নিউইয়র্ক ০৮:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

৭ নভেম্বর : জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিস : নব অধ্যায়ের সূচনা

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:২৪:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০১৪
  • / ১০৪২ বার পঠিত

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা অফিসারদের মধ্যে কেউ কেউ সেনাবাহিনীতে না ফিরে ভিন্ন ভিন্ন পেশা ও কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতেই থেকে যান। ১৯৭৫ সালের আগস্টের শেষ দিকে তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়। জেনারেল ওসমানীকে করা হয় প্রেসিডেন্টের সামরিক উপদেষ্টা। ৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের (১৯৭৫) অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের নামে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই অভ্যুত্থানের সূচনা পর্বেই জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয় এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তার স্থলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্য রাত পর্যন্ত দেশে একটা আতঙ্কজনক ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করে। এ অভ্যুত্থানের একটি রাজনৈতিক চিত্র বেরিয়ে আসে অচিরেই। অভ্যুত্থানকে স্বাগত ও সমর্থন জানিয়ে যে মিছিল বের হয় তাতে জনমনে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ১৫ আগস্টের পূর্ব-ক্ষমতাসীন শাসক দল বা শ্রেণীর সমর্থনেই অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছে। ১৫ আগস্ট-পূর্ব দেশের সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে জনমনে একই সঙ্গে শঙ্কা, ভীতি ও ক্ষোভ দেখা দেয়। ১৫ আগস্ট-পূর্ব পরিস্থিতির পুনরাবির্ভাব জনগণের কাম্য ছিল না। ফলে বলা যায়, শুরুতেই অভ্যুত্থানকারীরা জনসমর্থন হারান। তাছাড়া, এ অভ্যুত্থান ‘ভারতপন্থী’ হওয়ার ধারণাও জন্ম দেয়। ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের অতি উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস এরূপ ধারণা সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে প্রতিভাত হয়।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশের দ্বারা সংঘটিত হওয়ায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এর একটি রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর বৃহদাংশের বিশেষ করে সিপাহিদের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই প্রতিক্রিয়ার পেছনে আরও একটা বড় কারণ ছিল জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে দেয়া এবং আটক করা। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে বিশেষত সিপাহিদের কাছে ছিলেন খুবই প্রিয়। তারা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় এক অনন্য সাধারণ বিপ্লব- যা ইতিহাসে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে স্থান লাভ করেছে। বিপ্লবীরা প্রথমে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এবং তাকে কাঁধে নিয়ে উল্লাসের মধ্য দিয়ে পূর্বপদে বরণ করে নেয়। বিশ্বের কোনো সেনানায়ককে অফিসার ও সিপাহিরা এভাবে পদে ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন- এমন নজির বিরল।
৭ নভেম্বরের বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় দিক এই যে, এই বিপ্লবে সিপাহি ও জনতার আকাংক্ষা একই লক্ষ্যকে ধারণ করে একই বৈপ্লবিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে একাকার হয়ে যায়। সিপাহি-জনতার এরূপ সম্মিলিত বিপ্লবের ঘটনাও ইতিহাসে খুব বেশি নেই। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অস্তিত্ব যে অনিশ্চয়তা ও বিপন্নতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটে। তাই এ বিপ্লব থেকে আরও একবার প্রমাণিত হয় যে, সিপাহি-জনতার ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য এবং ঐক্যবদ্ধ তৎপরতাই স্বাধীন অস্তিত্বকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে পারে। বস্তুত, এই বিপ্লবের পথ ধরে দেশ-জাতিও এক নবঅধ্যায়ে প্রবেশ করে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, খন্দকার মোশতাক আহমদের স্থলে পূর্ব নির্ধারিত ও নভেম্বর তারিখে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ঐদিনই মধ্যরাতে সংঘটিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়, তাতে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধানের পদে প্রত্যাবর্তন করা ছাড়াও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে প্রদত্ত ভাষণে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী আর পুলিশ, বিডিআর, আনসার এবং অন্যান্যের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ মার্শাল ’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এ দায়িত্ব ইনশাল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আপনারা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সর্বস্থানে, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, স্থলবন্দর, বিমানবন্দর, নৌবন্দর, যানবাহন ও কলকারখানাগুলো পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। খোদা হাফেজ।’
জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় এভাবেই অভিষেক ঘটে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট সায়েমের স্থলে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২২ এপ্রিল রেডিও, টিভি ভাষণে তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিভিন্ন সময়ে দেশ ও জাতি আমার ওপর বিভিন্ন দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে। আমি আমার সাধ্যমত সে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছি এবং আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টার ভিত্তি হিসেবে আমাদের সমর্থনের ওপরই নির্ভর করেছি। দেশ পরিচালনার ব্যাপারে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য বিষয়ে ইতিমধ্যে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আরও কতিপয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন আমার ওপর দেশের রাষ্ট্রপতির গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। ইনশাল্লাহ এবারও আমি আপনাদের সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করবো।’
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রদত্ত তার এ প্রথম ভাষণে তিনি পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট সায়েমের প্রতি নিষ্ঠাসহকারে গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। ঐ ভাষণে তিনি তার ও তার সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে নির্বাচিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করেন। ’৭৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন এবং দেশের মানুষের মন-মানসিকতা, আশা ও আকাংক্ষার বাস্তব প্রতিফলনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী জারি করার কথা অবহিত করেন।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে, সংবিধান সংশোধনের কাজটি তিনই প্রথম করেন। ঐ ২২ এপ্রিলেই (১৯৭৭) প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা প্রদান করেন।
এই সংশোধনী অনুযায়ী, সকল কর্মের ভিত্তি হিসেবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থাই রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি বলে গৃহীত হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এ কথাগুলো সংযুক্ত করার কথা বলা হয়। এই ঘোষণা বলে ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গৃহীত হয়।
‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত করা।’
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাষ্ট্রীয় দর্শন, রাজনীতি, জাতিসত্তাগত পরিচয় নির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে নবধারার সূচনা হয়। এই ধারার সঙ্গে জনগণের আশা-আকাংক্ষা ও প্রত্যাশা যে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা তারই প্রমাণ বহন করে। (দৈনিক ইনকিলাব)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

৭ নভেম্বর : জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিস : নব অধ্যায়ের সূচনা

প্রকাশের সময় : ০১:২৪:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০১৪

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা অফিসারদের মধ্যে কেউ কেউ সেনাবাহিনীতে না ফিরে ভিন্ন ভিন্ন পেশা ও কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতেই থেকে যান। ১৯৭৫ সালের আগস্টের শেষ দিকে তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান করা হয়। জেনারেল ওসমানীকে করা হয় প্রেসিডেন্টের সামরিক উপদেষ্টা। ৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের (১৯৭৫) অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের নামে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই অভ্যুত্থানের সূচনা পর্বেই জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয় এবং সেনাবাহিনী প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তার স্থলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর মধ্য রাত পর্যন্ত দেশে একটা আতঙ্কজনক ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করে। এ অভ্যুত্থানের একটি রাজনৈতিক চিত্র বেরিয়ে আসে অচিরেই। অভ্যুত্থানকে স্বাগত ও সমর্থন জানিয়ে যে মিছিল বের হয় তাতে জনমনে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ১৫ আগস্টের পূর্ব-ক্ষমতাসীন শাসক দল বা শ্রেণীর সমর্থনেই অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয়েছে। ১৫ আগস্ট-পূর্ব দেশের সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে জনমনে একই সঙ্গে শঙ্কা, ভীতি ও ক্ষোভ দেখা দেয়। ১৫ আগস্ট-পূর্ব পরিস্থিতির পুনরাবির্ভাব জনগণের কাম্য ছিল না। ফলে বলা যায়, শুরুতেই অভ্যুত্থানকারীরা জনসমর্থন হারান। তাছাড়া, এ অভ্যুত্থান ‘ভারতপন্থী’ হওয়ার ধারণাও জন্ম দেয়। ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের অতি উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস এরূপ ধারণা সৃষ্টির মূল কারণ হিসেবে প্রতিভাত হয়।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশের দ্বারা সংঘটিত হওয়ায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এর একটি রাজনৈতিক পরিচয় দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর বৃহদাংশের বিশেষ করে সিপাহিদের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই প্রতিক্রিয়ার পেছনে আরও একটা বড় কারণ ছিল জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে দেয়া এবং আটক করা। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে বিশেষত সিপাহিদের কাছে ছিলেন খুবই প্রিয়। তারা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় এক অনন্য সাধারণ বিপ্লব- যা ইতিহাসে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে স্থান লাভ করেছে। বিপ্লবীরা প্রথমে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এবং তাকে কাঁধে নিয়ে উল্লাসের মধ্য দিয়ে পূর্বপদে বরণ করে নেয়। বিশ্বের কোনো সেনানায়ককে অফিসার ও সিপাহিরা এভাবে পদে ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন- এমন নজির বিরল।
৭ নভেম্বরের বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় দিক এই যে, এই বিপ্লবে সিপাহি ও জনতার আকাংক্ষা একই লক্ষ্যকে ধারণ করে একই বৈপ্লবিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে একাকার হয়ে যায়। সিপাহি-জনতার এরূপ সম্মিলিত বিপ্লবের ঘটনাও ইতিহাসে খুব বেশি নেই। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অস্তিত্ব যে অনিশ্চয়তা ও বিপন্নতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটে। তাই এ বিপ্লব থেকে আরও একবার প্রমাণিত হয় যে, সিপাহি-জনতার ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য এবং ঐক্যবদ্ধ তৎপরতাই স্বাধীন অস্তিত্বকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে পারে। বস্তুত, এই বিপ্লবের পথ ধরে দেশ-জাতিও এক নবঅধ্যায়ে প্রবেশ করে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, খন্দকার মোশতাক আহমদের স্থলে পূর্ব নির্ধারিত ও নভেম্বর তারিখে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ঐদিনই মধ্যরাতে সংঘটিত সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়, তাতে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধানের পদে প্রত্যাবর্তন করা ছাড়াও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে প্রদত্ত ভাষণে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী আর পুলিশ, বিডিআর, আনসার এবং অন্যান্যের অনুরোধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ মার্শাল ’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এ দায়িত্ব ইনশাল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আপনারা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন। দেশের সর্বস্থানে, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, স্থলবন্দর, বিমানবন্দর, নৌবন্দর, যানবাহন ও কলকারখানাগুলো পূর্ণভাবে চালু থাকবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। খোদা হাফেজ।’
জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় এভাবেই অভিষেক ঘটে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট সায়েমের স্থলে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২২ এপ্রিল রেডিও, টিভি ভাষণে তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিভিন্ন সময়ে দেশ ও জাতি আমার ওপর বিভিন্ন দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে। আমি আমার সাধ্যমত সে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছি এবং আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টার ভিত্তি হিসেবে আমাদের সমর্থনের ওপরই নির্ভর করেছি। দেশ পরিচালনার ব্যাপারে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য বিষয়ে ইতিমধ্যে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আরও কতিপয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন আমার ওপর দেশের রাষ্ট্রপতির গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। ইনশাল্লাহ এবারও আমি আপনাদের সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করবো।’
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রদত্ত তার এ প্রথম ভাষণে তিনি পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট সায়েমের প্রতি নিষ্ঠাসহকারে গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। ঐ ভাষণে তিনি তার ও তার সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে নির্বাচিত সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করেন। ’৭৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন এবং দেশের মানুষের মন-মানসিকতা, আশা ও আকাংক্ষার বাস্তব প্রতিফলনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী জারি করার কথা অবহিত করেন।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে, সংবিধান সংশোধনের কাজটি তিনই প্রথম করেন। ঐ ২২ এপ্রিলেই (১৯৭৭) প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা প্রদান করেন।
এই সংশোধনী অনুযায়ী, সকল কর্মের ভিত্তি হিসেবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থাই রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি বলে গৃহীত হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এ কথাগুলো সংযুক্ত করার কথা বলা হয়। এই ঘোষণা বলে ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গৃহীত হয়।
‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত করা।’
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাষ্ট্রীয় দর্শন, রাজনীতি, জাতিসত্তাগত পরিচয় নির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে নবধারার সূচনা হয়। এই ধারার সঙ্গে জনগণের আশা-আকাংক্ষা ও প্রত্যাশা যে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা তারই প্রমাণ বহন করে। (দৈনিক ইনকিলাব)