দ্বান্ধিক ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড’ ও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’!
- প্রকাশের সময় : ১২:০৪:০৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর ২০১৬
- / ৬৯৩ বার পঠিত
মোহাম্মদ আলী বোখারী: সাংবাদিকতায় মাস্টার্স মোস্তাফা জব্বার অবলুপ্ত দৈনিক গণকন্ঠে তার সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৭২ সালে। সেই থেকে এ মানুষটি মিডিয়া, ট্যুরিজম, প্রিন্টিং-পাবলিশিং, কম্পিউটার বিপণন, সফ্টওয়্যার নির্মাণ, ‘আইটি’ বা তথ্যপ্রযুক্তিগত শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নমূলক তৎপরতায় জড়িত থেকে জাতিকে উপহার দিয়েছেন ‘বিজয় কি-বোর্ড’, যা দিয়ে বাংলা, চাকমা, অসমীয় ও হিন্দি ভাষার টাইপিং সহজতর হয়েছে। এটি বাংলাদেশে কম্পিউটিং জগতের একটি বিস্ময় বললে অত্যুক্তি হবে না। পাশাপাশি কম্পিউটারের সঙ্গে অন্ধদের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে তার উদ্ভাবিত ‘বাংলা ব্রেলি পাবলিশিং সিস্টেম’, ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ দেশের লাইব্রেরিগুলোতে ব্যবহৃত ‘বিজয় লাইব্রেরি সফ্টওয়্যার’, মাইক্রোসফ্টের ‘উইন্ডোজ সেভেন’-এ বাংলা ও ইংরেজির ভাষান্তর পরীক্ষণ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ও সফ্টওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা সবটাই অত্যুৎজ্জ্বল স্বাক্ষর।
কিন্তু এই প্রতিভাধর মোস্তাফা জব্বার সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় চতুর্থবারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড’ নামক তিনদিনব্যাপি সম্মেলনের প্রাক্কালে বিবিসি বাংলা রেডিওকে একটি সাক্ষাতকার দেন। সেখানে তিনি ওই সম্মেলনের লক্ষ্যগত দিক সম্পর্কে বলেন, মানুষের কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রেক্ষিত হচ্ছে জনগণ সরকারের কাছ থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কী সেবা পায়, সরকার কতটা ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে এবং মানুষের জীবন ধারা কিভাবে পরিবর্তন হয়েছে – সেটাই সম্মেলনটিতে সরকার তুলে ধরবে।
এতে বিবিসি তাকে প্রশ্ন করে- বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকারের অগ্রগতি প্রশংসার দাবিদার। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই অগ্রগতি ধীর গতির লক্ষ্য করা যায়। যেমন ব্যান্ডউইথের নি¤œগতি, আউট সোর্সিংয়ের জন্য পেপলের মতো সেবা চালু করা যাচ্ছে না। এ বিষয়গুলোতে কী সর্বস্তরের তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও সরকার নজরে রাখেন?
উত্তরে মোস্তফা জব্বার বলেন, বিষয়গুলো যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার। তবে যদি হতাশার কথা বলেন তবে দুই একটি জায়গায় আমাদেরও হতাশা আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হতাশা হচ্ছে ইন্টারনেট। আগে ইন্টারনেট অবস্থা ভয়ঙ্কর রকম খারাপ ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ইন্টারনেটের প্রসারতা প্রশংসার দাবিদার। তবে যেখানে পরিবর্তনটা আসেনি সেটি হচ্ছে ইন্টারনেটের ধীরগতি। আমরা যে গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করি তা দিয়ে মেইল করা যায়, ফেসবুকে লাইক দেওয়া ও কমেন্টস করা যায়। আউটসোর্সিং, গবেষণা, পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে গতির ইন্টারনেট দরকার সেই গতির ইন্টারনেট আমাদের দেশে নেই। এছাড়া আমার মনে হয় দেশের ইন্টারনেট সেবার দাম জনগণকে শোষণের পর্যায়ে পড়ে। জনগণকে যে দামে ইন্টারনেট কিনতে হয় সেই দামের সাথে সরকারের ব্যান্ডউইথের দামেরও কোন মিল নেই। ইন্টারনেট সম্বন্ধে বাংলাদেশের মানুষের ধারণা ফেসবুক, ব্লগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
ওই কথাগুলো মোটা দাগে তুলে ধরার মতো। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে ইন্টারনেটের প্রসারতা বেড়েছে এবং তা ‘ধীরগতির’, সেটি দিয়ে মেইল করা যায়, ফেসবুকে লাইক দেওয়া ও কমেন্টস করা যায়; কিন্তু ‘ব্যবসা প্রসারের জন্য’ আউটসোর্সিং কিংবা ‘উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে জ্ঞান বিকাশের জন্য’ প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট নেই; এমনকী ইন্টারনেট সেবার দাম শোষণের পর্যায়ে, যা সরকারের ব্যান্ডউইথের দামের ‘সঙ্গে ব্যত্যয়পূর্ণ’।
বাস্তবে নব্বই দশকে ‘বুলেটিন বোর্ড সিস্টেম’র মাধ্যমে প্রথম ‘ডায়ালআপ’ প্রক্রিয়ায় ইমেইলের প্রচলন ঘটে বাংলাদেশে। এতে ‘ইউনিক্স টু ইউনিক্স কপি’ কিলোবাইটের হিসাবে ছিল মূল্য পরিশোধযোগ্য। ১৯৯৬ সালের জুনে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড ‘ভিস্যাট’ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দুটি ইন্টারনেট সেবা পরিবেশকের লাইসেন্স দেয়। ২০০৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১৮০-তে গিয়ে দাঁড়ায়। পরে ২০০৬ সালের মে মাসে ষোলটি দেশের কনসোর্টিয়ামভুক্ত ‘ফাইবার অপটিক’ সংযোগে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এটি ২০০৮ সালে ‘বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড’ ভুক্ত হয়। ওই সময়েই ‘বিটিআরসি’ ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের দাম ৮০ হাজার থেকে ১৮ হাজার করে। কিন্তু ধীর গতির ইন্টারনেটের দাম নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে ওই ‘ফাইবার অপটিক’ সংযোগের একটি লাইন সিঙ্গাপুর সংলগ্ন সমুদ্র তলদেশে বিচ্ছিন্ন হলে ইন্টারনেটের গতি লোপ পায়। বর্তমানে ওই সংযোগের পরবর্তী সংস্করণ সিঙ্গাপুর থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত নির্মাণাধীন রয়েছে ‘এসইএ-এমই-ডব্লিউই ফাইভ’, যা বাংলাদেশ হয়ে সবেমাত্র এ বছরের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের করাচিতে গিয়ে পৌঁছেছে, আশা করা হচ্ছে তা সম্পন্ন হলে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি আরো দ্রুততর হবে। ২০১০ সালের এক গবেষণা মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৬ কোটি ৩৯ লাখের উপরে ব্যবহারকারীর ৪৮ লাখই ‘শেয়ারিং’ ভিত্তিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, যা স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারনেটের গতিকে একক দৃষ্টিকোণে ধীর করেছে। তবু এই ব্যবহারকারীরাই ২০২০ সাল নাগাদ আড়াই শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি সঞ্চার করবে এবং প্রায় ৭ লাখ ৭৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ঘটাবে।
এগুলো বাস্তবিকই আশা জাগানিয়া প্রত্যাশা বটে। সে জন্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর পরিপূর্ণ স্বরূপ উন্মোচনে কথিত ‘ফেসবুক ও ব্লগে সীমাবদ্ধ’ এই ধারনাটি দ্রুতই পাল্টাতে হবে। কেননা ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড’ বলতে বোঝায়- তথ্যপ্রযুক্তিগত সকল উপকরণ ও মিডিয়া, যা ‘ডিজিটাল মার্কেটিং সার্ভিস’ হিসেবে গণ্য, তার সবটাই ২৪ ঘন্টা চিন্তার উন্মেষ, মতামত, শিক্ষার্জন এবং বিপুল সুযোগ পরিব্যপ্ত করতে পারস্পরিকভাবে একান্নবর্তী ও সংযুক্ত থাকবে। এটির চালিকা যেহেতু ‘ইন্টারনেট’ ভিত্তিক গ্লোবাল সিস্টেম, যা টিসিপি/আইপি প্রটোকল ভিত্তিক সংযোগ ব্যবস্থা; সেহেতু ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবব্রাউজার, ইলেকট্রনিক মেইল, নিউজগ্রুপ, ভয়েজ ওভার আইপি টেলিফোনি ও ফাইল শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে ‘পিয়ার টু পিয়ার নেটওয়ার্কস’ – এ সব কিছুর গতি প্রকৃতি দ্রুততর ও সুপ্রশস্ত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
টরন্টো, কানাডা।
ই-মেইল: bukhari.toronto@gmail.com