নিউইয়র্ক ০৮:৫৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ঢাকা ও প্যারিসের হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য কি অভিন্ন?

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০২:৫১:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ মার্চ ২০১৫
  • / ৬৩৫ বার পঠিত

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: ঢাকার অভিজিৎ হত্যা পশ্চিমা মিডিয়াতেও এবার বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। লন্ডনের কোনো কোনো পত্রিকাতেও তার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট। প্যারিসে শার্লি হেবডো কার্টুন ম্যাগাজিনের কার্টুনিস্টদের হত্যার পর ঢাকায় একই ধরনের জঙ্গিদের হাতে মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ায় পশ্চিমা মিডিয়ায় খবরটি যে গুরুত্ব পাবে এবং তারা দুয়ে দুয়ে চার করবে- এটা অনেকটাই ধরে নেওয়া গিয়েছিল।
অভিজিৎ হত্যার পেছনে যে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে এ সন্দেহটা আরো দৃঢ় হয়েছে এই গোষ্ঠীর শাফিউর রহমান ফারাবী নামে এক যুবক সাসপেক্ট হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়ায়। এর আগে বাংলাদেশে যেসব মুক্তমনা সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে তার পেছনেও ছিল এই ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী। একশ্রেণির পশ্চিমা মিডিয়া তাই দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পেরেছে। তারা প্রচার করছে, প্যারিসের পত্রিকাটিতে ইসলামের নবীকে (দ.) ব্যঙ্গ করে যে কার্টুন প্রকাশ করা হয়েছে, তা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্ত—র্ভুক্ত। ইসলামী জঙ্গিরা সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ড দ্বারা এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। সুতরাং যারা ইসলামের নবী সম্পর্কে উসকানিমূলক কার্টুন ছেপেছে তারা অপরাধী নয়, তারা ফ্রি থিংকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপাসক। যারা তাদের হত্যা করেছে, তারা অপরাধী এবং স্বাধীন মত প্রকাশের শত্রু।
সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাস থেকে শুরু করে ডেনিস কার্টুনিস্টদের ইসলাম ও মুহাম্মদ (দ.) সম্পর্কিত ব্যঙ্গচিত্রগুলো যে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আওতায় পড়ে এবং এর বিরুদ্ধে জঙ্গিদের সন্ত্রাস যে এই অধিকার হরণের মধ্যযুগীয় বর্বর চেষ্টা এটাই পশ্চিমা মিডিয়া এবং একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সম্মিলিতভাবে প্রচার করে আসছেন। ঢাকায় অভিজিৎ হত্যাকেও তাঁরা একই ক্যাটাগরিভুক্ত করে প্যারিস ও ঢাকার সাম্প্রতিক হত্যাকান্ড একই গোষ্ঠীর দ্বারা একই উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছে বলে প্রচার চালাচ্ছেন।
এত দুঃখ ও শোকের মধ্যেও কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করেছি, পশ্চিমা প্রচারণার অন্ধ অনুসারী ঢাকার এক ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকও তাঁর কাগজে ‘উই আর অল মুক্তমনা’ শীর্ষক এক নিবন্ধ লিখে পশ্চিমাদের অনুকরণেই বলেছেন,‘অভিজিৎ হত্যা মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত’। ব্যাপারটা কি এতই সরল? অভিজিৎ ও শার্লি হেবডোর কার্টুনিস্টদের হত্যাকারীরা একই জঙ্গিগোষ্ঠীর জ্ঞাতিভ্রাতা হতে পারে, কিন্তু তাদের হত্যাকান্ডের মোটিভ কি অভিন্ন? পশ্চিমা মিডিয়া এই দুই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য অভিন্ন বলে প্রচার করে প্যারিসের নিহত কার্টুনিস্টদের উসকানিমূলক ভূমিকাকে ঢাকার অভিজিৎ রায়ের মুক্তমনা (উসকানিমূলক মোটেই নয়) লেখাজোখার সঙ্গে তুলনা করে নিহত কার্টুনিস্টদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে আরো সহানুভূতিশীল করে তোলার চেষ্টা করতে পারে। তাতে ঢাকার এক সম্পাদক গলা মেলান কী করে? অভিজিৎ কি কখনো মহানবী (দ.) ও ইসলাম নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ বা কটূক্তি করেছেন? তিনি করেননি। তাহলে তাঁকে হত্যা করা হলো কেন? তাঁকে প্যারিসের বা ডেনমার্কের কার্টুনিস্টদের ভূমিকায় নামিয়ে আনা হলে তাঁর প্রতি কি অবিচার করা হয় না?
অভিজিৎ রায়ের সব লেখা আমি পড়েছি তা নয়। তবে বহু লেখা পড়েছি। তিনি নিহত হওয়ার পরের দিনই কলকাতায় স্টেটসম্যান পত্রিকা তাঁর একটি লেখা পুনঃপ্রকাশ করেছে। সেটিও পাঠ করে দেখেছি। তিনি ধর্ম ও ধর্মপুরুষদের নিয়ে কোথাও হাসি-মশকরা বা কটূক্তি করেননি। তিনি মুক্তমন নিয়ে সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে বিজ্ঞানের সত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই সত্যের সঙ্গে ধর্মীয় তত্ত্বের যেখানে বিরোধ আছে তা দেখিয়েছেন। এই লেখাগুলো আলোচনা ও বিতর্কমূলক। সালমান রুশদির লেখা বা ফরাসি ও ডেনিস কার্টুনিস্টদের মতো উসকানিমূলক ও আক্রমণাত্মক নয়। দেশ ও সমাজের প্রগতির জন্যই অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হওয়া উচিত। তাঁকে হত্যা করা কেবল স্বাধীন চিন্তার ওপর আঘাত বলা হলে অপরাধটিকে লঘু করে দেখানো হয়। এটা মানবতা ও সভ্যতার বিরুদ্ধে বর্বরতা। এরা জঙ্গি নয়, এরা পিশাচসিদ্ধ ঘাতক। এদের তৈরি করা হয়েছে মানবসভ্যতা বিনাশের জন্য; কেবল চিন্তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ধ্বংস করার জন্য নয়। ‘আমরা সকলে মুক্তমনা’- কেবল এই আপ্তবাক্য কপচিয়ে এদের নির্মূল করা যাবে না, এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি ও সমাজশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা পৃথিবীর সেই আদি যুগ থেকেই চলে আসছে। কখনো ধর্ম, কখনো সমাজ, কখনো রাষ্ট্রশক্তি এ চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞানের সত্য প্রকাশের জন্য গ্যালিলিওকে হত্যা করা হয়েছে। ‘আনাল হক’ (আমিই খোদা) এই কথা বলার দায়ে মহর্ষি মনসুরকে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতা সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে মুক্তচিন্তার মাধ্যমে যত এগিয়েছে, ততই দেশে ও সমাজে সব মতের সহাবস্থান সহজ হয়েছে। বর্বরতার যুগ অতিক্রম করে মানুষ মানবতার যুগে পদার্পণ করেছে। এ যুগেও ভিন্নমতের কণ্ঠরোধের জন্য নির্যাতনকারী দল, গোষ্ঠী, এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থাও রয়েছে। যেমন সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা। মুক্তচিন্তা ও মানবতার অগ্রগতির মুখে এই ব্যবস্থাগুলো টেকেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই মৃতপ্রায় দানবের দেহে আবার প্রাণ সঞ্চার করেছে ক্ষয়িষ্ণু ধনতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা।
ঢাকা ও প্যারিসের হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য কি অভিন্ন?
বিশ্বধনবাদ যখনই সংকটের সম্মুখীন হয়, তখনই তারা ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেয়। বিশ্বে ধর্মীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। মধ্যপ্রাচ্যে আল-কায়েদা ও তালেবানের জন্ম দিয়েছে পশ্চিমা শক্তি। সিরিয়ার সেক্যুলার আসাদ সরকারকেও উৎখাতের জন্য সৌদি আরবের সহযোগিতায় তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের জন্ম দিয়েছিল আমেরিকা। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী এবং পাকিস্তানের গণহত্যার সহযোগী জামায়াতকে ‘মধ্যপন্থী ইসলামী দল’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিল আমেরিকা।
এভাবে বিশ্বময় ‘ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী’ তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিক তার ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখছে এবং এই ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির মুনাফায় বিশ্বধনবাদের পতন ঠেকাতে পারবে ভাবছে। এ জন্যই পশ্চিমা মিডিয়ায় এককালে যেমন ছিল ‘কমিউনিস্ট জুজু’র ভীতি প্রচার; এখন চলছে ইসলামিক বা জিহাদিস্ট জুজুর ভীতি প্রচার। এই পশ্চিমা প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি অর্থ ঢালছে ইসরায়েল।
‘ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম এবং ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে সর্বত্র মুসলিম নামধারী সংগঠনগুলোর মুক্তিসংগ্রাম হচ্ছে টেররিজম’- এই বিভ্রান্তি বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর জন্য সালমান রুশদি থেকে শুরু করে ফরাসি ও ডেনিস কার্টুনিস্টদের পেছনে অঢেল টাকা ঢেলেছে ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা প্রভুরা। তাদের প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়ে বিভ্রান্ত ইসলামী জঙ্গিরা প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হয়েছে, তখনই পশ্চিমা শিবির থেকে রব তোলা হয়েছে, ‘গেল গেল, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা গেল’। এবং তাতে ধুয়া ধরেছেন বাংলাদেশের একশ্রেণির মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীও।
বাংলাদেশের তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী যদিও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের জঙ্গিদের জ্ঞাতিভ্রাতা, কিন্তু তাদের সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ডের লক্ষ্য এক বা অভিন্ন নয়। ইউরোপে জঙ্গিদের হত্যাকান্ড যতই বর্বর ও নিন্দার্হ কাজ হোক, তা প্রতিশোধমূলক হত্যা। ঘাতকরা মনে করছে, তারা ইসলাম ও মহানবী (দ.)-র অবমাননার প্রতিশোধ নিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিদের অবিরাম হত্যাকান্ড অন্য উদ্দেশ্যমূলক, তাদের হত্যাকান্ডের শুরু ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার তান্ডবের মাধ্যমে। এই বুদ্ধিজীবীরা, যেমন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ কেউ ধর্মবিরোধী একটি কথাও লেখেননি- ধর্মের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া দূরের কথা। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী ছিলেন। তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
বর্তমানেও নৃশংসভাবে যে বুদ্ধিজীবী ও ব্লগার হত্যা চলছে, একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাঁরা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষের লোক। তাঁদের লেখায় ধর্ম নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনা আছে, এমনকি ধর্মের তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কও আছে। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে কোনো অবমাননাকর উক্তি নেই। ধর্ম সম্পর্কে এই বিতর্ক আধুনিক সমাজ প্রগতির জন্যই আবশ্যক। কিন্তু এই মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচার দ্বারা তাঁদের মুরতাদ, ধর্মদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে এবং অনেককে হত্যা করা হচ্ছে। এই বুদ্ধিজীবী ও ব্লগারদের জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নেত্রীও মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিলেন।
আসলে বাংলাদেশে এই হত্যাকান্ড কোনো প্রতিশোধমূলক হত্যাকান্ড নয়। এই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রমনা এবং সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও ব্লগারদের (তারা হিন্দু-মুলমান যাই হোক) দেশ থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা এবং দেশটিকে তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার পথ সুগম করা। তা না হলে বাংলাদেশ একটি মুসলিম সরকার-শাসিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, শাসক আওয়ামী লীগ নেতারা পর্যন্ত বিসমিল্লাহ বলা ছাড়া কথা বলেন না, ধর্মের অবমাননা করে কথা বললে তাদের মন্ত্রীদেরও জেলে যেতে হয়; তাহলে এই দেশে বেছে বেছে দেশের মুক্তমনা সেরা বুদ্ধিজীবীদের এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ড কেন?
অভিজিৎ হত্যা দেশের দানবশক্তির বর্বরতার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের সরকার ও নাগরিক সমাজকে সচেতন করুক এবং এই দানব নিধনে তারা ঐক্যবদ্ধ হোক- এটাই আমার কামনা।

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

ঢাকা ও প্যারিসের হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য কি অভিন্ন?

প্রকাশের সময় : ০২:৫১:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ মার্চ ২০১৫

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: ঢাকার অভিজিৎ হত্যা পশ্চিমা মিডিয়াতেও এবার বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। লন্ডনের কোনো কোনো পত্রিকাতেও তার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট। প্যারিসে শার্লি হেবডো কার্টুন ম্যাগাজিনের কার্টুনিস্টদের হত্যার পর ঢাকায় একই ধরনের জঙ্গিদের হাতে মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ায় পশ্চিমা মিডিয়ায় খবরটি যে গুরুত্ব পাবে এবং তারা দুয়ে দুয়ে চার করবে- এটা অনেকটাই ধরে নেওয়া গিয়েছিল।
অভিজিৎ হত্যার পেছনে যে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে এ সন্দেহটা আরো দৃঢ় হয়েছে এই গোষ্ঠীর শাফিউর রহমান ফারাবী নামে এক যুবক সাসপেক্ট হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়ায়। এর আগে বাংলাদেশে যেসব মুক্তমনা সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে তার পেছনেও ছিল এই ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী। একশ্রেণির পশ্চিমা মিডিয়া তাই দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পেরেছে। তারা প্রচার করছে, প্যারিসের পত্রিকাটিতে ইসলামের নবীকে (দ.) ব্যঙ্গ করে যে কার্টুন প্রকাশ করা হয়েছে, তা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্ত—র্ভুক্ত। ইসলামী জঙ্গিরা সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ড দ্বারা এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। সুতরাং যারা ইসলামের নবী সম্পর্কে উসকানিমূলক কার্টুন ছেপেছে তারা অপরাধী নয়, তারা ফ্রি থিংকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপাসক। যারা তাদের হত্যা করেছে, তারা অপরাধী এবং স্বাধীন মত প্রকাশের শত্রু।
সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাস থেকে শুরু করে ডেনিস কার্টুনিস্টদের ইসলাম ও মুহাম্মদ (দ.) সম্পর্কিত ব্যঙ্গচিত্রগুলো যে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আওতায় পড়ে এবং এর বিরুদ্ধে জঙ্গিদের সন্ত্রাস যে এই অধিকার হরণের মধ্যযুগীয় বর্বর চেষ্টা এটাই পশ্চিমা মিডিয়া এবং একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সম্মিলিতভাবে প্রচার করে আসছেন। ঢাকায় অভিজিৎ হত্যাকেও তাঁরা একই ক্যাটাগরিভুক্ত করে প্যারিস ও ঢাকার সাম্প্রতিক হত্যাকান্ড একই গোষ্ঠীর দ্বারা একই উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছে বলে প্রচার চালাচ্ছেন।
এত দুঃখ ও শোকের মধ্যেও কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করেছি, পশ্চিমা প্রচারণার অন্ধ অনুসারী ঢাকার এক ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকও তাঁর কাগজে ‘উই আর অল মুক্তমনা’ শীর্ষক এক নিবন্ধ লিখে পশ্চিমাদের অনুকরণেই বলেছেন,‘অভিজিৎ হত্যা মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত’। ব্যাপারটা কি এতই সরল? অভিজিৎ ও শার্লি হেবডোর কার্টুনিস্টদের হত্যাকারীরা একই জঙ্গিগোষ্ঠীর জ্ঞাতিভ্রাতা হতে পারে, কিন্তু তাদের হত্যাকান্ডের মোটিভ কি অভিন্ন? পশ্চিমা মিডিয়া এই দুই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য অভিন্ন বলে প্রচার করে প্যারিসের নিহত কার্টুনিস্টদের উসকানিমূলক ভূমিকাকে ঢাকার অভিজিৎ রায়ের মুক্তমনা (উসকানিমূলক মোটেই নয়) লেখাজোখার সঙ্গে তুলনা করে নিহত কার্টুনিস্টদের সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে আরো সহানুভূতিশীল করে তোলার চেষ্টা করতে পারে। তাতে ঢাকার এক সম্পাদক গলা মেলান কী করে? অভিজিৎ কি কখনো মহানবী (দ.) ও ইসলাম নিয়ে কোনো ব্যঙ্গ বা কটূক্তি করেছেন? তিনি করেননি। তাহলে তাঁকে হত্যা করা হলো কেন? তাঁকে প্যারিসের বা ডেনমার্কের কার্টুনিস্টদের ভূমিকায় নামিয়ে আনা হলে তাঁর প্রতি কি অবিচার করা হয় না?
অভিজিৎ রায়ের সব লেখা আমি পড়েছি তা নয়। তবে বহু লেখা পড়েছি। তিনি নিহত হওয়ার পরের দিনই কলকাতায় স্টেটসম্যান পত্রিকা তাঁর একটি লেখা পুনঃপ্রকাশ করেছে। সেটিও পাঠ করে দেখেছি। তিনি ধর্ম ও ধর্মপুরুষদের নিয়ে কোথাও হাসি-মশকরা বা কটূক্তি করেননি। তিনি মুক্তমন নিয়ে সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে বিজ্ঞানের সত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই সত্যের সঙ্গে ধর্মীয় তত্ত্বের যেখানে বিরোধ আছে তা দেখিয়েছেন। এই লেখাগুলো আলোচনা ও বিতর্কমূলক। সালমান রুশদির লেখা বা ফরাসি ও ডেনিস কার্টুনিস্টদের মতো উসকানিমূলক ও আক্রমণাত্মক নয়। দেশ ও সমাজের প্রগতির জন্যই অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হওয়া উচিত। তাঁকে হত্যা করা কেবল স্বাধীন চিন্তার ওপর আঘাত বলা হলে অপরাধটিকে লঘু করে দেখানো হয়। এটা মানবতা ও সভ্যতার বিরুদ্ধে বর্বরতা। এরা জঙ্গি নয়, এরা পিশাচসিদ্ধ ঘাতক। এদের তৈরি করা হয়েছে মানবসভ্যতা বিনাশের জন্য; কেবল চিন্তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ধ্বংস করার জন্য নয়। ‘আমরা সকলে মুক্তমনা’- কেবল এই আপ্তবাক্য কপচিয়ে এদের নির্মূল করা যাবে না, এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি ও সমাজশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা পৃথিবীর সেই আদি যুগ থেকেই চলে আসছে। কখনো ধর্ম, কখনো সমাজ, কখনো রাষ্ট্রশক্তি এ চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞানের সত্য প্রকাশের জন্য গ্যালিলিওকে হত্যা করা হয়েছে। ‘আনাল হক’ (আমিই খোদা) এই কথা বলার দায়ে মহর্ষি মনসুরকে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতা সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে মুক্তচিন্তার মাধ্যমে যত এগিয়েছে, ততই দেশে ও সমাজে সব মতের সহাবস্থান সহজ হয়েছে। বর্বরতার যুগ অতিক্রম করে মানুষ মানবতার যুগে পদার্পণ করেছে। এ যুগেও ভিন্নমতের কণ্ঠরোধের জন্য নির্যাতনকারী দল, গোষ্ঠী, এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থাও রয়েছে। যেমন সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা। মুক্তচিন্তা ও মানবতার অগ্রগতির মুখে এই ব্যবস্থাগুলো টেকেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই মৃতপ্রায় দানবের দেহে আবার প্রাণ সঞ্চার করেছে ক্ষয়িষ্ণু ধনতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা।
ঢাকা ও প্যারিসের হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য কি অভিন্ন?
বিশ্বধনবাদ যখনই সংকটের সম্মুখীন হয়, তখনই তারা ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেয়। বিশ্বে ধর্মীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। মধ্যপ্রাচ্যে আল-কায়েদা ও তালেবানের জন্ম দিয়েছে পশ্চিমা শক্তি। সিরিয়ার সেক্যুলার আসাদ সরকারকেও উৎখাতের জন্য সৌদি আরবের সহযোগিতায় তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের জন্ম দিয়েছিল আমেরিকা। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী এবং পাকিস্তানের গণহত্যার সহযোগী জামায়াতকে ‘মধ্যপন্থী ইসলামী দল’ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিল আমেরিকা।
এভাবে বিশ্বময় ‘ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী’ তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আমেরিক তার ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখছে এবং এই ওয়ার ইন্ডাস্ট্রির মুনাফায় বিশ্বধনবাদের পতন ঠেকাতে পারবে ভাবছে। এ জন্যই পশ্চিমা মিডিয়ায় এককালে যেমন ছিল ‘কমিউনিস্ট জুজু’র ভীতি প্রচার; এখন চলছে ইসলামিক বা জিহাদিস্ট জুজুর ভীতি প্রচার। এই পশ্চিমা প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি অর্থ ঢালছে ইসরায়েল।
‘ইসলাম একটি সন্ত্রাসী ধর্ম এবং ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে সর্বত্র মুসলিম নামধারী সংগঠনগুলোর মুক্তিসংগ্রাম হচ্ছে টেররিজম’- এই বিভ্রান্তি বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর জন্য সালমান রুশদি থেকে শুরু করে ফরাসি ও ডেনিস কার্টুনিস্টদের পেছনে অঢেল টাকা ঢেলেছে ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা প্রভুরা। তাদের প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়ে বিভ্রান্ত ইসলামী জঙ্গিরা প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হয়েছে, তখনই পশ্চিমা শিবির থেকে রব তোলা হয়েছে, ‘গেল গেল, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা গেল’। এবং তাতে ধুয়া ধরেছেন বাংলাদেশের একশ্রেণির মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীও।
বাংলাদেশের তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী যদিও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের জঙ্গিদের জ্ঞাতিভ্রাতা, কিন্তু তাদের সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ডের লক্ষ্য এক বা অভিন্ন নয়। ইউরোপে জঙ্গিদের হত্যাকান্ড যতই বর্বর ও নিন্দার্হ কাজ হোক, তা প্রতিশোধমূলক হত্যা। ঘাতকরা মনে করছে, তারা ইসলাম ও মহানবী (দ.)-র অবমাননার প্রতিশোধ নিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিদের অবিরাম হত্যাকান্ড অন্য উদ্দেশ্যমূলক, তাদের হত্যাকান্ডের শুরু ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার তান্ডবের মাধ্যমে। এই বুদ্ধিজীবীরা, যেমন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ কেউ ধর্মবিরোধী একটি কথাও লেখেননি- ধর্মের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া দূরের কথা। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী ছিলেন। তাঁদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
বর্তমানেও নৃশংসভাবে যে বুদ্ধিজীবী ও ব্লগার হত্যা চলছে, একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাঁরা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষের লোক। তাঁদের লেখায় ধর্ম নিয়ে আলোচনা আছে, সমালোচনা আছে, এমনকি ধর্মের তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কও আছে। কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে কোনো অবমাননাকর উক্তি নেই। ধর্ম সম্পর্কে এই বিতর্ক আধুনিক সমাজ প্রগতির জন্যই আবশ্যক। কিন্তু এই মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচার দ্বারা তাঁদের মুরতাদ, ধর্মদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে এবং অনেককে হত্যা করা হচ্ছে। এই বুদ্ধিজীবী ও ব্লগারদের জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি নেত্রীও মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিলেন।
আসলে বাংলাদেশে এই হত্যাকান্ড কোনো প্রতিশোধমূলক হত্যাকান্ড নয়। এই হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রমনা এবং সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী ও ব্লগারদের (তারা হিন্দু-মুলমান যাই হোক) দেশ থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা এবং দেশটিকে তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার পথ সুগম করা। তা না হলে বাংলাদেশ একটি মুসলিম সরকার-শাসিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, শাসক আওয়ামী লীগ নেতারা পর্যন্ত বিসমিল্লাহ বলা ছাড়া কথা বলেন না, ধর্মের অবমাননা করে কথা বললে তাদের মন্ত্রীদেরও জেলে যেতে হয়; তাহলে এই দেশে বেছে বেছে দেশের মুক্তমনা সেরা বুদ্ধিজীবীদের এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ড কেন?
অভিজিৎ হত্যা দেশের দানবশক্তির বর্বরতার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের সরকার ও নাগরিক সমাজকে সচেতন করুক এবং এই দানব নিধনে তারা ঐক্যবদ্ধ হোক- এটাই আমার কামনা।