নিউইয়র্ক ০৭:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

সাবধান, গুপ্তঘাতক আপনার পাশেই হাঁটছে

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৭:৫৩:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ মার্চ ২০১৫
  • / ৮৮৮ বার পঠিত

পীর হাবিবুর রহমান: আমরা মানুষ। আমরা পায়ে পায়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা জানি না কখন কে কোথায় কিভাবে মারা যাব। মানুষের জীবন এখন সবচেয়ে সস্তা। সবকিছুর দাম বাড়ছে। দাম কমছে মানুষের জীবনের। আমরা মরতে চাই। জানি সবচেয়ে নির্মম সত্য হচ্ছে মৃত্যু। নিয়তির কাছে হার মানতেই হবে। কিন্তু বরাবর বলে এসেছি আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। হতে পারে হার্ট অ্যাটাকে। মেসিভ ব্রেন স্ট্রোকে, দুরারোগ্য ব্যাধি বা রোগশোকে। বয়সের ভারে। পৃথিবীতে মানবজাতির সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে জীবন। বেঁচে থাকার লড়াই করছে মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে। কিন্তু আমাদের বারবার বলতে হচ্ছে এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। এই দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরা রাজনীতিতে বহু মত-পথের সম্মিলন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম তা আর পেলামই না। আমরা স্বাধিকারের সংগ্রামে রক্ত দিয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এই জনপথ লাখো লাখো মানুষের রক্তে ভেসেছে। ঘর-বাড়ি ভিটেমাটি পুড়েছে। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ এনেছিলাম অনেক রক্তে। আমরা গণতন্ত্র এনেছিলাম কত শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে। তবু আমরা সংবিধান প্রদত্ত জনগণ ক্ষমতার মালিক তার প্রতিফলন ঘটতে দেখলাম না। তবু গণতন্ত্রের হা-হুতাশ শেষ হলো না। তবু সবার অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নিরন্তর নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা থেকেই গেল। এক সময় ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। একাত্তরে কবর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ফিরে এলো। এখন যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদ। সন্ত্রাসবাদ। গ্রেনেড, বোমা কত কি। এক সময় হরতাল-অবরোধ ছিল জনগণ সম্পৃক্ত মানুষের অধিকার আদায়ের কর্মসূচী। এখন পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যার নৃশংস কর্মসূচী। মানুষ মরছে। সাধারণ মানুষ। গরিব মানুষ। গরিবের পোলা মরছে। এরা ক্ষমতার রাজনীতি বুঝত না। এরা এমপি-মন্ত্রী হতে চায়নি কোনোকালে। তবু এরা মরছে। মানুষ হত্যার এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির টানা অবরোধ-হরতালে অর্থনীতিই শেষ হচ্ছে না। শতাধিক মানুষ অঙ্গার হয়ে পুড়ে মরছে। কত শত সারিবদ্ধ আগুনে পোড়া মানুষের বীভৎস চেহারা হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। ঘরে ঘরে কত যে মাতম। শোক আহাজারি। লঞ্চডুবিতে মরছে। বাড়তি যাত্রী বোঝাই করে লঞ্চ ছুটছে। সড়ক দুর্ঘটনা তো আছেই। মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে, ক্রসফায়ারে মরছে সে দেশেরই মানুষ। মানুষই মরবে। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে লাশ তো পড়ছেই। একটি অস্থির অশান্ত রাজনীতি দিনে, দিনে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ নির্বাসনে পাঠিয়েছে।
২৬ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার রাতে একুশের বইমেলায় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বিজ্ঞানমনস্ক লেখক মুক্তমনা ব্লগার প্রকৌশলী অভিজিৎ রায় প্রিয়তমা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বইমেলা শেষে মোটরবাইকে চড়ে কি রোমান্টিক চিত্তে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলেন। গায়ে তাদের বসন্তের হাওয়া। ভালোবাসা দিবসের সুখ যায়নি মন থেকে। বসন্ত বাতাস গায়ে মেখে দু’জনই ভাবলেন পথের ধারে দু’কাপ চা পান। সুন্দর মন নিয়ে মুক্ত চিন্তার যুগল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে চা পানের জন্য থামলেন। আর চাপাতি-রাম দা নিয়ে ঘাতকরা অভিজিতের ওপর হামলে পড়ল। তার স্ত্রী বন্যা রুখতে গিয়ে আহত হলেন। কিন্তু অভিজিৎকে এখানেই নৃশংসভাবে মাথায় কুপিয়ে মগজ বের করে ফুটপাত রক্তে ভাসিয়ে হত্যা করে নির্বিঘেœ চলে গেল। দেশ হারাল এক মেধাবী সন্তানকে। স্ত্রী হারাল স্বামী। কন্যাটি হারাল সারাজীবনের জন্য বাবার আদর। মা-বাবা হারালেন প্রিয় সন্তানকে। পুলিশের কত তল্লাশি-মহড়া, ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অদূরেই। কই তবু একজন মেধাবী সন্তানের জীবন রক্ষা হলো না। পাশেই তো কত মানুষ ছিল। জটলা পাকিয়ে রক্তে ভেজা শরীরে বন্যার সাহায্যের জন্য বাড়ানো হাত দেখেও কেউই প্রতিরোধে এগিয়ে এলো না। গরিব পকেটমারকে পেলে গণধোলাই দিতে কত বীর পাওয়া যায়। অথচ ঘাতক দানব প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে কাপুরুষও মেলে না।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে শত ফুল ফুটতে দিতে হয়। আস্তিক-নাস্তিকসহ নানা রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ থাকবে। নিষিদ্ধ জঙ্গিবাদী সংগঠন ছাড়া সব রাজনৈতিক দল স্বাভাবিক দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা আর নাগরিকসহ সবাই মত প্রকাশের বাক স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করবে। এসব অধিকার কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর করুণার নয়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের জীবন, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে সাংবিধানিক অধিকার। রাষ্ট্র জনগণের জানমালের হেফাজত করবে। কিন্তু কই? পারছে না তো। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যত্যয় ঘটলেই এমনটি হয়। ক্ষমতা ও আইনের অপব্যবহার, রাজনৈতিক দলের অগণতান্ত্রিক উগ্র হটকারী পথ আজ গোটা দেশের মানুষকেই নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মন্ত্রীগণ, রাজনীতিবিদগণ ভাষণে-বক্তৃতায় আর বিবৃতিতে দেশ ভাসিয়ে দিচ্ছেন। সংসদে মমতাজ গান গাইছেন, তারানা হালিম কাঁদছেন, ঘরজামাই বিরোধী দল মুখে কুলুপ এঁটেছে। মানুষ যে কতটা ত্যক্তবিরক্ত তার খবরও নিচ্ছেন না। জনগণের ওপর সম্মান ও আস্থা রেখে সরকার বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি কেউ হাঁটছে না। জনগণকে বোকা দর্শক ও জিম্মি বানিয়ে ক্ষমতা আরোহণ ও টিকে থাকার লড়াই চলছে। বিএনপি নামের দলটি লাগাতার অবরোধ-হরতাল চালিয়ে দেশবাসীকে অতিষ্ঠই নয়, পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যার রাজনীতির বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে অন্ধকার হটকারী নকশালি রাজনীতির পথ নিয়েছে। কোনো পথই গণতন্ত্রের নয়। আলোর পথ নয়। তবে সবার দায়িত্বশীল থাকা উচিত কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত যেন না লাগে।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে প্রথাবিরোধী সাহসী লেখক ও প্রতিভাবান দেশবরেণ্য মানুষ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে এভাবেই কুপিয়ে মৃতপ্রায় করেছিল ঘাতকরা। অভিজিৎকে করেছে ২৬ ফেব্রুয়ারী। বইমেলায় যখন ভাঙনের বিরহী সুর, তখনই এই ধরনের নারকীয় ঘটনা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে এ যেন একই সূত্রে গাঁথা। এমন বীভৎস হত্যাকান্ডের পরদিন মধ্যদুপুরে কোকিলেরাও ডাকেনি বিরহী সুরে। গাছে গাছে জোড়া শালিক নৃত্য করেনি। গোটা দেশ ব্যথিত। ক্ষুব্ধ।
এদিকে ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রেখে আদর্শবান তারুণ্যের যে ইস্পাত-কঠিন ঐক্য অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধে জ্বলে উঠত একদিন সেই শক্তিটাকেও নির্বাসিত করা হয়েছে।
হুমায়ুন আজাদের সব মতের সঙ্গে আমি একমত নই। অভিজিতের বেলায়ও তাই। তসলিমা নাসরীনের বেলায় তো বটেই। এমনকি প্রিয় কবি দাউদ হায়দারের বিতর্কিত কবিতার সঙ্গেও নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি, হত্যা, নির্বাসনে পাঠানো কিংবা হামলা করে মেরে ফেলা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। অন্যায়, অপরাধ আইন লঙ্ঘন করলে তার বিচার হোক। কিন্তু হত্যা, নির্বাসন, আক্রমণ, গুম গ্রহণযোগ্য নয়। একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সমাজে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়, পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারা, ঘাতকের চাপাতির আঘাতে জনারণ্যে মানুষ হত্যা, বিনাবিচারে নাগরিক হত্যা তখন আর বলা যায় না মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশে আমরা বাস করছি। বুক ফুলিয়ে স্বাধীনচেতা মন নিয়ে হাঁটছি। মানুষের জন্য এখন সতর্কবার্তা একটিইÑসাবধান, আপনার পাশেই গুপ্তঘাতক। (আমার কুলাউড়া)

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

সাবধান, গুপ্তঘাতক আপনার পাশেই হাঁটছে

প্রকাশের সময় : ০৭:৫৩:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ মার্চ ২০১৫

পীর হাবিবুর রহমান: আমরা মানুষ। আমরা পায়ে পায়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা জানি না কখন কে কোথায় কিভাবে মারা যাব। মানুষের জীবন এখন সবচেয়ে সস্তা। সবকিছুর দাম বাড়ছে। দাম কমছে মানুষের জীবনের। আমরা মরতে চাই। জানি সবচেয়ে নির্মম সত্য হচ্ছে মৃত্যু। নিয়তির কাছে হার মানতেই হবে। কিন্তু বরাবর বলে এসেছি আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। হতে পারে হার্ট অ্যাটাকে। মেসিভ ব্রেন স্ট্রোকে, দুরারোগ্য ব্যাধি বা রোগশোকে। বয়সের ভারে। পৃথিবীতে মানবজাতির সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে জীবন। বেঁচে থাকার লড়াই করছে মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে। কিন্তু আমাদের বারবার বলতে হচ্ছে এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। এই দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরা রাজনীতিতে বহু মত-পথের সম্মিলন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চেয়েছিলাম তা আর পেলামই না। আমরা স্বাধিকারের সংগ্রামে রক্ত দিয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এই জনপথ লাখো লাখো মানুষের রক্তে ভেসেছে। ঘর-বাড়ি ভিটেমাটি পুড়েছে। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ এনেছিলাম অনেক রক্তে। আমরা গণতন্ত্র এনেছিলাম কত শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে। তবু আমরা সংবিধান প্রদত্ত জনগণ ক্ষমতার মালিক তার প্রতিফলন ঘটতে দেখলাম না। তবু গণতন্ত্রের হা-হুতাশ শেষ হলো না। তবু সবার অংশগ্রহণমূলক নিরপেক্ষ নিরন্তর নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা থেকেই গেল। এক সময় ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। একাত্তরে কবর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ফিরে এলো। এখন যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদ। সন্ত্রাসবাদ। গ্রেনেড, বোমা কত কি। এক সময় হরতাল-অবরোধ ছিল জনগণ সম্পৃক্ত মানুষের অধিকার আদায়ের কর্মসূচী। এখন পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যার নৃশংস কর্মসূচী। মানুষ মরছে। সাধারণ মানুষ। গরিব মানুষ। গরিবের পোলা মরছে। এরা ক্ষমতার রাজনীতি বুঝত না। এরা এমপি-মন্ত্রী হতে চায়নি কোনোকালে। তবু এরা মরছে। মানুষ হত্যার এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির টানা অবরোধ-হরতালে অর্থনীতিই শেষ হচ্ছে না। শতাধিক মানুষ অঙ্গার হয়ে পুড়ে মরছে। কত শত সারিবদ্ধ আগুনে পোড়া মানুষের বীভৎস চেহারা হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। ঘরে ঘরে কত যে মাতম। শোক আহাজারি। লঞ্চডুবিতে মরছে। বাড়তি যাত্রী বোঝাই করে লঞ্চ ছুটছে। সড়ক দুর্ঘটনা তো আছেই। মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে, ক্রসফায়ারে মরছে সে দেশেরই মানুষ। মানুষই মরবে। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে লাশ তো পড়ছেই। একটি অস্থির অশান্ত রাজনীতি দিনে, দিনে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ নির্বাসনে পাঠিয়েছে।
২৬ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার রাতে একুশের বইমেলায় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বিজ্ঞানমনস্ক লেখক মুক্তমনা ব্লগার প্রকৌশলী অভিজিৎ রায় প্রিয়তমা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে বইমেলা শেষে মোটরবাইকে চড়ে কি রোমান্টিক চিত্তে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলেন। গায়ে তাদের বসন্তের হাওয়া। ভালোবাসা দিবসের সুখ যায়নি মন থেকে। বসন্ত বাতাস গায়ে মেখে দু’জনই ভাবলেন পথের ধারে দু’কাপ চা পান। সুন্দর মন নিয়ে মুক্ত চিন্তার যুগল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে চা পানের জন্য থামলেন। আর চাপাতি-রাম দা নিয়ে ঘাতকরা অভিজিতের ওপর হামলে পড়ল। তার স্ত্রী বন্যা রুখতে গিয়ে আহত হলেন। কিন্তু অভিজিৎকে এখানেই নৃশংসভাবে মাথায় কুপিয়ে মগজ বের করে ফুটপাত রক্তে ভাসিয়ে হত্যা করে নির্বিঘেœ চলে গেল। দেশ হারাল এক মেধাবী সন্তানকে। স্ত্রী হারাল স্বামী। কন্যাটি হারাল সারাজীবনের জন্য বাবার আদর। মা-বাবা হারালেন প্রিয় সন্তানকে। পুলিশের কত তল্লাশি-মহড়া, ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অদূরেই। কই তবু একজন মেধাবী সন্তানের জীবন রক্ষা হলো না। পাশেই তো কত মানুষ ছিল। জটলা পাকিয়ে রক্তে ভেজা শরীরে বন্যার সাহায্যের জন্য বাড়ানো হাত দেখেও কেউই প্রতিরোধে এগিয়ে এলো না। গরিব পকেটমারকে পেলে গণধোলাই দিতে কত বীর পাওয়া যায়। অথচ ঘাতক দানব প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে কাপুরুষও মেলে না।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে শত ফুল ফুটতে দিতে হয়। আস্তিক-নাস্তিকসহ নানা রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ থাকবে। নিষিদ্ধ জঙ্গিবাদী সংগঠন ছাড়া সব রাজনৈতিক দল স্বাভাবিক দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা আর নাগরিকসহ সবাই মত প্রকাশের বাক স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করবে। এসব অধিকার কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর করুণার নয়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের জীবন, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে সাংবিধানিক অধিকার। রাষ্ট্র জনগণের জানমালের হেফাজত করবে। কিন্তু কই? পারছে না তো। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যত্যয় ঘটলেই এমনটি হয়। ক্ষমতা ও আইনের অপব্যবহার, রাজনৈতিক দলের অগণতান্ত্রিক উগ্র হটকারী পথ আজ গোটা দেশের মানুষকেই নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মন্ত্রীগণ, রাজনীতিবিদগণ ভাষণে-বক্তৃতায় আর বিবৃতিতে দেশ ভাসিয়ে দিচ্ছেন। সংসদে মমতাজ গান গাইছেন, তারানা হালিম কাঁদছেন, ঘরজামাই বিরোধী দল মুখে কুলুপ এঁটেছে। মানুষ যে কতটা ত্যক্তবিরক্ত তার খবরও নিচ্ছেন না। জনগণের ওপর সম্মান ও আস্থা রেখে সরকার বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি কেউ হাঁটছে না। জনগণকে বোকা দর্শক ও জিম্মি বানিয়ে ক্ষমতা আরোহণ ও টিকে থাকার লড়াই চলছে। বিএনপি নামের দলটি লাগাতার অবরোধ-হরতাল চালিয়ে দেশবাসীকে অতিষ্ঠই নয়, পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যার রাজনীতির বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে অন্ধকার হটকারী নকশালি রাজনীতির পথ নিয়েছে। কোনো পথই গণতন্ত্রের নয়। আলোর পথ নয়। তবে সবার দায়িত্বশীল থাকা উচিত কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত যেন না লাগে।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে প্রথাবিরোধী সাহসী লেখক ও প্রতিভাবান দেশবরেণ্য মানুষ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে এভাবেই কুপিয়ে মৃতপ্রায় করেছিল ঘাতকরা। অভিজিৎকে করেছে ২৬ ফেব্রুয়ারী। বইমেলায় যখন ভাঙনের বিরহী সুর, তখনই এই ধরনের নারকীয় ঘটনা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে এ যেন একই সূত্রে গাঁথা। এমন বীভৎস হত্যাকান্ডের পরদিন মধ্যদুপুরে কোকিলেরাও ডাকেনি বিরহী সুরে। গাছে গাছে জোড়া শালিক নৃত্য করেনি। গোটা দেশ ব্যথিত। ক্ষুব্ধ।
এদিকে ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রেখে আদর্শবান তারুণ্যের যে ইস্পাত-কঠিন ঐক্য অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধে জ্বলে উঠত একদিন সেই শক্তিটাকেও নির্বাসিত করা হয়েছে।
হুমায়ুন আজাদের সব মতের সঙ্গে আমি একমত নই। অভিজিতের বেলায়ও তাই। তসলিমা নাসরীনের বেলায় তো বটেই। এমনকি প্রিয় কবি দাউদ হায়দারের বিতর্কিত কবিতার সঙ্গেও নয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি, হত্যা, নির্বাসনে পাঠানো কিংবা হামলা করে মেরে ফেলা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। অন্যায়, অপরাধ আইন লঙ্ঘন করলে তার বিচার হোক। কিন্তু হত্যা, নির্বাসন, আক্রমণ, গুম গ্রহণযোগ্য নয়। একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সমাজে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়, পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারা, ঘাতকের চাপাতির আঘাতে জনারণ্যে মানুষ হত্যা, বিনাবিচারে নাগরিক হত্যা তখন আর বলা যায় না মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশে আমরা বাস করছি। বুক ফুলিয়ে স্বাধীনচেতা মন নিয়ে হাঁটছি। মানুষের জন্য এখন সতর্কবার্তা একটিইÑসাবধান, আপনার পাশেই গুপ্তঘাতক। (আমার কুলাউড়া)