নিউইয়র্ক ০২:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

স্মৃতি রক্ষায় ‘কাস্ত্রোর’ অনিহা ॥ বিস্মৃতির তলানিতে ‘বঙ্গবন্ধু’

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:৩৫:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬
  • / ১৩৬৩ বার পঠিত

নব্বই বছর বয়সি কাস্ত্রো গেল ২৫ নভেম্বর মৃত্যুর বরণ করেন। এরপর নয় দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ৪ ডিসেম্বর শনিবার তাকে চিরবিদায় জানান লাখো মানুষ। সদ্য প্রয়াত এ বিপ্লবী নেতা এখন চিরনিদ্রায় শায়িত। বিশ্বের দীর্ঘ সময়ের ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণকারি ও কিউবার সাবেক রাষ্ট্র নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর অন্তিম শয়ান ঘিরে ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা।
বিশ্ব পূঁজিবাদ তথা পশ্চিমাদের কাছে তিনি স্বৈর-শাসক। আমাদের এরশাদও স্বৈর-শাসক। বিরোধী রাজনীতিবিদ’সহ অনেকেই বর্তমান সরকারকেও গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈর-শাসক বলে মূল্যায়িত করছেন। সে বিতর্কে আমি যাচ্ছি না। আজকে ফিদেল কাস্ত্রোর বিদায় বেলা তার ভাই ও কিউবান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো ঘোষণা দিলেন- ‘কিউবায় কাস্ত্রোর নামে থাকবে না কোনও স্মৃতিচিহ্ন’। এটা নাকি ফিদেল’র শেষ ইচ্ছে ও নছিহত ছিল। তাই তিনি তা বাস্তবায়নের অঙ্গিকারও করেন। বিদায়ী সমাবেশে প্রেসিডেন্ট রাউল বলেন, ‘আপনাদের ও বিশ্ব বিপ্লবিদের প্রিয় নেতার শেষ ইচ্ছে পূরণে চলতি মাসের শেষে জাতীয় পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে আইন প্রণয়ন করা হবে।’ ঘোষণার সাথে সাথে শোকে কাতর ও ব্যথিত উপস্থিত লাখো জনতার মুখে তাদের নেতার প্রতি আরো শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। সিএনএন এবং আলজাজিরার খবরে দেখলাম; অনেক তরুণ বলেই ফেললেন, ‘কারো অবদান কোন স্মৃতিস্তম্ভে গচ্ছিত রাখা হলে তা মুছে ফেলা সম্ভব; কিন্তু হৃদয়ে যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা- তা কখনো মুছে ফেলা যায় না।’
খবর মানুষ তথা একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে সংবাদটি দেখে অবাক হলাম। কি আশ্চর্য্য! এটা কি করে হয়? বিবেকের কাছে প্রশ্ন জাগলো। তিনি কেন এমনটি বলে গেলেন!! আমার জানতে ইচ্ছে করে এর উত্তর তাদের কাছে। যারা আমাদের দেশের তথাকথিত চেতনাধারি ও ক্ষমতাসিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দলীয় নেতারা এর কি কোন উত্তর দিবেন? যারা একজন প্রিয় নেতার ছবি আর নাম বিক্রি করে রাজনীতি করছেন। সত্যিই কারো কাছে কিন্তু এর উত্তর নেই। অথচ তারাই গর্ব করে বলে বেড়ান….‘ফিদেল কাস্ত্রো আর বঙ্গবন্ধুর’র সম্পর্ক নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পুরোধা ও বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফিদেল কাস্ত্রোর একটি উক্তির কথা আমরা শুনেছি। যা নিয়ে দেশের বর্তমান ক্ষমতাসিনরা প্রতিনিয়ত গর্ব করে থাকেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনার, ‘টিভি-টক-ঝাল-মিষ্টি’র শোতেও বাদ যায় নি। এখন কি বলবেন? বস্তুত আমরা মুখে যা বলি, যার বাস্তব প্রতিফলন করি না। এখন লেজে কুকুর নাড়ে, কুকুরে লেজ নাড়ে না! যার উদাহরণ কাজে নয়, কথায় বিশ্বাসী। যেমন-‘বিচার মানি-তাল গাছ আমার’। আমাদের জাতিগত ও জীনগত বৈশিষ্ট্য এমনই। সেই জন্মের পর থেকেই তা দেখে আসছি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা উপমহাদেশের গেরিলা যুদ্ধে’ পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন কিউবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। এরপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ও কাস্ত্রো এ দু’জনের সাক্ষাত। সে সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলজেরিয়ায় জোট বিরোধী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব দেয়া দু’নেতা একান্তে আলাপ-আলোচনা করেন। একপর্যায়ে ফিদেল ক্যাস্ত্রো না কি! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে যান? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখেনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ব্যক্তিত্ব ও সাহসে তিনি হিমালয়। আমিও তাদের মধ্যে একজন, যে এই হিমালয়কে দেখেছি।’ ভালো কথা। ওই সময়ে উক্তিটি আমাদের সদ্য স্বাধীন একটি দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় ছিল। কিন্তু আমি আমার প্রয়োজনে অন্যের গুনাবলী আর প্রসংশাকে মূল্যায়ন করবো; তবে তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন করবো না! এটা কি করে হয়? গণতন্ত্র ও মানুষের নাগরিক অধিকার ও আন্দোলনের অধিকারের কথা যদি বলি; তাহলে সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ কোরিয়ান প্রেসিডেন্ট বিরোধী আন্দোলন। সে বিষয়ে পরে আসছি। এখন ফিদেল কাস্ত্রোর শেষ ইচ্ছের মধ্যে থাকি। যিনি তাঁর দীর্ঘ ৫০ বছরের ক্ষমতা ও আরো বেশী সময় ধরে সা¤্রাজ্যবাদি ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন/যুদ্ধ এবং কিউবার বিপ্লব……এসবের নেতৃত্বের পাশাপাশি বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। অথচ সেই কস্ত্রোই তাঁর অতীত স্মৃতি ও ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছেন! কোন স্মৃতিই জিইয়ে রাখতে চান নি। এ বিষয়টি কি আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানবে? না তা সম্ভব নয়। তাহলে রাজনীতি ও তেলবাজদের কি হবে! এসব বাঁচিয়ে রাখতে হবেই হবে।
আমার কাছে মনে হয় ফিদেল কাস্ত্রো বুঝতে পেরেছিলেন…একদিন তার দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। বিরোধীরা তার ছবি ও স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙ্গে চুড়ে অবমাননা করতে পারে। কখনো কখনো তার ম্যুরালে আগুন/জুতো নিক্ষেপের মুখে পড়তে পারে। তাই তিনি বুঝে শুনইে ছোট ভাই ও বর্তমান প্রেসিডেন্টকে এসব স্মৃতির অতি উৎসাহি মনোভাব বন্ধের নছিহত করে গেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যুর পরে স্মৃতি রেখে গিয়ে লাভ কি? ফিদেল কাস্ত্রো এসব বুঝতে পেরেছিলেন- বাংলাদেশে যেমন সার্টিফিকেটধারি মুক্তিযোদ্ধার অভাব নেই; ঠিক তার মৃত্যুর পর ও তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর কিউবায় তথাকথিত বিপ্লবীদের উত্থান ঘটবে। তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর দল ভাঙন ধরবে, ইত্যাদি। দেশ ও তার দল আরো দ্বিধাবিভক্তিতে পড়বে। এ আশঙ্কায় তিনি তাকে নিয়ে কেউ রাজনীতি যেন না করতে পারে তাই কোন স্মৃতি সৌধ নির্মাণ বিরোধী মত দিয়ে গেছেন। এর ফলে সত্যিকারে যারা তার অনুসারি, তারা শত বছর ধরে তাকে মনে রাখবে হৃদয় থেকে। যা কেউ কখনোই মুছে ফেলতে পারবে না।
ঠিক তার উল্টোটা দেখছি আমরা বাংলাদেশে। দেশের নাম পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে হেন কোন বাজে কাজ নেই করা হয় নি। কোন জায়গা নেই তাঁর ছবি ব্যবহার করার রাজনীতি হচ্ছে না। বঙ্গভবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান/বস্তি/মার্কেট/ব্রীজ-কালভার্ট’সহ আরো কত যায়গায়……..বলতে লজ্জা লাগে। সব খানেই ছবি টানিয়ে উদ্বোধন। কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির স্বার্থে সুবিধাভোগিরা দলের শীর্ষ নেতা কিংবা প্রতিষ্ঠাকালিন নেতার নামকে ব্যবহার করে যাচ্ছেন। যা এখন দেশের একটি জাতীয় ট্রেন্ডে রূপ নিয়েছে। এতে করে বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়াউর রহমানের নামের সাথে বরং অবিচার হয়েছে/হচ্ছে। ঘৃণা বেড়েছে/বাড়ছে। কারণ-ভালোবাসা জোর করে আদায় করা সম্ভব নয়। অতীতের বিরোধী রাজনীতিবিদদের নামে যা আছে তা তুলে নেয়া হচ্ছে। বিমান বন্দরের পর এবার মাজার নিয়ে রাজনীতি। আর আমরা যদি স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলি; তাহলে মওলানা ভাসানী, জাতীয় চার নেতা ও জেনারেল ওসমানির ইতিহাস কেন আসবে না! এর জবাব নেই কারো কাছে। মুক্তিযুদ্ধ আর বিজয়ের মাস বলতেই বঙ্গবন্ধু ছাড়া কারো নাম নেই। বিএনপির আমলে জিয়াউর রহমান ঘোষক ছাড়া কারো অবদান ছিল না। জাতীয় চার নেতা ও অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্বদানকারিরা তাহলে কি তুচ্ছ?
আমরা কথায় কথায় পাকিস্তান বিরোধী। পাকিস্তানীদের নামে স্কুল/কলেজ কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুছে ফেলে বঙ্গবন্ধুর নামে রূপান্তর করতে দেখেছি কিংবা আগ্রহের কথা শুনেছি। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখে অবাক হলাম। তা হলো জাতীয় সংসদ ভবন। পাকিস্তানী সাবেক শাসক আইউব খানের শাসনামলে পাকিস্তানী পতাকার আদলে গড়া তৎকালিন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আইন সভা ভবন (বর্তমান জাতীয় সংসদ) -এর নকশা প্রীতি। আহারে একই অঙ্গে কত রূপ! সে সময়ে পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য দুরিকরণে বাংলাদশের বর্তমান রাজধানী ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী বা দ্বিতীয় শীর্ষ শহর গড়ার পরিকল্পনা থেকেই ওই নকশা করা হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তথা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের আইনসভার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাময়িক বন্ধে হয়ে যায় সেই নির্মাণ কাজ। শুনেছি জিয়াউর রহমানের চেষ্টায় শুরু হয়ে ১৯৮২ সালের ২৮শে জানুয়ারি তা সম্পন্ন হয়। জিয়ার শাহাদাতের পর তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এর উদ্বোধন করেন। একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের অষ্টম তথা শেষ অধিবেশন এই সংসদ ভবনেই অনুষ্ঠিত হয়। আইয়্যুব খানের শাসনামলে ‘লুই আই কান’র নকশায় পুরো স্থাপত্যশৈলী আর চার পাশকে দৃষ্টিনন্দন এলাকা হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা হয়। সেই পাকিস্তানের করানো চিন্তা-চেতনার নকশা বাস্তবায়নে আমাদের জাতি এখন তাহলে কেমন কলঙ্ক মুক্তির দিকে যাচ্ছে? এর জবাব দেবে কে?
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও জাতীয় সংসদ ভবনের এ সৌন্দর্য্য রক্ষায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারকেই বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছে বর্তমান ক্ষমতাসিন সরকার। নকশাটি গেল ১ লা ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দেশে আনা হয়েছে। এর পেছনে রাষ্ট্রীয় ও জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের ব্যয়ের হিসেব দেবে কে? জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনে কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এ থেকে জাতি কি পেয়েছে? কেবলই প্রতিহিংসা আর নিজেদের কর্তৃত্বকে জাহিরের এক অসম প্রতিযোগিতা দেখে চলেছি আমরা। শুনেছি লুই আই কানের নকশা’র জন্য একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া সফর করেছেন। তাও আবার সরকারি খরচে। কারণ সরকারি সিদ্ধান্ত তাই। এসবের মূল কারণ একটাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। তাই সরানোর উদ্যোগকে যৌক্তিক কারণ হিসেবেই মনে করছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সোনার নেতা-কর্মীদের প্রতিনিধিরা। এতদিন পাকিস্তানের নাম নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টার কথা শুনেছি। এখন কেন সেই লুই আই কানের করা পাকিস্তানীদের চিন্তার ও নির্মাণশৈলীর নির্ভর নকশার…‘দাঁড়ি-কমা’ ধরে এর বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগেছেন তারা। কিন্তু কেন? এর সঠিক ও বাস্তব সম্মত জবাব নেই কারো কাছে।
ফিদেল কাস্ত্রো যে হিমালয়কে দেখে গেছেন, জীবদ্দশায় তিনি সেই হিমালয়ের প্রতি অবিচার আর স্মৃতি ও নাম নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক নোঙরামিও দেখে গেছেন। তাইতো তিনি মৃত্যুর আগে ছোট ভাইকে তার মৃত্যুর পর নেয়া পরিকল্পনার কথাও বলে গেছেন। বারণ করেছেন, তার নামে কোন স্মৃতি সৌধ/সড়ক ও জনপদের নামকরণ যাতে না হয়। আমার জানতে ইচ্ছে করছে- আমাদের চেতনাধারি স্বাধীনতা কামিরা তাহলে কি কাস্ত্রোর এ নীতির বিরোধী? তারা কি এখন ফিদেল কাস্ত্রোকে আদর্শ মানবেন? এই হচ্ছে আমাদের রাজনীতি। এরই মধ্যে রাউল কাস্ত্রোর দেয়া তার ভাইয়ের বিদায়ী ভাষনে ফিদেলের স্মৃতি না রাখার পক্ষের ঘোষণাকে বিশ্ব রাজনৈতিক বোদ্ধারা দেখছেন ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে। আমরা তো জানি না বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে কিছু বলার সময় পেয়েছেন কি না? তবে, তাঁর সুযোগ্য কন্যার ও প্রধানমন্ত্রীর মুখে এবং দলীয় শীর্ষ নেতাদের মুখে শুনতে পাই তিনি স্বপ্ন দেখে গেছেন। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যমুনা সেতু এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেতু। ডিজিটাল বাংলাদেশেরও নাকি তিনি স্বপ্ন দেখে গেছেন। কিন্তু কাস্ত্রো কোন স্বপ্ন দেখে কিংবা রেখে যান নি। তিনি জীবদ্দশায় বাস্তবায়ন করে গেছেন, মরেও কিংবদন্তি হয়ে আছেন/থাকবেন। ঠিক তার বিপরীতে আমরা। পুরো দেশজুড়ে নামের বাহার আর অপব্যবহারে অতিষ্ঠ পুরো দেশ ও জাতি। এর থেকে পরিত্রাণ কে দেবে?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আমাদের আর কোন কিছু বলার নাই। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ‘পার্ক জিউন’ হাইকে অভিশংসনের মুখোমুখিতে পড়তে হয়েছে কেবল ঠুনকো একটি অভিযোগে। যা কোরিয়োনদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার এক বান্ধবিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য প্রকাশ্য ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু নিস্তার পান নি। একই দশা হয়েছিল ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রোসেফের বিরুদ্ধে। তাকেও অভিশংসনের মাধ্যমে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। এরই নাম গণতন্ত্র ও জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতি। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনে আগামী সপ্তায় পার্লামেন্টে ভোটাভুটির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির বিরোধীদলগুলো। শুক্রবার বিরোধীদের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। শনিবার এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
এ অবস্থায় যদি পার্ক পদত্যাগে বাধ্য হন; তবে তা হবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো প্রেসিডেন্টের জন্য মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার বিরল ঘটনা। ৩রা ডিসেম্বর শনিবারও তার দ্রুত পদত্যাগ চেয়ে বড় ধরনের মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। লাখো মানুষের অংশগ্রহণে রাজধানী সিউল’সহ বিভিন্ন শহরের এই আন্দোলনে বিরোধীদেরও সমর্থন রয়েছে। এ ইস্যুতে ইতিপূর্বে পার্ক দুই দফা ক্ষমা চেয়েছেন। এবং তিনি পদত্যাগেও রাজি রয়েছেন। এখন যদি আমরা বাংলাদেশের শক্তিশালী গণতন্ত্রের কথা বলি! তাহলে বাংলাদেশে কি ব্রাজিল ও দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক অধিকারের ছিটেফোটাও খুঁজে পাওয়া যাবে? সেটা কি আমাদের স্বপ্ন দেখানো জাতির পিতার কন্যাকে কেউ বলতে পারবেন? রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার ধ্বস। যদিও এসবে সরকার প্রধানের না কি কোন হাত নেই। তার দলের কারো ছিলো? এক গভর্ণরকে বলির পাঁঠা হতে দেখেছি এই যা। যেখানে জনগণ কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ; সেখানে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে রাজপথে মাঠে নামবে! বিষয়টি চিন্তারও বাইরে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর আসিফ নজরুলের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস আমার মনযোগ আকর্ষন করে। যা হবহু তুলে ধরা হলো:
[এক হুজুর ওয়াজ করছিলেন, ভাইয়েরা আমার, কোন অন্যায়-অবৈধ কাজ করা যাবেনা, মানা যাবেনা, এবং সমর্থন ও করা যাবেনা। যদি কোন সরকার অবৈধ, যালিম হয় তাকেও মানা যাবেনা, সমর্থন করা যাবেনা। হুজুর ওয়াজ শেষ করে বাড়ি চলে গেলেন। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর রাতে হুজুরের ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে! দরজায় এসে হুজুর জিজ্ঞেস করলেন কে ??? ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো – ‘জনগণের বন্ধু।’ হুজুর বললেন, জনগণের বন্ধু আবার কে ?? ওপাশ থেকেঃ দরজা খোলেন, না হয় আমরা দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ডুকব। হুজুরঃ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ কেমন বন্ধুরে- বাবা! ভয়ে ভয়ে দরজা খুললেন [এই কি!! এরা তো পুলিশ]।
পুলিশঃ- চলেন আপনাকে থানায় যেতে হবে। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।
হুজুরঃ- আমার কি অপরাধ, আমাকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ??
পুলিশঃ- থানায় গেলেই বুঝতে পারবেন।
হুজুরঃ- মানে?
পুলিশঃ- আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আপনি শেখ হাসিনা সরকার কে অবৈধ বলেছেন এবং সরকারের আইন মানতে নিষেধ করেছেন।
হুজুরঃ- আমি তো কারও নাম নেই নাই। সেটা বারাক ওবামার সরকার ও হতে পারে। ডেভিড কেমেরনের সরকার ও হতে পারে। সিসির সরকার ও হতে পারে। আমি তো শেখ হাসিনার সরকারের কথা বলি নাই?
পুলিশঃ- ধমক দিয়ে বললো, বেটা আমাদেরকে বেকুব পাইছো! আমরা জানিনা কার সরকার অবৈধ?]
অধ্যাপক আসিফ নজরুলের এই লেখা কিংবা স্ট্যাটাস হয়তো কাল্পনিক; কিন্তু এর মাধ্যমেই মূলত আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠেছে। জনগণের সরকার আর আগামী ভবিষ্যৎ গড়ার বর্তমার কারিগরদের এই হচ্ছে দেশ প্রেমের শুকনো বুলির রঙ ছড়ানোর নজির। যা থেকে উত্তরণ কবে, কোথায় কি ভাবে হবে? সে উত্তর জানা নেই কারো। তাই যারা ফিদেল কাস্ত্রোর উক্তিকে ব্যবহার করে রাজনীতি করছেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে থাকলে তার প্রতি বাস্তব সম্মান প্রদর্শন করতে চাইলে এসব ‘নেইম-ফেইম’র রাজনীতি বন্ধ করুণ। ফিদেল কাস্ত্রোর শেষ ইচ্ছে যে নজির স্থাপন করে গেছেন। তা থেকে শিক্ষা নিন। দেশ ও জাতি এবং দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য তাহলেও মানুষের হৃদয়ে যায় গা করে নেবে।

শিবলী চৌধুরী কায়েস
সাংবাদিক-লেখক
নিউইয়র্ক

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

স্মৃতি রক্ষায় ‘কাস্ত্রোর’ অনিহা ॥ বিস্মৃতির তলানিতে ‘বঙ্গবন্ধু’

প্রকাশের সময় : ০২:৩৫:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৬

নব্বই বছর বয়সি কাস্ত্রো গেল ২৫ নভেম্বর মৃত্যুর বরণ করেন। এরপর নয় দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ৪ ডিসেম্বর শনিবার তাকে চিরবিদায় জানান লাখো মানুষ। সদ্য প্রয়াত এ বিপ্লবী নেতা এখন চিরনিদ্রায় শায়িত। বিশ্বের দীর্ঘ সময়ের ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণকারি ও কিউবার সাবেক রাষ্ট্র নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর অন্তিম শয়ান ঘিরে ছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা।
বিশ্ব পূঁজিবাদ তথা পশ্চিমাদের কাছে তিনি স্বৈর-শাসক। আমাদের এরশাদও স্বৈর-শাসক। বিরোধী রাজনীতিবিদ’সহ অনেকেই বর্তমান সরকারকেও গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈর-শাসক বলে মূল্যায়িত করছেন। সে বিতর্কে আমি যাচ্ছি না। আজকে ফিদেল কাস্ত্রোর বিদায় বেলা তার ভাই ও কিউবান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো ঘোষণা দিলেন- ‘কিউবায় কাস্ত্রোর নামে থাকবে না কোনও স্মৃতিচিহ্ন’। এটা নাকি ফিদেল’র শেষ ইচ্ছে ও নছিহত ছিল। তাই তিনি তা বাস্তবায়নের অঙ্গিকারও করেন। বিদায়ী সমাবেশে প্রেসিডেন্ট রাউল বলেন, ‘আপনাদের ও বিশ্ব বিপ্লবিদের প্রিয় নেতার শেষ ইচ্ছে পূরণে চলতি মাসের শেষে জাতীয় পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে আইন প্রণয়ন করা হবে।’ ঘোষণার সাথে সাথে শোকে কাতর ও ব্যথিত উপস্থিত লাখো জনতার মুখে তাদের নেতার প্রতি আরো শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। সিএনএন এবং আলজাজিরার খবরে দেখলাম; অনেক তরুণ বলেই ফেললেন, ‘কারো অবদান কোন স্মৃতিস্তম্ভে গচ্ছিত রাখা হলে তা মুছে ফেলা সম্ভব; কিন্তু হৃদয়ে যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা- তা কখনো মুছে ফেলা যায় না।’
খবর মানুষ তথা একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে সংবাদটি দেখে অবাক হলাম। কি আশ্চর্য্য! এটা কি করে হয়? বিবেকের কাছে প্রশ্ন জাগলো। তিনি কেন এমনটি বলে গেলেন!! আমার জানতে ইচ্ছে করে এর উত্তর তাদের কাছে। যারা আমাদের দেশের তথাকথিত চেতনাধারি ও ক্ষমতাসিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দলীয় নেতারা এর কি কোন উত্তর দিবেন? যারা একজন প্রিয় নেতার ছবি আর নাম বিক্রি করে রাজনীতি করছেন। সত্যিই কারো কাছে কিন্তু এর উত্তর নেই। অথচ তারাই গর্ব করে বলে বেড়ান….‘ফিদেল কাস্ত্রো আর বঙ্গবন্ধুর’র সম্পর্ক নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পুরোধা ও বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফিদেল কাস্ত্রোর একটি উক্তির কথা আমরা শুনেছি। যা নিয়ে দেশের বর্তমান ক্ষমতাসিনরা প্রতিনিয়ত গর্ব করে থাকেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনার, ‘টিভি-টক-ঝাল-মিষ্টি’র শোতেও বাদ যায় নি। এখন কি বলবেন? বস্তুত আমরা মুখে যা বলি, যার বাস্তব প্রতিফলন করি না। এখন লেজে কুকুর নাড়ে, কুকুরে লেজ নাড়ে না! যার উদাহরণ কাজে নয়, কথায় বিশ্বাসী। যেমন-‘বিচার মানি-তাল গাছ আমার’। আমাদের জাতিগত ও জীনগত বৈশিষ্ট্য এমনই। সেই জন্মের পর থেকেই তা দেখে আসছি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা উপমহাদেশের গেরিলা যুদ্ধে’ পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন কিউবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। এরপর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ও কাস্ত্রো এ দু’জনের সাক্ষাত। সে সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলজেরিয়ায় জোট বিরোধী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব দেয়া দু’নেতা একান্তে আলাপ-আলোচনা করেন। একপর্যায়ে ফিদেল ক্যাস্ত্রো না কি! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে যান? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখেনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ব্যক্তিত্ব ও সাহসে তিনি হিমালয়। আমিও তাদের মধ্যে একজন, যে এই হিমালয়কে দেখেছি।’ ভালো কথা। ওই সময়ে উক্তিটি আমাদের সদ্য স্বাধীন একটি দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় ছিল। কিন্তু আমি আমার প্রয়োজনে অন্যের গুনাবলী আর প্রসংশাকে মূল্যায়ন করবো; তবে তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন করবো না! এটা কি করে হয়? গণতন্ত্র ও মানুষের নাগরিক অধিকার ও আন্দোলনের অধিকারের কথা যদি বলি; তাহলে সাম্প্রতিক উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ কোরিয়ান প্রেসিডেন্ট বিরোধী আন্দোলন। সে বিষয়ে পরে আসছি। এখন ফিদেল কাস্ত্রোর শেষ ইচ্ছের মধ্যে থাকি। যিনি তাঁর দীর্ঘ ৫০ বছরের ক্ষমতা ও আরো বেশী সময় ধরে সা¤্রাজ্যবাদি ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন/যুদ্ধ এবং কিউবার বিপ্লব……এসবের নেতৃত্বের পাশাপাশি বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। অথচ সেই কস্ত্রোই তাঁর অতীত স্মৃতি ও ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছেন! কোন স্মৃতিই জিইয়ে রাখতে চান নি। এ বিষয়টি কি আমাদের বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানবে? না তা সম্ভব নয়। তাহলে রাজনীতি ও তেলবাজদের কি হবে! এসব বাঁচিয়ে রাখতে হবেই হবে।
আমার কাছে মনে হয় ফিদেল কাস্ত্রো বুঝতে পেরেছিলেন…একদিন তার দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। বিরোধীরা তার ছবি ও স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙ্গে চুড়ে অবমাননা করতে পারে। কখনো কখনো তার ম্যুরালে আগুন/জুতো নিক্ষেপের মুখে পড়তে পারে। তাই তিনি বুঝে শুনইে ছোট ভাই ও বর্তমান প্রেসিডেন্টকে এসব স্মৃতির অতি উৎসাহি মনোভাব বন্ধের নছিহত করে গেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যুর পরে স্মৃতি রেখে গিয়ে লাভ কি? ফিদেল কাস্ত্রো এসব বুঝতে পেরেছিলেন- বাংলাদেশে যেমন সার্টিফিকেটধারি মুক্তিযোদ্ধার অভাব নেই; ঠিক তার মৃত্যুর পর ও তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর কিউবায় তথাকথিত বিপ্লবীদের উত্থান ঘটবে। তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর দল ভাঙন ধরবে, ইত্যাদি। দেশ ও তার দল আরো দ্বিধাবিভক্তিতে পড়বে। এ আশঙ্কায় তিনি তাকে নিয়ে কেউ রাজনীতি যেন না করতে পারে তাই কোন স্মৃতি সৌধ নির্মাণ বিরোধী মত দিয়ে গেছেন। এর ফলে সত্যিকারে যারা তার অনুসারি, তারা শত বছর ধরে তাকে মনে রাখবে হৃদয় থেকে। যা কেউ কখনোই মুছে ফেলতে পারবে না।
ঠিক তার উল্টোটা দেখছি আমরা বাংলাদেশে। দেশের নাম পরিবর্তন। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে হেন কোন বাজে কাজ নেই করা হয় নি। কোন জায়গা নেই তাঁর ছবি ব্যবহার করার রাজনীতি হচ্ছে না। বঙ্গভবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান/বস্তি/মার্কেট/ব্রীজ-কালভার্ট’সহ আরো কত যায়গায়……..বলতে লজ্জা লাগে। সব খানেই ছবি টানিয়ে উদ্বোধন। কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির স্বার্থে সুবিধাভোগিরা দলের শীর্ষ নেতা কিংবা প্রতিষ্ঠাকালিন নেতার নামকে ব্যবহার করে যাচ্ছেন। যা এখন দেশের একটি জাতীয় ট্রেন্ডে রূপ নিয়েছে। এতে করে বঙ্গবন্ধু কিংবা জিয়াউর রহমানের নামের সাথে বরং অবিচার হয়েছে/হচ্ছে। ঘৃণা বেড়েছে/বাড়ছে। কারণ-ভালোবাসা জোর করে আদায় করা সম্ভব নয়। অতীতের বিরোধী রাজনীতিবিদদের নামে যা আছে তা তুলে নেয়া হচ্ছে। বিমান বন্দরের পর এবার মাজার নিয়ে রাজনীতি। আর আমরা যদি স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলি; তাহলে মওলানা ভাসানী, জাতীয় চার নেতা ও জেনারেল ওসমানির ইতিহাস কেন আসবে না! এর জবাব নেই কারো কাছে। মুক্তিযুদ্ধ আর বিজয়ের মাস বলতেই বঙ্গবন্ধু ছাড়া কারো নাম নেই। বিএনপির আমলে জিয়াউর রহমান ঘোষক ছাড়া কারো অবদান ছিল না। জাতীয় চার নেতা ও অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্বদানকারিরা তাহলে কি তুচ্ছ?
আমরা কথায় কথায় পাকিস্তান বিরোধী। পাকিস্তানীদের নামে স্কুল/কলেজ কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুছে ফেলে বঙ্গবন্ধুর নামে রূপান্তর করতে দেখেছি কিংবা আগ্রহের কথা শুনেছি। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখে অবাক হলাম। তা হলো জাতীয় সংসদ ভবন। পাকিস্তানী সাবেক শাসক আইউব খানের শাসনামলে পাকিস্তানী পতাকার আদলে গড়া তৎকালিন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আইন সভা ভবন (বর্তমান জাতীয় সংসদ) -এর নকশা প্রীতি। আহারে একই অঙ্গে কত রূপ! সে সময়ে পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য দুরিকরণে বাংলাদশের বর্তমান রাজধানী ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী বা দ্বিতীয় শীর্ষ শহর গড়ার পরিকল্পনা থেকেই ওই নকশা করা হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তথা পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের আইনসভার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাময়িক বন্ধে হয়ে যায় সেই নির্মাণ কাজ। শুনেছি জিয়াউর রহমানের চেষ্টায় শুরু হয়ে ১৯৮২ সালের ২৮শে জানুয়ারি তা সম্পন্ন হয়। জিয়ার শাহাদাতের পর তৎকালিন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ও বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এর উদ্বোধন করেন। একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের অষ্টম তথা শেষ অধিবেশন এই সংসদ ভবনেই অনুষ্ঠিত হয়। আইয়্যুব খানের শাসনামলে ‘লুই আই কান’র নকশায় পুরো স্থাপত্যশৈলী আর চার পাশকে দৃষ্টিনন্দন এলাকা হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা হয়। সেই পাকিস্তানের করানো চিন্তা-চেতনার নকশা বাস্তবায়নে আমাদের জাতি এখন তাহলে কেমন কলঙ্ক মুক্তির দিকে যাচ্ছে? এর জবাব দেবে কে?
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও জাতীয় সংসদ ভবনের এ সৌন্দর্য্য রক্ষায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারকেই বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছে বর্তমান ক্ষমতাসিন সরকার। নকশাটি গেল ১ লা ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দেশে আনা হয়েছে। এর পেছনে রাষ্ট্রীয় ও জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের ব্যয়ের হিসেব দেবে কে? জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনে কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এ থেকে জাতি কি পেয়েছে? কেবলই প্রতিহিংসা আর নিজেদের কর্তৃত্বকে জাহিরের এক অসম প্রতিযোগিতা দেখে চলেছি আমরা। শুনেছি লুই আই কানের নকশা’র জন্য একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া সফর করেছেন। তাও আবার সরকারি খরচে। কারণ সরকারি সিদ্ধান্ত তাই। এসবের মূল কারণ একটাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। তাই সরানোর উদ্যোগকে যৌক্তিক কারণ হিসেবেই মনে করছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সোনার নেতা-কর্মীদের প্রতিনিধিরা। এতদিন পাকিস্তানের নাম নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টার কথা শুনেছি। এখন কেন সেই লুই আই কানের করা পাকিস্তানীদের চিন্তার ও নির্মাণশৈলীর নির্ভর নকশার…‘দাঁড়ি-কমা’ ধরে এর বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগেছেন তারা। কিন্তু কেন? এর সঠিক ও বাস্তব সম্মত জবাব নেই কারো কাছে।
ফিদেল কাস্ত্রো যে হিমালয়কে দেখে গেছেন, জীবদ্দশায় তিনি সেই হিমালয়ের প্রতি অবিচার আর স্মৃতি ও নাম নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক নোঙরামিও দেখে গেছেন। তাইতো তিনি মৃত্যুর আগে ছোট ভাইকে তার মৃত্যুর পর নেয়া পরিকল্পনার কথাও বলে গেছেন। বারণ করেছেন, তার নামে কোন স্মৃতি সৌধ/সড়ক ও জনপদের নামকরণ যাতে না হয়। আমার জানতে ইচ্ছে করছে- আমাদের চেতনাধারি স্বাধীনতা কামিরা তাহলে কি কাস্ত্রোর এ নীতির বিরোধী? তারা কি এখন ফিদেল কাস্ত্রোকে আদর্শ মানবেন? এই হচ্ছে আমাদের রাজনীতি। এরই মধ্যে রাউল কাস্ত্রোর দেয়া তার ভাইয়ের বিদায়ী ভাষনে ফিদেলের স্মৃতি না রাখার পক্ষের ঘোষণাকে বিশ্ব রাজনৈতিক বোদ্ধারা দেখছেন ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে। আমরা তো জানি না বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে কিছু বলার সময় পেয়েছেন কি না? তবে, তাঁর সুযোগ্য কন্যার ও প্রধানমন্ত্রীর মুখে এবং দলীয় শীর্ষ নেতাদের মুখে শুনতে পাই তিনি স্বপ্ন দেখে গেছেন। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যমুনা সেতু এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেতু। ডিজিটাল বাংলাদেশেরও নাকি তিনি স্বপ্ন দেখে গেছেন। কিন্তু কাস্ত্রো কোন স্বপ্ন দেখে কিংবা রেখে যান নি। তিনি জীবদ্দশায় বাস্তবায়ন করে গেছেন, মরেও কিংবদন্তি হয়ে আছেন/থাকবেন। ঠিক তার বিপরীতে আমরা। পুরো দেশজুড়ে নামের বাহার আর অপব্যবহারে অতিষ্ঠ পুরো দেশ ও জাতি। এর থেকে পরিত্রাণ কে দেবে?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আমাদের আর কোন কিছু বলার নাই। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ‘পার্ক জিউন’ হাইকে অভিশংসনের মুখোমুখিতে পড়তে হয়েছে কেবল ঠুনকো একটি অভিযোগে। যা কোরিয়োনদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তার এক বান্ধবিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য প্রকাশ্য ক্ষমাও চেয়েছেন। কিন্তু নিস্তার পান নি। একই দশা হয়েছিল ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রোসেফের বিরুদ্ধে। তাকেও অভিশংসনের মাধ্যমে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। এরই নাম গণতন্ত্র ও জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতি। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনে আগামী সপ্তায় পার্লামেন্টে ভোটাভুটির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির বিরোধীদলগুলো। শুক্রবার বিরোধীদের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। শনিবার এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
এ অবস্থায় যদি পার্ক পদত্যাগে বাধ্য হন; তবে তা হবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো প্রেসিডেন্টের জন্য মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার বিরল ঘটনা। ৩রা ডিসেম্বর শনিবারও তার দ্রুত পদত্যাগ চেয়ে বড় ধরনের মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। লাখো মানুষের অংশগ্রহণে রাজধানী সিউল’সহ বিভিন্ন শহরের এই আন্দোলনে বিরোধীদেরও সমর্থন রয়েছে। এ ইস্যুতে ইতিপূর্বে পার্ক দুই দফা ক্ষমা চেয়েছেন। এবং তিনি পদত্যাগেও রাজি রয়েছেন। এখন যদি আমরা বাংলাদেশের শক্তিশালী গণতন্ত্রের কথা বলি! তাহলে বাংলাদেশে কি ব্রাজিল ও দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক অধিকারের ছিটেফোটাও খুঁজে পাওয়া যাবে? সেটা কি আমাদের স্বপ্ন দেখানো জাতির পিতার কন্যাকে কেউ বলতে পারবেন? রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজার ধ্বস। যদিও এসবে সরকার প্রধানের না কি কোন হাত নেই। তার দলের কারো ছিলো? এক গভর্ণরকে বলির পাঁঠা হতে দেখেছি এই যা। যেখানে জনগণ কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ; সেখানে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে রাজপথে মাঠে নামবে! বিষয়টি চিন্তারও বাইরে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর আসিফ নজরুলের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস আমার মনযোগ আকর্ষন করে। যা হবহু তুলে ধরা হলো:
[এক হুজুর ওয়াজ করছিলেন, ভাইয়েরা আমার, কোন অন্যায়-অবৈধ কাজ করা যাবেনা, মানা যাবেনা, এবং সমর্থন ও করা যাবেনা। যদি কোন সরকার অবৈধ, যালিম হয় তাকেও মানা যাবেনা, সমর্থন করা যাবেনা। হুজুর ওয়াজ শেষ করে বাড়ি চলে গেলেন। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর রাতে হুজুরের ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে! দরজায় এসে হুজুর জিজ্ঞেস করলেন কে ??? ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো – ‘জনগণের বন্ধু।’ হুজুর বললেন, জনগণের বন্ধু আবার কে ?? ওপাশ থেকেঃ দরজা খোলেন, না হয় আমরা দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ডুকব। হুজুরঃ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ কেমন বন্ধুরে- বাবা! ভয়ে ভয়ে দরজা খুললেন [এই কি!! এরা তো পুলিশ]।
পুলিশঃ- চলেন আপনাকে থানায় যেতে হবে। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।
হুজুরঃ- আমার কি অপরাধ, আমাকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ??
পুলিশঃ- থানায় গেলেই বুঝতে পারবেন।
হুজুরঃ- মানে?
পুলিশঃ- আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আপনি শেখ হাসিনা সরকার কে অবৈধ বলেছেন এবং সরকারের আইন মানতে নিষেধ করেছেন।
হুজুরঃ- আমি তো কারও নাম নেই নাই। সেটা বারাক ওবামার সরকার ও হতে পারে। ডেভিড কেমেরনের সরকার ও হতে পারে। সিসির সরকার ও হতে পারে। আমি তো শেখ হাসিনার সরকারের কথা বলি নাই?
পুলিশঃ- ধমক দিয়ে বললো, বেটা আমাদেরকে বেকুব পাইছো! আমরা জানিনা কার সরকার অবৈধ?]
অধ্যাপক আসিফ নজরুলের এই লেখা কিংবা স্ট্যাটাস হয়তো কাল্পনিক; কিন্তু এর মাধ্যমেই মূলত আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার বাস্তব চিত্রই ফুটে উঠেছে। জনগণের সরকার আর আগামী ভবিষ্যৎ গড়ার বর্তমার কারিগরদের এই হচ্ছে দেশ প্রেমের শুকনো বুলির রঙ ছড়ানোর নজির। যা থেকে উত্তরণ কবে, কোথায় কি ভাবে হবে? সে উত্তর জানা নেই কারো। তাই যারা ফিদেল কাস্ত্রোর উক্তিকে ব্যবহার করে রাজনীতি করছেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে থাকলে তার প্রতি বাস্তব সম্মান প্রদর্শন করতে চাইলে এসব ‘নেইম-ফেইম’র রাজনীতি বন্ধ করুণ। ফিদেল কাস্ত্রোর শেষ ইচ্ছে যে নজির স্থাপন করে গেছেন। তা থেকে শিক্ষা নিন। দেশ ও জাতি এবং দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য তাহলেও মানুষের হৃদয়ে যায় গা করে নেবে।

শিবলী চৌধুরী কায়েস
সাংবাদিক-লেখক
নিউইয়র্ক