নিউইয়র্ক ১১:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

জাহাঙ্গীর আলম : চলে গেলেও জ্বেলে গেলেন বাতি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০৮:৪৬:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪
  • / ১০৫৯ বার পঠিত

নাসরিন চৌধুরী: দুজন চোখে পড়ার মত সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে ভরপুর। বিধাতা বোধ হয় খুব মনোযোগ দিয়ে যতœ করে জুটিটি বানিয়েছেন। কথায় বলে মেইড ফর ইচ আদার। জাহাঙ্গীর আলম ও কাওসার পারভিন। সুদর্শন আর সুদর্শনা। আমাদের কমিউনিটিতে মানিক রতনকে সব সময় খুব একটা দেখা যেত না।
কম প্রদর্শিত হলে আকর্ষন থাকে। কিন্তু তিনি যে মানবদরদী- মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই ব্যস্ত থাকতে চাইতেন। কিন্তু মরণব্যাধী ক্যান্সার এসে বাসা বাঁধলো শরীরে।
তারপরও কত হাসি খুশি, কত স্বপ্ন, ভাবনা, দেশ এবং সমাজ নিয়ে। আমার প্রিয় জাহাঙ্গীর আলম ভাই, আমার মত নতুন অভিবাসির প্রতি মমতায় ছিলেন বড় ভাইয়ের মত। তখন সবে মাত্র আমেরিকায় এসেছি, লেখার মানুষ, এসে শুধু লিখেই চলেছি। প্রবাস জীবনের কান্না হাসির সত্য ঘটনাগুলো কলমের ডগায় হুর হুর করে বের হতো। লেখা ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকায়। হঠাৎ একদিন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ফোন, আমি চিনি না।
উনি আমার লেখা পড়েন, পত্রিকার ভালো লাগে উনার, বললেন। সত্য সুন্দর, সত্য সূর্যের মত সাক্ষি দেয়, লিখে যান।
এমনি আরো কত জনের ফোন পেতাম সেই প্রথম দিকের দিনগুলোতে। জাহাঙ্গীর ভাই ফোনে অন্য একদিক জানালেন, বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনে আমাকে অংশ গ্রহন করতে হবে। কিন্তু আমার ছোট ছোট দুটি মেয়ে, ওদের জন্য কাজও নিতে পারি না। একেবারেই আমরা নতুন। দেড়শো ডলার লাগবে নমিনেশন ফি। না না করেও এড়াতে পারি না। বাসায় চলে এলেন টুটুল চৌধুরীকে নিয়ে। বাধ্য হলাম ইলেকশন করতে। সম্ভবত ৯৬-৬৭ সাল। নাট্য-সম্পাদক পদপ্রার্থী। আমার প্রতিদ্বন্দি শেখ সিরাজুল ইসলাম। টগবগে তরুণ। বিপার সঙ্গে জড়িত। কমিউনিটির পরিচিত মুখ।
হৈ হৈ রৈ রৈ চারপাশে। আমাকে কেইবা চেনে?
পত্রিকায় ছবির পর ছবি যাচ্ছে। ফখরুল আলম ভাইয়ের প্যানেলে আছি। বাংলাদেশে কোনদিন ভোটই দিইনি। আমেরিকায় এসে ইলেকসন করছি। ভোটার হয়েছি রুখশানা রুপা নামে এক বান্ধবীর সৌজন্যে। আমার ভোটার হওয়া বৈধ নয়। এ নিয়ে কত কান্ড। নির্বাচন কমিশনার ডা. মোহাম্মদ বিল্লার লং আইল্যান্ডের বাসায় যেতে হলো। আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচার মত। না ইলেকশন করতেই হবে। জাহাঙ্গীর ভাই শক্তহাতে হাল ধরলেন, আমার ভয় কি?
আহা কি হাসি খুশি অমায়িক। দেশের মানুষ ভালো থাকলে তিনি খুশি। কত ব্যাচেলর ভাই আছেন চারপাশে, পরোপকারী আর কাকে বলে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঐ সমস্ত বাঙলাদেশী ভাইদের জন্য পাত্রীর ব্যবস্থা করার চেস্টা করতেন। আমিও এই মানসিকতার। কেমন করে অন্যদের সাহায্য করবো। যদিও সোসাইটির নির্বাচনে আমি কেন, আমাদের প্যানেলে বেশীর ভাগেরই ভরাডুবি হয়েছিল সে বছর। আওলাদ হোসেন খান প্রেসিডেন্ট ও ফারজানা আপা সাধারণ সম্পাদক পদে জয়যুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় বাংলাদেশ সোসাইটি ছিল অনেক উজ্জ্ল, অনেক সম্ভাবনার এবং শক্তিশালীও বটে।
আহা ভোটের দিন সে কি মহাউৎসব। এষ্টোরিয়ার একটি স্কুলে ভোট গ্রহন হলো। নতুন অভিবাসী হিসাবে তখন পর্যন্ত স্কুলের ভেতর ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি।
আমি তো চমকিত। এত বিশাল স্কুল। আর এত বাঙ্গালীর সমাহার। গাড়ীতে গাড়িতে পোষ্টারে পোষ্টারে সয়লাব, জাহাঙ্গীর ভাই উৎসাহ উদ্দিপনায় টগবগ করছেন। নির্বাচনকে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। আমি মুগ্ধ, অভিভুত। আমার দুই শিশু কন্যাদের রাখা হয়েছে সোনিয়া চৌধুরী নামে এষ্টোরিয়ায় বসবাসরত এক বান্ধবীর বাসায়। সোনিয়ার স্বামী সাগর কবিতা লিখেন। লেখালেখির সুবাদেই সোনিয়ার সথে পরিচয়।
লেখালেখি করি বলেই আমি অনেকের প্রিয় এবং কাছের মানুষ হয়েছিলাম। কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী দিনগুলো। সোনিয়ার মেয়ে এবং আমার দুই মেয়ে বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনের দিন খেলাধুলা করে কাটিয়ে দিয়েছিল সোনিয়ার ক্রিসেন্ট ষ্ট্রিটের বাসায়। সেই তিন শিশু কন্যা এখন তন্বী তরুণ। দিন যায় কথা থাকে। নির্বাচনে অংশগ্রহন করার কারণে কত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সে সময় লক্ষ্য করেছি প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের কত সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা।
Jahagir Alamজাহাঙ্গীর ভাই দমে যাবার পাত্র না। তিনি প্রতিবারই চাইতেন নেপথ্যে থেকে বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন গুলোতে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হোক। কমিউনিটির উন্নতি হউক, সেই প্রচেষ্টা চালাতেন। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মত এমন বিনয়ী, মেধাবী দেশ-প্রেমিক পরোপকারী মানুষ আমার চোখে কমই পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশন তৈরী করে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সকলে এক সাথে মিলে প্রবাস জীবনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিভাবে উজ্জল করা যায়।
সবখানে দলাদলি, ভাংগন, উনাকে দুঃখ দিতো। তিনি কষ্ট পেতেন। তারপরও সবার প্রতি কি তীব্র ভালোবাসা অনুভব করেছেন। সবাই উনার পাশে থেকেছে বন্ধুর মত ভাইয়ের মত।
আমার সব সময় জাহাঙ্গীর ভাইয়ের প্রতি একটি অসম্ভব সুন্দর মন ছবি ছিলো। আমার কেবলই মনে হতো, রাজনীতি সচেতন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশে বসবাস করলে সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতেন।
Jahagir Alam w vhabi picকাওসার পারভিন, পারুল ভাবী কলেজে অধ্যাপনা করতে পারতেন। চমৎকার একটি জীবন হতো এই যুগলের। একমাত্র পুত্র নাহিয়ান এখানে যেমন মেধাবী ছাত্র, দেশে থাকলেও সে তাই হতো। প্রবাসী হওয়া কেন?
মরণ ব্যাধীতে যখন তিনি আক্রান্ত হলেন, নাহিয়ান তখন কত ছোট। পারুভাবী দক্ষ নাবিকের মত সংসারের হাল ধরলেন। অসম্ভব রূপবতি কাওসার পারভিন হাসপাতালে চাকুরী পেলেন। দু’জনের ঠোটের হসি কখনও ম্লান হয়নি। দাম্পত্য জীবনে সুখি হতে হলে খুব বেশী টাকা পয়সার প্রয়োজন হয় কি?
জাহাঙ্গীর আলম দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সৌহার্দ্য, শ্রদ্ধা, আর ভালবাসাটাই আসল মুলধন।
আমরা দুজন আমাদের এপার্টমেন্টের বাড়ান্দায় বসে রাতের আলো আধারীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে।
আচমকা আমি চমকে উঠি, জাহাঙ্গীর ভাইতো নেই। ডিসেম্বরের চার তারিখ চলে গেলেন, পৃথিবীকে গুড বাই জানিয়ে। এখনও তার কন্ঠ কানে বাজে। যেদিন উনার শেষ যাত্রা নির্ধারিত ছিল, সেদিন আমি কর্মক্ষেত্রে থেকে ফেরার পথে ম্যানহাটনের হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ৫৩১ নাম্বার রুমে তিনি ঘুমে, আধো জাগরেণ ব্যথায় কোকাচ্ছিলেন। ভাবী পারুল, কাওসার পারভিন খুব যতœ করে ম্যাসাজ করছিলেন। পুত্র নাহিয়ান চুপচাপ বসে আছে, কেমন এক অস্বস্থিকর পরিবেশ। হাই কমিশনের প্রাক্তন কর্মকর্তা রাজ্জাক ভাই এলেন, আমি জানতে চাইলাম জাকিয়া আপা আসেন নি? তখন শীতের বিষন্ন বিকেল। রাজ্জাক ভাই নীচু স্বরে বললেন, জাকিয়া গতকাল এসেছিল। ভাবী আমি কি ভাইকে একটু ম্যাসাজ করে দেবো?
কাওসার পারভিন কদিন একটানা হাসপাতালেই আছেন। তবুও কোন ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করেনি। বুকের সবটুকু ভালোবাসা আর মায়া দিয়ে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সেবা করে যাচ্ছেন। থাক, আপা আমিই করছি, আপনি বসেন।
আমি বসতে পারি না, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবী পায়ের কাছের চাদর উঠিয়ে দেখালেন, দেখেন আপনারা ওর শরীরে পানি নেমেছে। ফর্সা ধবধবে সাদা পা সোনার আলো রং চেহারায় মনে হলো আবার তারুণ্যের রূপ লাবণ্য শরীরে ঝলসে উঠেছে।
মন মানছিলো না। এই সোনার শরীর থেকে আত্মা উড়ে যাবে। তারপর উনাকে যতœ করে কবরের অন্ধকারে রেখে আসা হবে। না এ হতেই পারে না।
ভাইএর কপালে আলতো ছোঁয়া দিই, খুব নীচু স্বরে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি বাসায় ফিরলে ফোনে কথা বলবো।
রূম থেকে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা হয় না। হাসপাতালের চওড়া লবিতে সোফায় বসে থাকি। হাসপাতাল না যেনো পাঁচতারা হোটেল। এখানের সকল রোগীই ক্যান্সারের।
আমার এক আত্মীয়ের ছোটবোনের মত, তাকে ফোন করি, জাহাঙ্গীর ভাই এর প্রতি এই বোনটির অনেক শ্রদ্ধা। এমনি করে তিনি কতজনের মনে দ্বীপালি জা¦লিয়ে গেছেন। এখানের একটি পত্রিকায় জাহাঙ্গীর আলম ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। এষ্টোরিয়া থেকে গাড়ী ড্রাইভ করে ভাবীকে নিয়ে আমাদের ব্রঙ্কসের বাসায় এলেন, বছর খানিক আগের ঘটনা তখন, সামার। আমাদের বাড়ীর বারান্দায় বসে আড্ডা-কথা, আমি সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করে রেখেছিলাম। সে দিনের সেই সন্ধ্যাটি সোনালী দিনের উজ্জল স্মৃতি। দুজনে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই পুরোটাই খাটি সোনা। আমি মুগ্ধ, অভিভূত। কোন অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। দুজনে দুজনার, হাসি উচ্ছ্বলে সুখি দম্পত্তি।
একদিন হঠাৎ জাহাঙ্গীর বাই ফোন করলেন, উনার বাসায় আনেককে ডেকেছন। আমি যেনো আমার আম্মাকে নিয়ে যাই, আম্মা তখন আমার কাছে। বাসায় আমার শাশুড়িও আছেন, বললেন দুই খালাম্মাকেই নিয়ে আসেন।
সত্যিই আমারা স্বামী-স্ত্রী, দুই আম্মাকে নিয়ে উনাদের ক্রিসেন্ট ষ্ট্রিটের ফ্লাটে গেলাম। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বন্ধুদের মধ্যে সেদিনের ডিনারে স্বস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন আব্দুল্লা জাহিদ ভাই, আজহারুল হক সহ আরো অনেকে। এতো প্রীতি, সোহার্দ্য সে রাতটি ছিল চমৎকার।
আমার আম্মা খুব খুশি হয়ে বললেন, নিউ ইয়র্কে তোমার ভাই-বোনগুলো আসলেই আমার সন্তানের মতই। সবাই কত ভালো।
দেশ ছেড়ে দুর প্রবাসে আত্মীয়বিহীন যদিও থেকেছি কিন্তু আমার আপা আর ভাই এর অভাব নেই এই শহরে।
জাহাঙ্গীর ভাই আশ্চর্য এক মানুষ। মৃত্যুর আগে বোধহয় জ্বলে উঠেছিলেন। জাহাঙ্গীর ক্যান্সার ফাউন্ডেশন তৈরী করেছেন।
আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হতো কম, টেলিফোনে বিস্তর কথা হতো। আহা, ব্যথা, ব্যথা উনার শরীরে প্রায়ই কামড় বসাতো। গভীর রাতে ছুটতে ছুটতে তিনি এষ্টোরিয়ার মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে যেয়ে হাজির হতেন। আমারকে মরফিন ইনজেকশন দাও, আমি ঘুমাতে চাই।
স্ত্রী কাউসার পারভিনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভালোবাসায় তিনি মাথা নত করেন। ওর জন্যেই আমি বেঁচে আছি। বিয়ের পর বউকে সোনালি দিন দিতে পারি নাই। আমার দুর্ভাগ্য ক্যান্সার আমার সঙ্গি, পারভিন ও এর ভাগ্যের যাতনা বয়ে বেড়াচ্ছে।
আমি ভাবীর দিকে তাকাই, এক সাহসী যোদ্ধা। শ্বশুড় বাড়ীর লোকদের প্রশংসার পঞ্চমুখ। শুধু জাহাঙ্গীর ভাইএর একার ভালোবাসায় ভাবী সিক্ত নন। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ভাই-বোনেরাও কাওসার পারভীনকে অনেক বেশী ভালোবাসে। একা ফেলে সাথীকে, পাখি উড়ে গেলো দুর-দিগন্তে। ফিরতে না আর সে পাখি কোন দিন না।
আমরা যারা জাহাঙ্গীর ভাইকে চিনি, জানি, আমাদের কমিউনিটির সুখ, কল্যাণ কামনায়, নিবেদিত প্রাণ জাহাঙ্গীর আলম চলে গেলেও রেখে গেছেন স্বপ্ন। জাহাঙ্গীর ক্যান্সার হাসপাতালের কার্যক্রমেই তিনি বেঁচে থাকবেন। কয়েক বছর আগের ঘটনা- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মইনউদ্দিন তখন নিউ ইয়র্কে। ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনায় একিট নাগরিক সংর্ধ্বনা আয়োজন করছিল। বাংলাদেশী প্রবাসী সুশিল সমাজ, সেখানেও জাহাঙ্গীর বাই কান্ডারী হয়ে হাল ধরলেন। আমাকে ফোন করে দাওয়াৎ করলেন যাওয়ার জন্য।
এমনি কত ভালোলাগার পালক ছড়িয়ে গেছেন তিনি সবার প্রাণে। আমি জানি কাওসার পারভিন আলোকিত মানুষটিকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু স্বামী হিসেবে তিনি রেখে গেছেন আদর্শ, বাকি জীবনটা ভাবি তুমি নিরাহংকারী পরোপকারী ভালোমনের মানুষটির সকল চেতনা মগজে ধারণ করে পূর্ণ উদ্যামে বেঁচে থাকো।
তুমি কাজ থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছো বলে, ব্যথায় কস্ট পেলেও অনেক সময় তোমাকে ডাকেননি।
তুমি অনেক করেছো, জীবনের সকল সঞ্চিত শক্তি ব্যয় করেছো, তারপরও তুমি ক্লান্ত নও কাউসার পারভিন।
তোমার বাস সৃষ্টিকর্তার সংগে। তোমার আছে আগণিত শুভাকাঙ্খি। যারা জাহাঙ্গীর ভাইরের কাছের মানুষ ছিলেন, তুমি সাবার মায়া, শ্রদ্ধা পাচ্ছো ভাবি। তোমার তুলনা যে তুমি। তিনি চলে গেলেও বাতি জ্বেলে গেছেন। বাংলাদেশ সোসাইটির ক্রয়কৃত কবরে জাহাঙ্গীর ভাই এর শেষ শয্যা হয়েছে। একি তো বাংলাদেশ সোসাইটির জন্য গর্বের। এমন সোনার মানুষের জন্য সবারই প্রাণ কাঁদে।
কিছু করতে ইচ্ছে করে, মৃত্যু সংবাদ শুনতে ভালো লাগে না। তারপরও মৃত্যু হানা দেয় দুয়ারে। জাহাঙ্গীর ভাই ব্যথাবিহীন শরীরে ঘুমিয়ে থাকুন পরম শান্তিতে। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)

Tag :

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

জাহাঙ্গীর আলম : চলে গেলেও জ্বেলে গেলেন বাতি

প্রকাশের সময় : ০৮:৪৬:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪

নাসরিন চৌধুরী: দুজন চোখে পড়ার মত সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে ভরপুর। বিধাতা বোধ হয় খুব মনোযোগ দিয়ে যতœ করে জুটিটি বানিয়েছেন। কথায় বলে মেইড ফর ইচ আদার। জাহাঙ্গীর আলম ও কাওসার পারভিন। সুদর্শন আর সুদর্শনা। আমাদের কমিউনিটিতে মানিক রতনকে সব সময় খুব একটা দেখা যেত না।
কম প্রদর্শিত হলে আকর্ষন থাকে। কিন্তু তিনি যে মানবদরদী- মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাই ব্যস্ত থাকতে চাইতেন। কিন্তু মরণব্যাধী ক্যান্সার এসে বাসা বাঁধলো শরীরে।
তারপরও কত হাসি খুশি, কত স্বপ্ন, ভাবনা, দেশ এবং সমাজ নিয়ে। আমার প্রিয় জাহাঙ্গীর আলম ভাই, আমার মত নতুন অভিবাসির প্রতি মমতায় ছিলেন বড় ভাইয়ের মত। তখন সবে মাত্র আমেরিকায় এসেছি, লেখার মানুষ, এসে শুধু লিখেই চলেছি। প্রবাস জীবনের কান্না হাসির সত্য ঘটনাগুলো কলমের ডগায় হুর হুর করে বের হতো। লেখা ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকায়। হঠাৎ একদিন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ফোন, আমি চিনি না।
উনি আমার লেখা পড়েন, পত্রিকার ভালো লাগে উনার, বললেন। সত্য সুন্দর, সত্য সূর্যের মত সাক্ষি দেয়, লিখে যান।
এমনি আরো কত জনের ফোন পেতাম সেই প্রথম দিকের দিনগুলোতে। জাহাঙ্গীর ভাই ফোনে অন্য একদিক জানালেন, বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনে আমাকে অংশ গ্রহন করতে হবে। কিন্তু আমার ছোট ছোট দুটি মেয়ে, ওদের জন্য কাজও নিতে পারি না। একেবারেই আমরা নতুন। দেড়শো ডলার লাগবে নমিনেশন ফি। না না করেও এড়াতে পারি না। বাসায় চলে এলেন টুটুল চৌধুরীকে নিয়ে। বাধ্য হলাম ইলেকশন করতে। সম্ভবত ৯৬-৬৭ সাল। নাট্য-সম্পাদক পদপ্রার্থী। আমার প্রতিদ্বন্দি শেখ সিরাজুল ইসলাম। টগবগে তরুণ। বিপার সঙ্গে জড়িত। কমিউনিটির পরিচিত মুখ।
হৈ হৈ রৈ রৈ চারপাশে। আমাকে কেইবা চেনে?
পত্রিকায় ছবির পর ছবি যাচ্ছে। ফখরুল আলম ভাইয়ের প্যানেলে আছি। বাংলাদেশে কোনদিন ভোটই দিইনি। আমেরিকায় এসে ইলেকসন করছি। ভোটার হয়েছি রুখশানা রুপা নামে এক বান্ধবীর সৌজন্যে। আমার ভোটার হওয়া বৈধ নয়। এ নিয়ে কত কান্ড। নির্বাচন কমিশনার ডা. মোহাম্মদ বিল্লার লং আইল্যান্ডের বাসায় যেতে হলো। আমার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচার মত। না ইলেকশন করতেই হবে। জাহাঙ্গীর ভাই শক্তহাতে হাল ধরলেন, আমার ভয় কি?
আহা কি হাসি খুশি অমায়িক। দেশের মানুষ ভালো থাকলে তিনি খুশি। কত ব্যাচেলর ভাই আছেন চারপাশে, পরোপকারী আর কাকে বলে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঐ সমস্ত বাঙলাদেশী ভাইদের জন্য পাত্রীর ব্যবস্থা করার চেস্টা করতেন। আমিও এই মানসিকতার। কেমন করে অন্যদের সাহায্য করবো। যদিও সোসাইটির নির্বাচনে আমি কেন, আমাদের প্যানেলে বেশীর ভাগেরই ভরাডুবি হয়েছিল সে বছর। আওলাদ হোসেন খান প্রেসিডেন্ট ও ফারজানা আপা সাধারণ সম্পাদক পদে জয়যুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় বাংলাদেশ সোসাইটি ছিল অনেক উজ্জ্ল, অনেক সম্ভাবনার এবং শক্তিশালীও বটে।
আহা ভোটের দিন সে কি মহাউৎসব। এষ্টোরিয়ার একটি স্কুলে ভোট গ্রহন হলো। নতুন অভিবাসী হিসাবে তখন পর্যন্ত স্কুলের ভেতর ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি।
আমি তো চমকিত। এত বিশাল স্কুল। আর এত বাঙ্গালীর সমাহার। গাড়ীতে গাড়িতে পোষ্টারে পোষ্টারে সয়লাব, জাহাঙ্গীর ভাই উৎসাহ উদ্দিপনায় টগবগ করছেন। নির্বাচনকে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। আমি মুগ্ধ, অভিভুত। আমার দুই শিশু কন্যাদের রাখা হয়েছে সোনিয়া চৌধুরী নামে এষ্টোরিয়ায় বসবাসরত এক বান্ধবীর বাসায়। সোনিয়ার স্বামী সাগর কবিতা লিখেন। লেখালেখির সুবাদেই সোনিয়ার সথে পরিচয়।
লেখালেখি করি বলেই আমি অনেকের প্রিয় এবং কাছের মানুষ হয়েছিলাম। কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালী দিনগুলো। সোনিয়ার মেয়ে এবং আমার দুই মেয়ে বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচনের দিন খেলাধুলা করে কাটিয়ে দিয়েছিল সোনিয়ার ক্রিসেন্ট ষ্ট্রিটের বাসায়। সেই তিন শিশু কন্যা এখন তন্বী তরুণ। দিন যায় কথা থাকে। নির্বাচনে অংশগ্রহন করার কারণে কত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সে সময় লক্ষ্য করেছি প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের কত সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা।
Jahagir Alamজাহাঙ্গীর ভাই দমে যাবার পাত্র না। তিনি প্রতিবারই চাইতেন নেপথ্যে থেকে বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন গুলোতে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হোক। কমিউনিটির উন্নতি হউক, সেই প্রচেষ্টা চালাতেন। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মত এমন বিনয়ী, মেধাবী দেশ-প্রেমিক পরোপকারী মানুষ আমার চোখে কমই পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশন তৈরী করে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সকলে এক সাথে মিলে প্রবাস জীবনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিভাবে উজ্জল করা যায়।
সবখানে দলাদলি, ভাংগন, উনাকে দুঃখ দিতো। তিনি কষ্ট পেতেন। তারপরও সবার প্রতি কি তীব্র ভালোবাসা অনুভব করেছেন। সবাই উনার পাশে থেকেছে বন্ধুর মত ভাইয়ের মত।
আমার সব সময় জাহাঙ্গীর ভাইয়ের প্রতি একটি অসম্ভব সুন্দর মন ছবি ছিলো। আমার কেবলই মনে হতো, রাজনীতি সচেতন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশে বসবাস করলে সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতেন।
Jahagir Alam w vhabi picকাওসার পারভিন, পারুল ভাবী কলেজে অধ্যাপনা করতে পারতেন। চমৎকার একটি জীবন হতো এই যুগলের। একমাত্র পুত্র নাহিয়ান এখানে যেমন মেধাবী ছাত্র, দেশে থাকলেও সে তাই হতো। প্রবাসী হওয়া কেন?
মরণ ব্যাধীতে যখন তিনি আক্রান্ত হলেন, নাহিয়ান তখন কত ছোট। পারুভাবী দক্ষ নাবিকের মত সংসারের হাল ধরলেন। অসম্ভব রূপবতি কাওসার পারভিন হাসপাতালে চাকুরী পেলেন। দু’জনের ঠোটের হসি কখনও ম্লান হয়নি। দাম্পত্য জীবনে সুখি হতে হলে খুব বেশী টাকা পয়সার প্রয়োজন হয় কি?
জাহাঙ্গীর আলম দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সৌহার্দ্য, শ্রদ্ধা, আর ভালবাসাটাই আসল মুলধন।
আমরা দুজন আমাদের এপার্টমেন্টের বাড়ান্দায় বসে রাতের আলো আধারীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে।
আচমকা আমি চমকে উঠি, জাহাঙ্গীর ভাইতো নেই। ডিসেম্বরের চার তারিখ চলে গেলেন, পৃথিবীকে গুড বাই জানিয়ে। এখনও তার কন্ঠ কানে বাজে। যেদিন উনার শেষ যাত্রা নির্ধারিত ছিল, সেদিন আমি কর্মক্ষেত্রে থেকে ফেরার পথে ম্যানহাটনের হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ৫৩১ নাম্বার রুমে তিনি ঘুমে, আধো জাগরেণ ব্যথায় কোকাচ্ছিলেন। ভাবী পারুল, কাওসার পারভিন খুব যতœ করে ম্যাসাজ করছিলেন। পুত্র নাহিয়ান চুপচাপ বসে আছে, কেমন এক অস্বস্থিকর পরিবেশ। হাই কমিশনের প্রাক্তন কর্মকর্তা রাজ্জাক ভাই এলেন, আমি জানতে চাইলাম জাকিয়া আপা আসেন নি? তখন শীতের বিষন্ন বিকেল। রাজ্জাক ভাই নীচু স্বরে বললেন, জাকিয়া গতকাল এসেছিল। ভাবী আমি কি ভাইকে একটু ম্যাসাজ করে দেবো?
কাওসার পারভিন কদিন একটানা হাসপাতালেই আছেন। তবুও কোন ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করেনি। বুকের সবটুকু ভালোবাসা আর মায়া দিয়ে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সেবা করে যাচ্ছেন। থাক, আপা আমিই করছি, আপনি বসেন।
আমি বসতে পারি না, বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবী পায়ের কাছের চাদর উঠিয়ে দেখালেন, দেখেন আপনারা ওর শরীরে পানি নেমেছে। ফর্সা ধবধবে সাদা পা সোনার আলো রং চেহারায় মনে হলো আবার তারুণ্যের রূপ লাবণ্য শরীরে ঝলসে উঠেছে।
মন মানছিলো না। এই সোনার শরীর থেকে আত্মা উড়ে যাবে। তারপর উনাকে যতœ করে কবরের অন্ধকারে রেখে আসা হবে। না এ হতেই পারে না।
ভাইএর কপালে আলতো ছোঁয়া দিই, খুব নীচু স্বরে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি বাসায় ফিরলে ফোনে কথা বলবো।
রূম থেকে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা হয় না। হাসপাতালের চওড়া লবিতে সোফায় বসে থাকি। হাসপাতাল না যেনো পাঁচতারা হোটেল। এখানের সকল রোগীই ক্যান্সারের।
আমার এক আত্মীয়ের ছোটবোনের মত, তাকে ফোন করি, জাহাঙ্গীর ভাই এর প্রতি এই বোনটির অনেক শ্রদ্ধা। এমনি করে তিনি কতজনের মনে দ্বীপালি জা¦লিয়ে গেছেন। এখানের একটি পত্রিকায় জাহাঙ্গীর আলম ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। এষ্টোরিয়া থেকে গাড়ী ড্রাইভ করে ভাবীকে নিয়ে আমাদের ব্রঙ্কসের বাসায় এলেন, বছর খানিক আগের ঘটনা তখন, সামার। আমাদের বাড়ীর বারান্দায় বসে আড্ডা-কথা, আমি সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করে রেখেছিলাম। সে দিনের সেই সন্ধ্যাটি সোনালী দিনের উজ্জল স্মৃতি। দুজনে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই পুরোটাই খাটি সোনা। আমি মুগ্ধ, অভিভূত। কোন অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। দুজনে দুজনার, হাসি উচ্ছ্বলে সুখি দম্পত্তি।
একদিন হঠাৎ জাহাঙ্গীর বাই ফোন করলেন, উনার বাসায় আনেককে ডেকেছন। আমি যেনো আমার আম্মাকে নিয়ে যাই, আম্মা তখন আমার কাছে। বাসায় আমার শাশুড়িও আছেন, বললেন দুই খালাম্মাকেই নিয়ে আসেন।
সত্যিই আমারা স্বামী-স্ত্রী, দুই আম্মাকে নিয়ে উনাদের ক্রিসেন্ট ষ্ট্রিটের ফ্লাটে গেলাম। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বন্ধুদের মধ্যে সেদিনের ডিনারে স্বস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন আব্দুল্লা জাহিদ ভাই, আজহারুল হক সহ আরো অনেকে। এতো প্রীতি, সোহার্দ্য সে রাতটি ছিল চমৎকার।
আমার আম্মা খুব খুশি হয়ে বললেন, নিউ ইয়র্কে তোমার ভাই-বোনগুলো আসলেই আমার সন্তানের মতই। সবাই কত ভালো।
দেশ ছেড়ে দুর প্রবাসে আত্মীয়বিহীন যদিও থেকেছি কিন্তু আমার আপা আর ভাই এর অভাব নেই এই শহরে।
জাহাঙ্গীর ভাই আশ্চর্য এক মানুষ। মৃত্যুর আগে বোধহয় জ্বলে উঠেছিলেন। জাহাঙ্গীর ক্যান্সার ফাউন্ডেশন তৈরী করেছেন।
আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হতো কম, টেলিফোনে বিস্তর কথা হতো। আহা, ব্যথা, ব্যথা উনার শরীরে প্রায়ই কামড় বসাতো। গভীর রাতে ছুটতে ছুটতে তিনি এষ্টোরিয়ার মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে যেয়ে হাজির হতেন। আমারকে মরফিন ইনজেকশন দাও, আমি ঘুমাতে চাই।
স্ত্রী কাউসার পারভিনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভালোবাসায় তিনি মাথা নত করেন। ওর জন্যেই আমি বেঁচে আছি। বিয়ের পর বউকে সোনালি দিন দিতে পারি নাই। আমার দুর্ভাগ্য ক্যান্সার আমার সঙ্গি, পারভিন ও এর ভাগ্যের যাতনা বয়ে বেড়াচ্ছে।
আমি ভাবীর দিকে তাকাই, এক সাহসী যোদ্ধা। শ্বশুড় বাড়ীর লোকদের প্রশংসার পঞ্চমুখ। শুধু জাহাঙ্গীর ভাইএর একার ভালোবাসায় ভাবী সিক্ত নন। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ভাই-বোনেরাও কাওসার পারভীনকে অনেক বেশী ভালোবাসে। একা ফেলে সাথীকে, পাখি উড়ে গেলো দুর-দিগন্তে। ফিরতে না আর সে পাখি কোন দিন না।
আমরা যারা জাহাঙ্গীর ভাইকে চিনি, জানি, আমাদের কমিউনিটির সুখ, কল্যাণ কামনায়, নিবেদিত প্রাণ জাহাঙ্গীর আলম চলে গেলেও রেখে গেছেন স্বপ্ন। জাহাঙ্গীর ক্যান্সার হাসপাতালের কার্যক্রমেই তিনি বেঁচে থাকবেন। কয়েক বছর আগের ঘটনা- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মইনউদ্দিন তখন নিউ ইয়র্কে। ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনায় একিট নাগরিক সংর্ধ্বনা আয়োজন করছিল। বাংলাদেশী প্রবাসী সুশিল সমাজ, সেখানেও জাহাঙ্গীর বাই কান্ডারী হয়ে হাল ধরলেন। আমাকে ফোন করে দাওয়াৎ করলেন যাওয়ার জন্য।
এমনি কত ভালোলাগার পালক ছড়িয়ে গেছেন তিনি সবার প্রাণে। আমি জানি কাওসার পারভিন আলোকিত মানুষটিকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু স্বামী হিসেবে তিনি রেখে গেছেন আদর্শ, বাকি জীবনটা ভাবি তুমি নিরাহংকারী পরোপকারী ভালোমনের মানুষটির সকল চেতনা মগজে ধারণ করে পূর্ণ উদ্যামে বেঁচে থাকো।
তুমি কাজ থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছো বলে, ব্যথায় কস্ট পেলেও অনেক সময় তোমাকে ডাকেননি।
তুমি অনেক করেছো, জীবনের সকল সঞ্চিত শক্তি ব্যয় করেছো, তারপরও তুমি ক্লান্ত নও কাউসার পারভিন।
তোমার বাস সৃষ্টিকর্তার সংগে। তোমার আছে আগণিত শুভাকাঙ্খি। যারা জাহাঙ্গীর ভাইরের কাছের মানুষ ছিলেন, তুমি সাবার মায়া, শ্রদ্ধা পাচ্ছো ভাবি। তোমার তুলনা যে তুমি। তিনি চলে গেলেও বাতি জ্বেলে গেছেন। বাংলাদেশ সোসাইটির ক্রয়কৃত কবরে জাহাঙ্গীর ভাই এর শেষ শয্যা হয়েছে। একি তো বাংলাদেশ সোসাইটির জন্য গর্বের। এমন সোনার মানুষের জন্য সবারই প্রাণ কাঁদে।
কিছু করতে ইচ্ছে করে, মৃত্যু সংবাদ শুনতে ভালো লাগে না। তারপরও মৃত্যু হানা দেয় দুয়ারে। জাহাঙ্গীর ভাই ব্যথাবিহীন শরীরে ঘুমিয়ে থাকুন পরম শান্তিতে। (সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা)