নিউইয়র্ক ০৮:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

ক্ষমতার মোহে-আধিপত্যে বিপন্ন ‘বিশ্ব মানবতা’

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:০৫:১৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ নভেম্বর ২০১৫
  • / ৯৭৪ বার পঠিত

শিবলী চৌধুরী কায়েস: ইউরোপের শিল্প সাহিত্য আর সংস্কৃতির বৈশ্বিক কেন্দ্রস্থল ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) সন্ধ্যার মায়াবী আলোয় যখন কনসার্ট উপভোগে মত্ত ছিলেন; শহরটির হাজারো মানুষ, ঠিক তখনই ঘাতকদের হিং¯্র বোমায় কেঁপে উঠে পুরো সিটি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার সন্ত্রাসী হামলায় দেশটির খেলার মাঠ, রেস্তোরা থেকে শুরু করে কমপক্ষে ৪০টি স্থানে বোমা বিস্ফোরণে ফ্রান্সের পাশাপাশি হতবিহবল করে দেয় গোটা বিশ্বকে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস ফ্রান্সে। দেশটির মোট জনসংখ্যার সাত ভাগই মুসলমান। তাদের মতে, এই হামলায় শুধু ফ্রান্সই নয়; গোটা ইউরোপের মুসলমানরদের নতুন করে সঙ্কটে মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তবে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বৈতনীতি এবং আগ্রাসনমূলক মনোভাবের কথাও ভুলে গেলে চলবে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই প্রোফাইল পিক্সার পরিবর্তন করে প্যারিস হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন। পিছিয়ে নেই আমাদের বাংলাদেশও। আমার ফেসবুক বন্ধুর তালিকায় বাংলাদেশী শতকরা ৯৫ ভাগই তাই করলেন। নিন্দা জানানো ভালো। আমি নিজেও একটা স্ট্যাটাস দিয়েছি। টুইটারেও দিলাম। কিন্তু যতটা নিন্দা আমাদের দেশ করছে ততটা কিন্তু আমি আমেরিকান ফেসবুক বন্ধুদের ওয়াল কিংবা প্রোফাইল পিক্সারএ দেখিনি।
সবচেয়ে অনুতাপের বিষয় হচ্ছে, প্যারিস হামলার প্রভাব পড়েছে বিশ্বের রাজধানী খ্যাত অভিবাসী বান্ধব নিউইয়র্ক সিটিতে। যেখানে বসবাসকারি অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশী মুসলিম কমিউনিটির মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নাইন-ইলেভেন টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী হামলার পর অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন প্রাপ্য নাগরিক অধিকার থেকে। সিটির বিভিন্ন স্থানে বর্ণবাদি আচরণের শিকার হয়েছেন। চাকুরি ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছে। সেই অবস্থান থেকে কিছুটা কেটে ওঠার আগে ফ্রান্সের এই হামলাকে ফের মুসলিম বিরোধী মনোভাবকে জাগ্রত করবে বলে আশঙ্কা অনেকের। যদিও ইতোমধ্যে উদারপন্থি নিউইয়র্ক স্টেট গভর্ণর এন্ড্রু কুমো এবং সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাজিও ঘোষণা দিয়েছেন; নিউইয়র্কে সব ধর্মবর্ণ ও জাতিগোষ্ঠীর সহবস্থানই আগামীতে আরো এগিয়ে যাবে নিউইয়র্ক।
প্যারিস হামলা’সহ যে কোন হামলায় মানুষ হত্যা নিন্দয় অপরাধ। ইসলাম কেন কোন ধর্মই এসব হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে না বলে আমরা জানি। বস্তুত ধর্মের কথা বলে উগ্রপন্থিরা আজ কী করছে? অহিংসা পরম ধর্ম : শ্রী গৌতম বৌদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ ধর্ম প্রচারে বিশ্বাসী। কিন্তু! মিয়ানমারের আরাকানে অব্যাহত ভাবে মুসলিম রোহিঙ্গা হত্যা কী তাদের ধর্ম সমর্থন করে? বিশাল গণতান্ত্রিক দেশের দাবিদার ভারতের ‘শিব সেনা তথা কট্টর হিন্দুত্ববাদি দল বিজেপি’ ক্ষমতায় এসেই গরুর গোস্ত খাওয়ার অপরাধে মুসলামদের ওপর নির্যাতন হত্যা’সহ বর্বরতম ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। গরু কে মা বলে তারা গরুর চামড়া দিয়ে বানানো জুতো পায়ে দিয়ে ঠিকই চলছে; তখন কিন্তু মায়ের অমর্যাদা হয়নি। অথচ হিন্দু ধর্মীয় গুরুদের ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায় তারাও ‘গো-গোস্ত’ খেতেন। তাই বলছি কী হচ্ছে বিশ্বে?
ইতোমধ্যে আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী না কী ফোন করে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ কাজ করবেন। অন্যদিকে, আমাদের (ছ) হাছান মাহমুদ সাহেব না কী বলেছেন প্যারিস হামলার সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের হমলার যোগসূত্র রয়েছে। বাহ কী চমৎকার। সব মুখে বলে দিলেই বাস্তবতা রূপ নেয়। আর ইংরেজী থেকে অনুবাদ হয়ে তা মুসলিম বাংলাদেশী অভিবাসীদের জীবন বিপন্ন করার কাজে লাগানো যাচ্ছে খুব অনায়াসেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান আফগানিস্তানের ‘তালেবান ও আল-কায়দা’র পর মধ্যপ্রাচ্যের ‘আইএস’ বর্তমানে বাংলাদেশে ‘আনসারুল্লা- বাংলা টীম’। কোন কিছু ঘটার আগেই এ নামগুলো চলে আসে। স্বভাবতই ইসলামী যে ফোবিয়া চলছে এখন বিশ্বজুড়ে তারই প্রতিফলন। ব্যবধানটা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষমতা লোভ আর বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্যের লড়াই। এই দ্ইুয়ের দ্বন্দ্বে আজকে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সবশেষ ইয়েমেনে বোমা হামলা। ফিলিস্তিনিদের কথাও কী আর বলবো! সিরিয়ার অবস্থা সবার জানা।
যদি চলতি সপ্তাহের হিসেব ধরি তাহলে দেখা যাচ্ছে লেবাননে বৈরুতে বোমা হামলায় নিহত ১শ, ইসরাইলী হামলায় প্যালেস্টাইনে নিহত ৫শ, ইয়েমেনে ড্রোন হামলায় নিহত ২শ সব মিলিয়ে গেল বছরে শুধু সিরিয়া ইস্যুতে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। যদি শেষ পাঁচ বছর ধরা গড়ে ১.৫ মিলিয়ন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন আধিপত্যবাদ আর উগ্র জঙ্গীবাদের দ্বন্দ্বের জেরে। এছাড়াও কাস্মীর, বাংলাদেশে’র কথা বাদই দিলাম। সবশেষ ইউরোপের ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের হামলায় ১শ ৫০জন।
প্যারিস হামলার সমীকরণ জটিল আকার ধারণ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে প্যারিসে হামলা চালাল কে???? পশ্চিমা মিডিয়া বলছে হামলার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে আইএস/আইসিল এ হামলা চালিয়েছে/চালাতে পারে। খবরের উৎস হচ্ছে ওয়েব পেইজে বিবৃতি। যা ফলাও করে প্রচার করা হয় বিশ্বের নামি-দামি মিডিয়াতে। আরা আমাদের মতো দেশগুলো তা হুবহু অনুবাদ করে প্রচার করছি। প্রশ্ন আসতে পারে তাদের খবের উৎস কী? কেউ যাচাই করেনা। খবরের পেছনের খবর খোঁজার কোন দরকার নাই। তবে, নিউইয়র্ক টাইম’সহ কেয়কটি গণমাধ্যমে পোস্ট এডিটোরিয়ালে এসব বিষয়ে এখন লেখা-লেখি হচ্ছে। বস্তুত আইস’র উৎপত্তি নিয়ে। পশ্চিমা মিডিয়া যা লিখে তা শাব্দিক অনুবাদ করে হুবহু প্রচার ও প্রকাশ করে যাচ্ছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম। কিন্তু কেউ জানে না; আইস কোথায় থেকে কী ভাবে প্যারিসে হামলা করলো? কেনই বা হামলা করলো ফ্রান্সে!
বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা’সহ মিশরের সিনাইতে রাশান বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ২শ ২৪জন নিহত। একটা ঘটনা ঘটার পর তারা দাবি করলো কিংবা বিবৃতি দিলো এটাই কী যথেষ্ট? আইসিস এমন অনেক হামলার দায়িত্ব স্বিকার করেছে। বস্তুত রাশিয়া এবং বাংলাদেশ তদন্ত করে ওইসব ঘটনায় আইস’র জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি।
এর আগে উদারপন্থি ইসলামিক নেতা তুরস্কের এরদোগানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ওই দেশটিতেও বোমা হামলা চালায় আইএস। অথচ অব্যাহত ভাবে ফিলিস্তিনে মানুষ হত্যা করে চলেছে ইসরাইল সেখানে কিন্তু এই আইএস কোন হামলা করেছে এমন নজির নাই। যখনই জার্মান, ফ্রান্স’সহ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যের শরনার্থী গ্রহণ এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তখন প্যারিসের এই হামলায় মুসলমানদের কী লাভ হলো? বিশ্বের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এমন প্রশ্ন এখন ইসলাম নামধারি আইএস’র কাছে। তারা আসলে কী চায়? কে তাদের বলেছে?
এখন কথা হচ্ছে প্যারিস’সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় লাভবান কে? দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বিশ্ব মুসলমানদের মাথা নত হয়ে আসছে। লজ্জায় ঘৃণায় অপরাধবোধ কাজ করছে অভিবাসী বান্ধব দেশগুলোর মুসলমানদের মধ্যে। শিকার হচ্ছেন ‘হেট ক্রাইম’ তথা বর্ণবাদের। যদিও প্যারিসের ঘটনার পরপরই সারা বিশ্বের মুসলিমরা ‘হ্যাশ ট্যাগ’ দিয়ে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। অথচ একই দিন ইরাকে আতœঘাতি বোমা হামলায় ২৪জন মারা গেছেন। এছাড়াও লেবাননের বৈরুতে প্রায় ১শ জন। প্রতিনিয়ত এভাবেই নীরিহ মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন। যার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় এখন ‘হেট ক্রাইম’ সুনামিতে ভুগছে।
তাহলে কী দাঁড়ালো? আল-কায়দা, আইএস এরা কাদের সুবিধা করে দিচ্ছে। তাদের কর্মকান্ডে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষতি ছাড়া তো কোন লাভ হচ্ছে না! এখন প্রশ্ন উঠেছে এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের উৎপত্তি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াল ওয়ান-ইলেভেন’র হামলার ঘটনায় তখন নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান’র মতো বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে। তখনই প্রশ্ন উঠে টুইন-টাওয়ারে কর্মরত প্রায় ২ হাজার ৫শ জুইশ (ইহুদি) থাকলেও ভুলক্রমে ১জন ওই ঘটনায় নিহত হন। আর বাকী সবাই ছিল সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশী মারা গেছেন অসংখ্য। অনেকে জোরপূর্বক দেশান্তরিত (ডিপোর্টেশন) হয়েছেন। তাহলে বস্তুত হামলা কারিরা কী চাইছে মুসলিম না ব্যবহার করে?
আমরা দেখেছি; সিরিয় শরনার্থী ইস্যুতে তুর্কি সৈকতে শিশু ‘আইমানে’র নিথর দেহ দেখেও কি এসব মুসলিম নামধারিদের ‘হৃদয় কাঁদেনি’? দেহ থেকে খসে পড়া আফগান, পাকিস্তানী শিশুরদের আর্তধ্বনি, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বাবা-মা সন্তান হারা, সন্তানরা বাবা-মা হারা; শেষ আশ্রয়স্থল মায়ের গর্ভের শিশুটিও আজ নিরাপদ নয়; যা ‘আফগান-সিরিয়া-ইরাক-ইয়েমেন-ফিলিস্তিন এবং কাশ্মির’-এ নিত্যদিনের খবর।
ক্ষমতা লোভ আজকে শান্তি প্রিয় মানুষদের জঙ্গিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে বাংলাদেশ। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ’সহ লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সোনার বাংলাতেও আজকে ‘আনসারুল্লা বাংলা টীম’ নামের জঙ্গিসংগঠন সৃষ্টি হয়েছে এসব’র জন্যই কী দেশ স্বাধীন হয়েছে? তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও চেতনাবোধ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেই প্রশ্ন হয়তো আমার মতো সাধারণ অসংখ্য মানুষের।
পরিশেষে ইউরোপের প্যারিসের নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানাই। একই ভাবে পুরো বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক সেই প্রত্যাশা করি। মহান রাব্বুল আল-আমিন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি তিনি আমাদের হেদায়েত করুন। আমিন।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক
১৪ নভেম্বর ২০১৫

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

About Author Information

ক্ষমতার মোহে-আধিপত্যে বিপন্ন ‘বিশ্ব মানবতা’

প্রকাশের সময় : ০১:০৫:১৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ নভেম্বর ২০১৫

শিবলী চৌধুরী কায়েস: ইউরোপের শিল্প সাহিত্য আর সংস্কৃতির বৈশ্বিক কেন্দ্রস্থল ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। শুক্রবার (১৩ নভেম্বর) সন্ধ্যার মায়াবী আলোয় যখন কনসার্ট উপভোগে মত্ত ছিলেন; শহরটির হাজারো মানুষ, ঠিক তখনই ঘাতকদের হিং¯্র বোমায় কেঁপে উঠে পুরো সিটি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার সন্ত্রাসী হামলায় দেশটির খেলার মাঠ, রেস্তোরা থেকে শুরু করে কমপক্ষে ৪০টি স্থানে বোমা বিস্ফোরণে ফ্রান্সের পাশাপাশি হতবিহবল করে দেয় গোটা বিশ্বকে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস ফ্রান্সে। দেশটির মোট জনসংখ্যার সাত ভাগই মুসলমান। তাদের মতে, এই হামলায় শুধু ফ্রান্সই নয়; গোটা ইউরোপের মুসলমানরদের নতুন করে সঙ্কটে মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তবে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বৈতনীতি এবং আগ্রাসনমূলক মনোভাবের কথাও ভুলে গেলে চলবে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই প্রোফাইল পিক্সার পরিবর্তন করে প্যারিস হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন। পিছিয়ে নেই আমাদের বাংলাদেশও। আমার ফেসবুক বন্ধুর তালিকায় বাংলাদেশী শতকরা ৯৫ ভাগই তাই করলেন। নিন্দা জানানো ভালো। আমি নিজেও একটা স্ট্যাটাস দিয়েছি। টুইটারেও দিলাম। কিন্তু যতটা নিন্দা আমাদের দেশ করছে ততটা কিন্তু আমি আমেরিকান ফেসবুক বন্ধুদের ওয়াল কিংবা প্রোফাইল পিক্সারএ দেখিনি।
সবচেয়ে অনুতাপের বিষয় হচ্ছে, প্যারিস হামলার প্রভাব পড়েছে বিশ্বের রাজধানী খ্যাত অভিবাসী বান্ধব নিউইয়র্ক সিটিতে। যেখানে বসবাসকারি অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশী মুসলিম কমিউনিটির মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নাইন-ইলেভেন টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী হামলার পর অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন প্রাপ্য নাগরিক অধিকার থেকে। সিটির বিভিন্ন স্থানে বর্ণবাদি আচরণের শিকার হয়েছেন। চাকুরি ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়েছে। সেই অবস্থান থেকে কিছুটা কেটে ওঠার আগে ফ্রান্সের এই হামলাকে ফের মুসলিম বিরোধী মনোভাবকে জাগ্রত করবে বলে আশঙ্কা অনেকের। যদিও ইতোমধ্যে উদারপন্থি নিউইয়র্ক স্টেট গভর্ণর এন্ড্রু কুমো এবং সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাজিও ঘোষণা দিয়েছেন; নিউইয়র্কে সব ধর্মবর্ণ ও জাতিগোষ্ঠীর সহবস্থানই আগামীতে আরো এগিয়ে যাবে নিউইয়র্ক।
প্যারিস হামলা’সহ যে কোন হামলায় মানুষ হত্যা নিন্দয় অপরাধ। ইসলাম কেন কোন ধর্মই এসব হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে না বলে আমরা জানি। বস্তুত ধর্মের কথা বলে উগ্রপন্থিরা আজ কী করছে? অহিংসা পরম ধর্ম : শ্রী গৌতম বৌদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ ধর্ম প্রচারে বিশ্বাসী। কিন্তু! মিয়ানমারের আরাকানে অব্যাহত ভাবে মুসলিম রোহিঙ্গা হত্যা কী তাদের ধর্ম সমর্থন করে? বিশাল গণতান্ত্রিক দেশের দাবিদার ভারতের ‘শিব সেনা তথা কট্টর হিন্দুত্ববাদি দল বিজেপি’ ক্ষমতায় এসেই গরুর গোস্ত খাওয়ার অপরাধে মুসলামদের ওপর নির্যাতন হত্যা’সহ বর্বরতম ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। গরু কে মা বলে তারা গরুর চামড়া দিয়ে বানানো জুতো পায়ে দিয়ে ঠিকই চলছে; তখন কিন্তু মায়ের অমর্যাদা হয়নি। অথচ হিন্দু ধর্মীয় গুরুদের ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায় তারাও ‘গো-গোস্ত’ খেতেন। তাই বলছি কী হচ্ছে বিশ্বে?
ইতোমধ্যে আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী না কী ফোন করে ফরাসি প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছেন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ কাজ করবেন। অন্যদিকে, আমাদের (ছ) হাছান মাহমুদ সাহেব না কী বলেছেন প্যারিস হামলার সাথে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের হমলার যোগসূত্র রয়েছে। বাহ কী চমৎকার। সব মুখে বলে দিলেই বাস্তবতা রূপ নেয়। আর ইংরেজী থেকে অনুবাদ হয়ে তা মুসলিম বাংলাদেশী অভিবাসীদের জীবন বিপন্ন করার কাজে লাগানো যাচ্ছে খুব অনায়াসেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান আফগানিস্তানের ‘তালেবান ও আল-কায়দা’র পর মধ্যপ্রাচ্যের ‘আইএস’ বর্তমানে বাংলাদেশে ‘আনসারুল্লা- বাংলা টীম’। কোন কিছু ঘটার আগেই এ নামগুলো চলে আসে। স্বভাবতই ইসলামী যে ফোবিয়া চলছে এখন বিশ্বজুড়ে তারই প্রতিফলন। ব্যবধানটা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষমতা লোভ আর বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্যের লড়াই। এই দ্ইুয়ের দ্বন্দ্বে আজকে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সবশেষ ইয়েমেনে বোমা হামলা। ফিলিস্তিনিদের কথাও কী আর বলবো! সিরিয়ার অবস্থা সবার জানা।
যদি চলতি সপ্তাহের হিসেব ধরি তাহলে দেখা যাচ্ছে লেবাননে বৈরুতে বোমা হামলায় নিহত ১শ, ইসরাইলী হামলায় প্যালেস্টাইনে নিহত ৫শ, ইয়েমেনে ড্রোন হামলায় নিহত ২শ সব মিলিয়ে গেল বছরে শুধু সিরিয়া ইস্যুতে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। যদি শেষ পাঁচ বছর ধরা গড়ে ১.৫ মিলিয়ন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন আধিপত্যবাদ আর উগ্র জঙ্গীবাদের দ্বন্দ্বের জেরে। এছাড়াও কাস্মীর, বাংলাদেশে’র কথা বাদই দিলাম। সবশেষ ইউরোপের ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের হামলায় ১শ ৫০জন।
প্যারিস হামলার সমীকরণ জটিল আকার ধারণ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে প্যারিসে হামলা চালাল কে???? পশ্চিমা মিডিয়া বলছে হামলার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে আইএস/আইসিল এ হামলা চালিয়েছে/চালাতে পারে। খবরের উৎস হচ্ছে ওয়েব পেইজে বিবৃতি। যা ফলাও করে প্রচার করা হয় বিশ্বের নামি-দামি মিডিয়াতে। আরা আমাদের মতো দেশগুলো তা হুবহু অনুবাদ করে প্রচার করছি। প্রশ্ন আসতে পারে তাদের খবের উৎস কী? কেউ যাচাই করেনা। খবরের পেছনের খবর খোঁজার কোন দরকার নাই। তবে, নিউইয়র্ক টাইম’সহ কেয়কটি গণমাধ্যমে পোস্ট এডিটোরিয়ালে এসব বিষয়ে এখন লেখা-লেখি হচ্ছে। বস্তুত আইস’র উৎপত্তি নিয়ে। পশ্চিমা মিডিয়া যা লিখে তা শাব্দিক অনুবাদ করে হুবহু প্রচার ও প্রকাশ করে যাচ্ছে সারা বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম। কিন্তু কেউ জানে না; আইস কোথায় থেকে কী ভাবে প্যারিসে হামলা করলো? কেনই বা হামলা করলো ফ্রান্সে!
বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা’সহ মিশরের সিনাইতে রাশান বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ২শ ২৪জন নিহত। একটা ঘটনা ঘটার পর তারা দাবি করলো কিংবা বিবৃতি দিলো এটাই কী যথেষ্ট? আইসিস এমন অনেক হামলার দায়িত্ব স্বিকার করেছে। বস্তুত রাশিয়া এবং বাংলাদেশ তদন্ত করে ওইসব ঘটনায় আইস’র জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি।
এর আগে উদারপন্থি ইসলামিক নেতা তুরস্কের এরদোগানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ওই দেশটিতেও বোমা হামলা চালায় আইএস। অথচ অব্যাহত ভাবে ফিলিস্তিনে মানুষ হত্যা করে চলেছে ইসরাইল সেখানে কিন্তু এই আইএস কোন হামলা করেছে এমন নজির নাই। যখনই জার্মান, ফ্রান্স’সহ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যের শরনার্থী গ্রহণ এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তখন প্যারিসের এই হামলায় মুসলমানদের কী লাভ হলো? বিশ্বের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এমন প্রশ্ন এখন ইসলাম নামধারি আইএস’র কাছে। তারা আসলে কী চায়? কে তাদের বলেছে?
এখন কথা হচ্ছে প্যারিস’সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় লাভবান কে? দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বিশ্ব মুসলমানদের মাথা নত হয়ে আসছে। লজ্জায় ঘৃণায় অপরাধবোধ কাজ করছে অভিবাসী বান্ধব দেশগুলোর মুসলমানদের মধ্যে। শিকার হচ্ছেন ‘হেট ক্রাইম’ তথা বর্ণবাদের। যদিও প্যারিসের ঘটনার পরপরই সারা বিশ্বের মুসলিমরা ‘হ্যাশ ট্যাগ’ দিয়ে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। অথচ একই দিন ইরাকে আতœঘাতি বোমা হামলায় ২৪জন মারা গেছেন। এছাড়াও লেবাননের বৈরুতে প্রায় ১শ জন। প্রতিনিয়ত এভাবেই নীরিহ মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন। যার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় এখন ‘হেট ক্রাইম’ সুনামিতে ভুগছে।
তাহলে কী দাঁড়ালো? আল-কায়দা, আইএস এরা কাদের সুবিধা করে দিচ্ছে। তাদের কর্মকান্ডে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষতি ছাড়া তো কোন লাভ হচ্ছে না! এখন প্রশ্ন উঠেছে এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের উৎপত্তি নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াল ওয়ান-ইলেভেন’র হামলার ঘটনায় তখন নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান’র মতো বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে। তখনই প্রশ্ন উঠে টুইন-টাওয়ারে কর্মরত প্রায় ২ হাজার ৫শ জুইশ (ইহুদি) থাকলেও ভুলক্রমে ১জন ওই ঘটনায় নিহত হন। আর বাকী সবাই ছিল সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশী মারা গেছেন অসংখ্য। অনেকে জোরপূর্বক দেশান্তরিত (ডিপোর্টেশন) হয়েছেন। তাহলে বস্তুত হামলা কারিরা কী চাইছে মুসলিম না ব্যবহার করে?
আমরা দেখেছি; সিরিয় শরনার্থী ইস্যুতে তুর্কি সৈকতে শিশু ‘আইমানে’র নিথর দেহ দেখেও কি এসব মুসলিম নামধারিদের ‘হৃদয় কাঁদেনি’? দেহ থেকে খসে পড়া আফগান, পাকিস্তানী শিশুরদের আর্তধ্বনি, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বাবা-মা সন্তান হারা, সন্তানরা বাবা-মা হারা; শেষ আশ্রয়স্থল মায়ের গর্ভের শিশুটিও আজ নিরাপদ নয়; যা ‘আফগান-সিরিয়া-ইরাক-ইয়েমেন-ফিলিস্তিন এবং কাশ্মির’-এ নিত্যদিনের খবর।
ক্ষমতা লোভ আজকে শান্তি প্রিয় মানুষদের জঙ্গিবাদি রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে বাংলাদেশ। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ’সহ লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সোনার বাংলাতেও আজকে ‘আনসারুল্লা বাংলা টীম’ নামের জঙ্গিসংগঠন সৃষ্টি হয়েছে এসব’র জন্যই কী দেশ স্বাধীন হয়েছে? তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও চেতনাবোধ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেই প্রশ্ন হয়তো আমার মতো সাধারণ অসংখ্য মানুষের।
পরিশেষে ইউরোপের প্যারিসের নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানাই। একই ভাবে পুরো বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক সেই প্রত্যাশা করি। মহান রাব্বুল আল-আমিন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি তিনি আমাদের হেদায়েত করুন। আমিন।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক
১৪ নভেম্বর ২০১৫