজনকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। ওরা কয়েকজন এখন স্কুলে পড়ে।
coxs-bazar-beach-10২৫ জানুয়ারী সোমবার। সকালে কক্সবাজার থেকে বিদায় নিতে হবে। জানিনা আবার কবে আসব এ জীবনে। আদৌ আর আসা হবে কিনা কক্সবাজারের প্রিয় সমুদ্র সৈকতে!
সকালে কক্সবাজার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম বান্দনবন যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বান্দরবন যাচ্ছি আকা বাকা পাহাড়ী পথ আর উচু-নিচু পাহাড়ের কথা ভেবে ভালই লাগছে। কিন্তু পরক্ষনেই এ ভেবে খারাপ লাগছে যে কক্সবাজার থেকে বিদায় নিচ্ছি। যেতে তো হবেই এখানে থাকার যে কোন অবকাশ নেই। প্রত্যেকেরই তার নির্দিষ্ট স্থানে যেতে হবেই শত চেষ্টা করেও এটা খন্ডানো যাবেনা।
উচু-নিচু শ্বাসরুদ্ধকর পাহাড়ী রাস্তা, চারপাশে সারিবদ্ধ পাহাড়, মেঘের সাথে ছোয়াছুঁয়ি, ঝর্ণার ধারা, বহু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অকৃত্রিম সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া; ভ্রমনের জন্য এর চেয়ে ভালো স্থান আর কিইবা হতে পারে! হ্যাঁ আমি প্রকৃতির এক অসাধারণ উপহার বান্দরবনের কথাই বলছি। দেশের সবচেয়ে কম জনবসতিপূর্ণ জেলা বান্দরবন। সকাল ৭টায় আমরা বান্দনবন যাওয়ার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ত্যাগ করলাম। বান্দরবনের দুই পাশে ঘন জঙ্গল আর বিশাল বিশাল পাহাড়। রাস্তাগুলো এমন আকাবাকা আর উচু নিচু মনে হচ্ছিল ফ্যান্টাসী কিংডম এর রোলার কোস্টারে রাইড করছি। গাড়ি আকা বাঁকা পথে চলতে চলতে একপর্যায় বান্দরবন স্ট্যান্ডে চলে এলো। আমাদের গাড়ি এই পর্যন্তই স্টপ আর ভিতরে যেতে পারবেনা। সেখান থেকে পাহাড়ী পথে নীলগিড়ি যাওয়ার জন্য ছোট ছোট ‘চাঁন্দের গাড়ি’ নামে এক ধরণের যানবাহন পাওয়া যায়। আমরা সেসব চাঁন্দের গাড়িতে করে রওনা হলাম নীলগিড়ির উদ্দেশ্যে।
ওরে বাবারে- চান্দের গাড়িগুলো এমন হেলেদুলে চলছিল পাহাড়ী পথে। যেন জীবনের শেষ নি:শ্বাস বুঝি এখানেই নিতে হবে। এখানকার রাস্তাগুলো এমনভাবে তৈরী যেন এক রাস্তা থেকে কিছু পথ সামনের রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় পাহাড়ের উচুতে খাড়া ভাবে উঠছে। খাড়া পথে চলতে কিছুটা ভয় পেলেও খুব অ্যাডভেঞ্চারিং টোর লাগছিল। চান্দের গাড়িগুলো যখন কোন মোর ঘুরে তখন যেন আমরাও চরকির মতো ঘুরতে থাকি। চান্দের গাড়িতে করে পুরোটা পথ আমরা হা হা হু হু করে হাসতে হাসতে যাচ্ছিলাম মুখ আর বন্ধ রাখতেই পারছিলাম না। সবাই গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলাম ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’, ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বান্দরবন থেকে নীলগিড়ি যেতে পথে চিম্বুক পাহাড় পার হয়ে যেতে হয়। ২৩০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট বাংলাদেশের তৃতীয় উচ্চতম পর্বত চিম্বুক। চিম্বুক পাহাড় দেখতে ভারী সুন্দর। এই পাহাড়ের মূল অংশ থেকে সুর্যোদয় দেখতে অনেক মনোরম। তাই এই জায়গাটাকে বলা হয় চিম্বুকে সূর্যোদয়। চিম্বুক পাহাড় থেকে পাহাড়ী তেতুল কিনে নিলাম আদিবাসীদের কাছ থেকে। ভেবেছিলাম মিষ্টি হবে কিন্তু খুবই টক, যাইহোক পাহাড়ী তেতুল এটাও একটা পাহাড়ী ঐতিহ্য। এখানে কিছুক্ষন থেকে আবার নীলগিড়ির উদ্দেশ্যে পথ চলা। এরই মাঝে স্বপ্না আপার সুন্দন টুপিটা ভুল করে চিম্বুক পাহাড়ে রেখে গেছে। কি আর করার টুপির আশা ছেড়ে দিয়ে নীলগিড়ির নীলাকে দেখার উদ্দেশ্যে পাহাড়ী পথ ধরে চললাম সামনের দিকে। যদিও মনে হচ্ছিল রাস্তা ফুরোচ্ছেনা তবুও ভালই লাগছিল আকাবাকা পথে দুলতে দুলতে যেতে। যাচ্ছি আর দেখছি পাহাড় গুলো দেখতে কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন লাগছে। ভেবেছিলাম কুয়াশা পরেছে তাই এমন দেখাচ্ছে কিন্তু এক আদিবাসীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে পাহাড়গুলো অনেক দুরে তাই এমন কুয়াশাচ্ছন্ন দেখায় সব সময়।
coxs-bazar-beach-9পাহাড়গুলো যেন আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দারিয়ে আছে। দেখতে মেঘের মতো লাগছে। এভাবে হেলতে দুলতে চলে এলাম নীলগিড়িতে। নীলগিড়ি দেখতে আশ্চর্য রকম সুন্দর। এ যেন মেঘের উপর দাড়িয়ে আছে। বান্দরবন শহর থেকে ৪৮কিলোমিটার দুরে অবস্থিত এই মেঘের বাড়ি নীলগিড়ি। নীলগিড়ি পাহাড়ের চারপাশ থেকে যেন পুরো বান্দরবন দেখা যায়। সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতিটাকে তার নিপুন হাতে কত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন তা বুঝতে হলে প্রত্যেকেরই জীবনে একবার হলেও এখানে আশা উচিত। আকাশ যেমন নীল পাহাড়গুলোও যেন নীলাভা ধারণ করেছে। সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন এক পার্ক। বসার আসনগুলো এতো সুন্দর কারুকার্য করা মনে হয় যেন কোন জমিদার বাড়ি এসেছি। এমন মনোরম পরিবেশে ছবি না তুলে পারা যায়! তাই বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। পাহাড়ের চূড়ায় ক্যান্টিনের ব্যবস্থাও আছে। কিছুক্ষণ বেড়িয়ে সেখান থেকে লান্চ করে আবার যাত্রা শুরু করলাম বান্দরবন ফেরার উদ্দেশ্যে।
পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতেই মাঝপথে হঠাৎ চান্দের গাড়ি থামাল। এখানে নাকি পাহাড়ী আদিবাসীদের কিছু স্টল আছে তা দেখার এবং কিছু কেনাকাটার জন্য সবাই নামল কিন্তু আমি আর জোৎ¯œা আপা নামিনি। একটু পর স্বপ্না আপা আমায় ডাকতে লাগলেন। কি আশ্চর্য নামতে চাচ্ছিলাম না তবুও নেমে গেলাম কাছে। একি এ তো দেখছি ঝরনা। পাথরের পাহাড়ে ঝরনা। এটাই হচ্ছে শৈলপ্রপাত। বান্দরবানের রুমা সড়কের পাশে শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত প্রাকৃতিক ঝর্ণা হচ্ছে শৈলপ্রপাত। যদিও শীতের সময় ক্ষীনধারায় পানি নামছে তবে বর্ষায় প্রচুর পানি প্রবাহিত হয়। ঝর্ণার শীতল পানির ধারায় দেহ মন জুরিয়ে যায়। পাহাড়ের উপর থেকে বয়ে যাচ্ছে ঝরণার জলধারা। এই জলধারা কোথা থেকে আসছে আর কোথাইবা যাবে কে জানে!
কিছুটা সময় শৈলপ্রপাতে কাটিয়ে চলে এলাম বান্দরবন। সেখান থেকে আমাদের বাসে করে সোজা ঢাকায়। এভাবে রমণীয় কক্সবাজার থেকে রোমাঞ্চকর পরিবেশে তিন দিন কাটিয়ে চলে এলাম ব্যস্ত শহর ঢাকায় (সাভার), আমার ব্যস্ত জীবনে।
সাভার, ঢাকা।
২৬ জানুয়ারী.২০১৬